তখন ফড়িংকাল। সারাক্ষণ ফড়িংয়ের মতন ছটফট করি। হাওয়ার আগে ছুটি। আম্মা বলতেন, তিড়িংবিড়িং ছানা। আমি বলতাম, ‘তিড়িংবিড়িং তো করে ছাগল ছানা’।
আম্মা হাসতেন।
আমি বলতাম, ‘আমি কি তবে ছাগল ছানা?’
আম্মা তখনও হাসতেন। মায়েরা হাসেন। কান্না বুকে চেপেই হাসেন। সে আমরা জানিও। আর বাবারা? বাবারা কী করেন? বাবাদের গল্প আসলে জানা হয় না। সেবার প্রথম খানিক জানলাম। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আব্বার সাথে ঝগড়া করে খুব ভোরে নানুবাড়ি চলে গেছেন আম্মা। আব্বা সারাদিন এই নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য কিছু করেননি। বাড়ি থেকে নানুবাড়ি তখন হাঁটা পথে মাইল ছয়েক। গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই বলে হেঁটেই যেতে হয়। আম্মা যখন বেরিয়ে গেছেন আমি তখন ঘুমে। ঘুম ভেঙে আর আম্মার কথা মনে নেই। উঠোনভর্তি নতুন ধান এসেছে। সেই ধানের ঘ্রাণ বুকের ভেতর ম-ম সুবাস ছড়ায়। একটা দোয়েল, দুটো শালিক, কোথা থেকে ছুটে এসেছে। গাছের পাতার ফাঁক গলে এসেছে এক ফালি রোদ। সেই রোদের ভেতর ছায়া। ছায়ার ভেতর পাখিগুলো খুনসুটি করে। আমি দেখি। তন্ময় হয়ে দেখি, আহা! তারপর ছুটে যাই। ধান শালিকের সাথে ছোটাছুটি করে আমার দিন কেটে যায়। আম্মার কথা আর মনে থাকে না। মনে পড়তে থাকে দুপুর যত গড়ায়। যত বিকেল নামে, সন্ধ্যা আসে। আমার কান্না কান্না লাগে। আমি আব্বার গা ঘেঁষে দাঁড়াই, ‘আম্মা কই?’
আব্বার তখন রাজ্যের কাজ। দম ফেলার ফুরসত নেই। তার বিশাল বুকের ছাতি বেয়ে দরদর করে ঘাম নামছে। তিনি সেই ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘এই তো আইয়া পড়বো।’
‘কখন আইবো? কই গেছে?’
আব্বা এড়িয়ে যান, ‘কই আর যাইবো! আছে আশেপাশে কোথাও। আইয়া পড়বো।’
কিন্তু আম্মা আসেন না। আসে সন্ধ্যা। অন্ধকার নামতেই আমার বুক তড়পায়। ভারি ভারি লাগে। চোখে জল নামে। আমি চিৎকার করে কাঁদি, ‘আম্মার কাছে যামু, আম্মার কাছে যামু।’
দখিনের ফুরফুরে হাওয়ায় ক্লান্ত আব্বা খানিক গা এলিয়ে বসে ছিলেন। কিন্তু আমার অবিশ্রান্ত কান্নায় উঠে দাঁড়ালেন। গামছায় গা মুছে জামা পরলেন। তারপর আমার হাত ধরে বললেন, ‘চল যাই।’
আমি বললাম, ‘কই?’
আব্বা বললেন, ‘চান্দের দ্যাশে।’
আমি তাকালাম। মাথার ওপরে মস্ত চাঁদ। ওই চাঁদের দেশে আব্বা কীভাবে যাবেন? আমি বললাম, ‘চান্দের দ্যাশে যাওন যায়?’
আব্বা বললেন, ‘হু, যায়।’
‘কেমনে?’
‘চাঁন লক্ষ্য কইরা হাঁটতে হয়।’
আমরা বাপ-বেটা চাঁন লক্ষ্য করে হাঁটা দিলাম। গাছের পাতার ফাঁক গলে কাঁচা মাটির রাস্তায় জোছনার আলপনা আঁকা। সেই আলপনা পায়ে মাখাতে অদ্ভুত আনন্দ। আমি সেই আনন্দে ডুবে যাই। খানিক বাদে বাদেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ি। আব্বা পিছু ফিরে ডাকেন। থমকে দাঁড়ান। পিছিয়ে আসেন। আবার হাঁটেন। আমি তারপরও পিছে পড়ে যাই। বাড়ি থেকে কিছুটা দূর যেতেই হঠাৎ রাস্তার ওপর এক টুকরো কাঠে চোখ আটকে যায় আমার। একটা জং ধরা বিশাল লম্বা পেরেকের অর্ধেকটা বের হয়ে আছে। আমার দুষ্টুমি শুরু হলো। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম পা দিয়ে পেরেকটার মাথা বাঁকা করে দেয়ার। কিন্তু পারলাম না। শেষ অবধি রেগেমেগে পায়ের গোড়ালি দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম পেরেকের মাথায়। ঘ্যাঁচ করে অর্ধেকটা পেরেকের পুরোটাই ঢুকে গেলো পায়ে। আমি চিৎকার দিয়ে বসে পড়লাম।
আব্বা ছুটে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। গলগল করে রক্ত ছুটছে পা বেয়ে। ওই রাতে এই পা নিয়ে অতদূর নানুবাড়ি আমি কী করে যাবো? আব্বা নানুবাড়ির বদলে আমাকে নিয়ে ফিরে এলেন বাড়িতেই। আশেপাশে কোন ডাক্তার নেই। সারাটা রাত ওই তীব্র ব্যথা নিয়ে আমি কী করে কাটাবো! দাদী নানান গ্রাম্য চিকিৎসা শুরু করলেন। তাতে ব্যথা খানিক কমলেও আমার কান্না কমে না। বরং রাত যত গভীর হয়, কান্না তত তীব্র হয়, ‘আম্মার কাছে যাবো, আম্মার কাছে যাবো।’
কিন্তু অত রাতে তা সম্ভব নয়। আমার ব্যথা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সাথে কান্নাও। আব্বা শেষমেশ আমাকে কোলে তুলে নিলেন। তাতে যদি কান্না কিছুটা থামে। কিন্তু থামে না। কী মনে করে হঠাৎ উঠান ঘিরে হাঁটতে শুরু করলেন আব্বা। আর আমিও আচমকা চুপ করে যাই। কারণ আব্বা যখন হাঁটেন, তখন তার হাঁটার কারণে একটা ছন্দ হয় শরীরে। একটা কম্পন টের পাই আমি। সেই ছন্দবদ্ধ কম্পনে আমার পায়ের ব্যথা যেন খানিক কম টের পাই। খানিক আরাম লাগে। কিন্তু আব্বা হাঁটা থামালেই ব্যথাটা যেন ফিরে আসে আবার। সাথে সাথেই গুঙিয়ে কেঁদে উঠি আমি। আব্বা তাই থামতে পারেন না। তিনি হাঁটতেই থাকেন। হাঁটতেই থাকেন। উঠানের ও-প্রান্ত থেকে এ-প্রান্ত। এ-প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। হাঁটতেই থাকেন। সারা রাত। রাত গভীর হয়। আরও গভীর। সারাদিনের কর্মক্লান্ত আব্বার শরীরখানা ভেঙে পড়তে চায়। প্রবল ঘুমে চোখ বুজে আসে প্রায়। কিন্তু আব্বা হাঁটেন। হাঁটতেই থাকেন। ভোরের আলো না ফোটা অবধি তিনি হাঁটেন। আমি আমার শীর্ণ দু’পায়ে তার কোল জড়িয়ে, বুকে মাথা রেখে ঘুমাই। আর তিনি হেঁটে চলেন। ফজরের আজান হয়, ভোরের আলো ফোটে। পাখি ডাকে। আব্বা হাঁটাতেই থাকেন। আমি ঘুমাতেই থাকি। সেই ঘুমের ভেতর হয়তো কতশত রঙিন স্বপ্ন! কিন্তু আব্বা থামলেই আমার স্বপ্ন ভেঙে যায়। ব্যথা জেগে ওঠে। আব্বা তাই থামেন না। তিনি হেঁটে চলেন। হাঁটতেই থাকেন। তার সন্তানের ব্যথাহীন নির্ভার ঘুম কিংবা রঙিন স্বপেপ্নর জন্য। তিনি থামলেই ব্যথা ফিরে আসবে। আমার স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
বহু বহুকাল পরে অবশ্য বুঝেছিলাম, বাবারা আসলে জীবনজুড়েই থামেন না। কারণ বাবারা জানেন, তারা থেমে গেলে তাদের সন্তানরা স্বপ্ন দেখতে পারবে না। তাদের নানাবিধ ব্যথা, যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হবে। তারপর জেগে থাকতে হবে স্বপ্নভঙ্গের সীমাহীন যন্ত্রণায়! বাবারা তাই ক্লান্ত হলেও থামেন না। তারা সন্তানের স্বপ্ন কাঁধে নিয়ে হাঁটতেই থাকেন।
দুই.
আব্বা তখন ঢাকায় থাকেন।
ছোটখাটো চাকরি করেন। সাপ্তাহিক বন্ধ শুক্রবার। প্রতি মাসে অন্তত একবার বিষ্যুদবার সন্ধ্যায় তিনি সদরঘাট এসে লঞ্চে ওঠেন। সারারাত লঞ্চযাত্রা শেষে শুক্রবার কাকভোরে বাড়িতে পৌঁছান। তারপর কোনভাবে দিনটা বাড়িতে কাটিয়ে সন্ধ্যা হতেই আবার ঢাকায় ফেরার লঞ্চে ওঠেন আব্বা। ওইটুকু মাত্র সময়! তারপরও বাড়ির জন্য মন কেমন করে তার! অপেক্ষায় থাকেন আরাধ্য বিষ্যুদবারের।
সেবার ভোররাতে এসে আম্মাকে ডাকলেন আব্বা, ‘দরজা খোলো’।
আম্মা দরজা খুললেন। আব্বা অন্ধকারেই তার হাতের ব্যাগখানা ঘরের দাওয়ায় রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাদাত ঘুম থেকে ওঠে নাই এখনো? আইজ মক্তব নাই?’
আম্মা বললেন, ‘ও-তো বাড়িতে নাই।’
‘বাড়িতে নাই মানে!’ আব্বার কপাল কোঁচকায়।
‘ওর খালায় আইছিলো। খালার লগে তাগো বাড়িতে বেড়াইতে গেছে।’
আব্বা আর কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। আম্মা বললেন, ‘কী হইছে? আইজই চইল্যা আইবো। দুপুরের মইধ্যেই।’
আব্বা এবারও কথা বললেন না। তবে আচমকা ঘুরলেন। তারপর বিস্মিত, হতভম্ব আম্মার চোখের সামনে দিয়ে হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। আমাদের গাঁয়ে তখনও যানবাহন বলতে কিচ্ছু নাই। খালাবাড়ি পায়ে হাঁটা সুদীর্ঘ পথ। সারারাত না ঘুমানো আব্বা সেই সুদীর্ঘ পথ শীতের গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে হেঁটে চললেন। খালাবাড়ি পৌঁছালেন ঘণ্টা দুই পর। আমি তখনো গো-গো করে ঘুমাচ্ছি। আব্বা সেই ঘুমন্ত আমাকেই বিছানা থেকে তুলে কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। বাড়ছে রোদও। আব্বা সেই রোদ গায়ে মেখে অতটা পথ আবারও পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছালেন।
আমার ঘুম ভাঙলো তারও কিছু পর। ঘুম ভাঙা আমি তো অবাক! দু’হাতে চোখ রগড়েও বিশ্বাস হয় না কিছুই! আচ্ছা, কোথায় আমি? স্বপ্ন দেখছি না তো? আমার স্পষ্ট মনে আছে, কাল রাতেও আমি খালাবাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন, এ কোথায় জেগে উঠলাম আমি? বাড়িতে! তা কী করে সম্ভব? আমি আবার দেখি। দেখি, আব্বা শুয়ে আছেন আমার পাশে! আমার ঘোর কাটে না। স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। আমি হাত বাড়িয়ে আব্বাকে ছুঁয়ে দেই, সত্যি তো? আব্বা হাসেন। তার গায়ে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে চারধারে। আমায় ছুঁয়ে যায়। আর সব সত্যি সত্যি স্বপ্ন মনে হতে থাকে!
তিন.
আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিক পড়ি।
গা ভর্তি জলবসন্ত উঠেছে। বড় বড় টসটসে বসন্ত। শরীরজুড়ে অসহ্য ব্যথা, অস্বস্তিকর অনুভূতি। ঈদের আগের দিন দুপুরে আব্বা এলেন বাড়িতে। আমি শুয়ে ছিলাম উঠোনে ডালিম গাছের নিচে। আব্বা বাড়িতে ঢুকেই আমাকে দেখলেন। গা ভর্তি জলবসন্ত নিয়ে আমি করুণ গলায় গোঙাচ্ছি। আব্বাকে দেখে সেই গোঙানি যেন আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলো। আব্বা আমার সামনে এসে খানিক দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ দেখলেন আমাকে। তারপর খুব নির্বিকারভঙ্গিতে বললেন, ‘এইটুকুতে ব্যাটামাইনসের কিছু হয় না। এতো অল্পতে কাতর হইলে চলে! চলে না। ব্যাটামাইনসের কাছে এইটা কোন অসুখ হইলো?’
আব্বা আর আমার পাশে দাঁড়ালেন না। আম্মাকে ডেকে চিৎকার করে বললেন, ‘কই, ভাত দাও, খিদা পাইছে।’
আমার চোখ ফেটে কান্না চলে এলো। আব্বা এমন কেন?
ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে ভাত খেতে বসেছি। আমি, ছোট ভাই, আব্বা আর আম্মা। আব্বার দুধ-কলা-ভাত খুব পছন্দ। আমি আড়চোখে আব্বার দিকে তাকালাম। আব্বার প্লেটভর্তি দুধ। কিন্তু তিনি প্লেটে হাত দিচ্ছেন না। বসে আছেন। আম্মা বললেন, ‘কী হইলো, খান না?’
আব্বা জবাব দিলেন না। তিনি ভাত মাখতে লাগলেন। আমরা খেতে শুরু করলাম। কিন্তু হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আব্বা খাচ্ছেন না। তিনি কেবল ভাত মেখেই যাচ্ছেন। মেখেই যাচ্ছেন। আম্মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হইলো, ভাত খান না?’
আব্বা এবারও জবাব দিলেন না। হঠাৎ দেখি তার প্লেটভর্তি দুধের ভেতর টুপটাপ টুপটাপ কিছু একটা পড়ছে। কী পড়ছে? আমি আব্বার দিকে ভালো করে তাকালাম।
তিনি নিঃশব্দে কাঁদছেন।
চার.
২০০৬ সালে আব্বা স্ট্রোক করে অনেকটাই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আব্বা তার ডান পাশটা নড়াতে পারেন না। দেখতে রাসেল ক্রোর মতন সেই মানুষটা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছেন। হঠাৎ যেন বুড়ো হয়ে গেছেন। সারাক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। চুপচাপ। নিঃশব্দ। কারো কাছে কোন চাওয়া নেই, অভিযোগ নেই, অভিমান নেই। বাইরে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। আদিগন্ত নীল আকাশ। তিনি নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। আমার খুব ইচ্ছে হয় মানুষটাকে কাঁধে নিয়ে ছুটি। আমাকে নিয়ে যেমন ছুটেছেন। মাইলের পর মাইল। ঠিক তেমনি।
উড়ে যাই আদিগন্ত দিগন্তে।
পরিশিষ্ট-
সেদিন সেহরির সময় বাড়িতে ফোন দিলাম। আম্মা ফোন ধরে বললেন, ‘হ্যালো’।
আমি বললাম, ‘আব্বাকে দেন।’
আম্মা খানিক অবাক হলেন। সাধারণত বাড়িতে ফোন দিলে আম্মার সাথেই বেশি কথা হয়। আব্বা ফোনে কথা বলতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। আম্মা আব্বাকে ফোন দিলেন। আব্বা ফোন ধরতেই আমি বললাম, ‘আব্বা, আব্বা, ও আব্বা, আব্বা, আব্বা…’
আব্বা অবাক গলায় বললেন, ‘কী হইছে আব্বা?’
আমি বললাম, ‘আব্বা, ও আব্বা, আব্বা, আব্বা, আব্বা, ও আব্বা… আব্বা।’
আব্বা এবার রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি বিভ্রান্ত গলায় বললেন, ‘কী হইছে আব্বা? কিছু হইছে?’
আমি আবারও বললাম, ‘ও আব্বা, আব্বা, আব্বা, আব্বা, আব্বা… ও আব্বা।’
আব্বা বললেন, ‘আব্বা, কী হইছে, কী হইছে?’
আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, ‘কিছু হয় নাই। এমনিই। অনেক দিন ধরে আপনারে ফোন দেই না। কতদিন আব্বা আব্বা বলে ডাকি না। মনে হচ্ছিল আব্বা আব্বা ডাকার জন্য বুকের ভেতরটা শুকাই গেছে। পানি না খাইতে পারলে যেমন তৃষ্ণা লাগে, সেইরকম। গলা শুকাই গেছে, কেমন খা-খা লাগতেছিল বুকের মধ্যে। এই জন্য তৃষ্ণা মিটাইলাম। আব্বা, আব্বা, ও আব্বা, আব্বা, আব্বা…।
আমি ফোন রেখে দিলাম। খানিক বাদে আম্মা ফোন দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তুই তোর আব্বারে কী বলছস?’
আমি বললাম, ‘কেন? কী হইছে?’
আম্মা বললেন, ‘কী হইছে মানে? সেইটা তুইই জানস। সে ফোন রাখনের পর থেইকা কাঁনতেছে আর কাঁনতেছে। নামাজে দাঁড়াইয়া মোনাজাত ধইরাও হাউমাউ কইরা কাঁনতেছে। কী কইছস তোর আব্বারে…?’
কী বলেছি আমি?
আমি হঠাৎ চুপ করে যাই। একদম চুপ। আম্মার প্রশ্নের কোনো জবাব দেই না। চুপ করে বসে থাকি। নিঃশব্দ। আম্মা আমাকে জিজ্ঞেস করতেই থাকেন। আমি জবাব দেই না। আমার চোখ ক্রমশ ঝাপসা হতে থাকে, গাল ভিজে যেতে থাকে। বাইরে সুবহে সাদিকের আলো ফুটছে। সেই আবছা আলোর দিকে তাকিয়ে আমার হঠাৎ মনে হতে থাকল, আব্বা কাঁদুক, কাঁদুক। কাঁদুক তার পুত্রও। জগতে এইসব কান্নার খুব দরকার, খুব, খুব।
এই অস্থির সময়ে অজস্র কষ্ট, বেদনা, হাহাকার, ঘৃণা, মৃত্যু, জিঘাংসার কান্নায় ক্রমশ ডুবে যেতে থাকা জগতে, পৃথিবীর সকল পিতা ও পুত্রের এমন গভীরতম অনুভূতির তীব্র কান্না, এমন অপার ভালোবাসায় ডুবে থাকা বিশুদ্ধ কান্না খুব দরকার। খুব দরকার।