কনের পক্ষ থেকে একটি জিজ্ঞাসা এলো। এটি কাগজে লিখে পাঠানো হয়েছে। তাতে লিখা,
– ‘দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা আমার জন্যে খুব জরুরী। আমি জানতে চাইছি, আপনি সরকারি যে চাকরিটি করছেন সেটি কি আপনি নিজের যোগ্যতা বলেই পেয়েছিলেন নাকি তা পেতে কোন রকম ঘুষ দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়েছিলো?’ পাত্রী তানহার পক্ষ থেকে পাঠানো কাগজে লিখা এমন প্রশ্ন দেখে আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। এটি দিয়ে গেছে তার ছোটভাই তায়েফ। সাত-আট বছর বয়স হবে ওর। আমাকে হঠাৎ করে এভাবে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে উপস্থিত সবাই রীতিমতো অবাক হয়ে গেলো। মামা জিজ্ঞেস করলো,
– কি ব্যপার রিয়াদ, কি হয়েছে? আর এই কাগজে কি লিখা? আমি বললাম,
– আমাকে এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে হবে। জরুরী একটি কাজ রয়েছে। আমরা এই সম্বন্ধের বিষয়ে পরেও আলোচনা করতে পারবো। চলো মামা! খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না হলে যে আমি এমনটি কখনো করবো না সেটি মামা খুব ভালো করেই জানে। আর তাই, তানহার মাকে বুঝিয়ে বলে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। এবার মামা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– রিয়াদ, কি হয়েছে তোর বলতো আমায়! কেন এভাবে হুট করে বেরিয়ে এলি? কি এমন রাজকার্য রয়েছে তোর হ্যা?
মামার সাথে আমার সম্পর্কটা মামা-ভাগ্নে কম বন্ধুসুলভ বেশি। খুব আদর করে আমায়। আমি আমার প্রায় সবকিছু নিয়েই মামার সাথে সলাপরামর্শ করি। তানহার মামা আমার মামার বন্ধু হোন। তাঁদের দুজনের পরিচয়ের সুবাদেই আজ তানহাকে দেখতে এসেছিলাম। মামাকে যদিও সবকিছু বলি কিন্ত এখন তানহার প্রশ্নের সম্বন্ধে কি করে বলবো সেটা নিয়ে ইতস্তত বোধ করছি আমি। এমন সময় মামার ফোনে একটি কল আসে। পকেট থেকে ফোন বের করে স্কিনের দিকে তাকিয়েই যেন কিছুটা অবাক হয়ে যায় মামা। তাঁকে বিস্মিত হতে দেখে জিজ্ঞেস করি,
– কি হয়েছে মামা, কার ফোন?
– মাহমুদ ফোন দিয়েছে। হয়তো জানতে চাইবে কেন ওর ভাগনীর সাথে তোর বিয়ের আলাপ পাকাপাকি না করেই বেরিয়ে এলাম।
– ওহ। কিছু একটা বলে দাও। পরে আমরা কথা বলছি। মামা এবার ফোন রিসিভ করে আমার থেকে একটু দূরে সরে গেলো। মিনিট দুয়েক কথা বলে ফিরে এলো আবার। পকেটে ফোন রাখতে রাখতে এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– এবার বলতো কি হয়েছে তোর? ততক্ষণে আমার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। মামার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে বিষয়টা বেশ জটিল। আমার কাঁধে হাত রেখে এবার মামা বললো,
– রিয়াদ, স্বাভাবিক হ। কি হয়েছে বল আমায়! হাতের এই কাগজে কি লিখা রয়েছে? দেখলাম এটি পড়েই তুই উঠে দাড়িয়েছিলি। এটা কি তানহা দিয়েছে? কি লিখেছে এতে? আচ্ছা, তানহা কি কোন রিলেশন করে? বলতে, এমনকিছু কি এতে লিখেছে যে, সে এবিয়েতে রাজি নয় বা অন্য কাউকে পছন্দ করে? বুঝতে পারছি আমাকে এভাবে দেখে মামার মাথা ঠিক নেই। তাই এতগুলো প্রশ্নও করে ফেললেন একসাথে। আমি কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকার পর বললাম,
– যা ভাবছো তেমন কিছু নয় মামা। মামা এবার কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
– কিন্তু হয়েছে টা কি সেটা তো বলবি আমায়! না বললে কি করে কি করবো আমি! বল কি হয়েছে? এবার সেই কাগজটি এগিয়ে দিলাম মামার দিকে। হাতে নিয়ে সেটা পড়লো। পড়ার পর মামাওও চুপসে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা নিচুস্বরে বললো,
– এটা কি ধরনের প্রশ্ন ভাগ্নে! তানহা এটা কেন জিজ্ঞেস করলো? আমি এই জীবনে বহু মানুষের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে দিয়েছি। বহু ছেলের পক্ষ হয়ে মেয়ে দেখতে গিয়েছি কিন্তু, কখনোই কোন মেয়েকে এধরনের প্রশ্ন করতে দেখিনি! আমি বললাম,
– এবার বলো, আমার কি করা উচিৎ ছিলো তখন? আমি কি তখন বলে দিতে পারতাম যে, আমি চাকরী নেয়ার জন্য দশ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছি। বললে কি মনে করতো আমায় বলো! আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এধরণের প্রশ্ন কেন করলো বলতে পারো? মামার মুখে কোন জবাব নেই। রাতের খাবার খেয়ে ছাদে হাটাহাটি করছি আর অনলাইনে নিউজ পড়ছি। এমন সময় মেসেজ রিকোয়েস্ট এলো একটি। আইডির নাম ‘তানহা তেহজিব।’ সালাম দিয়েছে ও সাথে জিজ্ঞেস করেছে উত্তর না দিয়ে পালিয়ে এলাম কেন। মেসেজ রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে লিখলাম,
– ওয়ালাইকুমুসসালাম। সে মুহুর্তে কিছুই করার ছিলোনা আমার। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। কি করছেন এখন? তানহা,
– ছাদে বসে আছি। ভালো থাকবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।
– শুনুন! একটি কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো।
– কি কথা?
– আমাকে বলুন যে, এধরনের প্রশ্ন করার পেছনে রহস্য কি?
– বাদ দিন। এসব নিয়ে এখন আর কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই।
– আমাকে উত্তরটা জানালে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। দয়া করে বলুন!
– অসৎ উপায়ে রোজগার কারী কোন ব্যক্তির ঘরে যেতে চাইনা আমি। তাছাড়া, যদিও আপনি সরকারি চাকুরী করেন সেক্ষেত্রে আমার জানা প্রয়োজন যে, যার সাথে আমি সারাজীবন থাকবো সে তার উপার্জনের পথটি সৎ ভাবে বের করেছে নাকি তাতে অসৎ উপায়ে প্রবেশ করেছে। এজন্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু আপনি তো ভালোমন্দ কিছু না বলেই পালিয়ে গেলেন। আমি কিছুই যেন টাইপ করতে পারছিলাম না আর। কোনরকমে লিখলাম,
– আচ্ছা ঠিক আছে। ইনশাআল্লাহ্ খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে। আল্লাহ্ হাফেজ। মামাকে ফোন দিলাম এবার। রিসিভ করলো মামা। আমি,
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুমুসসালাম। কি ব্যপার ভাগ্নে?
– মামা, তোমার চেনাজানা বিজ্ঞ কোন মুফতি আছেন?
– আছেন। কেন?
– কাল উনার কাছে যাবো। হাতে কাজ রেখোনা কোন।
পরেরদিন গেলাম মামার চেনাজানা একজন মুফতি সাহেবের কাছে। আমার চাকরীতে ঢোকার সকল প্রসেস উনাকে খুলে বললাম। উনাকে বললাম যে, আমি যদিও যোগ্যতা রাখি কিন্তু, যারা চাকরি দিয়েছেন তারা চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ নিয়েছেন। বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরি নিতে ঘুষ দিতে হয়েছে। সবকিছু শুনে মুফতি সাহেব বললেন,
– দেখো বাবা, আমাদের প্রিয়নবী ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহণকারী উভয়কে অভিসম্পাত করেছেন।’ (আবু দাউদ ৩৫৮২) তাই ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়া জায়েয হবে না। এতে একদিকে ঘুষ প্রদানের কবীরা গুনাহ হয়, অন্যদিকে ঘুষদাতা অযোগ্য হলে অন্য চাকরিপ্রার্থীর হক নষ্ট করারও গুনাহ হয়।
অবশ্য কেউ যদি প্রকৃতপক্ষে চাকরির যোগ্য হয় এবং ঘুষ প্রদান হারাম হওয়া সত্বেও ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয় আর পরবর্তীতে সে যথাযথভাবে দায়িত্ব আঞ্জাম দেয় তাহলে এভাবে চাকরি নেওয়া নাজায়েয হলেও বেতন হালাল হয়ে যাবে। কিন্তু যদি সে তার কর্মক্ষেত্রে অযোগ্য হয় এবং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে তার জন্য ঐ চাকরিতে থাকা বৈধ হবে না। আর ঠিকমত দায়িত্ব পালন না করে বেতন নেওয়াও বৈধ হবে না। (তিরমিযী ১৩৩৭)
মুফতি সাহেবের থেকে এবিষয়ে জেনে যেনো মনটা হালকা হয়ে গেলো আমার। যাক, আলহামদুলিল্লাহ্, আমি তো যোগ্যতা থাকার পরও বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়েছি। তারমানে, আমি যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে এই চাকরী থেকে প্রাপ্ত বেতন আমার জন্য হালাল হবে। মামা যা বুঝার বুঝে গেলো। দেরি না করে বেরিয়েই তানহার মামাকে ফোন করে সব বলে দিলো। এবার মামা ভাগ্নে মিলে গিয়ে ঢুকে পড়লাম নিকটস্থ একটি কফিশপে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে এক হাতে ফোনের ডাটা অন করতেই স্কিনে মেসেজ ভেসে উঠলো! তানহা মেসেজ পাঠিয়েছে,
– ‘আসসালামু আলাইকুম। যাইহোক, শঙ্কাটা দূর করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ইনশাআল্লাহ্ আমরা শীঘ্রই মিলিত হবো।’ মেসেজটি পড়ামাত্রই মনটা আনন্দে নেচে উঠলো আমার। চোখেমুখেও তার প্রভাব পড়লো। বিষয়টি মামা বুঝতে পেরে বললো,
– কি ব্যপার ভাগ্নে, আমার বোনের হবু পুত্রবধূর বার্তা চলে এসেছে তাহলে হ্যা! একগাল হেসে মামাকে বললাম,
– তুমিও না মামা! মামা বললো,
– ভাগ্নে, মেয়েটা কিন্তু আসলেই খুব বুদ্ধিমতী। আল্লাহ্ তোদের সুখী করুন এই দোয়াই করি। সাথে আমার বোনকেও।
গল্পের বিষয়:
গল্প