[সিগ্রন শ্রীবাস্তব জার্মান মূলের একজন ভারতীয় লেখিকা। থাকেন দিল্লিতে। জন্ম ১৯৪৩ সালে। বহুমুখী প্রতিভাধর এই লেখিকা একজন ভালো চিত্র এবং ভাস্কর্য শিল্পীও। মূলত কিশোর-কিশোরীদের জন্য ২৫টিরও বেশি বই লিখেছেন তিনি। অধিকাংশই ছোটগল্প। সবচেয়ে জনপ্রিয় বইটির নাম ‘A Moment of Truth’ যেটিতে প্রায় সারা দুনিয়ার প্রেক্ষাপটেই গল্পগুলো লিখেছেন। ‘আদভিয়া’ সেই সংকলনের অন্যতম সেরা গল্প। ছোটদের জন্য বহু ছায়াছবি এবং দূরদর্শন প্রকল্পেও তিনি কাজ করেছেন। -অনুবাদক]
আমি নিশ্চিত নই আফগানিস্তানকে আমি ভালোবাসি কি বাসি না। বাবা ভালোবাসেন। যদিও তিনি এখানে এসেছেন মাস চারেকই হলো। খানাবাদ সেচ প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ার তিনি।
ভাই আর আমি দিল্লিতে কাকা-কাকিমার কাছে থাকি। সম্প্রতি বাবা-মায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাবো বলে এসেছি। কুন্দুজ শহরে। শহরটি রুশ সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সপ্তাহ শেষের বন্ধে আমরা ঐতিহাসিক স্থান বাক দেখে ফিরছিলাম। ফেরার পথটাই বড় বিরক্তিকর ঠেকল। পাথুরে পার্বত্য পথের স্থবিরতা, কোত্থাও এক চিলতে সবুজ নেই। পাহাড়ের গায়ে ভূতুড়ে সব গর্ত, পথের দু-ধারে ছড়ানো ছিটানো পাথর, ধুলো আর অসহ্য গরম। আমার ভীষণ অস্বস্তি করছিল। পাশে বসা ভাইয়ের দিকে তাকালাম। হঠাৎই সে এমন কিছু কথা বলল, যা আমিও আসলে ভাবছিলাম, “দেখ ওদিকে! মনে হয় না ওই জায়গাগুলো ডাকাতদের লুকোনোর আদর্শ জায়গা?”
মা খানিক সচকিত হয়ে কৌতূহল নিয়ে বাবার দিকে তাকালেন, বাবা হাল্কা একটা হাসি দিলেন। পথের থেকে নজর না সরিয়ে বললেন, ‘এই নিয়ে বলবার মতো পুরোনো বাসিন্দা আমি হইনি আফগানিস্তানে। কিন্তু সহকর্মীদের থেকে যা শুনেছি আর দেখেছি, আফগানরা বরং বেশ বন্ধুসুলভ আর অতিথিপরায়ণ হয়।’
গাড়ির সামনের গ্লাসে বাবার চোখে আমার চোখ পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন,বললেন, ‘এই পূজা! এত ভীতু দেখাচ্ছে কেন? আমরা এই তাশখুরঘানে পৌঁছুলাম বলে, সেখান থেকে কুন্দুজ খুব দূরে নয়।’ আমাদের মেজাজ বদল করতে তিনি বললেন, ‘তার বদলে তোরা কিছু পুরোনো দিনের গান করে শোনাস না কেন?’
ফলে আমরা গলা ছেড়ে জোরে জোরে গাইতে শুরু করলাম। এমন জোরে যাতে সব ভয় আর ডাকাত থাকলে ওরাও পালিয়ে যায়।
পথটা নেমে আবার যেখানে উঠে যাচ্ছিল বাবা গাড়িটা সামান্য ধীর করে আনলেন, এবং ডান দিকে গিয়ে দাঁড়ালেন। ‘ভাবনার কিছু নেই।’ আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন, ‘এই, পেছনের চাকাগুলো একটু দেখে নিচ্ছি।’ তিনি গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা সব কটা দরজা খুলে দিলাম যাতে খোলা বাতাস কিছু ভেতরে ঢুকে। কিন্তু যে বাতাস ঢুকল সে ছিল প্রচণ্ড গরম আর শুকনো।
মা পায়ের কাছ থেকে ফ্লাস্কটা তুলে নিলেন। আমি রুমাল দিয়ে কপাল মুছে নিলাম। কুন্দুজে গিয়ে পৌঁছেই ঠান্ডা জলে গা ডুবিয়ে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করতে হবে –আমি ভাবছিলাম।
‘পূজা একটু জল খাবি?’ মা জিজ্ঞেস করলেন। আমি মাথা নাড়িয়ে হাত বাড়ালাম, আর তার ওপাশটায় পথের দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে হাত থেকে কাপ পড়ে গেল।আমার জিন্সে আর গাড়ির ম্যাটে জল গড়িয়ে পড়ল।
‘পূজা!’, মা বকা দিয়ে উঠলেন।
‘গাধা!’ ভাই ঘোঁত করে উঠল।
মায়ের বিস্মিত মুখের ওপারটাতেই আমার চোখ আটকে গেছে। দুটো লোক আমাদের গাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে। দুজনের একজন খানিক লম্বাটে। সে প্রায় গাড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বলে, অন্যটি পেছনে সহজে দাঁড়াতে পারছিল না। খোঁড়াচ্ছিল। পুরো মুখ ঢাকা। পাগড়ির ভেতর থেকে চোখগুলো ওদের জ্বলজ্বল করছিল। হাঁটু অব্দি কালো কোট। দুদিকে লম্বা হাত ঝুলছে, যেন কোনো দৈত্যাকার পাখির পাখা। ওরা সোজা আমাদের দিকে আসছিল। আমি ওদের দিকে দেখিয়ে চিৎকার করে বললাম, ‘ডাকাত! ডাকাত!’ মা ঘুরে তাকালেন। একটা লোক মাথার উপরে লাঠি ঘোরাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে ‘আদভিয়া!’
মাও ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর হাত থেকে ফ্লাস্ক পড়ে গেল কোলে। জানালার থেকে দূরে সরে গিয়ে তিনি ফিসফিসিয়ে বাবাকে ডাকলেন, ‘রোহন! রোহন! বাঁচাও!’
‘পাপা! পাপা!’, আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম এবং গাড়ির অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাব বলে ভাইয়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। সে আমাকে উল্টো ঠেলে দিল এবং কড়া স্বরে বলল, ‘পেছনে যা পূজা! বোকার মতো করিস না!’ সে দরজার বাইরে গিয়ে বাবাকে ডাকল, ‘পাপা, ডাকাত! ওরা সোজা আমাদের দিকে আসছে। চলে এসো। আমাদের যেতে হবে! গাড়ি স্টার্ট দাও পাপা! জলদি! প্লিজ!’
সুধীর, আমার ভাই, জোরে দরজা বন্ধ করে আমাদের চেঁচিয়ে বলল, ‘দরজা বন্ধ কর। জানালার গ্লাসগুলো তোল তাড়াতাড়ি!’
ভয়ে অবশ আমি গাড়ির সিটে হেলান দিলাম। আমার দিকে তেড়ে আসা লোক দুটোর দিকে তাকাচ্ছিলাম। লম্বাটি ইতিমধ্যে গাড়ির বনেটের কাছে পৌঁছে গেছে। ওর বাঁ হাত মায়ের দিককার জানালাতে পৌঁছে গেছে। দুই একবার লেগে পিছলেও গেছে। সে কিছু একটা বলে চেঁচাচ্ছিল।
‘জানালাটা বন্ধ করো মা!’ ভাই চেঁচাচ্ছে শুনতে পেলাম, ‘দরজা লক করো মা। দরজা বন্ধ করতে হবে। তোর দিকের জানালাটা তোল পূজা! শুনতে পাচ্ছিস?’
শুনতে আমি ঠিকই পাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন বহু দূর থেকে সে বলে যাচ্ছে। আমি নড়তে চাইছিলাম, চাইছিলাম জানালাটা তুলি। কিন্তু পারিনি। আমি বুঝতে পারছিলাম বাবা স্টিয়ারিংয়ের ফাঁক দিয়ে নিজেকে গলিয়ে দিচ্ছিলেন এবং নিজের পাশের জানালাটা বন্ধ করে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলেন, ‘দরজা বন্ধ কর!দরজা বন্ধ কর!’ তারপরে তিনি চাবি ঘোরাতে শুরু করলেন। এক! দুই! গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নিল।
আপনা আপনি আমি জানালার হ্যান্ডেল ধরতে এগোলাম। দ্রুত ঘোরাতে গিয়ে হাত ফস্কে যাচ্ছিল। যে লোকটা মায়ের জানালার কাছে এসে পড়েছিল আমার নজর ওর উপর আটকে আছে। এদিকে আমার হাত উল্টো দিকে ঘুরছিল আমি খেয়াল করিনি। ফলে বন্ধ হওয়ার বদলে জানালা আরো খুলে যাচ্ছিল। লোকটি ওর হাত ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। ততক্ষণে আমি ভুলটি ধরে ফেলে গ্লাস তুলতে শুরু করেছি। ওর হাত সেই গ্লাসে আটকে গেল। সে গ্লাস ধরে ফেলল, এবং নিচের দিকে চেপে জোর খাটিয়ে আবার খুলতে চেষ্টা করল। কিন্তু গ্লাস ধীরে ধীরে হলেও উপরে উঠে যাচ্ছিল, যদিও কষ্ট হচ্ছিল তুলতে। শেষে যখন একেবারে উপরে উঠে গেল জানালার ফ্রেমের সঙ্গে ডাকাতের আঙুল চেপে ধরল। লোকটি উফ- আহ করে জানালা ছেড়ে দিল। সে জানালাতে ঘুসি চালাল, ওর লাঠি দিয়ে কতক ঘা বসাল। পরে লাঠি ছেড়ে দুই হাতে দরজার হাতল ধরে চেষ্টা করল। মায়ের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে গেল। যা বলছিল, শোনাচ্ছিল ‘আদভিয়া’।
ও ব্যর্থ হলে পেছন থেকে অন্য লোকটিও এলো। সে আমার জানালায় চেপে ধরল। মুঠি দিয়ে ঘুসি চালাল। উপরের ফাঁক দিয়ে ঘুসিটা আমাকে ছুঁয়েই ফেলছিল। আমার হাত ধরে ফেলে নিজেকে সামনে ঠেলে দিচ্ছিল। রক্তলাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে গর্জে যাচ্ছিল ‘আদভিয়া! আদভিয়া!’
ওর দিকে তাকিয়ে আমি না পারছিলাম নড়তে, না কিছু বলতে। আমি শুধু পারছিলাম ওর ধুলোভরা দাড়িভরা নোংরা মুখের দিকে তাকাতে আর বারে বারে ওর চেঁচিয়ে বলা শুনতে, ‘আদভিয়া, আদভিয়া! লুতফুন মারা দাওয়া বিত্তে।’ আমার হাত ঝাঁকিয়ে অন্য হাতটাও ভেতরে নিয়ে আসছিল। আমি চিৎকার দিলাম, ‘পাপা!’
সামনের সিটের পেছনটায় আমাকে যেন ছুঁড়ে ফেলল প্রায়, আবার ধাক্কা খেয়ে পেছনে চলে গেলাম। ডাকাতটাও সামনের দিকে ঝাঁকুনি খেল একটা। সে আমার হাত ছেড়ে জানালা ধরে ঝুলে পড়ল। গাড়িতে গতি আসতেই ও পড়ে যাচ্ছিল পথে, কিন্তু জানালা ছাড়েনি। বাঁ হাতে তখনো ধরে রেখেছে। ওর নোংরা মাথাটা উপরে নিচে দুলছিল, আর সে পেছনে পেছনে দৌড়ে দৌড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল, ‘আদভিয়া, আদভিয়া, আদভিয়া।’
একবার, দু’বার, বারেবার।
তারপর ওর হাত ছুটে চলে গেল গাড়ি থেকে। ওর হাত, ওর মুখ এবং ওর কণ্ঠ। আমাদের গাড়ি এবড়োখেবড়ো ভাঙা পথ দিয়ে দ্রুত ছুটল। পেছনে পড়ে রইল ধুলোর মেঘ।
আমি আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। কিন্তু সুধীর তাকিয়েছিল। আনন্দে সে চেঁচিয়ে জানাল, ‘ওদের হারিয়ে দিয়েছি! ওদের থেকে ছাড়া পেয়ে গেছি! পা! ওয়াও!’
সে আমার দিকে তাকাল ভীষণ তাচ্ছিল্যভরে, ‘তুই এত বোকা হতে পারিস কী করে পূজা? তুই জানিস না কী করে জানালার কাঁচ তুলতে হয়?’
‘বন্ধ কর ওকে বকা!’ বাবা বললেন,’এমন পরিস্থিতিতে অমনতর হয়েই থাকে।’
‘কিন্তু ডাকাতগুলো ওকে প্রায় গলা চেপে ধরতে যাচ্ছিল’, সে গলা চড়িয়ে বলল।
‘না ধরেনি!’, আমি মিনমিনে প্রতিবাদ করলাম।
‘বেশ! সময় পেলে ও ছুরি বের করে ধরত, তুই…’
‘সুধীর!’ এবারে মা বললেন, ‘তুই থামবি। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ যে আমরা সবাই রক্ষা পেয়ে গেছি।’
‘ঠিক আছে।’খানিক বিরক্তিভরে বলে সে আরেকবার আমার দিকে একটা তাচ্ছিল্যের নজর ছুঁড়ে দিল। জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে সে মাথা দুলিয়ে গলা চড়িয়ে বলল, ‘আমরা ওদের হারিয়ে দিয়েছি! বাবা তুমি দারুণ! তুমি মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছ।’
ওই কয়েকটি মুহূর্ত আমার কাছে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল।
‘এই লোকগুলো’, ভাই বলে গেল,’আমাদের ঘড়ি, মায়ের চেন নিয়ে যেতে চাইছিল। আমরা ওদের আচ্ছা সামাল দিয়েছি। হারিয়ে দিয়েছি!’ আনন্দে ও নিজের হাতে তালি দিল। কিন্তু আমার সেরকম কোনো আনন্দ হচ্ছিল না।
আমার প্রায় কান্না পাচ্ছিল, মাথার ভেতরে যেন তখনো প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে,’আদভিয়া, আদভিয়া।’
‘পা, রাতের খাবার পরে শেষঅব্দি আমি মুখ খুললাম, ‘আমি ডিকশনারিতে ‘আদভিয়া’ শব্দটা দেখতে চাই। জানতে চাই শব্দটির মানেটা কী?’
‘ওটার মানে ‘হাত তোল’, খিরের শেষ চামচটা মুখে নিতে নিতে ভাই বলল, ‘নইলে আমি তোমাকে খুন করব নইলে…।’
‘সুধীর!’ মা ওকে চুপ করাল। বাবা শোওয়ার ঘর থেকে একটি ভারি ডিকশনারি নিয়ে ফিরলেন।
শব্দটা খুঁজে পেতে তার মুহূর্ত সময়ও লাগল না, কিন্তু মুখে উচ্চারণ করতে মিনিটখানিক সময় নিলেন। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে এলো, চোখ ভার হয়ে এলো। ধরা গলাতে তিনি বললেন, “আদভিয়া মানে ‘ঔষধ’।”
বহুক্ষণ কারো গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। একসময় মায়ের গলা থেকে বেরোল হাহাকার, ‘হায়! হায়!’
আবার। আবার।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। ভাইয়ের দিকে তাকালাম এবং তাই করলাম যা আমি সেই বিকেল থেকে করতে চাইছিলাম। কেঁদে ফেললাম।
সুশান্ত কর। পেশায় শিক্ষক।
অবস্থান : তিনসুকিয়া, আসাম, ভারত।