তিথী

তিথী
তিথী কোনোদিন কল্পনাও করেনি ও প্রেমে পড়বে। তাও এইভাবে! কত আচানক ঘটনাই না ঘটে মানুষের জীবনে। অথচ তিথী সারাজীবন ভেবে এসেছে এইসব প্রেম ভালোবাসা ওর জন্য না। কত ছেলেকেই তো দেখল, কতজন কথা বলতে আসলো, ভাব ভালোবাসার প্রস্তাব দিলো। কই, এর আগে কোনোদিন তো কাউকে একটুও ভালো লাগেনি। সবসময় ভেবেছে বাবা মায়ের কথামত এরেঞ্জ ম্যারেজ করে নিবে। তারপর একটা ঘর, একটা গাড়ি, দুটো বাচ্চা। সুখের সংসার। অথচ সেই তিথীই কিনা বিসিএস ক্যাডার ছেলের সম্বন্ধ ভেঙে দিলো। শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্য৷ অথচ মজার ব্যাপার হলো ছেলেটাকে এখনো দেখেইনি তিথী৷
শুধু জানে একটা চওড়া কাধ, লাল চেকের শার্ট, সবুজ লুঙ্গি, নীল স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর শিরশির শব্দ৷ এইটুকু নিয়েই ওর ভালোবাসা। সেদিনের কথা ভাবলে এখনো বুকের মধ্যে কেমন কেমন করে ওঠে তিথীর। এই কেমন কেমন করাটাকেই বুঝি মানুষ নাম দিয়েছে প্রেম। সেদিন ছিল খুব সম্ভবত শনিবার। তিথী রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বেলকনিতে এসে বসেছে প্রতিদিনের মতই। তিনতলার বেলকনি থেকে আকাশ দেখা যায়। আর দেখা যায় রাস্তা৷ রাস্তার ওপাশে স্যূয়ারেজ লাইন। ড্রেনের পাশে নাম না জানা লতাপাতার জঙ্গল। সেদিন ছিল জোসনা। আকাশে থালার মত চাঁদ উঠেছে। লোডশেডিং এর পর হুট করেই জোসনা যেন বেড়ে গেল। ঝিঝি ডাকছে কোথাও। খুব হাওয়া দিচ্ছে৷ কেমন একটা মায়াময় পরিবেশ। তিথী বেলকনিতে বসে গান শুনছে। ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।’
এই গানটার কারণেই কিনা কে জানে, প্রথমবারের মত তিথীর মনে হলো কাউকে ভালোবাসা জিনিসটা খুব একটা খারাপ না। নিজের একটা মানুষ থাকলো, যাকে নিশ্চিন্তে মনের সব কথা বলা যায়। ভার্সিটিতে যাওয়ার নাম করে কোনো পার্কে হাত ধরাধরি করে হাটা যায়। রেস্টুরেন্টে বসে স্যুরুৎ স্যুরুৎ করে কফি খাওয়া যায়। আচ্ছা খুব কি দেরি হয়ে গেছে? মাস্টার্স শেষ বর্ষে পড়ছে তিথী। কলেজের মত প্রেমে পড়ার বয়স কি আর আছে ওর। এখন তো না চাইলেও সেই এরেঞ্জ ম্যারেজ। কাউকে ভালো না বাসার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একটু কি আফসোস হলো তিথীর?
“কেন মেঘ আসে, হৃদয়ও আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না তখন, ঠিক তখন ছেলেটাকে দেখলো ও। ছেলে নাকি যুবক? এতো দূর থেকে বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তিনতলার বেলকনি থেকে নীচে রাস্তায় দাঁড়ানো ছেলেটার মুখটা বোঝা যাওয়ার কথা না। পরনে লাল চেক শার্ট, সবুজ লুঙ্গি, নীল স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ছেলেটা হেটে হেটে ল্যামপোস্টের আলোর একদম নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠিক তিথীদের গেটের সামনে। তিথী উপর থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছে। ছেলেটা রাস্তার ওপাশে বেড়ে ওঠা জঙ্গলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলো। দুই হাতে লুঙ্গিটা বেশ খানিক উচু করলো। সামনের দিকে ঝুকে গেল।
তারপর সেই শব্দটা। শিরশির! শিরশির! পাতার ওপর বৃষ্টি পড়লে যেমন শব্দ হয়। তিথীর কয়েক সেকেন্ড লাগলো বুঝতে যে ছেলেটা হিসু করছে। লজ্জা পেল ও। এখন চোখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত। কিন্তু পারল না তিথী। যেন দৃশ্যটা ওকে হিপনোটাইজ করে ফেলেছে। আকাশে বিশাল চাঁদ, জোর বাতাস, জোসনার কোমল আলো, ঝিঝির ডাক, প্রসাবের শিরশির, সব মিলিয়ে দৃশ্যটাতে কি যেন ছিল। তিথী চোখই ফেরাতে পারলো না। কাজ শেষ করে ছেলেটা উঠে আবার হেটে হেটে চলে গেল। তাও চোখ ফেরাতে পারল না তিথী। লতাপাতার ওপর অনেকটা জায়গা জুড়ে ভিজে আছে। হালকা ফেনাও দেখা যাচ্ছে। সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়েই রইলো, চেয়েই রইলো। “কি রে, অনেক রাত হলো। ঘুমাবি না?” আম্মুর ডাকে সংবিৎ ফিরে পেল ও। দ্রুত রুমে ঢুকে বিছানা রেডি করে শুয়ে পড়ল। ঘড়িতে তখন রাত দুইটা বেজে বিয়াল্লিশ মিনিট।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলো তিথী। আজ ওর বিয়ে। সারা বাড়ি খুব সুন্দর করে সাজানো। অনেক আত্মীয়স্বজন। তিথী লাল বেনারসি পরে বসে আছে ঘরে। বাইরে খুব হৈ হুল্লোড় হচ্ছে। হঠাৎ কে যেন বললো, এই বর এসেছে, বর এসেছে। মুহুর্তেই তিথীকে একা রেখে সবাই ছুটলো বর দেখতে। ঘরে আর কেউ নেই। তিথীরও ইচ্ছা হলো নিজের বরকে দেখার৷ বিছানা ছেড়ে উঠে উকি দিলো জানালা দিয়ে। অনেক লোকের ভীড়। কিন্তু বর কই? ঐতো দেখা যাচ্ছে। শেরওয়ানি আর পাগড়ি পরা। আশ্চর্য, কি করছে লোকটা? সবার সামনে রাস্তার ওদিকে মুখ করে বসে হিসু করছে। কেউ একজন এই অবস্থাতেই ফুল ছিটাচ্ছে বরের গায়ে। ঘুম ভেঙে গেল তিথীর। খুব দূরের কোনো মসজিদে তখন ফজরের আজান দিচ্ছে।
সারাদিন বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার ব্যার্থ চেষ্টা করল তিথী। কিন্তু কোনোভাবেই গতরাতের ঘটনাটা মাথা থেকে সরাতে পারলো না। চোখের সামনে শুধু একটা দৃশ্যই ভাসলো দিনভর। ল্যামপোস্টের আলো, লাল চেক শার্ট, উবু হয়ে বসা একটা মানুষ, শিরশির শব্দ। তিথী একসময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সে রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘড়ি দেখছে বারবার। রাত সাড়ে দশটা। আজও বেলকনিতে তিথী। আজ ফোনে নজরুল সঙ্গীত। ‘আলগা করো গো খোপার বাধন, দিল ওহি মেরা ফাস গায়ি।’ একটা মানুষ প্রতিদিন একই জায়গায় হিসু করতে বসবে না। এটা কমন সেন্স। নিজেকেই নিজে বোঝালো তিথী। আবার একই সাথে একটু পরপর তাকাচ্ছে রাস্তার দিকে। কি করবে, মন যে যুক্তি মানে না।
রাত এগারোটায় ঘরে চলে আসলো তিথী। কেন যেন কান্না পাচ্ছে ওর। ঘুমানোর চেষ্টা করলো শুয়ে৷ ঘুম আসছে না। সাড়ে এগারোটার দিকে হঠাৎ করেই মনের মধ্যে কেমন করে উঠলো ওর। এটাকেই কি টেলিপ্যাথি বলে? এক দৌড়ে বেলকনিতে গিয়ে দেখে মানুষটা বসে আছে উবু হয়ে। সেই একই চেক শার্ট, লুঙ্গি, স্যান্ডেল। আশ্চর্য, মানুষটার আর জামা নেই নাকি? শিরশির শব্দটা আজকে একটু জোরেই আসছে। আজ কি বেশি হিসু চেপেছে তার? কে জানে! তিথীর খুব কান্না পাচ্ছে। তিথী শুধু চেয়ে রইলো একভাবে। দেড়টা অব্দি। অথচ লোকটা চলে গেছে অনেক আগেই। তিথীর এতো পাগল পাগল লাগছে কেন! আশ্চর্য! লোকটা আসলো তার পরদিনও। আসলো তারও পরদিন। ছয় সাতদিন পর তিথী বুঝে গেল এমনটা প্রতিদিনই ঘটবে। রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে কোনো একসময় লোকটা ওদের বাসার সামনে দিয়ে হেটে হেটে যাবে। যাওয়ার সময় ল্যম্পোস্টের নিচে বসে হিসু করবে। জানতেও পারবে না ওপাশের চারতলা বাড়ির তিনতলায় একটা মেয়ে এই সময়টার জন্য কি তীব্র আকর্ষণ নিয়ে সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে। তার হিসু করা দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মত।
তিথীর সারাদিন কোনো কাজেই মন বসে না। ছটফট করে। ঘড়ি দেখে একটু পরপর৷ সন্ধ্যার পর ব্যাপারটা অনেক বেড়ে যায়। ছটফটানি আর ঘড়ি দেখা। আম্মু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এমন কেন করছিস? কি হয়েছে তোর?’
তিথী কোনো কথা বলে না। ঘনঘন পানি খায়৷ গলা শুকিয়ে গেলে কি করবে? আগে যে মানুষকে ডেকে ডেকেও খাবার টেবিলে আনা যেত না সে এখন রাত নয়টা বাজতেই তাড়াহুড়া করে খেয়ে নেয়। তারপর বেলকনিতে গিয়ে বসে। বেশিক্ষণ বসেও থাকতে পারে না।
বেলকনি জুড়ে পায়চারি করে। আর রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে৷ এসময় ওর ব্লাড প্রেশার মাপলে নির্ঘাত অনেক হাই আসবে। নিজের হার্টবিট নিজেই শুনতে পায় ও। হাত পা কাঁপে। তারপর মানুষটাকে দেখলেই সমস্ত উত্তেজনা শান্ত হয়ে যায় নিমেষেই। অদ্ভুত এক শান্তি শান্তি ভাব চলে আসে তিথীর মধ্যে। বেলকনির গ্রীলে হাত রেখে তিথী যেন একদম সেটে যায় গ্রীলের সাথে। শিরশির শব্দটা ওর কানে মধুর কোনো সঙ্গীত হয়ে বাজে। যেন বেথোফেন এর সিম্ফনি। যেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সেতার। একটা সামান্য শব্দ মানুষের কানে এতো মধুর লাগতে পারে? একটা সামান্য দৃশ্য লাগতে পারে এতো লোভনীয়? তিথী তার এই চব্বিশ বছরের জীবনে প্রথমবারের মত রিয়েলাইজ করলো সে প্রেমে পড়েছে। মানুষটাকে না দেখেই প্রেমে পড়েছে। একটা চওড়া কাধ, একটা উবু হয়ে বসা পিঠ, একটা আবছা চেহারা আর একটা শিরশির শব্দের প্রেমে পড়েছে তিথী।
মানুষটার সব মিলিয়ে দুইটা শার্ট, দুইটা গেঞ্জি আর একটা ফতুয়া। দুইটা প্যান্ট আর দুইটা লুঙ্গি। স্যান্ডেল ঐ একটাই। একটা প্যান্টে চেন সিস্টেম আরেকটাতে বোতাম। যেদিন চেনওয়ালা প্যান্ট পরে আসে সেদিন হিসু করতে বসার আগে ‘সিৎ’ করে চেন খোলার শব্দ হয়। সব মুখস্থ তিথীর। সব। সেই ঘটনার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। এখন নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে ও। বাসার কেউ বুঝতে পারেনা ওকে দেখলে যে ওর ভেতরে কি চলছে। সারাদিন স্বাভাবিক মুখ করে ঘুরে বেড়ায়। কলেজে যায়, রান্না করে ইউটিউব দেখে, ফেসবুক চালায়। কিন্তু যত কাজই থাক, রাত সাড়ে নয়টা বাজতেই পাল্টে যায় তিথী। সব কাজ শেষে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। একটা শাড়ি পরে। হালকা লিপিস্টিক লাগায়। টিপ নেয়। তারপর দশটার মধ্যে হাজির বেলকনিতে। না, ওর সাজগোজ দেখবে না মানুষটা। কিন্তু সাজতে ভালো লাগে তিথীর। যেমন কোনো অনুষ্ঠান বা ডেটে যাওয়ার আগে মানুষ সেজে যায়, তেমনি। লোকটা টের না পেলেও, ওর কাছে তো এটা ডেটের মতই। ভুল ভবিষ্যৎ একটা ব্যাপার ঘটে। লোকটা হিসু করে যাওয়ার পর হাওয়ার সাথে ঝাঝালো টাইপ গন্ধটা উড়ে আসে তিথীর বেলকনিতে। বুকভরে ঘ্রাণ নেয় তিথী। ওর কি যে ভালো লাগে৷ কোনো বিদেশি পারফিউম এর কাছে কিছুই না। রাতে শুয়ে শুয়ে কল্পনায় লোকটার সাথে কথা বলে ও৷
– এই ছেলে, তুমি কি পানি কম খাচ্ছ?
– কেন বলো তো?
– আজ মাত্র একচল্লিশ সেকেন্ডেই হিসু করা শেষ তোমার। বেশি করে পানি খাবা। অন্তত দুই মিনিট ধরে করবা। আমি অপেক্ষা করে থাকি না?
– আচ্ছা খাবো।
– প্রমিজ করো?
– প্রমিজ।
– অনেক ভালোবাসি।
– আচ্ছা।
– আচ্ছা কি, বলো আমিও ভালোবাসি।
– আমিও ভালোবাসি।
তিথীর বাসা থেকে ছেলে দেখা শুরু করেছে। প্রথমে আসলো এক সচিবের ছেলে। ব্যবসায়ী। অনেক টাকা। না করে দিল তিথী। তারপর ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট। বাবা মায়ের খুব পছন্দ। ওরাও পছন্দ করলো তিথীকে। সব ঠিকঠাক। এমন সময় তিথী ওর আম্মুকে গিয়ে শান্ত গলায় বললো, ‘আমি এক বোতল বিষ কিনে রেখেছি। এই বিয়ে হলে বাসর রাতে ঢোকার আগে খাবো।’ বিয়ে ভেঙে গেল এটাও।
তিথী সারাজীবন প্রেম না করে ভুল করেছে। এখন কাউকে ভালোবেসেও তাকে হারাতে ও দেবে না। কোনোভাবেই না। তিথী তাই ভাবলো এবার ওর অনুভূতির কথা মানুষটাকে জানানো উচিত। ও এমনিতে যথেষ্ট সুন্দরী, বড়লোকের মেয়ে। ওকে দেখলে কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারবে না। শুধু জানাতে হবে ও মানুষটাকে ভালোবাসে। কিন্তু উপায় কি? আইডিয়া আসলো। একটা চিঠি লিখলো তিথী। ওর মনের সমস্ত আবেগ এক করে দিয়ে। তারপর কাগজটা দিনের বেলা রেখে আসলো লোকটা যেখানে হিসু করে ঠিক সেখানে।
পরদিন গিয়ে দেখে কাগজটা খুলেও দেখেনি সে। সেই জায়গাতেই পড়ে আছে। কিন্তু ভিজে আছে। কাগজটা সাবধানে তুলে আনলো তিথী। রোদে শুকিয়ে ডায়েরির ভেতর তুলে রাখল। এভাবে কাজ হবে না। অন্যকিছু ভাবতে হবে৷ কি করা যায় ভাবছে তিথী। তখন ঘটনাটা ঘটলো। রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল কিন্তু দেখা নেই মানুষটার। এরকম তো হয়না কখনো। তিথীর অস্থির লাগা শুরু হলো। বারোটা বেজে গেল তাও আসলো না। একটার দিকে ওর চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করলো। সারারাত বসে রইলো তিথী। আসলো না সে। সকালে আম্মু ওকে দেখে চমকে উঠলেন, ‘কিরে, কি হয়েছে তোর? এরকম দেখা যাচ্ছে কেন।’
– কিছু হয়নি। যাও তো তুমি।
তিথী নিজেকে বোঝালো, নিশ্চয় মানুষটার কোনো কাজ ছিল। অথবা সে আত্মীয় বাড়ি গেছে। একদিন না ই আসতে পারে। আজ নির্ঘাত আসবে। আসতেই হবে। কিন্তু আসলো না সেদিনও। সারারাত তিথীর চোখ দিয়ে একভাবে জল পড়লো। সকালে আম্মু দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘মা রে, আমাকে বল তোর কি হয়েছে। তুই যা বলবি আমরা সব মেনে নিব। তোর সুখই আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ তিথী সারাদিন খাওয়াদাওয়া করলো না। দরজা বন্ধ করে বসে রইলো। আম্মু আব্বু দুইজনই এসে অনেক অনুনয় বিনয় করেও কথা শোনাতে পারল না তিথীকে। সাড়ে আটটার দিকে দরজা খুলে বের হলো তিথী। মুখ ধুলো। নতুন শাড়ি পরলো। লিপিস্টিল নিলো। টিপ পরলো। চুল বাঁধলো। তারপর বারান্দায় এসে বসে রইলো।
তিথীর কেন যেন মনে হচ্ছে আজ মানুষটা আসবে। উপরওয়ালা কি ওর ডাক শুনবে না? ও মানত করেছে, আজ সে আসলে কোনো ভিখারিকে তিনবেলা খাওয়াবে। না, আসলো না। একসপ্তাহ হয়ে গেল আসল না। দুই সপ্তাহ হলো। তিথী খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে বিছানা ধরলো। এতো দূর্বল যে শোয়া থেকে উঠতেই পারে না সারাদিন। কিন্তু রাত হলে ঠিকই ওঠে। বারান্দায় গিয়ে বসে। বসে থাকে সারারাত। কিন্তু আসেনা মানুষটা। যেন হুট করেই উধাও হয়ে গেছে সে। অনেক ডাক্তার দেখানো হলো। কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। তিথী দিনদিন শুকিয়ে যেতে লাগলো। ডাক্তার বলেছে, এভাবে চলতে থাকলে খুব বড় কোনো রোগে পড়বে ও।
এক রাতে বাবা তিথীর রুমে আসলেন। তিথী বেলকনিতে বসা৷ চেয়ার টেনে পাশে বসলেন। তিথীর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ‘মা রে, আমি সারাজীবন অনেক টাকা আয় করেছি। অনেক পরিশ্রম করেছি। সব তোর সুখের জন্য। তুই ছাড়া আমার আর কেউ নাই রে মা। আজ তোর কি হয়ে গেল? কোনো ছেলেকে ভালোবাসিস তুই? বল আমাকে। সে যেমনই হোক আমি মেনে নিব। বল মা।’ তিথীর সব আবেগ বাধ ভেঙে গেল। বাবার বুকে মাথা রেখে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বললো ও। সব শুনে তিথীর বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোকে কথা দিলাম ঐ ছেলেকে আমি খুজে বের করে দিব।’
– তুমি সত্যি বলছ বাবা? প্রমিজ?
– হ্যা রে মা, প্রমিজ।
তিথীর বাবা তার সমস্ত চেষ্টাই করলেন। আশেপাশে সব জায়গায় খোজ নিলেন। দারোয়ান ছাড়াও আরেকটা লোক ঠিক করে দিলেন যার দায়িত্ব সারারাত রাস্তার পাশে বসে থাকা। যাতে কেউ হিসু করতে আসলে বাসায় খবর দিতে পারে। সে শুধু এই কাজের জন্য বেতন পাবে। এছাড়া লাগালেন সিসি ক্যামেরাও। আশেপাশের কয়েক এলাকায় মাইকিং করলেন। “একটি বিশেষ ঘোষণা। একমাস আগে নিরালার মামনি ভিলা নামের হলুদ রঙের চারতলা বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় যিনি প্রতিদিন প্রসাব করতেন তার জন্য থাকছে বিশেষ পুরস্কার…কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি!”
স্থানীয় ক্যাবলে বিজ্ঞাপন দিলেন। “আপনি কি কখনো নিরালার মামনি ভিলার সামনে প্রসাব করেছেন? তাহলে আপনাকেই খুজছি আমরা। হ্যা ভাই…খুলনার নিরালায় অবস্থিত মামনি ভিলা।” কিন্তু না, দেখা নেই লোকটার। কয়েকজন অবশ্য এসেছিল পুরস্কারের লোভে। তিথী তাদেরকে বলেছে ওইখানে প্রসাব করতে। তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একনজর দেখেই না করে দিয়েছি তিথী। ও মানুষটাকে চেনে। সেই কাধ, সেই পিঠ, সেই শিরশির শব্দ প্রতিদিন স্বপ্নে আসে ওর। এতো সহজে ভুল হওয়া সম্ভব না। সেই ঘটনার প্রায় ছয়মাস কেটে গেছে। সবাই প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে। একরকম নিশ্চিত যে মানুষটা আর আসবে না। এরকম একদিন তিথীর ফোনে রাত দেড়টায় একটা ফোন আসে। দারোয়ানের নাম্বার। রিসিভ করতেই বলে, ‘আপামনি একটু বেলকনিতে আসেন তো।’
ফোনটা ছুড়ে ফেলে দৌড়ে যায় তিথী। রাস্তার দিকে তাকাতেই পরপর দুইবার হার্টবিট মিস হয় ওর। ঐতো সেই কাধ, সেই পিঠ, সেই শিরশির শব্দ। কয়েক মুহুর্তের জন্য তিথীর মনে হয় ও স্বপ্ন দেখছে। ও বাস্তবে নেই। তারপরই চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। বাবা মা দোড়ে আসেন। তিথীর বাবা রাস্তার দিকে একবার তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে ফেলেন। মানুষটা তখন উঠে দাঁড়িয়ে হাটা শুরু করেছে। তিথীর বাবা চিৎকার করে নাইটগার্ড আর দারোয়ানকে বলেন, ‘ধরো ওকে৷ যেতে দিওনা। ধরো।’ মোতালেবের বয়স বিয়াল্লিশ। বিবাহিত। দুই ছেলে এক মেয়ে। ভাড়ায় অটো চালায়৷ প্রতিদিন মালিকের কাছে অটো জমা রেখে হেটে হেটে বাসায় যায়। যাওয়ার পথে একটা ল্যাম্পোস্টের গোড়ায় প্রসাব করে। মাঝে লুকিয়ে ফেনসিডিল কিনতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে ছয়মাস জেল খেটেছে। গতকালই ছাড়া পেয়েছে। আজ আবার অটো নিয়ে বের হয়েছিলো। আগের মতই বাড়ি ফেরার পথে আজও প্রসাব করছিলো। তখনই শোনে কেউ চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। মেয়ে কণ্ঠ।
ভয় পেয়ে যায় মোতালেব। দ্রুত কাজ শেষ করে চলে যেতে চায়। কিন্তু কেউ একজন দৌড়ে এসে ধরে ফেলে ওকে। সাথে চিৎকার চেচামেচি। ধরে টানতে টানতে ওকে সামনের বাড়িটার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুই বুঝতে পারেনা মোতালেব। তিথী খুব কাঁদছিলো। মোতালেবকে দেখে কান্না আরো বাড়ে। শান্ত হতে বেশ অনেকটা সময় নেয়। তারপর মোতালেব এতো বয়স্ক, তার বউ বাচ্চা শুনে নির্বাক হয়ে যায় তিথী। তিথীর বাবা বলেন, ‘তুই চাইলে এই লোকের সাথে আমরা বিয়ে দিতে রাজি আছি।’ না সূচক মাথা নাড়ে তিথী। অন্য কারোর সংসার ও নষ্ট করতে পারবে না। ও ওর ভালোবাসার মূল্য রাখবে। আর সেক্রিফাইসের থেকে প্রকৃত ভালোবাসার প্রমাণ আর কিছুতেই হয়না। মোতালেবের সাথে একা একটু শেষবারের মত কথা বলতে চায় তিথী।
– ভালো আছো তুমি?
– জে হ্যা। আপনে?
– তুমি জানো না আমি কেমন আছি?
– আমি ক্যামনে জানমু?
– তুমি কিভাবে পারলে মোতালেব।
– আমি কি কচ্ছি?
– কিছু না। শোনো তোমায় একটা কথা বলি।
– বলেন।
তিথী বুকে পাথর বেধে সন্তর্পণে চোখ মুছে আস্তে আস্তে বলে, ‘আজ থেকে আর কোনোদিন তুমি আমাদের বাসার সামনে প্রসাব করতে আসবে না। আর কোনোদিন না।’
– জে আচ্ছা।
– মনে থাকবে?
– থাকবো।
– কিন্তু আজ শেষবারের মত তুমি একবার যাওয়ার সময় প্রসাব করে যাবা। পারবা না।
– পেশাব তো নাই। তিথী পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়, পানি খাও বেশি করে। তারপর ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে তারপর যাও।
– জে আচ্ছা।
শেষবারের মত ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় বসে হিসু করছে মোতালেব। আকাশে আজ সেই প্রথমদিনের মত বিশাল চাঁদ উঠেছে। হঠাৎ খুব বাতাস শুরু হলো। মানুষটা উবু হয়ে বসেছে। প্যান্টের চেন খোলার শব্দ হলো, ‘সিৎ’ করে। তারপর সেই শিরশির শিরশির। অঝোর ধারায় জল গড়াতে লাগলো তিথীর দুই চোখ দিয়ে৷ মন্ত্রমুগ্ধের মত মোতালেবের দিকে চেয়ে রইলো ও। ওর মনে হলো, এই সময়টা যেন কোনোদিন শেষ না হয়, কোনোদিন না৷
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত