পুরনো রংচটা একটা জিনসের প্যান্ট আর ছাই রঙের টি-শার্ট পরে বউয়ের চোখ ফাঁকি দিয়েই সেমিপাকা রান্নাঘরের খড়ির মাচার কাছ থেকে ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে উঠোন পেরিয়ে সন্তর্পণে পাটক্ষেতের ভেতর ঢুকে পড়ল সে। দৃশ্যটা প্রতিবেশী দু-একজনের চোখে পড়লেও পড়ে থাকতে পারে, তবে তা আমলে নেওয়ার মতো কিছু নয়। শ্রাবণ মাস এসে যাওয়ায় পাটগাছগুলো লকলকিয়ে দেড়-মানুষ সমান হয়ে উঠেছে। বর্গাচাষিকে দেওয়া পাটক্ষেতটা তত বড় নয়, মোটে পনেরো কাঠা। তার পরের বিঘেখানেক উঁচু জায়গায় প্রপিতামহ আমলের দশ-বারোটা আকাশছোঁয়া আমগাছ, বুড়ো হয়ে যাওয়ায় সেগুলোর কোনোটিতে হঠাৎ কোনো বছর দুটো-একটা ফল ধরলে আশ্চর্যই হতে হয়। এর মাঝে দুটো শিমুল আর একটা কদম গাছও আছে। তার ওপারেই বাঁশবাগান আর বেতের ঝোপ দিয়ে পুরো জায়গাটা পরিবেষ্টিত বলে এখানে সহজে কারো নজর চলে না, বড় একটা আসেও না কেউ। প্যান্টটা গোড়ালির ইঞ্চি-দুই ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে রবারের জুতো পরা পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়সের লোকটা আমবাগানের ঘাসে ছাওয়া বেলে মাটির ভেতর আনমনে খানিক পায়চারি করে। তারপর আমগাছের ডাল ও পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আজকাল সকালের আকাশটা দেখলে তার মনটা কেমন যেন করে ওঠে; ভয়-বিস্ময়, না বিষণœতা, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে। হতে পারে কেবল নিজের অসহায়ত্ব-চেতনা হৃৎপি-ের দেয়ালে ছলকে ওঠে এবং তা থেকে একধরনের বাষ্পীয় বিক্ষোভবোধও জন্মে মনের কোনো কন্দরে।
এখানকার উপজেলা কৃষি অফিসের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ইরফান খন্দকার। কৃষিশাস্ত্রে এমএসসি ডিগ্রি নিয়েও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিই জুটেছিল তার। ভালোর মধ্যে এটুকু যে নিজের এলাকায় পোস্টিং, পৈতৃক বাড়িতে থেকেই চাকরি করার সুবিধাটা পায় সে। অফিসের বড়কর্তা জানেন তার সাম্প্রতিক দুর্বিপাক, আজকাল প্রায়ই অফিস কামাই হচ্ছে, ইরফান আজো অফিসে যাবে না। ছেলেটা প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রিতে, ওকে হয়তো এতক্ষণে ঘুম থেকে জাগিয়ে দুখানা রুটি কি আধা প্লেট ভাত-ভর্তা খাইয়ে স্কুলে পাঠানোর জন্য রেডি করে দিচ্ছে তার মা। আর দুবছর তিন মাসের মেয়েটা হয়তো এখনো নীল চাদর পাতা বিছানায় জানালার পাশে ঘুমিয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে সকালের এক টুকরো শুভ্র আকাশ; কিংবা শিশুটি জেগে উঠে ব্যস্ত মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমের ভাবটা কাটিয়ে নিচ্ছে। ইরফানকে যদিও কিছু বলে না তবু সে টের পায়, মাহমুদার শরীর আজকাল আর মোটেই চলতে চায় না, হাত-পা প্রায়ই ঝিমঝিম করে, পেশিগুলো আড়ষ্ট হয়ে আসে। মাহমুদার চোখের দিকে চোখ রেখে বড় একটা কথা বলে না ইরফান, চারটি চোখের দৃষ্টি এক হলেই বুকের ভেতর কী-রকম একটা হাহাকারের ধ্বনি বেজে ওঠে, দুটি জ্যান্ত হৃৎপি-ের ভেতর বইতে থাকে শ্বাসরোধী ঘূর্ণি বাতাস। তবু ঘর-গৃহস্থালি থেকে কি আর মুক্তি আছে? সকাল থেকে এতো কাজের মধ্যেও হয়তো দু-তিনবার বাসি আঁচলে চোখ মুছতে হয়েছে মাহমুদাকে; লোকের সামনে কাঁদতে নয়, অশ্রু লুকোতেই পছন্দ করে সে।
আমবাগানের ভেতর মৃত্তিকা-গহিনে ইরফানের পূর্বপুরুষদের অনেকের সঙ্গে মা-বাবা আর দাদাও শুয়ে আছেন, নিরন্তর গভীর তন্দ্রায়। এই তিনটে কবর ছাড়া বাকিগুলোর নিশানা কারো জানা নেই, সময়ের ঢেউ পুরনোকে এভাবেই ভাসিয়ে দৃষ্টিসীমার বহু বহু দূরে নিয়ে যায়; মগজ ও খুলি, যকৃৎ ও হৃৎপি-, চর্ম ও রোমকূপ ধুলো-কাদায় ফেলে গিয়ে তারা কিংবদন্তি হয় লোক-লোকান্তরের। তাই ইরফান জানে, এ-মুহূর্তে ভূপৃষ্ঠে সে তার পূর্বসূরিদের সমাধির ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে আরো বড় করে ভাবলে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ তথা গোটা পৃথিবীই তো এক বিরাট সমাধিক্ষেত্র। এই জায়গাটা নির্জন ও দৃষ্টির আড়াল বলে পাখিরা এখানে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। শালিক, চড়–ই, শ্যামা, টিয়া, দোয়েল, ঘুঘু সকাল-সন্ধ্যা দিব্যি রাজত্ব করে বেড়ায় মাটিতে, ঝোপে, গাছের ডালে; পোকা-কেঁচো বা পাকা বুনো ফল প্রভৃতি খুঁটে খুঁটে খায়। এখনো পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে আছে এই পরিবেশ, একটা-দুটো কাঠবিড়ালি কি বেজি হঠাৎ হঠাৎ দৌড়ে পালাচ্ছে, ইরফানকে দেখে তারা আজ হয়তো একটু সাবধানি। শেষ পর্যন্ত শিমুল গাছের তলাটা নির্বাচন করে সে, ফাল্গুন-চৈত্র এলে পতিত গাঢ় লাল ফুলে মাটির ওপরটা কেমন দেখাবে তা সহজেই বুঝতে পারে সে। গাছের ত্রিকোণাকার গোড়া থেকে ছয়-সাত হাত দূরে কোদালের দুটো কোপ দিয়ে পরখ করে দেখে। না, মনে হচ্ছে ঠিকই আছে। তারপর ঘাসের ওপর অনেকটা আলগোছে ছোট ছোট কোপ দিয়ে সে চার হাত দৈর্ঘ্য আর আড়াই হাত প্রস্থের একটা ক্ষেত্রে দাগ দিয়ে নেয়। দক্ষিণ দিক থেকে পরিমিত মাপে কোপ দিয়ে নরম মাটি কাটা শুরু করে। খুব বেশি শব্দ করতে চায় না সে, যাতে কোনো লোক তার কাজটা টের না পায়। বস্তুত মানুষের সঙ্গে বেশি মেশা কখনো পছন্দ নয় তার, আজকাল দরকার ছাড়া একটি শব্দও বলে না সে, কারো সঙ্গে দেখা করে না। মিনিট-পঁচিশের মধ্যে পুরো জায়গাটা আধা হাতের চেয়ে গভীর হয়ে ওঠে, ততক্ষণে ইরফানের সারাশরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম নামছে, ছাই টি-শার্টের বুক-পিঠ ভিজে একাকার। আরো মিনিটদশেক মাটি কেটে ঝুড়ি ভর্তি করে ওপরে রাখে। একদিকের গর্তে পা রেখে খানিক জিরিয়ে নেয়, তারপর ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটে। ফেরার সময় উঠোনের কোণে পেয়ারা গাছটার পাশে মাহমুদার চোখ এড়াতে পারে না।
‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আর হাতে এসব কী?’
‘আমবাগানের ভেতর একটু কাজ করলাম।’
মাহমুদা আর কথা বাড়ায় না। সে ভাবে, অফিস থেকে হয়তো গাছের চারা-টারা নিয়ে আসবে তাই অগ্রিম গর্ত খুঁড়তে গিয়েছিল। বস্তুত এই বাড়ির সর্বত্র কী-রকম এক নিস্তব্ধতা। উঠোনে, রান্নাঘরের পাশে লিচুগাছের তলায়, ঘরের ভেতর বুক শেলফে, পানির ট্যাপে, বেসিনের ওপরকার আয়নায়, ভাতের থালায়, তরকারির চামচে, ওষুধের বাক্সে – সর্বত্রই যেন ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু শুকিয়ে জলের দাগ পড়ে আছে। গত ছ-সাত মাসে বাংলাদেশ-ভারত,
ঢাকা-ব্যাঙ্গালুরু কম ছোটাছুটি করেনি মাহমুদা আর ইরফান। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চূড়ান্ত কথা যেদিন জানিয়ে দিলেন সে-মুহূর্তে এই জনক-জননী বেদনায়, রক্তক্ষরণে, বজ্রপাতে জীবিত মানুষ থেকে দুটি পাথুরে মূর্তিতে পরিণত হয়েছিল। পাথুরে মাহমুদা তবু কাঁদে – চব্বিশ ঘণ্টাই কাঁদে সে। ঘুমে কিংবা জেগে থাকায়, স্ফুট কিংবা অস্ফুট; সে-ক্রন্দন কখনো বুক, গলনালি, নাকের গহ্বর, গাল-চোখ ছাপিয়ে যায়, আবার কখনো বক্ষপিঞ্জরের তলায় অলিন্দ আর নিলয়ে চলে আকাশ-ভাঙা নিঃশব্দ হাহাকার। কিন্তু ইরফান কাঁদতে পারে না, তার দুই চোখ অশ্রুহীন থাকে, শোকাচ্ছন্ন হওয়ার পরিবর্তে বিক্ষুব্ধ হতে ইচ্ছা করে তার। কার কাছে অশ্রুপাত, কার প্রতিইবা বিদ্রোহ জানে না সে, তাই কেবল প্রতিনিয়ত অস্থি-তরুণাস্থিতে, রক্তনালি-মাংসপেশিতে দুমড়ে-মুচড়ে যায় সে। হঠাৎ হঠাৎ একটি তীব্র বাজপাখি নির্দয় ধারালো ঠোকর মারে তার ধুকধুক করতে থাকা টকটকে লাল হৃৎপি-ে। ডাক্তারের মতে, আর বড়জোর একটা কি দেড়টা মাস। তারপর তাদের কেয়ামত, হ্যাঁ এর আগেই যদি সত্যি সত্যি কোনো এক প্রত্যুষে ইস্রাফিলের শিঙা বেজে কেয়ামত-প্রলয়ের ভয়ানক ধূম্র-অগ্নি আর ধুলোঝড় ধেয়ে আসে তাতে বরং কম ভীত হবে সে। কারণ সে-প্রলয় সমগ্র সাগর-পাহাড়-আকাশের, পৃথিবীর সকল মানুষের, সকল প্রাণী-উদ্ভিদ ও বস্তুরাশির প্রলয়। কিন্তু এই সময়ের এই কেয়ামত কেবলই তাদের, একটি ঘরের, একটি বিবর্ণ উঠোনের; নিতান্ত নিঃসঙ্গ দুটি মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে এই নিরুপায় বিমূঢ় লড়াই। পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব বেশ কোমল মনের মানুষ, একদিন সন্ধে বেলা প্রার্থনা-পর্ব শেষে তিনি নির্জনে ধর্মের ভারী ভারী বাণী শুনিয়ে সান্ত¡না দেন ইরফানকে। ‘ভাই, পৃথিবীটা একটা পরীক্ষাক্ষেত্র, এখানে মানুষের আসার সিরিয়াল আছে, কিন্তু চলে যাওয়ার সময় সিরিয়াল ভাঙে – তিনি বৃদ্ধকে রেখে শিশুকে নিয়ে যান, পিতাকে রেখে সন্তানকে, মেনে না নিয়ে উপায় কী। পরলোকে এ-শোকের প্রতিদান তিনিই দেবেন।’ কিন্তু এসব কথায় ইরফানের বুকের ভেতরকার জমাট বরফগুলো গলে না কিছুতেই। প্রতি নিশ্বাসে ওই রক্তিম বরফেরা ফুসফুসের বায়ুপ্রবাহকে যেন রুখে দিতে চায়। ইরফান এক-দেড় মাস পরের কোনো ঘটনা ও দৃশ্য কিছুতেই ভাবতে চায় না। তবু কতক কালো রঙের হায়েনা দুঃস্বপ্নের বেশে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তাকে। তাই সে আমবাগানের ভেতর ওই মৃত্তিকা খননের পরিকল্পনাটা নিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় সে কিছু চন্দ্রমল্লিকা, জিনিয়া, গাঁদা, বেলি ফুলের গাছ গোড়ার মাটি আর ফুটন্ত ফুলসহ নিয়ে আসে। শুক্রবার আবারো ইরফান ঝুড়ি-কোদাল হাতে চলে যায় বৃক্ষপরিবেষ্টিত চিহ্নিত মাটির কাছে। প্রথমে নির্ধারিত মৃত্তিকা ক্ষেত্রের পরিসীমার দুফুট দূরে ওই বারোটি ফুলগাছ লাগিয়ে দেয়। তারপর গর্তের মাটিতে কোপ দিতে দিতে কতক কেঁচো কাটা পড়ল, কিছু ঘুগরো পোকা আর বড় বড় কালো পিঁপড়ে পালিয়ে গেল। আধা ঘণ্টাখানেক খনন করে হাঁপিয়ে ওঠে সে। একটা গাছের ঘন ছায়ায় বসে সঙ্গে আনা এক বোতল পানি শেষ করে। আজ একটু বেলা করে এসেছে বলে রোদটা তেতে উঠেছে, বাতাসের আর্দ্রতাও বেশি। গামছায় মুখ-গলা-কাঁধ মুছে নিয়ে সে আবার নেমে পড়ে চৌকো গর্তটার ভেতর। দক্ষিণ দিকের একটা কোনায় কোপ দিলে কোদালের মাথায় খট করে আওয়াজ হয়। সেখানে কাদামাটি মাখা একটি অস্থি দেখতে পায় সে। কোদালের মাথা দিয়ে কোনাটা খুঁড়ে মানুষের আস্ত একটা ফেমার পেয়ে যায় সে। নেড়েচেড়ে দেখে প্রায় অক্ষত, অবিকৃত ওই হাড়। কে জানে কতদিনের পুরনো, কত প্রজন্ম আগেকার, কীভাবে কোন রূপে আজ আছে এই হাড়ের প্রকৃত মালিক। স্বর্গ কিংবা নরকে? নাকি ওইসব ভাঁওতাবাজি মিথ্যা বয়ান, মানুষের উদ্ভট কল্পনা – ওই হাড়ের মালিক কোত্থাও নেই, চিরকালের জন্য বিলীন হয়েছে পঞ্চভূতে। খাঁচার ভেতর অচিন পাখির গল্প নিছক ভাববাদীদের অলস-অযৌক্তিক ভাবনার ফল। এসব ভাবতে ভাবতে খানিক দূরে গিয়ে পাটক্ষেতের কাছাকাছি একটা অগভীর গর্ত খুঁড়ে মানব-অস্থিটা পুঁতে রাখে ইরফান। তারপর ফিরে আসে নিজের খননক্ষেত্রে, আরো আধা ঘণ্টা বাদে সে গভীরতা মেপে দেখে প্রায় দেড় হাত হয়েছে। উপরিতলের মাটি ছিল সামান্য কালচে, সে-তুলনায় নিচের মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি বলে রংটা হালকা, অনেকটা রুপালি ধরনের। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাটিতে-ক্ষেতে ব্যবহারিক বিদ্যার জন্য অনেক কাজই করেছে তারা। কিন্তু এভাবে এতখানি গভীরের মাটি কাটেনি কখনো, নেই কবর খোঁড়ার অভিজ্ঞতা, তবু নিজের অনেকটা আনাড়ি হাতের এই খননের কাজটা পছন্দ হয় তার। গলায় ঝোলানো আধভেজা সবুজ গামছাখানা লম্বালম্বি মাটির ওপর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে সে। তার শরীরের তিনদিকে মৃত্তিকা আর ওপরে খোলা আকাশ। সদ্য কর্ষণকৃত তাজা মাটির গন্ধে কী রকম একটা আবেশ সৃষ্টি হয় তার ইন্দ্রিয়ে, নাকে, চোখে, ত্বকে। শিমুলপাতা, আমপাতার ফাঁকে আলোক ঝলমলে আকাশ। সেই আকাশেই তো যত রহস্য, মানুষের ভাবনা-কল্পনা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ভয়-আস্থা সবকিছুর একটি বড় উৎস আকাশ – ওই মহাশূন্য, ওখানেই নাকি তাবৎ ভূত-ভবিষ্যৎ। ইরফানের মাঝে মাঝে মনে হয়, সে যদি পারত তাহলে শূন্যের ওপারে মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটন করত, এজন্য প্রয়োজনে উৎসর্গ করে দিত এই জীবন, ক্ষয় করত প্রাণের প্রতিটি নিশ্বাস। কিন্তু কীভাবে? সাধনা? তপস্যা? জনশূন্য পাহাড়, সমুদ্রতীর কিংবা অরণ্যে গিয়ে সেই সাধনা কি সে করতে পারবে? তাহলে কি সত্য ধরা দেবে তার কাছে? প্রকাশ পাবে তার এই হৃৎপি-ছেদী বেদনার কারণ, এ কি পূর্বজনমের দুষ্কর্মের কোনো ফল? আর যাঁরা সাধনা করেছেন তাঁরাও কি জেনেছেন নির্ভুল সত্য? তাহলে সকলের সিদ্ধান্ত একই রকম নয় কেন? কেন মানবের সমুদ্রে এত স্বতন্ত্র জল? এত ভিন্ন বর্ণ? বিচিত্র কল্লোল? কোলাহল-বিদ্বেষ? নিত্য সংঘর্ষ ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউয়ের?
দু-তিন দিন মাটি খোঁড়া বন্ধ রেখে এক ফাঁকে এসে ইরফান ফুলগাছগুলোতে পানি দেয়, গোড়ার মাটিগুলো চেপে দেয়,
হেলে-যাওয়া গাছটার পাশে লাঠি পুঁতে পাটের সুতো দিয়ে বেঁধে দেয়। গাছগুলোর গোড়ায় যথেষ্ট আদি মাটি ছিল বলে ওরা
তিন-চার দিনে নতুন পরিবেশে যথেষ্ট মানিয়ে নিয়েছে, হেলেপড়া ফুলের কুঁড়িগুলো মাথা তুলেছে। তারপর একদিন দুপুরের পর সে আরো এক হাত মাটি খোঁড়ে, সেদিন তার একটু বেশি কষ্ট হয়, বৃষ্টির পানি জমেছিল আধা হাত। সে-পানি প্রথমে বালতি দিয়ে সেচে তুলতে হয়, তারপর কাদামাটি খোঁড়ার পালা। এবার গর্তটা অনেকটা কবর আকৃতির হয়, যদিও প্রস্থ একটু বেশি। মাটি বেশি ভেজা বলে আজ আর গামছা পেতে শোয়া হয় না। যাওয়ার আগে প্রস্থের দিকে আরো খানিকটা কেটে তিন ধাপের একটি সিঁড়ি বানায় সে। পরদিন বিকেল বেলা অফিস থেকে ফিরে মেয়েটাকে কোলে করে জায়গাটা পরিদর্শন করতে যায় সে। ভেতরের মাটি আজ শুকনো ঠনঠনে। মেয়েকে কোলে নিয়ে মাটির সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় গর্তটার ভেতর। শিশুটি আধো আধো কণ্ঠে বলে, ‘বাবা, এতা কী?’
‘এটা একটা ঘর বাবা।’
‘আমলা এই ঘলে থাকব?’
‘হ্যাঁ, থাকতে পারি মাঝে মাঝে।’ মেয়েকে পাশে দাঁড় করিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে ইরফান। পিতার দেখাদেখি মেয়েটিও তার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে।
ইরফান বলে, ‘বাবা এখানে তো অনেক ধুলো মাটি!’ বলতে বলতে নিজের বাহুর ওপর কন্যার মাথা তুলে নেয়।
শিশুটি বলে, ‘গাতের নিতে এই ঘলটা তো থুব ভালো বাবা, আমি এখানে ধুমাই?’
‘হ্যাঁ ঘুমাও মা’ বলে শিশুটির বুকে আলতো করে থাবা দিতে থাকে ইরফান। খানিক পরে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছে ও। প্রতিদিনই ওর জীবন থেকে একটা করে দিন খসে পড়ছে। তারপর এভাবে ইরফানের একটা আস্ত কলিজা মাটির নিচে রেখে যেতে হবে, ঠিক এই ঘরটাতে। এভাবে ও ঘুমিয়ে থাকবে অনন্তকাল। ইরফান যদি পারত তাহলে সেও চিরকালের জন্য শুয়ে থাকত কন্যার পাশে – এভাবে, যেমন মেয়েটি নিশ্চিন্তে পক্ষী-শাবকের মতো ঘুমিয়ে আছে পিতার বাহুর ওপর। থাক ও যতক্ষণ ঘুমায় ঘুমিয়ে থাক এভাবে। আমিও মাটির গন্ধ নিতে নিতে ঘুমাই ওর পাশে। চোখ বন্ধ করে ইরফান, খানিক পরে আবার চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকায়। না, এখানে এভাবে ঘুম আসবে না তার। আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে দুচোখ জলে ভরে ওঠে। ভেতরে কান্নার প্রচ- একটা ঘূর্ণিপাক রোধ করতে গিয়ে বুক আর গলার ভেতর অদ্ভুত একটা আওয়াজ হয়। সেই শব্দে মেয়েটি একবার চোখ মেলে তাকিয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। সে-সময় ইরফান কন্যার দিকে তাকিয়ে দেখে ওর কপাল-গলা ঘামে একাকার। আলগোছে বাহু থেকে কন্যার মাথাটা নামিয়ে দৌড়ে গিয়ে পাতাসহ আমগাছের একটা ছোট ডাল ভেঙে এনে বাতাস করতে করতে সে ভাবে – এই শিশুরা মা-বাবার কাছে আসার আগে কোথায় থাকে? কী আশ্চর্যভাবে এক-একটি সন্তান আসে মাতা-পিতার কোলজুড়ে, সমগ্র হৃদয় পেতে বসে ওরা, তারপর অকালে ঝরেপড়া এই ফুলগুলো আবার কোথায় চলে যায়? স্বর্গে? ওরা কীভাবে থাকে মা-বাবাকে ছাড়া? ইরফানের চোখের কোনাটা ভিজে ওঠে; তখন হঠাৎ মনে হলো শিশুটির গালে এক ফোঁটা জল পড়ল, তারপর কপালে আরেক ফোঁটা। এ তো অশ্রু নয়, আরে বৃষ্টি নামছে! মেয়েকে দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে গর্ত থেকে উঠে ফুলগাছ মাড়িয়ে ছুটতে থাকে সে। পাটক্ষেত অতিক্রম করতে
করতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন বাড়তে থাকে। এ-অবস্থায় বৃষ্টিতে ভিজলে ওর কষ্ট আরো বাড়বে, ইরফান মেয়েকে বুকের ভেতর আগলে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে, দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য। ছুটতে ছুটতে বাড়ির পথ ছেড়ে পিচের রাস্তায় এসে পড়ে, তখনো সে দৌড়াচ্ছে। নিজের জামার বোতাম খুলে বুকের দুপাশের কাপড়টা দিয়ে ঢেকে নিয়ে তুলতুলে মানবশিশুটাকে প্রাণের ভেতর আগলে ধরে দৌড়াতে থাকে। অপ্রশস্ত গ্রামীণ পাকা রাস্তা দিয়ে তার দৌড়ানো দেখে কেউ কেউ তাকিয়ে থাকে। দু-একজন বৃত্তান্ত বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ পায় না। হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন জিজ্ঞেস করে ভাই, ‘কী হয়েছে? দৌড়াচ্ছেন যে? মেয়েকে হাসপাতালে নেবেন?’
ইরফান বলে, ‘বৃষ্টি বৃষ্টি, আরো ঝড় আসবে, ঝড়!’
লোকটা ইরফানের চেনা নয়, সে অবাক হয়ে হেসে বলে, ‘কই ঝড়, আকাশ তো ঝকঝকে পরিষ্কার। ওড়া মেঘের ছিটেফোঁটা বৃষ্টি সে তো দু-মিনিটেই থেমেছে।’
ইরফান থমকে দাঁড়ায়, সে নদীর তীরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এতক্ষণে যেন সম্বিৎ ফেরে তার। তখনই কেবল খেয়াল করে বাড়ি ছেড়ে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে চলে এসেছে সে। আরে তাই তো – এখানে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। রাস্তাঘাট শুকনো খটখটে, ধূলিময়। লোকটা কী যেন বলে গেল – ‘মেয়েকে হাসপাতালে নেবেন?’ হ্যাঁ হাসপাতালেই তো নিতে চায় সে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোনো হাসপাতাল কি আছে, যেখানে গেলে তার আত্মজা সুস্থ হয়ে উঠবে? ইরফান খেয়াল করে তার কোলে শিশুটি জেগে উঠেছে। একবার ডাক দেয় ‘বাবা।’ ইরফান ওর গালে চুমু দিয়ে আবারো বুকের সঙ্গে আগলে ধরে, ‘ঘুমোও মা’ বলে দু-চার পা হেঁটে রাস্তায় একটা ভ্যান পেয়ে সেটায় উঠে চালককে বলে, ‘খন্দকারপাড়া যাও।’
ইরফান দূর থেকেই খেয়াল করে, মাহমুদা ছেলের হাত ধরে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বাড়ির বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। মাহমুদার কণ্ঠ আজকাল খুব নিচু। অন্য সময় হলে সে হয়তো চিৎকার করে কথা বলত। এখন সে ক্ষীণকণ্ঠেই বলে, ‘তোমরা কোথায় ছিলে? আমরা দুজন খুঁজছি তন্নতন্ন করে?’
ইরফান কী করে বলবে যে সে কন্যার জন্য অগ্রিম একটি সমাধি খনন করেছে? আত্মজাকে হঠাৎ একদিন ওইভাবে মাটিচাপা দিয়ে আসতে পারবে না সে। তাই প্রতিদিন একটু একটু করে নিজের হৃদয়কে পাথর করে তোলার শিক্ষা নিচ্ছে আর শিশুটিকেও লুকিয়ে নিয়ে শেখায় মৃত্তিকা-শয়নের পাঠ, চিরনিদ্রার অমোঘ কাব্য। ইরফান স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে কেবল তার দুচোখের দিকে তাকায় এক পলক। মাহমুদার আর কিছু বলার সাহস হয় না। তার দুটি সন্তানের জনকের নির্বিকার অশ্রুহীন চোখে এ-মুহূর্তে সে মহাসাগরের নোনা জল দেখতে পায়। কন্যাকে পিতার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বুকের ভেতর চেপে ধরে দুচোখ আঁচলে লুকোয় মাহমুদা। ততক্ষণে এলোমেলো হাওয়ার সাথি হয়ে আবার এক পশলা বৃষ্টি নামে কৃষ্ণচূড়া, জাম, জামরুল-মেহগনি গাছের মাথায়। ইরফান ভাবে, কবরটাতে আবার পানি জমে যাবে না তো? তার মনে হয় এক্ষুনি ছুটে যাবে ওই খননের কাছে। ঘাসের নিচে মাটির ঘ্রাণ ভীষণ টানছে তাকে।
সূত্র: কালিও কলাম