ক.
আম্বিয়া বুড়ি নিজ ঘরের বারান্দায় বসে কাঁথা সেলাই করছিল, চশমা ছাড়া— যদিও তার বয়স মানুষ মনে করে আশি বছরের সামান্য ঊর্ধ্বে। কিন্তু সে নিজের বয়স গণনা ও চোখের জ্যোতির উপর ভিত্তি করে নিশ্চিত হয় যে, তার বয়স একশো দশ বা বারো হবে অথবা কম করে হলেও তা একশো বছরের উপরে এবং সূচের প্রতিটি ফোঁড়ে ফোঁড়ে তার মগ্নতা ছিলো গভীর।
কেননা এখন যে কাঁথাটি সে সেলাই করছে, এটা তার নতুন নেওয়া কাজ। কায়ছেদ চেয়ারম্যানের বউ বাপেরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে কার যেনো একটি নতুন ডিজাইন করা কাঁথা দেখে খুব মনে ধরেছিল। চেয়ারম্যানের বউ, আত্মসম্মানে বাধবে বলে চাইতেও পারেনি তার কাছে। শেষমেষ ওই কাঁথার মতো আরেকটি তৈরি করে নিতে চাইলে তার মনে পড়ে শ্বশুরবাড়ির পাশে থাকা আম্বিয়া বুড়ির কথা, যে কিনা কাঁথার জগতে কতো রকম আর কতো পদের কাঁথার নকশা হতে পারে, সারক্ষণ এর ধারণা মাথায় নিয়ে ঘোরে। বাপেরবাড়ি থেকে এসে একদিন সে আম্বিয়া বুড়িকে ডেকে দেখে আসা কাঁথাটির নকশা আংশিক মুখে মুখে বলে দিলে, আম্বিয়া বুড়ি বুঝে নেয় চেয়ারম্যানের বউ কোন নকশার কথা বলতে চাইছে। কিন্তু আম্বিয়া বুড়ি আগে কখনও এই কাজটি করেনি। তবুও যখন চেয়ারম্যানের বউ তাকে বলে, “তুমি এটা করতে পারবা তো, বুড়িমা?” বা “এই কাজ কি আগে করেছো বুড়িমা?” তখন আম্বিয়া বুড়ি নিজের ভেতরে কাজ করতে পারার আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে ফেলে “হ্যাঁ, কোনো চিন্তার দরকার নেই, আমার যে হাত খুব পাকা। চেয়ারম্যানের বউ তখন খুশি হয়ে কাঁথা সেলাইয়ের জন্য অগ্রিমই তাকে পাঁচশো টাকার নোট হাতের ভেতরে গুজে দেয়। সেই অগ্রিম নেওয়া পাঁচশো টাকার দায়ে অথবা নিজের কাজটি আরও নিঁখুতভাবে উপস্থাপন করতে কাঁথা সেলাইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে তার দৃষ্টি ও মন এমনভাবে মনোযোগী ছিলো যে, নিজের গালে চিবাতে থাকা পানের চাপা শব্দটুকু প্রায় স্থির হয়ে গেলেও সেদিকে তার কোনোরূপ খেয়াল ছিলো না।
খ.
সময়টা নিস্তব্ধ ছিলো। গাছের পাতা নড়া কিংবা উড়ে যাওয়া পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ পর্যন্ত হয় না এমন। ঠিক সেসময় আম্বিয়া বুড়ির ঘরের পেছন দিকে শেখদের যে বিশাল সুপারি বাগান রয়েছে, মনে হলো সেখান দিয়ে মানুষের একটি বড়সড় দল কাউকে তীব্র গতিতে ধাওয়া শুরু করেছে। আর ধাওয়াটা তীব্র হওয়ার পরিচয়বাহক ধ্বনি হই হই’ শব্দ তাদের মুখ থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে পুরো সুপারি বাগানটিকে গরম করে দিলে, সেই গরমের তাপ কিছুটা এসে লাগল আম্বিয়া বুড়ির কানে। সঙ্গে সঙ্গে কাঁথা থেকে তার মন উঠে গেলো। সেলাইয়ের ফোঁড় বন্ধ হলো এবং কৌতূহলী হয়ে সে ধীরে ধীরে পা বাড়াল সুপারি বাগানের দিকে। বাগানে প্রবেশ করতে করতে সে বুঝতে পারল, ছুটতে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করেই যেনো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। কেন? আম্বিয়া বুড়ির কৌতূহলটা সামান্য থেকে সামান্যতম বেড়ে গেলো। অথচ এখনও ধেয়ে আসা সেই দলটি তার দৃষ্টিগোচর হলো না। সে অম্লান চেহারায় এদিক-ওদিক তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুহূর্ত পরে, সুপারিবাগানের একটি কোণায় দলটি বিশালাকারে গোল পাকিয়ে তাদের শিকারকে আয়ত্বে এনে ধুপধাপ বাড়ি শুরু করে দিলে, আম্বিয়া বুড়ির কৌতূহলটি সেখানেই শেষ হয়ে গেলো এবং ধুপধাপ আঘাতের শব্দে দলটির অবস্থান তার দৃষ্টিতে এসে যায়।
কিছুক্ষণ পর জানতে পারল, তারা একটি কুকুর ধরে পিটিয়ে মেরেছে। যারা মেরেছে, ওরা হলো এই গ্রামের বাদর মার্কা উঠতি যুবক।
আম্বিয়া বুড়ি দাঁড়িয়ে থেকে কুকুরটি মেরে ফেলার কোনো কারণ জানতে পারল না। তাই সে বয়সের ভারে এসে যাওয়া মায়ায় ফিস ফিস করে বলতে লাগল, ইশ ইশ কেন যে অবলা পশুটারে মারল এরা। এর ভেতরে হঠাৎ করে তার সামনে থেকে শেখদের বংশের একেবারে ছোট্ট ছেলেটা দৌড়াতে দৌড়াতে যাচ্ছিল, তার চোখ-মুখের ভাবে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল সেও কুকুরটি মারায় নিজের কৃতিত্ব রেখেছে। তার নাম বাপ্পি। আম্বিয়া বুড়ি তাকে ডাক দিলো, এই বাপ্পি! কুত্তোডারে মারল কেন রে? জানিস? বাপ্পি একথার উত্তর না দিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল বুড়ির দিকে। তারপর চোখে-মুখে একঝাক উচ্ছ্বাস ছেড়ে বলল, আরে বুড়ি মা তুমি জান না কিছু? তোমার ছাগলডার পেট ফুটো করে দেছে কুত্তোডা! আমাগের উঠোনে, বাঁচপে না মনে হয়। বাপ্পির কথাটুকু শোনার পরে অকস্মাৎ যেনো কিছু একটা বুড়ির পায়ের নিচ থেকে সরে গেলো। নিজেকে একেবারে হালকা লাগল তখন। কিছু মুহূর্ত আগে কুকুরটার প্রতি তার যে মায়া ছিলো, নিমিষে সেটা উধাও হয়ে গেলো এবং সেই মায়াটুকু স্থানান্তরিত হয়ে নিজের ছাগলটার উপরে গিয়ে পড়ল। আর কিছু না ভেবে সে কাঁদো কাঁদো হয়ে দ্রুত পায়ে শেখদের বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল, বাপ্পির পিছনে পিছনে।
গ.
ওদিকে কুকুরটার মৃতদেহ শেখদের সুপারি বাগানে পড়ে রইল। যারা মেরেছিল, তারা কেবল মেরে ফেলা পর্যন্তই নিজেদের কর্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছিল। পরে একজন একজন করে চলে যেতে যেতে কেউ আর নিজ দায়িত্বে মৃতদেহটি নদীতে কিংবা কোনো গর্তে ফেলল না। তারপর মানুষের পদচারণা কুকুরটির নিকট থেকে সরে গেলে সেখানে ধীরে ধীরে বিভিন্নরকম মাছিদের উৎপাত বেড়ে গেলো এবং কুকুরের দেহটি ক্রমশ পচতে শুরু করল।
ঘ.
মধ্যরাত। অনিকেত ঘুম থেকে ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠল। অনুভব করল, তার গলা শুকিয়ে একেবারে শুকনো পাতার মতো খস খস করছে। অন্ধকারে পানির গ্লাস বরাবর সে টেবিলে হাত ঘষতে লাগল; তবুও গ্লাসটি হাতে বাধল না। কিছুক্ষণ আগে ঘুমের ভেতরে সে ভয়ঙ্কর কিছু স্বপ্নে দেখেছে, সেই স্বপ্নের শেষে ভয়ের পরিমাণ সহ্যের বাইরে চলে গেলে অথবা তখন স্বপ্নের শেষ দেয়ালে নিজের পিঠ ঠেকে গেলে, নিজেকে বাঁচাতে সে ঘুমটিকে ভেঙে ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। কিন্তু ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা যে কী ছিলো, সহসা তার মনে পড়ল না। তারপর সে মাথার দিক থেকে এগিয়ে লাইট জ্বালাল এবং তাতে ঘরটি আলোময় হয়ে গেলে দেখা গেলো, ঘরের এ ফকফকা আলোয় তার বুকের ভেতরে জমে থাকা ভয়ও অনেকটা দূরীভূত হলো।
এরপর অনিকেত বড় বড় শ্বাস তুলে পানির চুমুক নিলো আর ধীরে ধীরে তার স্মৃতিতে স্বপ্নে দেখা ভয়ঙ্কর জিনিসগুলো ফিরতে লাগল— তার মনে হলো, স্বপ্নটা ঠিক এমন ছিলো, বিশাল একটি শহর, সেই শহরের প্রশস্ত একটি সড়ক দিয়ে অনিকেত নিজের মনে হাঁটছে। তার আগ-পিছ করে করে আরও অনেক মানুষ হাঁটছে সেই সড়ক দিয়ে। সময়টা তখন সন্ধের পর, রোড লাইটের আলোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চারিদিকে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল অনিকেত, কিন্তু কী যে ভাবছিল তা অনিকেতের মনে পড়ছে না স্পষ্ট করে। তবে অনিকেতের ধারণা, তার মাথায় বড় কোনো ভাবনা ছিলো এবং চোখ ছিলো বৃষ্টিস্নাত রাস্তার ভাঁজে ভাঁজে। হঠাৎ করে তার মনে হলো, তার পেছনে হয়তো ছোরা নিয়ে একজন লোক তাকে অনুসরণ করছে। লোকটিকে দেখার জন্য যখনি অনিকেত পেছনে তাকাল অমনি লোকটি আড়াল হয়ে গেলো অন্য কারও শরীরের ভেতরে। এতে তার ভয় আরও বেড়ে গেলে সে লোকটিকে না দেখতে পাওয়ার ভান করে পায়ের গতি বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করল এবং সেই সঙ্গে তার শরীর থেকে মৃদু ঘামও ঝরতে শুরু করল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর অনিকেতের মনে হলো, তার পেছনে ছোরা হাতে নেওয়া লোকটি শুধু একজনই নয়, বরং পুরো সড়কে ছোরাবিশিষ্ট আরও কয়েকজনও তাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে। সে আর তাকাল না। ভয়ে তার কলজে শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তখন সে নিজেকে লুকোতে সড়কে থাকা অন্যান্য পথচারীদের হাঁটার ফাঁকে ঢুকে যাবে ঠিক করল। ঠিক তখনই খেয়াল করল সে, চলতে থাকা সাধারণ মানুষগুলোও ধীরে ধীরে কোথায় যেনো হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। সে তাদেরকে ডাকতে উদ্ধত হলো, কিন্তু ততোক্ষণে তারা উধাও হয়ে পুরো সড়ক লোকশূন্য হয়ে গেলো। অনিকেতের বুক ক্রমশ ধুক ধুক করতে লাগল। সে এবার কান খাড়া করে টের পেল তার একেবারে পেছনেই সেই ছোরা হতে লোকগুলো এসে গেছে। অনিকেত ওদের দিকে তাকানোর সাহস পেল না। সে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল, কিন্তু দু’টো পা যেনো খুব নরম আর ভারী হয়ে গেলো। সে চেষ্টা করেও দৌড়াতে পারল না আথবা দৌড়ানোর গতিটা এতো ধীরে হলো যেনো তা প্রায় হাঁটার মতো। ওদিকে ছোরাবিশিষ্ট লোকগুলো একেবারে অনিকেতের পিছনে এসে তার কোমরের বাম পাশে আঘাত করলে অকস্মাৎ তার ঘুমটি ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙার পরে সে বুঝতে পারল যে সেটা আসলে একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছিলো মাত্র। ওদিকে তার বুকের ধড়ফড়ানি কমল না তখনও।
রাতের মধ্যভাগ। চাদের আলোয় বাইরে ঝিকমিক করছে। অনিকেত দোতলা থেকে নিচে নেমে এসেছে। ভয়ঙ্কর স্বপ্নটি দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে, তার ঘুম আসছে না এখন। সে ভাবল, হয়তো পুকুর পাড়ে কিছুসময় বসে থাকলে মনটা ভালো হতে পারে। তাই সে ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে শেখেদের পাকা পকুর ঘাটে এসে বসল। একটি সিগারেট ধরিয়ে স্বপ্নটি ভোলার চেষ্টা করল সে। তারপর ধীরে ধীরে তার মনে এলো, সে কেবল আজকেই এ স্বপ্নটি দেখেনি। সে ঠিক এই একই স্বপ্ন কয়েকটা দিন ধরে দেখছে। হুবহু একরকম, যে স্বপ্নটা ভয়ে মাখা— ছোরা হাতে নিয়ে কয়েকজন লোক তাকে ধাওয়া করছে। বিনা কারণেই। লোকালয়ে অথবা নির্জনে। আর অসহায়ভাবে অনিকেত শুধু পালাতে চেষ্টা করছে, কখনও নিরাপদ কোনো স্থানে, কখনও বা মানুষের ভিড়ে। কিন্তু কোনোভাবেই সে পালাতে পারছে না। সে যেখানেই যাক না কেন, ছোরা হাতে লোকগুলো তাকে দেখে ফেলছে এবং সেদিকেই তারা আক্রমণ করতে উদ্ধত হচ্ছে আর কী যেনো বলতে চাচ্ছে— কয়েকদিনের এ স্বপ্নগুলিতে দৃশ্যত কোনো অমিল নেই, অনেক্ষণ ভেবে অনিকেত নিশ্চিত হলো। এরপর রাতের চাঁদটি ধীরে ধীরে মেঘের আড়াল হয়ে গেলে, অনিকেত মনের ভেতরে রাখা দিনলিপির একটি পাতা বের করে পড়তে শুরু করল, মনযোগী হয়ে।
দিনলিপি: একটি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষক ধরা পড়েনি, ধরা পড়ার পূর্বেই সে পালিয়েছে। ওদিকে এলাকার একদল হৃদয়বান মানুষ ধর্ষিতা শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। কিন্তু শেষমেষ শিশুটি বাঁচতে পারেনি অথবা হৃদয়বান মানুষগুলো শিশুটিকে বাঁচাতে পারেনি। মৃত্যু ও ধর্ষণের বিষাক্ত ছোবলে তার মৃত্যু হয়েছে। ধর্ষণের এ বিভীষিকাময় গল্পটি আমার এই গল্পে বলা দু-’চার লাইনের মতো করেও শেষ হতে পারত, যদি অনিকেতের মতো সমাজের কথা ভাববার মতো কোনো মানুষ এখানে না থাকত কিংবা জন্ম না হতো। হ্যাঁ, তো অনিকেত গল্পটি শেষ হতে দিলো না। ঠিক যেনো শেষ হওয়ার পূর্বক্ষণে সে সমাপ্তি লাইনটি টেনে ধরে আরও বড় করতে লাগল। এইভাবে।
ফেসবুকে কয়েকজনকে নিয়ে ধর্ষণের বিচার চেয়ে একটি গ্রুপ খুলেছিল সে। একটি ইভেন্ট খুলেছিল। তারপর যারা যারা এই কাজকে ভালোবেসে ইভেন্ট বা গ্রুপে যোগ দিয়েছিল, তারাও শিশু ধর্ষণের বিচার চেয়ে নিজেদের টাইমলাইনে স্টাটাস দিয়েছিল। ধর্ষকের একটি কালারফুল পিকচারও অ্যাটাচ করেছিল সবার স্টাটাসে স্টাটাসে। টানা সপ্তাখানেক ধরে এমন চলছিল এবং শিশু ধর্ষণের এই ছোট্ট আন্দোলনটিও সফল হয়ে উঠছিল বলে তারা মনে করছিল। তাদের এ আন্দোলন গ্রাম ডিঙিয়ে মফস্বলে, মফস্বল ছাড়িয়ে শহরে পৌঁছেছিল, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত— সর্বশ্রেণীর মানুষের চোখে খবরটি বেশ হইচই তুলেছিল। বহু মানুষ সেই আন্দোলনে যে যেভাবে পেরেছিল সমর্থন করেছিল। অনিকেত সেদিন এটা ভেবে অনেক খুশি হয়েছিল যে, এতো এতো মানুষ শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চয় এতো এতো মানুষের প্রতিবাদের ভাষাও কম শক্তিশালী নয়। এবার সত্যিই শিশু ধর্ষণের দুর্ধর্ষ ধর্ষকটি উপযুক্ত শাস্তি পাবে। ধর্ষিতা শিশুটির বাবা-মা-ও সঠিক বিচার পাবে।
এ আন্দেলনের সবকিছু ঠিক ছিলো, কিন্তু এর ভেতরে কোত্থেকে কারা যেনো বিভিন্নরকম হুমকি-ধমকি দিতে শুরু করল অনিকেতকে। ফোনে কিংবা ফেসবুকে। ইনবক্স খুললেই ভয়ঙ্কর সব মেসেজ। মেসেজগুলোতে কেউ আন্দোলন উঠিয়ে নিতে বলল, কেউ এ নিয়ে চেচামেচি করলে মুণ্ডু নামিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাল। কেউ বলল নিজের বোন যেহেতু নয় সেহেতু এতো আন্দোলনের কী দরকার তোমার। সাথে আরও গালি ছিলো। আরও ছিলো জীবননাশের আশঙ্কা। অনিকেত খুব ভয় পেয়েছিল এতে। তাই সে সেদিন থেকে হঠাৎই যেনো চুপসে যেতে শুরু করল। নানারকম চিন্তা তার মাথাকে যেনো আরও ভারী করে ফেলল।
তারপর একদিন অনিকেত ভাবল, গল্পটি কি এখানেই মাটি চাপা পড়বে? নাকি জীবনের রিস্ক নিয়েই সে লড়ে যাবে?
ঙ.
অনেক্ষণ পুকুরপাড়ে বসে থাকার পরে অনিকেতের চোখে ঘুমের একটু ভাব নেমে এলে, সে ভাবল এবার ঘরের ভেতরে উঠে যাবে। সে চাঁদের আলোয় মেশানো অন্ধকারে চটি জোড়া খস খস করতে করতে পায়ে পরল। তখন তার মনে হলো অথবা নিজের চোখেই যেনো সে দেখল, ওদের পুকুর পার হয়ে শেখদের যে সুপারি বাগান রয়েছে সেখানে সেই মৃত কুকুরটি টান টান হয়ে পড়ে আছে; যেটাকে আম্বিয়া বুড়ির ছাগলের পেট ফুটো করে দেওয়ার কারণে এলাকার ছেলেপেলে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। অথচ ওদের কারোরই মনে হয়নি যে, মৃত এ দেহটি কোথাও পুঁতে রাখতে হবে বা কোথাও ফেলে দিতে হবে। কুকুরটির জন্য অনিকেতের কেন যেনো খুব মায়া হলো। সে ধীরে ধীরে পুকুরের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কুকুরটির কাছে গেলো এবং তখন আফসোসের স্বর যেনো তার গলা থেকে গলে পড়ল…ইশ…।
অনিকেত হঠাৎ যেনো শুনতে পেল, তার পেছন দিয়ে মানুষের একটি দল এই সুপারি বাগানের দিকে ছুটে আসছে, বেশ তীব্র আর হিংস্র গতিতে। অনিকেত পেছনে না ফিরেই কিছুটা অনুমান করতে পারল যে, এ দলটি তারাই যারা সকালবেলা কুকুরটি মেরে গিয়েছিল। কিন্তু এই এতো রাতে ওরা আবার এলো কেন? ওরা কি ভাবল কুকুরটি এখনও জীবিত আছে? অনিকেত ওদের দিকে না তাকিয়ে নিজের কাছে প্রশগুলি তুলল।
তারপর সে পেছনে তাকিয়ে বিস্মিত হলো, ভয় পেল এবং তারপর আর কিছুই মেলাতে না পেরে সে হকচকিয়ে গেলো। সে দেখল ছুটে আসা লোকগুলির হাতে হাতে চক চক করে ওঠা সব ধারালো ছুরি, আর তারা ছুটে আসছে ঠিক তার দিকেই। এই দৃশ্যটা যে হুবহু সেই স্বপ্নের মতো, অনিকেত বুঝতে পারল। অনিকেত জ্ঞান হারিয়ে সেখানে পড়ে গেলো। ঠিক মৃত কুকুরটির দেহের কাছে। লম্বালম্বিভাবে। অসহায়ভাবে। যেনো মাত্রই সেখানে দ্বিতীয় আরেকটি কুকুরের মৃত্যু হলো।