‘গ’ নাকি ‘ঘ’ বগি, সেটি ভালো করে দেখার আগেই ফোন বেজে উঠল। কাঁধের ব্যাগ আর হাতের টিকিট কোনোমতে সামলে ফোন তুললাম। যা ভেবেছিলাম, রাসেল। ওর কাছে যাওয়ার থাকলে আমি এই ভয়টাই পাই। ফোন করতে করতে জ্বালিয়ে মারে। কিছুক্ষণ পর পর কোথায়, কতদূর ইত্যাদি ইত্যাদি। যেন কোথায় বললেই চিনবে, পুরো রাস্তা মুখস্থ করে বসে আছে! তবে এবার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, ফোন রিসিভ করতেই ব্লাকআউট। নতুন কেনা ফোনের এই অ্যাকটিভিটিটা বেশ, সময়মতো চার্জ শেষ হয়ে যায়। ব্যাগে পাওয়ার ব্যাংক আছে অবশ্য, কিন্তু কী দরকার। থাক না টেনশনে।
ট্রেনে উঠলাম। উপবন সময়মতোই ছাড়ল, ইদানীং ট্রেন লেট হয় না বেশি। উঠে মনে হলো, রাসেলকে টেনশনে রাখা ঠিক হবে না। পাওয়ার ব্যাংক লাগিয়ে ফোন করে জানালাম, ঠিকমতোই ট্রেনে উঠেছি। রাসেল শরীফ ছেলে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বার্থে টিকিট কেটে মেইল করেছে। না হলে আমার যে আলসেমি, এবারও সিলেট যাওয়া হতো না। আমরা একসঙ্গে পড়তাম। ইউনিভার্সিটি শেষ করে ও সিলেটে চাকরি নিয়েছে, আমি ঢাকায়। যাব যাব করে ছয় মাস চলে গেছে ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। তাই বেচারা এবার কোনো ঝুঁকি নেয়নি, টিকিট করে পাঠিয়েছে।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দুটি জিনিস দেখলাম। ট্রেন থেমে আছে, মানুষ হুড়মুড়িয়ে নামছে। আর মানুষের চেয়েও জোরে নামছে বৃষ্টি। জুলাইয়ের ভাপসা গরমের পর এমন বৃষ্টিতে যত খুশি হওয়ার কথা, আমি তার চেয়েও বেশি খুশি হলাম। কারণ রাসেল আমার আগমন উপলক্ষে রাতারগুল, বিছনাকান্দিসহ নানা জায়গায় ঘোরার প্ল্যান করেছে। আমি আরামপ্রিয় লোক। ডে-অফের সঙ্গে কোনোমতে দুই দিন ছুটি ম্যানেজ করেছি, এত ছোটাছুটি পোষাবে না। বৃষ্টি আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বোধ হয় এভাবে ঝরছে। খুশি খুশি মন নিয়ে নেমে দেখি সাতসকালেও রাসেল উপস্থিত! সত্যি, এই বেশি কেয়ারিং ব্যাপারটাই ওর বিরক্তিকর।
ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে রাসেলের বাসায় হাজির হলাম। শহর থেকে একটু দূরে, একটা নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের সাততলায় থাকে ও। লিফট নেই। সারা রাত জার্নির পর কাকভেজা হয়ে এসে সাততলায় হেঁটে ওঠা—এর চেয়ে খারাপভাবে দিনটা শুরু হতেই পারে না। রাসেলের করুণ মুখের দিকে চেয়ে কিছু বললাম না। তবে কষ্ট করে ওপরে উঠতেই মন ভালো হয়ে গেল। চারদিকে গাছপালা, ঝুম বৃষ্টি—সব মিলিয়ে অসাধারণ ভিউ। একমাত্র যন্ত্রণা শাখামৃগ! চারপাশে বাড়িঘর নেই, মানুষের প্রশ্নই আসে না। তবে সে অভাব পূরণ করেছে বানরের দল। তারা সংখ্যায় এত বেশি যে একটা গাছে পাতার চেয়ে বানরের সংখ্যাই বেশি মনে হলো। এতক্ষণে মনে পড়ল, কয়েক মাস আগে এই সিলেটেই বানরের উত্পাত থেকে বাঁচানোর দাবিতে মানববন্ধন হয়েছিল!
ক্ষুধা লেগেছিল প্রচণ্ড। বৃষ্টিতে ভিজে তা আরো দ্বিগুণ। গোসল করে এসে দেখি এলাহী কারবার। মুগের ডালের খিচুড়ি, ডিম ভাজা, মুরগির তরকারি, সালাদ আর আচার। এই ঝুম বৃষ্টিতে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! খিচুড়ি মুখে দিয়ে জাস্ট হারিয়ে গেলাম। দারুণ! সত্যি রাসেল ছেলেটার এলেম আছে। এরপর কখন তিন প্লেট খিচুড়ি চালান করে শুয়ে পড়েছি মনে নেই। যখন বুঝলাম দেখি বিকেল ৩টা, আর বৃষ্টি থেমে গেছে।
‘ওঠ, চার ঘণ্টা ধরে ঘুমাচ্ছিস’, রাসেলের কথা শুনে উঠে বসলাম। দেখি, সে প্যান্ট পরে বেশ রেডি। ‘চল, পাশেই একটা চাবাগান আছে, বৃষ্টির পর যা লাগে না’, উত্সাহ নিয়ে বলল রাসেল। মনে মনে ভাবলাম, অলস শরীর নিয়ে একদিনে তিনবার সাততলা ওঠা-নামা করলে কাল নির্ঘাত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। তবে রাসেলকে তো সে কথা বলা যায় না, ত্বরিত ফ্রেশ হয়ে নিচে নামা শুরু করলাম। তবে নিচতলায় নামতেই একসঙ্গে দুটি ঘটনা ঘটল। প্রকাণ্ড বাজ পড়ে বৃষ্টি শুরু হলো, সঙ্গে সঙ্গেই অবধারিত লোডশেডিং। আমরা বাজ উপেক্ষা করেই গাড়িবারান্দায় বসলাম, এখনই আবার সাততলায় উঠতে ইচ্ছা করছে না। দারোয়ান চাচার সঙ্গে পরিচয় হলো, তিনি আদা-লবঙ্গ দিয়ে দুরন্ত চা করে আনলেন। দ্রুতই গল্প জমে উঠল। হঠাত্ চোখ গেল ওপরে, দেখি ঢ্যাঙা মতো এক লোক বিল্ডিংয়ের সাততলা থেকে দ্রুত নেমে আসছে। লাফিয়ে লাফিয়ে দড়ি ধরছে আর ছাড়ছে। যেন মজার কোনো খেলা। আমি ভয়ে চিত্কার করে উঠতেই রাসেল বলল, ‘উনি বদি ভাই। দারোয়ান চাচার জামাতা। একসময় সার্কাসে ছিলেন। এখন রংমিস্ত্রির কাজ করেন। এই বিল্ডিংয়ে রঙের কাজ উনিই করছেন। ’ শুনতে শুনতে দেখছিলাম লোকটাকে। রাসেলের কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি নিচে নেমে এলেন। পরিচয় হলো ভদ্রলোকের সঙ্গে। তবে কথা বেশি বাড়ার আগেই বৃষ্টি বাড়ল। অগত্যা সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ফের ওপরে এলাম।
এর পরের ঘটনা বড়ই করুণ। বৃষ্টির ছাট আরো বাড়ল এবং পরের দিনও সে ধারাবাহিকতা বজায় থাকল। বর্ষাকালের কী মহিমা! লাভের মধ্যে এই যে বাজ পড়া বন্ধ হলো। বিদ্যুত্ও এলো। আমি আর রাসেল একের পর এক সিনেমা দেখতে লাগলাম, সঙ্গে অবশ্যই নানা রকম খাওয়া। পরদিন সকালেই বিল্ডিংয়ের আশপাশে কোমরপানি জমে গেল, নির্মাণ শ্রমিকরাও কেউ কাজে এলো না। কার্যত আমরা জলবন্দি, মূল জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন।
তার পরের দিন ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চাইলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি বৃষ্টি নেই। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। দুজন মিলে বের হলাম। সারা দিন কয়েকটি চাবাগান আর রাতারগুল ঘুরেই সিলেট সফর শেষ হলো। পরদিন দুপুরের ট্রেনে ঢাকা ফিরব। দেখলাম, রাসেলের খুব মন খারাপ, পছন্দের আরো কত জায়গায় বেচারা ঘোরাতে চেয়েছিল! দ্রুতই আসব—এই আশ্বাস আর দামি এক রেস্টুরেন্টে ভরপেট খাওয়ানোর পর বেচারার মুখে হাসি ফুটল। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতের খাওয়ার আর ঝামেলা ছিল না। দুই বন্ধু গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি, মনে নেই। পরদিন রীতিমতো কড়া রোদ। রাতে ফ্যান বন্ধ ছিল। গরমে ঘুম ভেঙে গেল। কয়টা বাজে দেখতে গিয়েই আবিষ্কার করলাম, ঘড়িটা নেই। যেখানে থাকার কথা, মানে বেডসাইট টেবিলে নেই। উঠে প্যান্টের পকেট, ব্যাগসহ সম্ভাব্য সব জায়গা দেখলাম। নেই। ফের শুয়ে ভাবতে লাগলাম। আমি গরিব হলেও ‘ঘড়িরোগ’ আছে। হাতঘড়ি পছন্দ করি। বলা যায়, এটাই আমার একমাত্র বিলাসিতা। নিজে তো কিনিই, গিফটও পাই। এই ঘড়িটা যেমন এক বড় আপু বিদেশ থেকে এনে দিয়েছেন। দাম হয়তো খুব বেশি কিছু না। কিন্তু আমার প্রিয় হওয়ার জন্য ঘড়ি নামটাই যথেষ্ট, দাম বেশি হওয়া লাগে না। এর মধ্যে রাসেল ঘুম থেকে উঠেছে, কালকে বাসা থেকে বের হওয়ার পর কী কী হয়েছে ভেবেছি, কিন্তু ঘড়ি পাইনি। রাসেল বেচারার মনমতো সব জায়গা ঘোরাতে পারেনি বলে এমনিতেই মন খারাপ ছিল, সঙ্গে ঘড়ি হারানোয় খুবই শরমিন্দা হলো। কারণ আমার ঘড়িরোগের কথা সে ভালোভাবেই জানে। আমার চেয়ে দেখা গেল ওরই মন খারাপ। ওকে চাঙা করতে দুজনে মিলে রান্নার কাজে লেগে গেলাম। হঠাত্ বলে উঠল রাসেল, ‘দারোয়ান চাচার জামাই বদি ভাই তোর ঘড়িটা নিয়েছে। আমরা কাল বাইরে গেলাম তখনই। ওনার স্কিল তো দেখেছিস, আর এখনো জানালাও ভালোভাবে লাগে নাই। তার জন্য এটা কোনো ঘটনাই না। ’
‘সত্যি বলতে তার সুযোগই সবচেয়ে বেশি। কারণ, যেভাবে পানিতে সব ডুবে ছিল আগের দিন, অন্য কারো এখানে আসার চান্স নেই, তা ছাড়া সেদিন তো আমরা ঘরেই ছিলাম। সরালে কালকেই কেউ সরিয়েছে, কিন্তু কালকেও তো কোনো শ্রমিক কাজে আসেনি’, বললাম আমি।
‘শোন, ঘটনা কী হয়েছে তা আমি যেমন বুঝতে পারছি, তুইও পারছিস। চল, নিচে গিয়ে বদি মিয়াকে ধরি। কিছু টাকা দিলেই দিয়ে দেবে। তাতেও কাজ না হলে ভয় দেখাব’, রাসেল খুবই উত্তেজিত।
আমি অবশ্য ততটা নই। বললাম, ‘শান্ত হ। তিনি ঘড়িটা না-ও নিতে পারেন। আর নিলেও ফেরত দেওয়ার জন্য নেননি। এতক্ষণে হয়তো বেচে দিয়েছেন। খামাকা ঝামেলা করে লাভ নেই। আমি তো আজকেই চলে যাব, কিন্তু তোকে তো এই বাসায়ই থাকতে হবে। কাজেই ওদের সঙ্গে ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই। তুই এখানে একা থাকিস, না জানি কোন ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দেয়। ’
এই কথা শোনার পর রাসেল ঠাণ্ডা হলো। ততক্ষণে মাংসটা হয়ে এসেছে, ভাত তো আগেই হয়েছিল। আলুটা ভর্তা করে নিলাম। তোফা ব্যবস্থা। এমন সুখাদ্য পেটে পড়াতে ঘড়ির কথা ভুলে গেলাম।
দুপুর নাগাদ রাসেলের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম। ও স্টেশন পর্যন্ত আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আমার প্রবল আপত্তিতে পারেনি। ট্রেন ঠিক সময়ই ছাড়ল। তবে মাথার গিঁটটা ছুটল ঘণ্টা দুয়েক পর। লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় বুঝে গেলাম ঘড়িচোর কে। আফসোস, তাকে ধরার কোনো উপায় নেই!
প্রিয় পাঠক, বলুন তো ঘড়িচোর কে? কিভাবেই বা চুরি গেল।