এক যে ছিল দুই। শরীরটা বাঁকানো, কিন্তু মনটা ভীষণ সরল। আর সরল মন হলে যা হয়, দুইয়ের মনে ভীষণ দুঃখ। দুঃখটা হলো সেসব সময় দ্বিতীয় হয়। প্রথম হয় এক। এককে তাই দুইয়ের ভীষণ হিংসা। দুই যদি এক হতো! আহা, কী মজাটাই না হতো! দুই তাহলে সব সময় প্রথম হতো। সবার আগে দুইকে ডাকা হতো।
দুই ভাবল, এটা এখনো হতে পারে। হতে পারে যদি এক না থাকে।
দুই ঠিক করল, এককে বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেবে। আর তাই দুই চলল একের সন্ধানে।
যেতে যেতে যেতে বনের মধ্যে দেখল বিরাট একটা ড্রাগন। ড্রাগনের চোখে আগুন। ড্রাগনের নাম হুতাশন। হুতাশন বলল, ‘শোনো দুই, এককে হারানো খুব কঠিন কাজ! কারণ এক হলো এক! সে সবকিছুতেই এগিয়ে থাকে!’
দুই বলল, ‘তাতে কী? আমিও ফার্স্ট হব! আমি ছড়া বলতে পারি, নামতা গুনতে পারি!’
হুতাশন বলল, ‘এগুলো পারলে তো হবে না শুধু! যুদ্ধও পারতে হবে! একের আছে একচোখা দৈত্যের বিরাট বাহিনী!’
মনটা দমে গেল দুইয়ের। হুতাশন বলল, ‘তবে চিন্তা নেই। আমি তোমাকে আমার ক্ষমতা দিয়ে দিচ্ছি।’ বলেই হুতাশন দুইয়ের চোখে হাত বুলিয়ে দিল। দুইয়ের চোখটা যেন কেমন করে উঠল। হুতাশন মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘এখন চাইলেই তুমি তোমার চোখ দিয়ে আগুন বের করতে পারবে!’
দুইয়ের বিশ্বাস হলো না। কিন্তু একটু কটমট করে তাকাতেই তার চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল আগুন। দুইয়ের খুশির সীমা নেই।
এবার দুই চলল এককে ধরতে। কিন্তু কিছু দূর যেতে না যেতেই সে পথ হারিয়ে ফেলল। যাওয়ার কথা পাহাড়ে, গেল সে সমতলে। চারদিকে শুধু নীল নীল গাছ। গাছের মাথায় লাল লাল ফুল। আর সেসব নীলগাছের ভেতর থেকে ছুটে আসতে থাকল একটা বেবুন…না একটা হাতি…না একটা ময়ূর…সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত প্রাণী। দুইকে দেখেই প্রাণীটা জাপটে ধরে বলল, ‘তুই আমার দোস্ত!’
দুই অবাক হয়ে বলল, ‘দোস্ত? কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনিই না!’
প্রাণীটা বলল, ‘এখন চিনে নাও। আমার নাম বেহাহাম!’
‘বেহাহাম? এটা আবার কেমন নাম?’
‘খুবই ভালো নাম। বেবুনের বে, হাতির হা, আর ময়ূরের ম মিলিয়ে নাম বেহাম!’
‘কিন্তু আরেকটা হা? সেটা কীসের জন্য?’
সঙ্গে সঙ্গে বেহাহামের চোখ জ্বলে উঠল। নাকের ওপর পড়ল ভাঁজ। দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘সেটা এই হায়েনার জন্য!’
এবার বেহাহামের শরীরে হায়েনার চিহ্ন। ঝাঁপিয়ে পড়ল দুইয়ের ওপর। বলল, ‘কত্ত দিন কিচ্ছু খাই না! এবার তোকে আমি খাব দোস্ত!’
আরও পড়ুন: পাখির আবার বিদায় কি?
দুই ছুটল প্রাণভয়ে। কিন্তু পারল না। তাকে জাপটে ধরে ফেলল বেহাহাম। হাঁ করে যেই না বেহাহাম দুইকে খেতে যাবে, অমনি দুই শক্ত চোখে তাকাল বেহাহামের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল আগুন। ঝলসে গেল বেহাহামের মুখ। কেঁপে উঠল বেহাহাম। চিৎকার করে বলল, ‘পুড়ে গেলাম পুড়ে গেলাম…মরে গেলাম রে! একবার আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে এক…আর এবার আমাকে পুড়িয়ে মারল দুই!’
একের কথা শুনে দুই তাড়াতাড়ি বেহহামকে বলল, ‘এক কে তুমি চেনো? কোথায় আছে এক?’
বেহাহাম মুখের আগুন নিভিয়ে বলল, ‘জানি। কিন্তু তুমি যদি কথা দাও আমাকে আর পোড়াবে না, তাহলেই শুধু বলব এক কোথায়।’
‘আর পোড়াব না!’
‘অমুক পাহাড়ে তমুক মাথার সমুক গুহায় থাকে এক। ওখানে কেউ যায় না একচোখা দৈত্যগুলোর ভয়ে।’
দুই বলল, ‘আমি যাবই!’
চলল চলল চলল দুই! অনেক অনেক দিন পথ চলল দুই!
আরও পড়ুন: পাতা ঝরার দিন
তারপর একদিন দেখা মিলল অমুক পাহাড়ের। সেখানে খুঁজতে খুঁজতে তমুক মাথা আর সমুক গুহাও পেয়ে গেল এক। ব্যস, আর কোথায় যায়! দুই ছুটল সেই গুহায়। কিন্তু গুহার কাছে যেতেই দেখল কে যেন চুপচাপ বসে আছে ঝরনার পাশে। কাঁদছে পিঠ ফুলিয়ে। মনটা খারাপ হলো দুইয়ের। বলল, ‘এই যে, তুমি কাঁদছ কেন? মা বকেছে?’
সে মাথা নাড়াল। দুই এগিয়ে গেল। বলল, ‘কে তুমি? কী করো এখানে? কেন কাঁদছ?’
সে বলল, ‘আমি এক। আর আমি খুব একা তো তাই কাঁদছি!’
দুই অবাক। বলল, ‘তুমি এক? তুমি একা?’
‘হুম। সবাই মনে করে সব সময় প্রথম হই বলে আমার বোধ হয় খুব অহংকার! সবাই ভাবে আমার অনেক একচোখা দৈত্য আছে! আসলে কী জানো, আমার ওসব কিচ্ছু নেই। আর আমি চাই সবাই আমার কাছে আসুক, আমার সঙ্গে খেলুক! কিন্তু কেউ আসে না, জানো! আসলে কেউ আমাকে ভালোবাসে না।’
আরও পড়ুন: বিদায়ের দায়
দুইয়ের মনটা একের জন্য খুব খারাপ হলো। এত কষ্টে থাকে এক! এই কষ্টের কাছে তো দুইয়ের কষ্ট কোনো কষ্টই না! দুই এবার একের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি দুই! আজ থেকে তুমি আর একা থাকবে না এক…আজ থেকে তোমার বন্ধু হলো দুই!’
এক ভীষণ অবাক হয়ে দুইয়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলল। বলল, ‘সত্যি আমরা বন্ধু?’ দুই মাথা নাড়াল।
আর এরপর থেকে এক আর দুইয়ের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গলে চিরদিনের জন্য।