–আচ্ছা তুমি ভার্জিন তো?
বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর মুখে এমন প্রশ্ন শুনতে হবে এমনটা আশা করেনি তানহা। প্রশ্নটি শোনার পর একবার তার স্বামী আসিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নুইয়ে ফেলে। উত্তর না পেয়ে আসিফ আবারো প্রশ্ন করে-
–বলো? তুমি ভার্জিন তো? তানহা কিছু সময় মৌনাবলম্বন করে আসিফের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে-
-আচ্ছা আমরা বেলকনিতে গিয়ে বসি?
–মানে? বেলকনিতে কেন?
-চলুন না। আপনার প্রশ্নের উত্তরটা নাহয় ওখানে গিয়েই দেবো। আসিফ বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে দুটো চেয়ার নিয়ে একটিতে নিজে বসে অন্যটি সামনে রেখে দেয় তানহার জন্য। কিছু সময় পর তানহা হাতে করে দুটো চায়ের কাপ নিয়ে আসে…
–এতো দ্রুত চা বানিয়ে আনলে কিভাবে?
-ফ্লাক্সে রাখা ছিলো, ওখান থেকেই এনেছি।
–হুম।
-আচ্ছা বাইরে চাঁদ কেমন জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে দেখুন।
–কিন্তু আমার উত্তরটা?
-(জোরে নিশ্বাস ফেলে) আপনার ধৈর্য হবে সবকিছু শোনার জন্য?
–মানসিকভাবে আমি অতটা দুর্বল নই।
-আমি মানসিক ধৈর্যের কথা বলিনি। আপনার এতো কিছু শোনার জন্য সময় হবে কিনা সেটা জিজ্ঞাসা করেছি। হয়তো বিরক্তও বোধ করতে পারেন।
–না, তুমি বলতে থাকো।
চায়ের কাপে মৃদু শব্দ করে এক চুমুক দেওয়ার পর তানহা বলতে শুরু করে কলেজের পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে একটি ছিলো শুভ্র। পরিচিত বললে হয়তো ভুল হবে। বলা যায় অতি পরিচিত। জানিনা অল্প কয়েকদিনের মাথায় তার সাথে এতো ঘনিষ্ঠ কিভাবে হয়েছিলাম। এমনও হয়েছিলো যে সে কোনো একদিন ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে সম্পূর্ণ ক্লাসই আমার কাছে অসহ্য লাগতো। বলা যেতে পারে সে ক্লাসে থাকা মানে আমার ক্লাসের প্রতি মনোযোগ থাকা।
তবে সে মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতো। কিন্তু কলেজ ছুটির পর ঠিকই দেখলাম গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অবস্থা তখন এমন হতো যে ইচ্ছা করতো তাকে চায়ের সাথে গুলিয়ে খেয়ে ফেলি। আমার রাগ মিশ্রিত লাল চোখ দেখে সে মুচকি মুচকি হাসতো। হয়তো মাঝে মাঝে আমাকে রাগাতে ভালোই লাগতো তার। একদিন তাকে ক্লাসে অনুপস্থিত দেখতে পেয়ে আগের মতোই অস্বস্তিবোধ হতে লাগলো। কলেজ ছুটির পর অন্যদিনের মতোই দ্রুত কলেজ গেইটের দিকে হাটতে লাগলাম। আসেপাশে অনেক খুঁজাখুঁজির পরেও তার ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। আমার মন তখন কান্না শুরু করে দিলেও চোখ দিয়ে পানি বের করতে পারলাম না চক্ষুলজ্জার ভয়ে। প্রচন্ডরকম মন খারাপ করে বাসায় গিয়েই ফোন দিলাম। মন আরো বেশি খারাপ হলো যখন তার ফোন সুইচড অফ পেলাম।
পরদিন তাকে দেখার আশা নিয়ে আবারো কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ক্লাসরুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গুনে গুনে তিনবার পায়চারী করার পরেও তাকে দেখতে পেলাম না। ক্লাসে প্রচন্ড অমনোযোগীতার কারণে বারবার ক্লাস টিচারদের বকা খেতে হলো। তবে মনে হচ্ছিলো এতো অপমান আমার গা থেকে ঠিক কচুপাতার পানির মতো বেয়ে পড়ছিলো। অন্যদিনের থেকে আরো দ্রুত গেইটের দিকে যেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ আশেপাশে দেখার পরেও তাকে দেখতে পেলাম না। এবার চোখ দিয়ে পানি বের না হয়ে পারলো না। গেইটের সামনে থাকা বেঞ্চটির উপরে বসেই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম। তার কিছু সময় পরেই দেখলাম শুভ্র সাইকেল নিয়ে কলেজের দিকে আসছে আর হাতে কিছু কদমের ফুল। আমার সামনে এসেই সাইকেল থামিয়ে বললো..
-এই নে তোর কদমের ফুল।
–কোথায় ছিলি এতোদিন?
-এতোদিন কই? একদিনই তো আসিনি।
–একদিন তাইনা? জানিস আমার কতোটা টেনশন হচ্ছিলো?
-আচ্ছা? টেনশন হচ্ছিলো বুঝি? কেন টেনশন হচ্ছিলো একটু বলুন তো দেখি..
–জানিনা।
-জানিস না নাকি বলতে চাস না?
–বললাম তো জানিনা।
-আচ্ছা জানতে হবে না। এখন চল।
–কোথায় চলবো?
-তোকে বাসস্টপেজে এগিয়ে দিয়ে আসি।
–বয়েই গেছে তোর সাথে যেতে।
তার উপর জমে থাকা সকল রাগ আর অভিমান ঢেলে দিতে ইচ্ছা করছিলো। তার দেওয়া ফুলগুলোও নেইনি। আর কিছু না বলেই একা হাটতে লাগলাম। ভেবেছিলাম শুভ্র পিছন থেকে ডাক দিবে। কয়েক পা হাটার পরেও যখন দেখলাম সে ডাকছে না তখন পিছনে ফিরে তাকালাম। দেখলাম শয়তানটা সেখানে কদমগুলো রেখে চলে গেছে। পিছনে এসে কদমগুলো নিয়ে আবারো হাটতে লাগলাম। শুভ্রর উপর রাগ হচ্ছিলো খুব। বাসায় এসে ফোনটা হাতে নিতেই শুভ্রর এসএমএস চোখে পড়লো। লেখা ছিলো,”ফুলগুলো নিবি না তো আবার পিছনে ফিরে আসলি কেন?” তার মানে সে কোথাও লুকিয়ে ছিলো। তার উপর রাগ আরো বাড়তে লাগলো। পরদিন একটু আগেই ক্লাসে পৌঁছেছিলাম। তবে আজ সামনের বেঞ্চে না বসে ইচ্ছা করেই মাঝের দিকে বসেছিলাম। রীতিমত শুভ্র ক্লাস শুরু হওয়ার পর আসলো। স্যারের থেকে পারমিশন নিয়েই মেয়েদের সারির দিকে তাকালো। আমাকেই খুঁজছিলো অবশ্যই। আমি ইচ্ছা করেই মাথা নিচু করে রাখলাম যাতে দেখতে না পায়। কয়েক সেকেন্ড পর আমায় না দেখতে পেয়ে পিছনের দিকের বেঞ্চে বসে পড়লো।
স্যার নাম ডাকতে শুরু করলেন। আমার রোল আসতেই প্রেজেন্ট দিয়েই পিছনের দিকে তাকালাম। দেখলাম শুভ্র চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটদুটো নিঃশব্দে নড়ে উঠলো। ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারলাম সে ‘কুত্তি’ উচ্চারণ করেছে। তার রাগ দেখে ভালোই লাগলো। এবার একটু বুঝুক তাকে ক্লাসে না পেলে আমার কেমন ফিল হতো। চায়ের কাপে আরেক চুমুক দিয়ে তানহা আবারো বলতে শুরু করলো এভাবেই চলতে লাগলো আমাদের দিনগুলো। কিন্তু এতোগুলো দিন একসাথে থাকার পরেও তাকে বলা হয়নি যে শুভ্র আমি ভালোবাসিরে তোকে। ভেবেছিলাম আমি কেন বলবো? সে নিজেই তো বলতে পারে। তবে ভালোবাসার মধ্যে বারবার ভালোবাসি বলাটা জরুরী নয়, ভালোবাসাটাই জরুরী। আমি তাকে ভালোবাসতাম সে জানতো। আর আমিও জানতাম সে আমাকে ভালোবাসে। তবে তা একে অন্যকে বলা হয়নি কখনো। কিন্তু কখনো বুঝতে পারিনি যে এই ভালোবাসি শব্দটা আর কোনোদিন বলা হবেনা।
বিয়ের রঙ্গিন শাড়ি দিয়ে চোখদুটো মুছতে চেষ্টা করে তানহা। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে আবারো বলা শুরু করে সেদিন ছিলো মঙ্গলবার। তবে দিনটি আমার জন্য অমঙ্গলের ছিলো। শুধু অমঙ্গল বললে ভুল হবে, বলতে পারেন আমার জীবনের সবথেকে খারাপ একটা দিন। সেদিন শুভ্র ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলো। ছুটির পর দেখি কলেজ গেইটের সামনের বেঞ্চে হাতে একটি গোলাপ নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখতেই উঠে দাঁড়ালো। অন্যদিনের মতো আর চোখ রাঙাই নি। বরং মজা করে জিজ্ঞাসা করলাম,
–কিরে শুভ্র? কাকে প্রোপজ করবি?
-দেখি কোনো এক সুন্দরীকে।
–তো সুন্দরীটা কে শুনি?
-তোকে কেন বলবো? যা ভাগ।
কথাটা মনের ভিতরে খুব গভীরভাবে দাগ কেঁড়েছিলো। তার সাথে আর কথা না বাড়িয়েই মাথা নিচু করে বাস স্টপেজের দিকে যাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম শুভ্র ডাক দিয়ে বলবে, “কোথায় যাচ্ছিস পাগলি? মজা করেছিলাম তোর সাথে। তুই ছাড়া আর কাকে প্রোপজ করবো?”
কিন্তু অনেক্ষণ হাটার পরেও “এই তানহা” বলে কোনো ডাক শুনতে পেলাম না। মনকে কোনোভাবে শান্তনা দিতে পারছিলাম না যে শুভ্র অন্য কাউকে কিভাবে প্রোপজ করতে পারে? যাত্রী ছাউনিতে উঠার জন্য রাস্তা ক্রস করতে হতো। পার হতে যাবো এমন সময় পিছন থেকে কেউ হাত টেনে ধরে। পিছনে ফিরতেই দেখি শুভ্র;আমার হাত এখনো ধরে আছে। জীবনের প্রথম কোনো ছেলের স্পর্শ পেলাম। আমার সমস্ত শরীর যেন কাঁপতে লাগলো। হাত টান দিয়ে ওর হাতের মুঠো থেকে সরিয়ে নিলাম। বুঝতে পারলাম যে ও এতক্ষণে আমার পিছে পিছেই আসছিলো…
–আমার পিছনে কেন এসেছিস? যা তোর সুন্দরীকে প্রোপজ কর।
-তোর পিছে না আসলে প্রোপজ করবো কিভাবে?
–মানে?
-মানে তোর মাথা। ফুলটা নিবি নাকি অন্য কাউকে দেবো?
–কাঁদালি কেন আমায়?
-দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো যে কাঁদলে কেমন লাগে তোকে। হিহি।
শুভ্রর হাত থেকে গোলাপটি নিজের হাতে নিলাম। মাথায় একটা চিন্তায় ঘুরপাক খেতে লাগলো যে ছেলেটা এতো বাঁদর কেন। তার বাঁদরামোর কথা ভেবে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির চিহ্ন ভেসে উঠলো। এটা ভাবতে ভাবতেই রাস্তা পার হচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিলো যেন আমি কোনো মাঠে একা হাটছি। কখন যে ভুলে গিয়েছলাম যে আমি ব্যস্ত রাস্তার মাঝে তা নিজেও বুঝতে পেরেছিলাম না।
কয়েক মূহুর্ত পরেই পিছন থেকে কেউ সজোরে ধাক্কা মারলো। ছিটকে গিয়ে পড়লাম যাত্রী ছাউনীর কাছেই। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সকল গাড়ি থেমে গেছে। আস্তে আস্তে রাস্তার মাঝে ভিড় তৈরি হচ্ছে। কপালে চোট লেগেছিলো একটু। তাই এক হাতে কপাল চেপে ধরে ভিড়ের মাঝে যেতে লাগলাম। দেখলাম সেখানে শুভ্রর দেহটা রাস্তার উপরে শুয়ে আছে। আমি যেন শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুভ্রর তখনো শ্বাস চলছিলো। আমায় দেখতে পেয়েই ঠোঁট দুটো বাকিয়ে একটু হাসতে চেষ্টা করলো। আমি কোনোমতে তার কাছে গিয়েই রাস্তার মাঝে বসে পড়লাম। দ্বিতীয়বারের মতো সে আমার এক হাত তার রক্তমাখা দুহাতের মধ্যে চেপে ধরে বললো, “তোর এই হাত ধরে জ্যোৎস্না রাতের মধ্যে হাটতে পারলাম না রে পাগলিটা। মাফ করে দিস আমায়।” এম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হাসপাতালের স্ট্রেচারে করে নেওয়ার সময় সে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তখনো তার সেই রক্তমাখা হাত আমার হাতটি ধরে ছিলো। আমায় বাঁচাতে গিয়ে তার নিজের জীবনটাই মৃত্যুর মুখে ফেলে দিলো। আমি নিজেকে ক্ষমা করবো কিভাবে জানিনা। সারা জীবনের জন্য তার হাত ছেড়ে দিতে হলো। আর আজ আমি এখানে, আপনার সাথে।
কথাগুলো শেষ করে তানহা একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে চোখদুটো মুছে নেয়। এরপর আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”চা ঠান্ডা হয়ে গেলো তো।” এতক্ষণ বাদে আসিফ তার চায়ের কাপের দিকে খেয়াল করলো। তার চোখ দুটো ও কিছুটা অশ্রুসিক্ত হয়েছিলো। তানহা আবারো বলে,”আপনি আমার কাছে মাত্র একটা প্রশ্ন করেছিলেন। আমি আমার উপর থাকা সকল সন্দেহকেই দূর করে দিলাম।” এক বছর পর.. বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরের জ্যোৎস্নার আলো দেখছিলো আসিফ। একটু পরেই তানহা এসে বললো, “নাও তোমার চা।” আজ আর চা জুড়িয়ে যায় নি। চা খাওয়া শেষ হলেই আসিফ তানহার হাত ধরে বলে..
–চলো!
-কোথায়?
–ঐ যে চাঁদ তার সম্পূর্ণ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিয়েছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প