আমার মাথার মধ্যে তারারা নাচে ঝাঁক বেঁধে! উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল গতিতে নাচে। তারাদের গায়ের পিচকিরি রং পিছলে পড়ে আকাশে। সেলুলয়েড ফিতায় যখন তখন ভেসে ওঠে বাঁদরনাচ! চোখ বন্ধ করলেই কানের ভেতর শুনতে পাই কান্না। কে কাঁদে? শাপলা ঝিনু নাকি মীরা? ঘরের মধ্যে শেয়াল ঢুকে পড়ে জানালা দিয়ে, একসাথে অনেকগুলো। মেঝে ফুঁড়ে কখনও কখনও উঠে আসে আস্ত গরিলা! আমার মাথা ঝিমঝিম করে, আমি আর দেখতে চাই না কিছু। চোখের সামনে ড্রপসিন চাই এখুনি, এই মুহূর্তে। কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে যাক দৃশ্যপট –
নীলাম্বরী ছয় আনা
ঝালমুড়ি ছয় আনা
কলের পুতুল ছয় আনা ভাই
তালের পাখা ছয় আনা
ছয় আনা—–
সকাল হতেই ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ি আমি-
ওই তো হুডতোলা রিক্সায় হায়দার আর শশী চেপেচুপে বসে আছে। একদম ঠাসাঠাসি। বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা আমার সামনে দিয়েই টেনে নিয়ে গেলো ওদের। রিক্সাওয়ালার কাঁধে রানারের পেটমোটা চিঠির কাপড়ের থলের মতো দুই মানুষ! হায়দার, শশী। দুজনের কেউই আমাকে দেখতে পায়নি, শুধু আমিই কি দেখলাম? দেখলাম হায়দারের নোনা ঘামে ভিজে চুপসে যাচ্ছে শশীর ওড়না, খাবি খাওয়া মাছের মতো তড়পাচ্ছে শশী! হায়দার পাকা শিকারীর মতো খেলাচ্ছে শশীনামক এই বিশাল কাতলা মাছ। শশী তড়পাচ্ছে আর তড়পাচ্ছে, তড়পাতে তড়পাতে একদম আমার মাথার ভেতর ঢুকে পড়লো। সুড়ুৎ করে একটা শব্দও হলো যেনো! এখন আমি আর আমি নেই, যেনো শশী হয়ে গেছি। লেপ্টে যাচ্ছি হায়দারের শরীরে। হায়দারের হাত কিলবিল করছে আমার উন্নত বাড়ন্ত স্তন যুগল সামাল দিতে, তার হা করা মুখ, চুক চুক করা শব্দ, ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া লালা মিশে যাচ্ছে আমার গালে। উফ কী কুৎসিত! কী জঘন্য! হায়দারের জিভের ঘোলাটে আঠালো পদার্থের বিশ্রী গন্ধে আমার পাকস্থলির ভেতরে ঘটে যাচ্ছে প্রলয়! উঠে আসছে ফেনাভাত, পিচ্ছিল তেতো জারক রস! তার কালো পুরুষ্ট কামুক ঠোঁট খামচে দিচ্ছে আমার বুক, পিঠ। ধারালো নখের আঁচড়ে কেটে যাচ্ছে আমার শরীর! আমি পথের পাশেই বসে যাই, বমি করি হড়হড় করে।
রাস্তার পাশের আধময়লা ফার্মেসি থেকে উঠে আসেন আরও আধময়লা পোশাকের সিরাজ ভাই, আমি তার গা থেকে ইঁদুর মরা গন্ধ পাই, আমার উদ্গীরণের বেগ বাড়ে-
ভাবি শরীর খারাপ করেছে? রিক্সা ডাকবো?
আমি ঘোলাটে চোখে ছায়াচিত্রের মতো সিরাজ ভাইয়ের ঠোঁট নড়া দেখি, শব্দ শুনি না কোনো!
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সিরাজ ভাই আমার জন্য একটা রিক্সা নিয়ে আসেন। রিক্সাওয়ালা হায়দারের রিক্সাওয়ালার মতোই বুড়ো! যেনো হায়দারের ভাড়া করা রিক্সাটাই চক্রাকারে ঘুরে বেড়ায় আমার আশে পাশে, হায়দারের গা বেয়ে পিছলে পড়াটাই যেনো আমার নিয়তি!
টুংটাং ঘণ্টা বাজিয়ে রিক্সা চলতে শুরু করেছে, সিরাজ ভাই তাকিয়ে থেকে আমার চলে যাওয়া দেখছেন। মাত্র কিছু সময় আগে হায়দারও গিয়েছে এ পথে, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে সিরাজ ভায়ের চোখ খুঁজি, তিনি কি দেখেছেন সব! কী জানি দেখুক, যে যাকে খুশি দেখুক না! আমিতো দিনরাত মাথার মধ্যে বায়োস্কোপ দেখি আমারতো কোনো সমস্যা হয় না!
আমি আর পিছনে ফিরে তাকাই না।
বাসায় ফিরে পরপর দুবার গোসল করি, এই বিগত যৌবনে এসে খুব বিশ্রী রকম ধর্ষিত হওয়ার অনুভূতিতে ডলে ডলে পরিষ্কার করি সব। তারপরও মনের খুঁতখুঁতানি যায় না, সময় নিয়ে ধর্ষণের আলামত খুঁজি শরীরে। পাই না। ক্লান্ত লাগে খুব। বড়মেয়ে শাপলা দরজায় নক করে যায়, উঁচুস্বরে বকে-
মা, এই বুড়ো বয়সে কী হয় তোমার! ঘর থেকে বাইরে গেলে কেনো? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মরবে নাকি!
শাপলার কথা কানে নিই না, মেয়েটা তড়বড় করে কথা বলে, বেশিরভাগই ঝাঁঝের কথা। আমি শাপলার কথা আড়াল করে নিজের কাজে ডুবে যাই! দুপুর গড়িয়ে যায়! টিভির চলতি সংবাদে পরিচিত রিক্সাটা খু্ঁজি। রানা প্লাজায় ধ্বংসস্তূপে হাজার হাজার মৃত মানুষের মুখ দেখাচ্ছে আজ। অদ্ভুত! এতো এতো মৃতদের মাঝেও একটা হায়দার বা একটা শশীর মুখ নেই!
শাপলা আবার কথা বলতে শুরু করেছে-
—মা সিরাজ কাকা ফোন করেছিলেন
–কিছু বললেন?
শাপলা চোখ নামায়
–তোর বাবা ফিরেছেন?
শাপলা কলের পুতুলের মতো ঘাড় নাড়ায়। বিরক্ত লাগে! আমি আবার দুর্যোগের খবরে ডুবে যাই। ভাল্লাগে না এতো মৃত্যু, চ্যানেল পাল্টাই। রোমান্টিক প্রেমের নাটক চলছে একটা! স্থির হই। একটা কিশোরী মেয়ের চোখভরা টলটলে পানি। তার প্রেমিক তাকে কথা দিয়েছিল মিডনাইট সানে অনথনের সাথে স্যুপ খাওয়াবে, ফার্স্টডেট ছিলো তাদের! কিন্তু ছেলেটা কথা রাখেনি, ডজনখানেক বন্ধুসমেত অভুক্ত মেয়েটা ফিরে এসেছে বিনা ট্রিটে! মেয়েটা সিদ্ধান্ত নেয় এই অপমানে সে আত্মহত্যা করবে, খসখস করে লিখছে সুইসাইড নোট! আমি টিভি বন্ধ করে দেই, বিরক্ত হই, চ্যানেলওয়ালারা কোথায় পায় এসব বস্তাপচা গল্প!
হায়দার ফিরেছে। শশীও হয়তো। হায়দারের কানের দুপাশের সাদা চুল। গত সপ্তাহে নিশ্চই রং লাগানো হয়নি, বুড়োটে লাগছে দেখতে।
হায়দারতো এতো বেখেয়ালি ছিলো না, ইদানীং কেন যে এতো আগোছালোভাবে বাইরে যায়, কে জানে। হায়দারের সবকিছুর মতো এ ব্যাপারটায়ও আমার বিরক্ত লাগে, তবু কিছু বলার আগ্রহ পাই না মনে।
হায়দার আমার কাছে এসে বসে। আমি সরে যাই, ভয় হয় হায়দারের গা থেকে আবার যদি কোনো আদিম গন্ধ আসে! হায়দার বুঝতে পারে বিষয়টা, কপাল কুচকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়! প্রশ্ন করে-
বিপি মাপিয়েছো?
হু
কতো?
স্বাভাবিক।
বমি হয়েছে নাকি?
হু প্রতিবার যেমন হয়।
হায়দারের মাথা কাঁধ বরাবর ঝুঁকে যায়! মনে হলো দৃষ্টিও নত!
—খুকি, আমার শরীরী ব্যাপারটায় এখনও কেন তোমার এমন হয় বুঝি না!
আমি চোখ নামাই, অপরাধী লাগে নিজেকে! আমি নিজেও ঠিক বুঝি না কেন আমার এমন হয়! হায়দারের সাথে আমার শরীরের হিসেব মিটেছে প্রায় বিশ বছর, আরও বেশিও হতে পারে। তারপরও কেন এমন হয়! এর মাঝে একটা কথা ভেবে খুব হাসিও পায়! এই বুড়ো বয়সে এখনও হায়দার কোন সুখে আমায় খুকি নামে ডাকে!
হায়দার গ্লাসে করে পানি আনে, এগিয়ে আনে মুখের কাছে, আমি আর ফেরাই না! ইদানীং আমার প্রতি হায়দার অনেক বেশি যত্নশীল। মেনোপজের পর আমার মেজাজটাই বরং খিটখিটে হয়ে আছে! জরায়ুর টিউমারের বিস্তৃতি বেড়েছে, ক্যান্সারও নাকি হতে পারে, হোক! ভালোলাগে না এসব ভাবতে! আমার বুড়োটে শরীরে ক্লান্তি অনেক! কথা বলতে বলতে আমার চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে হায়দার, প্রাণপণে যতোটা পারি তক্তপোশের আরাম বালিশে লেপ্টে রাখি শরীর! হায়দার পায়ের কাছে কুচকে থাকা চাঁদরের ভাঁজ খুলে ঢেকে দেয় আমার নগ্ন পা। একে একে আমি তলিয়ে যাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে।
ঘুম বেশি সময়ের না। তন্দ্রার মাঝে টের পাই অর্ক আর ঝিনুকে নিয়ে হায়দার খেতে বসেছে, গল্প করছে, হাসছে! শাপলা গুছিয়ে দিচ্ছে সব, ঝিনু হাত নেড়ে নেড়ে কণ্ঠ ভেঙেচুরে দেখাচ্ছে তার নতুন বন্ধু সুজানের ঢং! রোজকার পুরনো দৃশ্য!
একটা দীর্ঘশ্বাস গলা বেয়ে উঠে আসে, সে শ্বাসটা বেওয়ারিশ হাওয়ায় রং-বেরংয়ের দেয়ালে ঘুরে বেড়ায় কিছুক্ষণ! থাক আমার বুদ্বুদে ইচ্ছেরা আমার কাছেই থাক! লোভ করে কী হবে? হায়দার, অর্ক, ঝিনু আর ওই খাবার টেবিল আমার নয়! আমি তো মুহূর্তের জন্যও ভুলে যেতে পারি না আমার শশী হয়ে যাওয়ার বিভ্রম। হায়দারের কামুক মুখ! আচ্ছা এমনও তো হতে পারে আজ দুপুরে কিছুই ঘটেনি, আমি কিছুই দেখিনি। হয়তো রিক্সায় হায়দার ছিলো না, ছিলো না শশীও, যারা ছিলো তারা অন্য কেউ। নরক থেকে উঠে আসা গলিত শব তারা। তাদের গায়ে হাজার রকম মরা-পচার দুর্গন্ধ, থুতু চটচটে শরীর, ঘাম আর আঠালো জিহ্বা তাদের! আমি জানি খাওয়ার টেবিলে বসে থাকা এ হায়দার সে দৃশ্যের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত!
হায়দার হাসছে গা দুলিয়ে, ঝিনুককে আশ্বাস দিচ্ছে- আসছে সামারে তারা বেড়াতে যাবে! অর্কর হোস্টেল ছুটি হোক তারপর। এরমধ্যে শাপলার হবুও বরও হয়তো প্রবাস থেকে ফিরবে। আসুক সব! নিয়ে যাবে সবাইকে মীরার বাসায়।
মীরার কথা ওঠায় আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মীরা! আমার অগ্রজ। কতোদিন দেখা হয় না দুবোনের! মীরাকে শেষ দেখেছিলাম হায়দারের সাথে সঙ্গমরত অবস্থায়। চিলেকোঠায়! মীরা তখন সদ্য সংসার ফেরত ডিভোর্সি! আহত বাঘিনী এক! সত্যি বলতে মীরা আর হায়দার প্রস্তুত ছিলো না আমার এমন আকস্মিক আবির্ভাবের জন্য। আমার চোখের সামনে তখন মীরার উত্তপ্ত শরীর, হায়দারের কামুক দাঁত। মীরার দুধসাদা শরীরে হায়দারের পুরুষালি চিহ্ন কেমন কেটে কেটে বসে ছিলো। দৃশ্যটার ব্যঞ্জনা হঠাৎ আমার কাছে বহুমাত্রিক হয়ে যায়। আমার মনে হয় এ দৃশ্য অনেক পুরনো, সেসময় থেকেও বছর সাতেক আগের ঘটনা। আবছায়া স্বপ্ন দৃশ্যের মতো আমার মনে পড়ে এ ঘরে কে যেনো থাকতো, আমাদের মায়ের দিককার আত্মীয় কেউ, খুব সম্ভবত মিরন নাম! একদিন এই চিলেকোঠায় মিরন বা হায়দার ছিলো, আমাকে অথবা মীরাকে খুব জোরে জাপটে ধরেছিল সে। তখন কী হয়েছিল ঠিক মনে পড়লো না আর! তবে এটা মনে আছে সেদিন আমার বা মীরার সালোয়ার থেকে গড়িয়ে পড়েছিল অনেক রক্ত, লালে ভিজে ছিলো মেঝে। আমি কিছু মেলাতে পারছিলাম না, তালগোল পাকিয়ে তাকিয়ে ছিলাম হায়দার আর মীরার দিকে, তাদের দলিত মথিত সঙ্গম কেমন চটচটে। ঘেন্না ঘেন্না! তাদের নির্লজ্জ সহবাসে আমার গা গুলিয়ে ওঠে, আমি কার্নিশ ধরে উগরে দেই পাকস্থলির বর্জ্য! আমার মনে হলো সেই থেকে আমার উদগীরণ রোগের শুরু, একবার শুরু হলে নাড়িভুঁড়িসহ উঠে আসে! অস্বীকার করার উপায় নেই আমার বাড়াবাড়ি সন্দেহ বিভ্রমও তখন থেকেই শুরু!
বিবাহ বিচ্ছেদ শব্দটা সে সময়ও বেশ প্রচলিতই ছিলো! তবে শব্দটা আমার একদম পছন্দ নয়, মীরাকে এসবে মানায়! ভাঙতে গড়তেই শান্তি ওর! পরে জেনেছিলাম, মীরার বিচ্ছেদজনিত নাটকের পেছনের নায়ক নাকি হায়দার! তবে এই সত্য কেউ আমায় জানিয়েছে, না আমি নিজে নিজে জেনেছি সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। মীরার ভালোবাসার সমীকরণটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। হায়দারকে মীরা ভালোবাসে, সে ভালোবাসা যে সে ভালবাসা নয়, একেবারে সিনেমার নায়িকাদের মতো ভালোবাসা। আমার অল্প বয়সের তিন তিনটা ছেলেমেয়েও মীরার চোখের মণি। শুধু আমার বেলায় তার উটকো ঘৃণা। আচ্ছা মীরা কি আমায় হিংসে করে? কেন করবে? সে কী জানে না আমার পেটে বিদ্যে থাকলেও মাথায় ঝিঁঝিঁর অসুখ! যুদ্ধ ফ্যাসাদ কী আমি পারি? তবুও কেন এমন করে মীরা!
আমার বুঝে আসে না তাদের এই সঙ্গম দৃশ্য দেখার পর আমার কাকে ঘৃণা করা উচিত! মীরাকে নাকি হায়দারকে? কাকে ঘৃণা করা আমার জন্য একটু হলেও সুবিধের হবে? আমি অলস অকর্মণ্য। নিজের ঘরে বসে বসে কতো দীর্ঘ সময় আমি এসব যোগ-বিয়োগ করেছি, কেউ কী তা জানে?
আমি জানি আমার ইতিহাস কাপুরুষতার ইতিহাস! নিজের গল্প বলতে গেলে ধান ভানা তো হবেই না বরং শীবের গীত বেশি হয়ে যাবে। বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে। বিয়ের আগে থেকেই আমি শীতল, একটু নিরুত্তাপ স্বভাবেরও। ভুল বললাম! আমার শরীরে তাপ যথেষ্টই ছিলো! হাড় কাঁপানো কী এক জ্বর যখন তখন জাকিয়ে উঠতো শরীরে। কী একটা গোপন অপারেশন করার কথাও ছিলো আমার হয়নি, শরীরে কুলায় না! মন আর মগজ সেই থেকে একটু দুর্বল! তবুও ঠিক ঠিক মনে আছে মীরার সাথেই হায়দারের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো একসময়, আমার তখন সবে পনের! আমার এই শোকতাপ জর্জর পাটকাঠির মতো শরীর নিয়ে হায়দারকে আমি বেশ ভয় করতাম! বিয়ের পর হায়দার আমায় অনেক যত্ন করতো খাইয়ে দিতো পরিয়ে দিতো, এমনকি যত্ন করে লেখাপড়াটাও করিয়েছে! হায়দারের পরিচয় যদি আমার স্বামী না হতো তবে তাকে আমি অনায়াসে বাবা বা বড় ভায়ের আসনে বসিয়ে শ্রদ্ধা করতাম খুব!
আচ্ছা হায়দার তুমি আমায় বিয়ে করেছো কেন?- এ প্রশ্ন করেছি বহুবার, এ প্রশ্নে হায়দার হাসে! রহস্যময় হাসি।
আঁতুড় ঘরে শাপলাকে কোলে নিয়েও এই এক কথা নিয়ে কতো ঘ্যানঘ্যান করেছি! কে দেয় উত্তর! আমার কেবলই সন্দেহ হতো হায়দারের ছোঁয়ায় প্রেম নাকি শুধুই স্নেহ? তবে ছেলেপুলে হলো যে এতোগুলো? ঝিনু নয় অর্কর জন্মের পর পরই আমি অনুভব করি আমার সংশয়ের সবটা ভুল নয়! হায়দার আসঙ্গ আলিঙ্গনে আমার জন্য প্রেম নয়! অনুকম্পা। তার উষ্ণতা অন্য কারও ঘামের জন্য! বন্ধ ঘরের সেই খুলে যাওয়া দরজায় দাঁড়িয়ে সেই প্রথম আমি হায়দারকে চিনেছিলাম পুরোপুরি, বিয়ের সাত বছর পর-
আমার সুস্থ হতে অনেক সময় লেগেছিল সেবার! এই মারাত্মক ঘটনার ধাক্কায় আমার ভেতরের ভিত নড়ে যায়, কী যেনো তৈরি হয় আমার ভেতর। ডাক্তার বলে এর নাম অবসেশন! আমি ধরেই নিলাম আমার নারীত্বের প্রয়োজন নেই, অপ্রয়োজনীয় নারীত্ব নিয়ে বিব্রত আমি। মৃত্যু চাই এর। সেই তেইশ বছর বয়সে রাত-দিনের প্রার্থনায় আত্মনিগ্রহে শরীরে জানাই বার্ধক্যের আমন্ত্রণ। জড়তায় গুটিয়ে নিই নিজের তেজ। আয়নায় দাঁড়িয়ে তুচ্ছ করি নিজের লাস্যরূপ! অন্যদিকে হায়দারের প্রতিক্রিয়া হয় এর ঠিক বিপরীত! তার অপরাধবোধ তাকে আমার প্রতি প্রচণ্ড উত্তেজিত করে তুললো নতুন করে! আমরা বুঝতে পারি আমি হায়দার দুজনই এখন দুজনের কাছে নগ্ন! আমাদের মাঝে আর কোনো আবরণ নেই! হায়দারের চরম ক্ষুধার্ত রূপ ইতোমধ্যে আমার চেনা হয়ে গেছে, সেখানে নিজেকে দেখি কুচকে যাওয়া এক মৃত কেঁচোর মতো! সাদা রক্তহীন, অচঞ্চল! হঠাৎ হঠাৎ এই জলজ্যান্ত বাঘকে যে সংঙ্গমে পাওয়ার ইচ্ছে আমার হতো না তা কিন্তু নয়, তবে সে ইচ্ছা নিতান্তই সাময়িক! কারণ, আমি জানি আমি মীরা নই! বাঘিনী রূপে আমার কুৎসিত কদর্য রূপ হা হয়ে বের হয়ে যাবে আমি জানতাম। আমি পালাতে চাই আমার কাছ থেকে, আমি পালাতে চাই হায়দারের কাছ থেকে। শুরু হয় আমার আর হায়দারের এক অসম যৌনজীবন পর্ব। রাতের অন্ধকারে হায়দার যখন আমায় চেপে ধরতো ঠিক অন্য কাউকে ধরার মতো, আমি তখন হাসফাস করে মরে যেতাম। তিক্ত ধর্ষণজাত অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসতাম দূরে। বালিশের দুপাশে দুজন দুরকম দীর্ঘশ্বাসে পার করে দিতাম রাত! হায়দার চিৎ হয়ে পরে থাকতো বিছানায়, দাঁতে দাঁত কাটতো, ঘামতো আর চিৎকার করতো, ক্ষমা চাইতো; আর আমি বরফ শীতল বুড়োটে শরীর নিয়ে পড়ে থাকতাম বালিশের অপর পাশে নির্ঘুম মৃত!
আমার খুব ভয় হতো। যদি বাঁধ ভেঙে যায় আমার বা হায়দারের! যদি পরিত্যক্ত ঘোষণায় আমার স্থান হয় কোন বৃদ্ধ শকুন মরা ভাগাড়ে! অথবা শুরু হয় হায়দার-মীরার নতুন অধ্যায়! তবে? আমি জানি হায়দার ছাড়া আমার কোনো বিকল্প আশ্রয় নেই, বাপের বাড়ি যাওয়া বারণ, কেন জানি না পরিবারের কারও কাছেই মনে হয় আমি কেউ না, একদম কেউ না, আমি মানেই এক জলজ্যান্ত আতঙ্ক। শুনেছি আমার কারণেই বাবা আর মায়ের মধ্যে ঝগড়া হতো খুব, আবার সেই আমিই ফেরত যাবো তাদের কাছে? এসব সাত-পাঁচ ভেবে অস্থির হই, ঠিক তখনই হায়দারকে আমার আপনও লাগে একটু, ইচ্ছে করে পেছন থেকে আকড়ে ধরি হায়দারের শার্ট। পরক্ষণেই বোধ ফেরে! মুহূর্তেই ধাতস্থ হই। নিজের লোভী কাপুরুষ আত্মসম্মান বোধহীন নারীসত্তায় চরম ঘৃণায় ছুড়ে মারি একদলা থুতু- লেপটে থাকা আয়নার বিকৃত মুখকে চোখ রাঙিয়ে বলি-
ছি! তুই এতো লোভী? এত কাঙাল!
আমি জেনেছিলাম আমি ফুরিয়েছি। সব পরাজিতের ইতিহাসে মৃত্যু নেই। আমিও পারিনি, বৈরাগ্যে ডুবে গিয়ে শুরু করি নিজের সাথে নিজের সংসার । হায়দার আগের মতোই উদ্দাম বেপরোয়া! আমার ভেতরে দিনে দিনে হায়দার ঢুকে যায় এক কামুক পুরুষ হিসেবে! পিতা নয় স্বামী নয় এক পুরুষ! শুধু এক পুরুষ!
আমার বয়স বাড়ে, হায়দারকে নিয়ে আমার অবসেশনের মাত্রাও বাড়ে! এখন আর তা শুধু হায়দারের মধ্যে স্থির নেই! সব পুরুষেই এসে ঠেকেছে। এমন কী আমার নিজ সন্তান অর্ককে নিয়েও এখন আমার সন্দেহ! মনে হয় তার নিষ্পাপ সরল চোখের আড়ালে সর্পিল লালসার কালো জিভ লকলক করছে! আমার অন্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, এমনকি অবশও! সবাই বলাবলি করে আমি নাকি ছিটগ্রস্ত! অসুস্থ! আমি দীর্ঘসময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের অসুস্থতা খুঁজি! কোথায় অসুখ আমার? আমার ডান চোখটা ঝাপসা ছিলো বিয়ের আগেই, সাদা অস্বচ্ছ প্রলেপে অনেকটা সময় পৃথিবী আমার কাছে ছিলো অস্পষ্ট, তাইতো ভালো ছিলো! এখন কেন তবে সব এতো স্পষ্ট! মাথাটার কী প্রয়োজন আছে? সারাদিন বায়োস্কোপ দেখা ছাড়া এ মাথার আর কোনো কাজ নেই যেনো।
আমি ভেবে নিয়েছি সংসারে আমার কোনো দায় নেই, দায়িত্ব নেই! মাঝে মাঝে লেখালেখি করি একটু, চোখে একটা চশমা আছে, সময় পেলে চশমার কাঁচের ধুলো সরাই। ডায়বেটিসের অজুহাতে হেঁটে বেড়াই এখানে সেখানে! আমার হিজিবিজি লেখার ঝুলিতে তেমন কোনো গল্প নেই। একটা গল্পই হাজার রকমে লিখি, গল্পের সারবস্তু হায়দারের যৌনজীবন! নায়ক হায়দার হলেও নায়িকা কতো কে! কখনও শশী, কখনও মীরা কখনও সেই পনের বছরের খুকি। আমি জানি আমিও হায়দারের নায়িকা। প্রধান চরিত্র কিনা বলতে পারবো না। হায়দারের এই খুকি নামক নায়িকার বয়স এখন মধ্য পঞ্চাশ। সে চায় তার চারপাশে অনেক কিছু ঘটুক, ধুলো সরানোর অবসরে সেসব সে চোখ মেলে দেখবে। তার অন্তর্জাত মানসিক বোধে বার্ধক্য আছে সত্যি কিন্তু কৌতূহল তো মরেনি। অপেক্ষায় আছে কিছু একটার! ঘটবেই কোনো না কোনোদিন কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটবে।
মাঝে মাঝে কৈশোরের উচ্ছ্বাসে পরম মমতায় আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধ রূপ, আহা স্বেচ্ছায় ডেকে এনেছি এই জরা। অকাল বার্ধক্য! সময়ের নির্লিপ্ততায় কখনও কখনও ক্লান্ত লাগে। বুকের ভেতরটা হু হু করে! আমার হাতের কাছেই জীবন ছিলো, শুধু অবহেলায় ফেলে দিলাম তার রস! অস্থির হয়ে অ্যালবামের পৃষ্ঠায় রঙিন সময় খুঁজি। এইতো সবে শাপলার জন্ম হলো, ঝিনু স্কুল স্পোর্টসে ফার্স্ট। এ ছবিতে অর্ক সাইকেলে বসে আছে। বাঁকা হয়ে আছে তার মাথায় ক্যাপ। আহা সবকিছুর মাঝেইতো হায়দার! বুকে তৃষ্ণা জাগে, আবার তা শূন্যে মিলিয়ে যায়। লোভ সংবরণ করি। চক্ষু কর্ণের অক্ষমতা প্রার্থনা করি। পার করি সময়, নিজের ভেতর নিজে একা, শব্দহীন!
হায়দারের চেষ্টা ছিলো আমাকে সংসারী করার, ছিলামও সংসারেই, তবুও সে কেমন করে যেনো বুঝে গেল সংসারে আমার অনুপস্থিতির ফাঁকি। আমার শুধু অসুখ আর অসুখ হয় শুধু। সুখ নেই কোথাও। সেই ছাব্বিশ না যেনো ষোলতে হয়েছিল গাঢ় অসুখ, তারপর বছর বছর তার রূপ পাল্টে যায় শুধু। আমার এখনকার রোগ বিভ্রমের রোগ। আমি যত্রতত্র শুধু হায়দারকে দেখি। সুস্থ স্বাভাবিক রূপে নয়, সঙ্গমের পূর্বাবস্থায়। কখনও মীরার সাথে, কখনও শশীর সাথে, কখনও বা থাকে অচেনা কেউ! মীরাকে তো সবাই চেনে, এবার বলে নেই শশী কে? শশীর পরিচয় সংক্ষিপ্ত। আমার দেখাশোনার জন্য হায়দার শশী নামের একটা মেয়ে রেখেছে। আমাকে দেখেও রাখে মেয়েটা। ভালো মেয়ে, শরীরও বাড়ন্ত। এখন নিয়ম করে শশী আমাকে দেখে, আর আমি দেখি শশীকে, সাথে থাকে হায়দার! কখনও হুডতোলা রিক্সায় কখনও খোলা মাঠে! অদ্ভুত বিষয় এ দৃশ্য আমি ছাড়া আর কেউ দেখে না, কখনওই দেখে না!
আমার সাথে হায়দারের জীবনের গল্পটাকে মাঝে মাঝেই একঘেয়ে লাগে। বৈচিত্র্য নেই একটুও। টেনে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না, যেকোনো একটা চরিত্র মেরে ফেলতে পারতাম! কাকে মারবো? হায়দার, শশী, মীরা নাকি আমি নামের খুকি চরিত্রটাকে! তাড়াহুড়া নেই কিছু, একজনকে মারলেই হলো। আমাকে মেরে ফেলাটাই সুবিধের! হায়দার, মীরা বা শশীকে মারতে গেলে অনেক কূট-কৌশল জানতে হবে। হাঙ্গামা হবে খুব। এসব সামলানোর মতো অতো শক্তি আমার নেই! যাক তারচেয়ে আমি নিজেকে মারার কথা চিন্তা করি একটু বেশি করে। ধরে নিই আমার কঠিন কর্কট রোগ। ধরে নিই এখন এ ঘরে প্রায়ই নতুন নতুন লেডি ডক্টর আসে, সাথে আসে নিত্য নতুন নার্স। আমি আমার কাছে আসা নার্স বা ডক্টরের সাথে হায়দার গোপন সম্পর্ক ধরে নেই। এতোটা ধরতে গেলেই শুরু হয় সমস্যা! পাকস্থলী উল্টে আসে। বেসিনের কল ছেড়ে বমি করি অথবা শাওয়ার ছেড়ে গোসল করি! শাপলা এসে চিৎকার করে; বকে –
এই বুড়ো কালে তোমার কী হয় মা? জ্বর বাঁধিয়ে মরবে নাকি?
নাহ মরবো কেন আমার ডান হাতে একটা লোহার চুড়ি, এর অনেক শক্তি, জীবনীশক্তি বাড়ায় সাথে যৌবনশক্তিও। বিয়ের পর প্রথম বাবার বাড়ি গেলে মা পরিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল এই চুড়ির গুণে স্বামী বশে থাকবে, পেটে সহজে ছেলেপুলে বাঁধবে। মা আমাকে নিয়ে কেন যেনো খুব দুশ্চিন্তা করতেন, তিনি হয়তো আগেই টের পেয়েছিলেন আমার সংসারটা ঠিক স্বাভাবিক হবে না। মা চাইতেন আমার ঘরভরা ছেলেপুলে হোক, স্বামী যেনো ভুলে থাকে মায়ায়! মায়ের কথা রেখেছিলাম খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে। ঘর আলো করে জন্ম দিয়েছি তিন তিনটে সন্তান-
শাপলা
ঝিনুক
অর্ক
ছোটটার খুব রাগ। বাউণ্ডুলে, লেখাপড়া মনে লাগে না তার। বুঝ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার খুব নেওটা ছিলো। বড় হয়ে ভিড়ে গেলো বাপের দলে। সেদিন দেখলাম ঘরে গানের আসর বসেছে তাদের, ভরাট কণ্ঠে অর্ক ফোক গান গাইছে –
আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে…
আহা সেই ভাসা পানি। পৃথিবীর সব কোলাহল আজ সমান তালেই চলছে, জীবনের আনন্দে সব উন্মাতাল, কেবল আমি একা এক প্রাণহীন ফসিল মানুষ। অসাঢ় শরীরে স্বাদহীন কাল কাটিয়ে দিই স্মৃতি আর বিস্মৃতির হিসেব মিলিয়ে। আমার একেকটা দিন একেকটা বছর। ঘরের সবাই অপেক্ষা করছে কোনদিন যদি আমি স্বাভাবিক হই, যদি ভিড়ে যাই তাদের হাসি আনন্দময় কোলাহলে, হোক সেটা মৃত্যুর আগ মুহূর্তে, তবুও। দীর্ঘশ্বাস নামে। সত্যি যদি আমি পারতাম সবার ইচ্ছে পূরণ করতে, ছেলে, ছেলে বউ আর ঘর ভরা নাতিপুতিদের নিয়ে একটা জীবন পার করা কি খুব কঠিন ছিলো! হয়তো না। হায়দার কী ভালোবাসেনি আমায়? চাইলে কী মিশে যাওয়া যেতো না সংসার যাত্রায়? পারিনি কেন? অক্ষমতা নাকি অভিমান? থাক সেসব। আমি বুঝেছি প্রথম যৌবনে দূরত্বের যে বিষ আমি পান করেছি তা উগরে না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই আমার। এখন অপেক্ষা শুধু পরম সময়ের, ভ্রান্ত সংসারের মায়া আর কতো? জেনেছি ভালোবাসতে না পারা নিষ্ফলা বৃক্ষ শুষ্কই থাকে, তবুও তো সে বৃক্ষে ফল ধরেছে! আমার শাপলা, ঝিনু, অর্ক! কেবল ফুল ফোটাতে পারিনি।
খুব ধীর হলেও টের পাই আমি বদলে যাচ্ছি। শরীরটা খারাপ যায় খুব! ডাক্তার আসে ঘন ঘন, আমি বুঝতে পারছি এবার থেকে ঘরের মধ্যেই থিতু হতে হবে। আজকাল খুব অদ্ভুত দৃশ্য মাথায় ঘোরে, পানির পিপাসা হয়! আশেপাশে লাগে কাউকে, সবচেয়ে বেশি আসে হায়দার। এঘর একসময় তার জন্য নিষিদ্ধ ছিলো অথচ আজ আমার নিষেধ করার শক্তি নেই! এখন এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে, আমার ছেলেপুলেরা আসে কম, কিন্তু কেন আসে না তা আর খোঁজ নিয়ে জানা হয়ে ওঠে না। আজ একমাস হতে চলল অর্ক বাড়ি আসে না, আমি অস্থির হই, সে কি রাগ করেছে কারও উপর! নাকি অভিমান! আমি কখনও চাইনি তারা তার বাবাকে ঘৃণা করুক, হায়দারের শরীরী দ্বন্দ্ব আমার সাথে, সন্তান কেন তার দায় নিবে? কিন্তু আবার এও মনে হয় অর্কর অভিমান ঠিক তার বাবার প্রতি নয়, আমার প্রতিই বেশি! অন্যদেরও কী তাই! হবে হয়তো। আমি জানি আমি আমার ছেলেমেয়েদের কারুরই ঠিক বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি। কানাঘুষায় বুঝতে পারি মীরার সাথে তাদের সখ্যতা আমার সাথে সখ্যতার চেয়ে বেশি! আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার একটা জীবনের জন্য ভাগ্যবিধাতা কতোরকম পরাজয়ের ইতিহাস লিখে রেখেছেন। মরার আগে যদি একবার দেখে যেতে পারতাম সব!
এতোক্ষণে সবাই নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমার জীবনের জন্য মীরা একটি অপরিহার্য চরিত্র! অতীব আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বহুকাল পর আমার অসুস্থতাজনিত সমস্যায় মীরা এসেছিল এ বাড়ি। মাঝে হয়তো তিরিশ বছর হবে, এর বেশিও হতে পারে! মীরা বদলে গেছে অনেক! এখন ওকে দেখতে কেমন মা মা লাগে। মীরাকে কাঁদতে দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। কী বলবো বুঝে উঠতে পারিনি! আচমকা বোকার মতো প্রশ্ন করে বসি-
মীরা, তোর আর হায়দারের বিয়েটা ভাঙলো কেনো?
মীরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় এ প্রশ্নে
জানাটা প্রয়োজন?
হু
জেনে?
আমি নিরুত্তর!
দীর্ঘ সময় আমরা চুপ হয়ে থাকি, নীরবতা ভেঙে মীরাই প্রথম কথা বলে-
-খুকি তোর মাথায় কবে থেকে ঝিঁঝিঁ ধরা রোগ মনে আছে?
আমি স্মৃতি হাতড়ে কিছু পাই না।
-আচ্ছা বলতো কবে থেকে পুরুষজাতির প্রতি তোর অতিরিক্ত সন্দেহ রোগ দেখা দিয়েছে?
হ্যাঁ, এটার উত্তর আমার জানা আছে, আমার জানা আছে সেই চিলেকোঠার ইতিহাস, তবুও ঘটনাটা আবছা অস্পষ্ট বলে মীরাকে আমার কিছু বলা হয়ে হঠে না। চুপ মেরে থাকি আগের মতোই!
মীরা ঝাঁঝের সাথে প্রশ্ন করে
-কী হলো উত্তর দে?
কী উত্তর দেবো আমি, দূর ছাই আমার কী কিছু মনে থাকে?
আমার নির্লিপ্ততায় মীরা ক্ষেপে ওঠে-
-শোন খুকি আজ তোকে বলতেই হবে, তোর এই সরল সোজা ভোলাভালা সন্ন্যাসী জীবন কিসের ভড়ং? তুই কাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিস আমাকে না হায়দারকে? আমরা তোর সাথে অন্যায় করেছি খুব তাই না? আর তুই?
কতো সহজে ভুলে গেলি সেই চিলেকোঠায় নিজের সতীত্ব হারানোর গল্প, চোখের সামনে ছারখার হয়ে গেলো আমাদের মা-বাবার সুখের বোঝাপড়ার সম্পর্ক, আমার-হায়দারের প্রেমের সম্পর্ক, কিসের জন্য, কার জন্য?
শুধু তোর জন্য, তোর জন্য আমাদের আশ্রিত মিরন মামা পিশাচ হয়েছিল, পরিবারের সম্মান ভুলে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেললো। ধ্বংস করে দিলো সব।
নিজের অতীতটা ভুলে গেলি খুকি? কই নিজের জেদ, ঈর্ষা আর অভিমান-তো একটা বারের জন্য ভুলিসনি। আসলে তুই না পাগল, না সুস্থ! নিজের ষোল আনা নিয়ে সংসার আকড়ে পড়ে রইলি অথচ সংসারের কোনো দায়িত্ব নিতে পারলি না এককোণাও, সব সামলাতে হয়েছে আমাকে একা, গোপনে। অধিকারহীন লজ্জায়। তুইতো জানিস না তুই একটা স্যাডিস্ট, সাইকিক! শুধু তোর জন্য আমার আর হায়দারের একটা জীবনটা বৃথা হয়ে গেছে!
এসব তোর বুঝে আসে না খুকি? আসে না। আসবে কেন তোর মাথায়তো ছোটবেলা থেকেই ঝিঁঝিঁ ধরা রোগ, তোর তো কোনো শক্তিও নেই, দুর্বল তুই, মনে আছে মিরন মামা সেই যে অপকর্ম করে তোর পেট বাঁধিয়ে দিলো, তারপরের ঘটনা মনে আছে তোর? দুর্বল শরীরে অ্যাবরশন করানোর উপায়ও ছিলো না আমাদের। আমরা তোকে মেরে ফেলিনি তাই এই ঘাটের মরা হয়েও বেঁচে আছিস আজও।
হতভাগী সেসময় আমার বিয়ে না ভাঙলে তোর এই শাপলার জন্ম হতো কখনও? কে দিত ওর পরিচয়? বল কে দিত? পৃথিবীতে হায়দার কী দুজন আছে?
মীরা রাগে কাঁপছে, ফুলে ফুলে উঠছে তার পিঠ, ক্রমে বদলে যাচ্ছে চোখের রং! শ্বাস পড়ছে দ্রুত! আমি আর কিছু শুনতে পাই না। কানের কাছে বাজছে শুধু ঝিঁঝিঁর শব্দ, আমি মীরার বিকৃত মুখভঙ্গি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি-
একপ্রহর
দুইপ্রহর,
তিনপ্রহর
রাতের শেষ প্রহরে একা অন্ধকার ঘরে আবার আমার ঘুম ভাঙে, অনুভব করি বুকের ভেতর চাপ। কিসের যেনো তৃষ্ণা আমার! তরল পানির নাকি তরল হাসি আনন্দময় একটা জীবনের ঠিক বুঝতে পারি না। বয়স হয়েছে অনেক নিজের জীবননাট্যের ড্রপসিন পড়লো বলে, ইদানীং ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে আসে সব। প্রেমহীন একটা জীবন আমার, ফিকে তামাটে। কখনও কখনও ভয়ঙ্কর কালো। আমার বুক ভেঙে আসে দীর্ঘশ্বাস, আহা এতো তৃষ্ণা ছিলো আমার! অথচ ভুল ঘুমে কেটে গেলো একটা জীবন।
তৃষ্ণাহীন!
উপভোগহীন!
অস্থির আমি জেগে উঠি এবার। বাতি নিভে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে জ্বলে ওঠে যেমন তেমনি আমি জ্বলে উঠি হঠাৎ। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে খুঁজি হায়দারের মুখ, কতোকাল ভালোবাসি না তাকে, আর একটু সময় পেলে এবার হয়তো বাসতাম। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। চোখের সামনে দলবেঁধে উড়ছে জোনাক পোকা। আমি হাসফাস করি বাঁচতে চাই আবার। লিখে যেতে চাই হায়দারকে নিয়ে হাজার হাজার প্রেম-অপ্রেমের কাব্য!