এক ফোঁটা বৃষ্টি

“আজকের দিনটা খুব সুন্দর, মেঘ ছাওয়া আকাশটা যেন প্রকৃতিরাণীর ছবি আঁকার ক্যানভাস। খেয়ালী মেয়ে মেঘের ওপর নানা রঙের তুলির টানে কত রঙের আলপনাই না ফুটিয়ে তুলছে সারা আকাশ জুড়ে। মেঘেরাও নানানরকম রং পাল্টে চলেছে! কখনো ধুলো ধুলো রং, তো কখনো কালচে-সাদা, আবার কখনো মাটি মাটি রংয়ের ওপর একটু করে নীলের ছাপ, আবার কখনো গাঢ় কালচে ছাইরঙা হয়ে, ধীরগতিতে আমার জানালার সীমিত একফালি ফ্রেমের এপাশ থেকে ওপাশে ভেসে চলেছে আপনমনে,না জানে কোন সে এক অজানার উদ্দেশ্যে, তাকিয়ে থাকতে থাকতে আপনা আপনিই মন জুড়ে ভেসে এল মনখারাপের বাদল, সে জলভরা কালচে স্মৃতির চাপচাপ দলা পাকানো মেঘমালা উদাস আমার মনটাকে ছেয়ে ফেলতে না ফেলতেই বাইরের সত্যিকারের আকাশটা কেমন মেঘলা হয়ে এলো; ধীরে ধীরে আকাশের রং গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে হতে এক সময়ে …….”।

এতটা একটানা লিখে পেনটা বন্ধ করতেই হোল, বৃষ্টির ছাঁট ঢুকছে ঘরে। জানলাটা বন্ধ না করলেই না, এদিকে ভাইঝির বাংলা রচনাটিও শেষ না করলেই না। বেজার মুখে উঠতে যাবো, তার আগেই দেখি কে যেন ঝটপট জানালাদুটোর পাল্লা টেনে বন্ধ করে টিউবলাইটটা জ্বালিয়ে দিল। কে কাজটা করলো সেটা দেখতে পেয়ে আমার মুখেও বুঝিবা হাসির টিউবলাইটই জ্বলে উঠল।

– ওমা টাপুর যে, কখন এলি?

– এই তো এলাম গো দিদি, এসেই সিধে তোমার ঘরে, ভাগ্যিস এলাম, যা তালকানা মানুষ বাপু তুমি, আমি না এলে ভিজে এক্‌সা হতে যে, লেখাপড়া নিয়ে বসলে কি আর কোনদিকে খেয়াল থাকে তোমার? এত বড়টি হলে, তাও স্বভাবটি গেল না!

বকতে বকতে চেয়ারটি বিছানার পাশে টেনে নিয়ে এসে গ্যাঁট হয়ে বসলো।আমারও অনেকদিন পর পাকাবুড়ীর বকুনি খেতে মন্দ লাগছিল না।বাড়ীতে এখন বকুনি দেবার কেউ নেই যে, তাইওটা তো এখন আমারই কাজ। বসেই আড়চোখে লেখার কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন..

– এতকম আলোয় লিখছো যে বড়? চশমার কাঁচটা ওই কাঁচের গেলাসের তলার মত না হলে পোষাচ্ছে না বুঝি? তা কি এত মন দিয়ে লেখা হচ্ছে শুনি?

হাসি চেপে গম্ভীর মুখে বললাম-

– প্রেমপত্র!

– পেমপত্তর ?আর তুমি ? হু, সে মুরোদতোমার থাকলে তো বত্তে যেতাম গো, বাড়ীর এতগুলো সুন্দর সুন্দর বৌদিদের ভীড়ে একটা জামাইবাবু তো পেতাম !

– আরে তোর জন্য সে চেষ্টাই তো করছি, একটা জামাইবাবু বিহনে তোর কত যে দুঃখ, বুঝতে কি আর বাকি আছে কারো?

– তোমার না সবটাতেই ঠাট্টা, বলোনা এত মন দিয়ে একলা ঘরে অন্ধকারে কি লিখছো?

– লিখছি আমার মাথা আর তোর মুন্ডু, হোল?

– তা ওই মাথা মুন্ডু লিখে তো ভালোই চালাচ্ছো দেখছি, কত্তা মা বেঁচে থাকলে বড় খুশী হতেন, বলো ?কি চেষ্টাটাই না করতেন তোমায় পড়ানোর জন্য, আর তুমি গেছো মেয়ে, দাদাদের সাথে সারাদিন চড়কিবাজি করে বেড়াতে, আর তোমার কপালটাও দেখো দিদি, সেই পড়াশুনো আর তোমার পিছু ছাড়লো না, তখন পড়তে চাইতে না, আর এখন তো লোকের মুখে শুনি তোমার ছাত্তররাই নাকি আর তোমার কাছে পড়তে চায় না!

নিজের সম্বন্ধে এ নিদারুণ ফিডব্যাক শুনে উল্টে পড়ে যে যাই নি তার কারণ টাপুরের সেই অতি বিখ্যাত মুচকি হাসি, ফিচলামিতে ভরা।

– আর পড়তে চাইবেই বা কেন? দিদিমনির যদি পড়ানোর থেকে নাটক নভেল গপ্পো লেখার কাজটা বেশী পিও হয়, তো ছা্ত্তর পালাবে না?

টাপুরের আবার ‘র’ ফলার সাথে বিশেষ সদ্ভাব নেই। নাটক নভেল আমি লিখিনা, তবে হ্যা, আমার দু’ একটি গল্প ছাপার হরফে আত্মপ্রকাশ করেছে বটে, টাপুরের আপাত আক্রমণটি সে দিকেই দেখে তাড়াতাড়ি বললাম,

– উফ্‌ টাপুর, বকতে পারিস বটে বাপু তুই, রাই-এর স্কুলে কি এক বাংলা রচনা লিখতে দিয়েছে, তাই লিখছিলাম।

– তাতো বটেই, তোমার তো সারাজীবন হোমটাস্ক মেজদা করে দিল,এখন মেজদার মেয়েরটা তুমি না করে দিলে চলে?

নাঃ, মেয়েটা দেখি আজ একটা অনর্থ না করে ছাড়বে না। মেজবৌদি শুনতে পেলে আজ এ বাড়ীতেই নতুন করে মহাভারতের পালা শুরু হয়ে যাবে। অতএব অন্যকথায় যাওয়াই ভালো।

– আজকাল তো তোকে দেখতেই পাই না টাপুর, কোথায় থাকিস রে?

– কি কথার ছিরি গো দিদি, রোজ আসছি, বড়দিদাকে রামায়ণ মহাভারত পড়ে দিয়ে যাচ্ছি, মন্দিরে পেন্নাম ঠোকাতে নিয়ে যাচ্ছি,তা তুমি চোখে চশমা এঁটে তিনতলার চিলেকোঠায় একটেরে হয়ে বই মুখে বসে থাকলে আর দেখবে কোথা থেকে?

– তা আজ বড় মনে করে এলি যে?

– ওই দেখো, ভালো কথা ভুলে যাচ্ছিলাম, আজ শ্রাবণ সংক্কান্তি যে, টুপুর….

– নামটা কানে আসতে আমার প্রসাদসুদ্ধহাতটাও যেমন মুখের কাছে এসে থেমে গেল, তেমনি মুখরা টাপুরটাও কথা থামিয়ে ওড়নার কোনে চোখটা মুছে নিলো।

টাপুর আর টুপুর…একটুকরো স্মৃতিমাখা আবছা ছায়া,..ছেঁড়া ফ্রকপড়া দুটো ছোট্ট মেয়ে, এই তো সেদিনের কথা।

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে বাসন মাজতে,ঘর মুছতে আসত বুড়ি মাসী। মাঝ বয়সী, পরনে মিলের আধময়লা ছাপা শাড়ি, খুব শক্তপোক্ত চেহারা, গায়ের রঙ খুব কালো ছিল, রোদে পোড়া কালো রঙ, মুখে অজস্র আঁকিবুকি, মাথার চুল পুরো কালো, তবু যে কেন সবাই বুড়ি মাসী বলতো কে জানে, খালি আমার মা ডাকতেন সুনির মা, কিন্তু সুনিটি যে কে তা আমরা জানতাম না, সুনি বলে কাউকে দেখিও নি কোনদিন। অনেক পুরোনো লোক, শুনেছি আমার স্বর্গতা বড়ঠাকুমার আমলে এ বাড়ীতে কাজে লেগেছিল। বড়ঠাকুমাকে দাদাদের মনে থাকলেও আমার একটুও মনে পড়ে না, খালি আমার নিজের ঠাকুমার মুখে ওনার গল্পই শুনেছি। বুড়ী মাসীর নিজের বলে কেউ যে ছিল তাই-ই জানতাম না,সেই কোন সাতসক্কালে এসে কাজে লাগতো আর ফিরত সেই সূয্যি ডোবার পর, কামাই টামাই, জ্বর জ্বালাও কোনদিন হয়েছে বলে শুনিনি।তা সেই বুড়িমাসী বলা নেই কওয়া নেই টানা চারদিন কামাই করার পর টুপটাপ বৃষ্টিভেজা সক্কাল বেলায় দুটো ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে নিয়ে এসে হাজির।ছেঁড়া ফ্রকপড়া দুটো ছোট্ট মেয়ে, চুলে চিরুনী নেই,নাক বইছে, রাজ্যের ধুলোভরা পায়ে রংচটা প্লাস্টিকের চটি।আমার আবার ছোটবেলা থেকেই সব ব্যাপারেভারী কৌতুহল, অতএব দাদাদের কানে সঠিক খবরটি পৌঁছে দেবার বাসনায় মা জেঠিমার চোখ পাকানো উপেক্ষা করে সটান হাজির ঠাকুমার দরবারে, একদম কোল ঘেঁষে।বড়দের কথাবার্তায় বুঝলাম এ দু’টি নাকি মাসীর নাতনী, মেয়ের ঘরের মেয়ে,পরপর তিন মেয়ের পর আবার যমজ বোন, শ্বশুরঘরে মেয়েকে অনেক কথা শুনতে হয় বলে মাসী গিয়ে নিয়ে এসেছে।আমার তো শুনে আনন্দে লাফানোর উপক্রম, বাচ্চাদুটো তাহলে মাসীর সাথে দিনভর এখানেই থাকবে, বাড়ীর ছোট বলে দাদারা সবসময় আমার ওপর কর্তৃত্ব ফলায়,এবার আমিও ছড়ি ঘোরানোর লোক পেলাম বলে!

– ও মাসী, কি নাম গো ওদের?

– ওদের নাম? ঘেন্না আর ফেলনা।

– ওমা এ আবার নাম হল নাকি? আমি হেসে গড়িয়ে পড়লেও বড়রা কেউ হাসলো না।

ঠাকুমা তাড়তাড়ি বললো,

– না সুনির মা, এ বাড়ীতে ও নাম চলবে না,টাপুর টুপুর বৃষ্টিভেজা দিনে মেয়েদুটোকে আনলে যখন, এ বাড়ীতে সবাই এখন থেকে ওদের ওই টাপুর টুপুর নামেই ডাকবেখন।ও বড় বৌমা বাচ্চাদুটোকে কিছু খেতে দাও দেখি, আর ছোটবৌমা, দেখোতো মিঠির ছোটবেলার ভালো জামা টামা,খেলনা-পাতি দু একটা আছে নাকি!

সেই থেকে দু’বোন আমার জ্যান্ত পুতুলের মত নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে গেল।আমার কাছে বকা খেত, অ আ ক খ , এ বি সি ডি , এক দুই শিখতো, ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটতো, বুড়ি বাসন্তী, আইশ-বাইশ খেলত, না কথা শুনলে চড় চাপড় দিতেও থামতাম না, বদলে আমার চকলেট টফি কেক খাবারের ভাগ পেত, ছবি আঁকার খাতা,রং পেন্সিলপেত,দাদাদের চুল ধরে টানা,গাট্টা খাওয়া থেকেও বাঁচতো।এ ভাবেই চললো বেশ কিছুদিন,প্রায় বছর দুয়েক, তখন ওরা স্কুলেও যেতে শুরু করেছে, হঠাৎ একদিন ওদের বাবা এসে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেল ওদের, কোথায় কাদের বাড়ীতে নাকি ঘরের কাজ করবে, দুটো পয়সা রোজগার করে বাপের অভাবের সংসারের সুরাহা করবে !

বুড়িমাসীর থেকে খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হলেও ধীরে ধীরে পুরানো রুটিনেই আবার অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।মাঝে মধ্যে টাপুর টুপুরকে মনে পড়ত অবশ্যই, কিন্তু টানটা অতটা ছিল না,বুড়ীমাসিও খবর পেত না, যতদিন না টুপুর মরে গিয়ে নিজে খবর হয়ে উঠলো আর কাঁদতে কাঁদতে স্বয়ং টাপুর-ই সে খবর নিয়ে হাজির হোল আমাদের বাড়ী।টুপুর নাকি জ্বর হয়ে মরে গেছে, কিন্তু টাপুর জানে কথাটা সত্যি না, এক পড়াতেই দুই আলাদা বাড়ীতে দু বোনে কাজ করত, তাই টাপুর জানে কাজের বাড়ীতে কথায় কথায় সামান্য ভুল ত্রুটিতে কি মারটাই না খেত টুপুর,এমনকি মরার পরেও ওর গলার, গায়ের, কালশিটে পড়া দাগগুলো অন্যকাহিনীই বলছিল।ঐ বাড়ীর লোকেরা টাপুর টুপুরের বাবাকে হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে থানা পুলিশ এড়িয়েছে, টুপুর মরায় এই বিরাট পৃথিবীর করো কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না তবে টাপুরের ছোট্ট জীবনটায় অনেক বদল এসেছে।

ও টুপুরের মত ভাগ্যের হাতে মার খেতে খেতে মরে যেতে রাজী নয়, ওআর লোকের বাড়ী কাজ করবে না,পড়বে, পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।তাই কাজের বাড়ী ছেড়ে বাবার কাছে ফেরত গেছিল, সেখানে বেদম মার খেয়ে দিদিমার কাছে পালিয়ে এসেছিল, মেয়ের সংসারে আরো অশান্তির ভয়ে বুড়ীমাসীও তখন ওকে নিজের কাছে রাখতে সাহস না পেয়ে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ী। বাবা জেঠার আপত্তি থাকলেও ঠাকুমা আর পিসি-ঠাকুমার জোরে আমাদের বাড়ীতেই ওর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। রান্নার কাজ করত যে বুড়ী বিন্দিপিসি, তার থাকার ঘরেই আরেকটা তক্তাপোষ পেতে দেওয়া হয়েছিল। আবার স্কুল যাওয়া শুরু করেছিল টাপুর।সময়ের সাথে ভুলেই গেছিলাম যে টাপুর আমাদের কেউ হয়না।

এর পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে, সেদিনের অনেক চরিত্রই আর আমাদের মাঝে নেই।ঠাকুমা,জেঠিমা,জেঠামশাই,বাবা,বুড়ীমাসী,বিন্দিপিসি,কতজন!আমিওতো প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়, তবু টাপুর আছে।ওর বাবা মারা যাবার পরে মা আর বিধবা মেজবোনকে নিজের কাছে নিয়ে এসে সংসার পেতেছে আমাদের বাড়ী থেকে বেশ খানিকটা দূরে, নতুনপাড়ায়। টাপুরের স্থানীয় মেয়েদের স্কুলের ক্লার্কের চাকরীটাই এখন ওদের তিনজনের ভরসা।

– কি গো দিদি, হাতে পেস্সাদটা নিয়ে কি এত আকাশপাতাল ভাবছো গো ? ওই এককুচি পেয়ারা আর একটা বাতাসা খেতে লোকে কত সময় যে নষ্ট করতে পারে সেটা তোমায় দেখে শেখা উচিত। কিন্তু আমার বাপু তোমার মত সময় নষ্ট করলে তো আর চলবে না,বাড়ী সুদ্ধ সবাইকে পেস্সাদ খাইয়ে বাড়ী গিয়ে এই সন্ধেবেলাতেই আবার মাকে নিয়ে দাঁত তোলাতে যেতে হবে, ক’দিন ধরে বুড়ী যা ভোগাচ্ছে না।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে টাপুরের মুখের লুকানো কষ্ট, ক্ষোভ, অন্তর গ্রাস করে থাকা প্রিয়জন হারানোর সন্তাপ। প্রতিদিনের মতোই ফেরত আসছে দৈনন্দিন বারোমাস্যার কাহিনী, পার্থিব যত পাওয়া না পাওয়ার খতিয়ান, মুছে যাচ্ছে ওর স্বপ্ন দেখা চোখ থেকে অতীত বঞ্চনার অশ্রু স্রোত । এই পরিবর্তনই তো জীবন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত