অবসরে কয়েকদিন নীরবে নির্জনে ভেবে কূল-কিনারা করতে পারি না। মনে ভীষণ রকম ভাব আনার চেষ্টা করি। ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করে দু’হাজার যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, শুধু দেখতেই আমি সুন্দরী নই, মাথায় কবিতা লেখার ভাবও আছে ঢের।
রাতে আহার সেরে যখন খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়ি তখন কবিতার লাইন বারংবার মাথায় ঘুরপাক খায় কিন্তু কলমের অগ্রভাগে আর কিছুই আসে না। অবশেষে নব্য ফেসবুক কবিদের ভাব চুরি করে চৌর্যবিদ্যায় নিপুণতার সঙ্গে একটা কবিতা কোনো রকমে লিখে ফেললাম।
পরদিন বাড়িতে কিসের যোগাড়যন্ত্র চলছে। আমি কোনোরূপ কিছু বুঝে উঠতে পারি না। বিকেলে মা আমার হাতে একটা শাড়ি দিয়ে বললেন, তোমাকে দেখতে আসছে, দেরি করো না, সেজেগুজে তৈরি হয়ে নাও। আমি অন্দরে ঢুকে মনে মনে এই ফন্দি বের করলাম, বরপক্ষের আমাকে পছন্দ হোক আর না হোক, বরের মুখখানি ভালো করে নিরীক্ষণ করে সাময়িক সময়ের জন্য তার প্রেমে পড়ব। রাতের নিভৃতে সে প্রেমকে মনের উত্তাপে জ্বালিয়ে একটি করুণ রসের কবিতা লিখব। কাল সকালে পোস্ট করে যুবকদিগের মাথা ঘুরিয়ে দেব। হাই-হ্যালো করে যখন একটার পর একটা ম্যাসেজ আসবে তখন কায়দা করে উত্তর দিয়ে বুঝিয়ে দেবো, যারা আমাকে এতোদিন সুন্দরী লক্ষ্মী দেবী ভেবেছ তাদের উদ্দেশ্য করে বলছি, চেয়ে দেখ, কবি হিসেবেও আমি কম সিদ্ধহস্ত নই।
রাত গভীর হলো, মনে ভাব নিলাম। আকাশ-পাতাল এক করে ভাবলাম, কিন্তু কবিতার দেবী স্বরস্বতী মাথায় আর ভর করে না। বার বার ঘুরেফিরে মনের মধ্যে নদীপাড়ের ঝুপরি ঘরে বসবাসরত কিশোরের কথা মনে আসে। সে রাতে আমার আর কিছুই লেখা হয়নি। সারারাত কিশোরকে নিয়ে বিভোর স্বপ্নে কাটিয়ে দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠলাম। ঘুমের ঘোর কাটার পরে রাতের স্বপ্নের বিশদ বিবরণ দিয়ে একটি গদ্য হোক কিংবা পদ্য হোক কিছু একটা লেখার ফন্দি করলাম। বুঝতে পারলাম, বিদ্যাদেবী দূরে কোথাও বসে বিদ্রুপ করছেন। মনে হলো, আমি তার অট্টহাসির কলতান কিছুটা শুনতে পেলাম।
পরের দিন পড়ন্ত বিকেল প্রতিদিনের থেকে অনেকটা সুপ্রসন্ন মনে হলো। কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা বাদ দিয়ে ক্যামেরা সম্বলিত মোবাইলটা নিয়ে বাড়ির পশ্চিম দিকের বাগান অভিমুখে যাত্রা করি। ডজন খানেক নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুললাম। তার কোনোটিতে নিজেকে রাজকন্যা, কোনোটিতে বাগানের সুন্দর ফুল বলে মনে মনে আবিষ্কার করলাম। অবশেষে ফেরার পথে শরীরের বসন কিছুটা আলগা করে নতুন ভঙ্গিমায় কয়েকটি ছবি তুলে হাসিমুখে বাড়ি ফিরলাম। মনে মনে এই বলে কিছুটা সহাস্যে কৌতুকবোধ করলাম, এবার ছবিগুলো পোস্ট দিয়ে নবীন, তরুণ, যুবকের হৃদয় স্পর্শ করে বয়োঃবৃদ্ধ গোছের ফেসবুক পুরুষের মনে যৌবনের উন্মাদনা জাগিয়ে তুলব। এই ছবির দিকে তাকিয়ে যুবক-বৃদ্ধের মনে উত্তাপ বাড়বে। কমেন্টস বক্সে রাশি রাশি রোমান্টিক ভাব জমা হবে। হাজার লাইক আসবে। বন্ধু মহলে আমার কদর দিন দিন বাড়বে।
সন্ধ্যার আগেই ঈশাণ কোণ থেকে থেমে থেমে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। একটু পরেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে প্রবলবেগে ঝড় বইতে শুরু করল। নদীপাড়ের ঝুপরি ঘরে বসবাসরত কিশোর পরিবার আমাদের ঘরে আশ্রয় নিলো। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের বেগ তুমুল আকার ধারণ করে। বেড়িবাঁধের কয়েকটি জায়গা ছুটে গেছে। নদীর বাঁধ ছুটে জোয়ারের পানি জনবসতিতে প্রবেশ করতে শুরু করে। মধ্য রাতের পূর্বেই আমাদের ঘরের খাট ছুঁই ছুঁই পানি হয়ে গেলো। আমি একটা খুঁটিকে আশ্রয় করে কোনোমতে ঘরের এককোণে খাটের উপর দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া ঘরের চালা আকাশের কোনো ঠিকানায় যেনো নিয়ে গেলো। মাথার উপর অন্ধকার আকাশে তাকিয়ে দেখি শো শো শব্দে অনতিদূরে গাছের ডালপালা দুলছে। অন্ধকারে বাবা মাকে দেখতে পেলাম না। একটা দমকা হাওয়া ঢেউ তুলে খুঁটির থেকে আমাকে আলাদা করে দিলো। অন্ধকারে হাতড়াতে থাকি কিন্তু কিছু একটা অবলম্বন করে জীবন রক্ষা করার মতো হাতের কাছে কিছুই পাইনি। শেষে কোনো একটা শক্ত হাত আমার হাতের উপর এসে পড়ল। অন্ধকারে সে হাত কার ছিলো সেটা অননুমেয় তবে বুকে কতোকটা সাহস সঞ্চার করলাম। কতোক্ষণ স্রোতের টানে ওই হাত ধরে ভাসলাম, এক সময় আমি দূরে সরে যাচ্ছিলাম। তখন দু’টো শক্ত হাত আমাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করল। আকাশে বিজলি চমকালো, দু’টি মুখ দু’টি মুখের সামনে মুর্হূতের জন্য পরিষ্কার হলো। তাকিয়ে দেখলাম, কিশোর আমাকে তার বুকের সঙ্গে সজোরে চেপে ধরে আছে।
রাতের অন্ধকারে ঢেউ আমাদের দু’জনকে কোথায় নিয়ে গেলো জানি না। একটি কলাগাছের অংশ হাতের কাছে পেলাম, সেটাকে ধরে কতোটা সময় আমরা স্রোতের অজানা গন্তব্যে ভাসতে লাগলাম তা জানা নেই। গাঢ় অন্ধকার আমাদের মাথার উপর আচ্ছন্ন করে আছে, তীরের ফলার মতো ঠাণ্ঠা বৃষ্টির ফোটা মুখে পড়ছে। কলিজা শুকিয়ে আসছে, হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে। ভয়, ক্লান্তি আর অবসাদে একসময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। হয়তো, কিশোর তখন নিজের জীবনের সঙ্গে আরেকটি জীবনের ভার নিয়েছে। অন্ধকার পৃথিবীর দুরন্ত স্রোত আমাদেরকে তার নিজস্ব গন্তব্যে নিয়ে চলছে।
প্রভাতের আলোয় তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যেও শরীরে কিছুটা উত্তাপ অনুভব করি। প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের বেগ আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে তা আমি জানি না। জ্ঞান ফিরে দেখি জামা-কাপড় ছেঁড়া অর্ধনগ্ন অবস্থায় কিশোরের বুকের উপর শুয়ে আছি। নিজের শরীর আবৃত করার ব্যস্ততায় লজ্জা পেয়ে তাকে ছেড়ে দিলাম। শরীরে অন্য রকম কিছু একটা অনুভব করলাম। মনে হলো ঝড়ের রাতের প্রভাতের আগে আরেকটি ঝড় আমার শরীরের উপর বয়ে গেছে। শরীরে বয়ে চলা আরেকটি ঝড়ের সঙ্গে ইতোপূর্বে আর পরিচিত হইনি।
চারিদিকে ধ্বংসস্তুপ, সব সবুজ মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বানের জল আবার নদীতে ফিরে গেছে। মাঠে ময়দানে নদীর কচুরিপানা আর কতো রকমের জঞ্জাল পড়ে আছে। দূরে নারকেল গাছের মাথায় গৃহস্থের দামী কাপড় ঝুলছে। অনতিদূরে দু’টো কুকুর ছানা মৃত পড়ে আছে। তারই পাশে দেখা যায় নগ্ন বৃদ্ধার মরদেহ। দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখি, সবুজ ধানের ক্ষেত আর সবুজ গাছপালা মাটির সঙ্গে মিশে একাকার। মনে হয়, কেয়ামতের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে পৃথিবী সমান মাঠে পরিণত হয়েছে। যখন সম্বিত ফিরে আসে তাকিয়ে দেখি পাশে কিশোর নেই। সে কোথায় চলে গেছে সেদিকে আর খেয়াল করিনি। বাবা-মায়ের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা অনুমান করতে পারছি না। আমি গাছের গুঁড়ি ডালপালা সরিয়ে নিজের ভিটায় চললাম। ঘরহীন উন্মুক্ত ভিটায় একা মেঘময় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
একটা আশংকা এবং ভয় নিয়ে চারদিকে বাবা মাকে খুঁজতে থাকি। ধানের ক্ষেত, আলের পাশে ছড়িয়ে আছে চেনা মানুষের মরহেদ। সেখানে চিরচেনা বাবা-মায়ের মরদেহের অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পেলাম না। স্বেচ্ছাসেবী দল এসে মরদেহগুলো বেড়িবাঁধের উপর জড়ো করছে কিন্তু সেখানেও আমার পরম আপনজনদের কারও মরদেহ দেখতে পেলাম না। ঝড়ের প্রলয় আর মনের ভীষণ বিধ্বস্ততায় নিথর হয়ে গেলাম। যখনি নতুন মরদেহ আসে সঙ্গে সঙ্গে বাঁধের উপর ছুটে যাই কিন্তু আমার পরিবারের কেউ নেই সেখানে। তিনদিন পার হলে অর্ধগলিত পিতা-মাতার মরদেহের সন্ধান পেলাম। প্রতিবেশীর সহযোগিতায় গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে শত অশ্রু বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মরদেহ দু’টি কবরস্থ করলাম। এই পৃথিবীর সুন্দর সূর্যের হাসি ম্লান হয়ে গেলো। ভর দুপুরেও অমাবস্যার অন্ধকার আমাকে আচ্ছন্ন করে। আপনজন হারিয়ে ভীষণ একা প্রতিবেশীদের সঙ্গে দিনাতিপাত করতে শুরু করলাম।
নদীপাড়ের কিশোরদের ঘরের চিহ্ন মাত্র নেই। দিগন্তজোড়া মাঠ ঘাট একটা শূন্য ভূমিতে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে ধ্বংসস্তুপের সঙ্গে মরহেদের রক্তের গন্ধ। আমি একলা মেয়ে কী করে আবার জীবন শুরু করব সে ভাবনায় অধীর হয়ে গেলাম। কিশোর সেই যে চলে গেছে, আর আসেনি। কোথায় গেছে জানি না। পরিচিতজনের একমাত্র কাছের প্রতিবেশী কিশোর কাছে থাকলে অন্তত কিছুটা হলেও ভরসা পেতাম কিন্তু এই অসহায় যুবতীর পিঠে কিংবা মাথায় হাত রেখে ভরসা দেওয়ার মতো আর কেউ নেই। যেদিন রিলিফের চাল আসে অভুক্ত পেটে চারটা দানাপানি দেওয়ার তাগিদে চেয়ারম্যান অফিসের বারান্দায় লাইনে দাঁড়াই। সারাদিন শেষে কয়েক কেজি চাল আর কিছু তেল-মসলার প্যাকেট নিয়ে বাড়িতে ফিরি। রাতে প্রতিবেশীর ডেরায় আপনজনের অভাব বোধকরে ফুঁপিয়ে কাঁদি। সকাল হলেই নারী থেকে যেনো পুরুষ হয়ে যাই। আপন ভিটায় নতুন ঘর তুলে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই যোগাড় করতে চেষ্টা করি। মনের ভিতর শতবার শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করেও হাঁপিয়ে উঠি। শেষে এক সপ্তাহের অক্লান্ত পরিশ্রমে এক প্রতিবেশী চাচার সহযোগিতায় একটা ডেরা গড়তে সক্ষম হই। আমার বাড়ন্ত শরীরে বেড়ে ওঠা যৌবনের দিকে প্রতিবেশী চাচা তার সহযোগিতার প্রতিদান চায়। আমি অবাক হয়ে চাচাকে কী রকম ভর্ৎসনা জানাবো তা ভেবে কূল কিনারা পাই না।
এরপর থেকেই আমার একলা জীবন যাপনের চেষ্টা চলে। বাড়ির আঙিনার শেষ মাথায় কয়েকটি তাজা কবরের ভয় আমাকে তাড়া করে। তবুও এই ভয়কে একদিন জয় করব ভেবে একলাই নতুনভাবে জীবন যাপন করতে থাকি।
যেখানে যাকে পাই তার কাছেই কিশোরের সন্ধান জানতে চাই কিন্তু কিশোরকে আজ পর্যন্ত এই লোকালয়ে কেউ দেখেছে বলে সায় দেয় না। তারপর একমাস অতিক্রান্ত হলে নিজের অস্তিত্বের মধ্যেই হঠাৎ কিশোরকে আবিষ্কার করলাম। খেতে অরুচি ধরেছে, শরীর বিনা কারনেই শুঁকিয়ে যাচ্ছে, সময়-অসময় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। যখন-তখন বমি করে বুক ভাসাই। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকি কিন্তু আমাকে দেখার মতো কেউ নেই। সময় এগিয়ে চলে, গ্রাম ছাড়িয়ে একটি নতুন খবর রাষ্ট্র হয়ে যায়। মৃত বাবা-মা অযথাই গালমন্দ শোনে। নিশ্চিত হতে আর মোটেও বাকি নেই আমি সন্তানসম্ভবা। একদিন যে রূপের আলোর বিচ্ছুরণ চারিদিক আলো করে যুবক ও মধ্যবয়সীদের হৃদয় আলোকিত করতো, সে রূপ এখন আর নেই। শরীরের যেসব ভাজে যৌবন উঁকি দিত সেখানে মলিনতার কালো দাগে ভরে গেছে। মুখের লাবণ্য কোথায় হারিয়ে গেছে সে আজ ইতিহাস। মলিন বস্ত্রে নিজের একুশ বছরের যুবতী বেশকে ত্রিশের পরের গৃহ পরিচারিকার ন্যায় আবিষ্কার করলাম। জগতে এমন কিছু দান আছে যা অজান্তেই আমাদের কাছে এসে যায়, দান নেওয়ার সময় পরিণতির কথা কেউ ভাবি না। তবে সেই দান একদিন এসে আমাদের এমন হেনস্থা করে তোলে তখন মনে হয়, এমন দান না নিলেই ভালো হতো।
কিশোরের ছেলে আমাকে মা মা বলে উতলা করেছে। তাকে আর খুঁজে পাইনি। সেই যে চলে গেছে আজও তার কোনো প্রকার সন্ধান পাইনি। একজন কুমারী মা হয়ে জগৎ সংসারে কোলের শিশুকে বুকে চেপে অপেক্ষা করছি। জীবনে কবি হওয়া আমার হয়ে ওঠেনি। মোবাইল সেই ঝড়ের রাতে কোথায় যে হারিয়ে গেছে আর খোঁজার চেষ্টা করিনি। কিশোরের অপেক্ষায় এক পিতৃহীন শিশুকে বুকে নিয়ে সমাজের গঞ্জনা সহ্য করে বেঁচে আছি। কিশোর কোনোদিন ফিরবে কিনা সে কথা হলফ করে পাঠক মহোদয়কে আর বলতে পারি না।