রেহান ক্লাসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে কবিতার প্রথম দুই লাইন বলেছে। বাকি ছয় লাইন মনে পড়ছে না। এই ঘটনা সব সময় ঘটে। রেহান বাসা থেকে পড়ে আসে। ক্লাসে স্যার পড়া জিজ্ঞেস করলে তার সব তালগোল পাকিয়ে যায়। পড়া বলতে পারে না। তখন স্যার রাগী চোখে তাকিয়ে থাকেন। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করে। তারা একেক দিন একেক রকম করে হাসে।
আজ তারা গুচ্ছ পদ্ধতিতে হেসেছে। হঠাৎ করে ক্লাসের এক জায়গা থেকে তিনজন হেসে উঠেছে। তাদের হাসি থামলে নতুন তিনজন হেসেছে। তাদের পর আবার তিনজন। হাসিদলের সিরিয়াল আগে ঠিক করা ছিল। হাসাহাসির এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে মুকিত। সে ক্লাসের নেতা টাইপের ছেলে। ক্লাসের সবাই তার কথা শোনে। কেউ শোনে ভয়ে। না শুনলে মুকিত পেটে ঘুষি মারে, নাহয় চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। আর কেউ শোনে তার কাজে মজা পায় বলে। মুকিতের মাথা দুষ্টুমিতে ভরা। সে অন্যের টিফিন খেয়ে তার টিফিন বক্সে গাছের পাতা রেখে দেয়।
রেহান ক্লাসে পড়া বলতে না পারলে যখন অন্যরা হাসে, তখন নওশিন মুখ ভার করে বসে থাকে। তার মন খারাপ হয়। রেহানকে দেখলে মায়া লাগে। নওশিন কয়েক দিন রেহানকে বলেছে, খুব করে মুখস্থ করবি। হেঁটে হেঁটে মুখস্থ করবি। চোখ বন্ধ করে মুখস্থ করবি।
রেহান বলল, অঙ্ক কীভাবে মুখস্থ করব?
নওশিন বলল, কবিতার মতো করে।
রেহান বলল, আমার তো কবিতা মুখস্থ করলেও মনে থাকে না।
নওশিন বলল, সেই জন্য খেতে-খেতে, যেতে-যেতে, শুয়ে-শুয়ে, দাঁড়িয়ে-বসে সব সময় মুখস্থ করতে থাকবি। দেখবি হয়ে যাবে।
রেহান ভীষণ সহজ-সরল নরম মনের একজন মানুষ। যে যা বলে সে তা-ই বিশ্বাস করে। সে নওশিনের কথা বিশ্বাস করল। হেঁটে-হেঁটে চোখ বন্ধ করে পড়া মুখস্থ করার চেষ্টা করল। কিছু হলো না। বাসা থেকে পড়ে এসে ক্লাসে বলতে গিয়ে ভুলে গেল।
ক্লাস ছুটির পর রেহান বাসায় ফিরছিল। নওশিন যাচ্ছিল ওর সঙ্গে। তখন মুকিত কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে রেহানদের কাছে এল। মুকিতের হাতে একটা সাদা ছোট্ট পাথর। এবড়োখেবড়ো মতো। মুকিত বলল, শোন রেহান, তোর জন্য এই পাথর নিয়ে এসেছি। বিশেষ পাথর।
নওশিনের বিশ্বাস হলো না। সে চোখ সরু করে তাকাল। তবে রেহান বিশ্বাস করল। বলল, এই পাথরে কী হবে?
মুকিত বলল, সামনে রেখে পড়বি। দেখবি তোর পড়া মনে থাকবে।
রেহান হাত বাড়িয়ে পাথর নিল। জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না এই পাথর মুকিত কোথায় পেয়েছে। ব্যাগের ভেতর পাথর রেখে দিল। রেহানরা চলে যাওয়ার পর মুকিতরা হেসে উঠল। এটা একটা ফালতু পাথর। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছে রেহানের সঙ্গে মজা করবে বলে।
দুই দিন পরে ক্লাসে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ম্যাডাম রেহানকে পড়া জিজ্ঞেস করেছেন। মুকিত ক্লাসের ছেলেমেয়েদের নিয়ে হাসির জন্য তৈরি হয়ে গেছে। ঘটনা ঘটেছে অন্য রকম। রেহান সুন্দরমতো পড়া বলেছে। সে মুখস্থ বলেনি। নিজের মতো করে গুছিয়ে বলেছে। রেহানের পড়া শুনে মুকিতরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেল।
রেহান নিজের ভাষায় গুছিয়ে প্রশ্নের উত্তর লেখে। শিক্ষকেরা খুশি হন। রেহান এখন ক্লাসে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পায়।
নওশিন বিস্ময় নিয়ে রেহানকে জিজ্ঞেস করল, খুব মুখস্থ করিস, তাই না? হেঁটে-হেঁটে, খেতে-খেতে, দুলে-দুলে?
রেহান বলল, আমি পড়া মুখস্থ করি না।
তাহলে পারিস কেমন করে?
পড়ার সময় মুকিতের দেওয়া পাথর সামনে রেখে দিই।
তাতে কী হয়?
আগে যখন পড়তে বসতাম তখন পড়ায় মন বসত না। একবার মনে হতো টেলিভিশনে কার্টুন দেখে আসি। একবার মনে হতো মায়ের মোবাইল ফোনে একটু গেম খেলি। কখনো মনে হতো পড়া বাদ দিয়ে কিছু খাই। এখন আমি কী করি জানিস?
কী করিস?
পড়ার সময় ওই সাদা পাথরটার দিকে কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকি। তখন আমার মনে কার্টুন বা গেম কিচ্ছু আসে না। মন দিয়ে পড়া বোঝার চেষ্টা করি। তাতে পড়া হয়ে যায়। আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম।
কী?
মুখস্থ করলে পড়া ভুলে যেতাম। কিন্তু খুব মন দিয়ে বুঝে পড়ি বলে এখন আর ভুলি না। নিজের মতো করে প্রশ্নের উত্তর বানাতে পারি।
পড়ার সময় তোর কার্টুন দেখার কথা মনে হয় না? গেম খেলতে ইচ্ছে করে না?
করে। যখন করে তখন ওই সাদা পাথরের দিকে তাকাই। একভাবে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। মন পড়ায় ফিরে আসে। পড়া শেষ হলে কার্টুন দেখি, খেলা করি। এখন অবশ্য আর পাথরটার দিকে তাকাতে হয় না। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। পাথর ছাড়াই আমি মন দিয়ে পড়তে পারি।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। পরীক্ষায় রেহান সবচেয়ে ভালো ফল করেছে। সব সাবজেক্টে সে বেশি নম্বর পেয়ে ক্লাসে প্রথম হয়েছে। নওশিন দৌড়ে এসে রেহানের দুই হাত আঁকড়ে ধরল। নওশিনের চোখে পানি। সে কাঁদছে। রেহান বলল, কাঁদছিস কেন? তোর পরীক্ষার রেজাল্ট অনেক ভালো হয়েছে।
নওশিন বলল, আনন্দে কাঁদছি। তুই এত ভালো রেজাল্ট করেছিস। আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।
রেহানের ভালো লাগছে। সে নওশিনের দিকে তাকিয়ে আছে। নওশিনের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে গালে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নওশিন চোখের পানি মুছে ফেলল।