মাইক্রোবাস থেকে নেমে ফরিদ বলল, এদিক দিয়েই যেতে হবে। অনেক আগে আমি একবার এসেছিলাম। রাস্তাটা মনে আছে।
সামনে নিবিড় গাছপালার বন, আকাশমুখী উঠে যাওয়া পাহাড়। বন পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে মাটির সরু একটা পথ। পাশাপাশি দুজন মানুষ হাঁটতে পারবে না। আগে পরে হাঁটতে হবে।
কালরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। দূর থেকেই দেখা যায় এঁটেল মাটির পথ থকথকে হয়ে আছে। বৃষ্টিজলে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে আছে গাছের পাতা। সকালবেলার রোদে ঝকঝক করছে। হাওয়ায় আসছে বুনোফুলের গন্ধ। দূর বনের ভেতর থেকে অচেনা পাখির ডাক ভেসে আসছিল।
আমি মুগ্ধ চোখে গাছপালা দেখি, পাহাড় চুড়ো আর কাদামাটির পথ দেখি। এই পথে যেতে হবে।
বাহার বলল, যাবেন?
মনির বলল, বাদ দেন। চলেন ঢাকা যাইগা।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। দেখে যাব।
বন পাহাড়ের ভেতর ঢুকে যাওয়া পথের মুখে একখানা চায়ের দোকান। সঙ্গে মুদি, মনোহরি দ্রব্যও আছে। বিস্কুট, কলা, পাউরুটি, বনরুটি আছে। এমন কি কোক পেপসিও।
দোকানের সামনের বেঞ্চে গল্পগুজব করছে কয়েকজন আড্ডাবাজ মানুষ। আমাদের দেখে একজন উঠে এল। হাতে কাগজের বিড়ি। ফুক ফুক করে বিড়ি টানছে। ভাঙাচোরা পোড়খাওয়া মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। মাথার চুল তেলে ভেজা, অতিরিক্ত কালো। বোধ হয় দুয়েকদিন আগে চুল কাটিয়েছে। ঘাড় এবং পরিপাটি জুলপি দেখে বোঝা যায়। সাদা ফুলহাতা শার্ট পরা, শার্টের হাতা কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত গোটানো। পরনে নীল সবুজের মিশলে দেয়া লুঙ্গি। লুঙ্গিটা একটু উঁচু করে পরা। হাঁটুরে মানুষেরা সাধারণত এইভাবে লুঙ্গি পরে। এইভাবে লুঙ্গি পরলে হাঁটার সুবিধে। খালি পায়ে তার বন পাহাড়ের কাদামাটি লেপটে আছে।
ফরিদের সামনে দাঁড়িয়ে লোকটি বলল, কোথায় যাবেন সাহেব?
বাড়বকুণ্ড।
মন্দিরে?
চট করে লোকটির দিকে মুখ ফেরাল ফরিদ। মন্দির ছাড়া আর কিছু দেখার আছে?
বিড়িতে টান দিয়ে লাজুক হাসল সে। না সাহেব।
তাহলে?
বলতে হয় বলে ফেললাম আর কী! মন্দিরে গেলে এই পথেই যেতে হবে। পথের একেবারে শেষ মাথায়, পাহাড়ের ওপর মন্দির।
বাহার বলল, এখান থেকে কতদূর?
বেশি দূর না। মাইল দেড়েক।
রাস্তা কেমন?
ভালো।
কোথায় ভালো? ওই যে কাদা দেখছি।
বৃষ্টি হলে কাদা তো সাহেব থাকবেই!
কাদার মধ্যে যাব কী করে?
মনির বিরক্ত হয়ে বলল, ধুর মিয়া বাহার, বাদ দেও তো! এই রাস্তায় দেড় মাইল যাওন যাইব না।
আমি মনিরের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বললাম, আপনি মাইক্রোবাসে বসুন, আমরা ঘুরে আসি।
মনির তার ডায়াবেটিস কাতর মুখে যতদূর সম্ভব মিষ্টি করে হাসল। আরে না! সবাই গেলে আমিও যামু।
ফরিদ বলল, আপনার জন্য হাঁটা ভালো তো! ডায়াবেটিস রোগীদের প্রচুর হাঁটতে হয়।
তা আমি হাঁটি। সকালবেলা দুই মাইল তো হাঁটিই।
বাহার বলল, কিন্তু হাঁটতে হয় কাদার মধ্যে। তুমি তো কাদায় হাঁট না। এ জন্য ডায়াবেটিসটা তোমার কন্ট্রোলে আসে না।
মনির গম্ভীর গলায় বলল, বিতলামী কইরো না মিয়া।
আমি বললাম, ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল মনিরুল হক সাহেব? যাবেন?
চলেন।
আমি ফরিদের দিকে তাকালাম। চল, ফরিদ।
আমার সঙ্গে রফিক আছে। আমার পিয়ন। বয়স সতেরো- আঠারোর কম নয়। তবে শরীরের গ্রোথ ভালো না। বেটে, রোগা। মুখের দিকে না তাকালে বয়স বোঝা যায় না। মনে হয় দশ-বারো বছরের ছেলে।
রফিককে বললাম, তুই যাবি নাকি?
রফিক লাজুক হেসে বলল, যাব, স্যার।
পাহাড়ি পথ। অনেক দূর হাঁটতে হবে।
অসুবিধা নাই স্যার। আমরা পাহাড়ের মানুষ। আমাদের ঘাটাইলে অনেক পাহাড়।
মাত্র হাঁটা দেব, হাতের বিড়িতে শেষ টান দিয়ে সেই লোকটি বলল, চলেন সাহেব, নিয়া যাই।
সঙ্গে সঙ্গে চায়ের দোকানদার বলল, হ্যাঁ ওরে নিয়া যান। পথঘাট ভালো চিনে। সবকিছু ঘুরাইয়া দেখাইতে পারব।
ফরিদ বলল, তাহলে আর কী! গাইডও পাওয়া গেল।
মনির বলল, এই মিয়া, নাম কী তোমার?
হেকমত।
হেকমতিটা তাইলে দেখাও।
মনিরের কথা বুঝল না লোকটি। বলল, কী করতে বলেন?
হাঁটো।
জ্বি, চলেন।
হেকমতের সঙ্গে সেই কাদার পথে পা বাড়ালাম আমরা। হেকমত আগে আর তার পেছনে আমাদের পুরোদল। আমি, আমার পেছনে ফরিদ, বাহার, মনির। সবশেষে রফিক।
বাড়বকু- সম্পর্কে বিশেষ একটা আগ্রহ বহুদিন ধরেই ছিল আমার। আশ্চর্য এক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে এখানে। এখানকার পাহাড়ের কোলে বাড়বকুণ্ড মন্দির। বারবানল কুমারীকুণ্ডে দিনরাত উষ্ণধারা বইছে। এই ঝর্ণাধারায় মাঝেমধ্যেই জ্বলে ওঠে অগ্নিশিখা। বাংলাদেশের একমাত্র উষ্ণ প্রস্রবণ। আজ সেই আশ্চর্য ঝরনাধারা দেখার সুযোগ হচ্ছে।
দূর থেকে থকথকে কাদার পথ যতটা বিপজ্জনক মনে হয়েছিল হাঁটতে শুরু করার পর দেখা গেল পথটি আমাদের ধারণারচে’ অনেক বেশি খারাপ এবং বিপজ্জনক। কোথাও কোথাও এমন পিচ্ছিল, কিছুতেই পা রাখা যায় না। আর পথ একবার ওপর দিকে উঠছে, একবার নামছে নিচে কিংবা সমতলে। কোথাও কোথাও জল জমে আছে, পথের দুধার থেকে ঝোঁপঝাড় এসে পড়েছে পথের ওপর। কোথাও কোথাও ভয়ংকর খাদ। তবে গড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই ভবলীলা সাঙ্গ হবে না, এমন দুর্ভেদ্য ঝোপজঙ্গল, বাঁশঝাড় আর গাছপালা, ওই সব ঝোপজঙ্গল গাছপালায় আটকে থাকতে হবে।
সবাই বেশ সাবধানে হাঁটছে। আমার পায়ে আমেরিকান পোলো কোম্পানির জুতো। বেশ আরামদায়ক এবং যেকোনো সংকুল পথে হাঁটার জন্য খুবই উপযোগী। এই জুতো পায়ে ইউরোপের পাঁচটি বিখ্যাত দেশ কিছুদিন আগে চষে ফিরেছি আমি। সুইজারল্যান্ডের মনোরম গ্রাম, প্যারিসের ইউরোপা ডিজনিল্যান্ড, রোমের ভ্যাটিকান সিটি, ফ্রাংকফুর্টের গ্যাটে ইনিসটিটিউট, লন্ডনের নিউবুড়ি পার্ক। বাড়বকুণ্ডের এই ভয়াবহ পথেও যে আমার সঙ্গী হবে এই জুতো, কল্পনাও করিনি। এবং এরকম কাদাপিচ্ছিল পথেও জুতোটি এত উপযোগী হবে ভাবতেই পারিনি। মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই হাঁটতে পারছি। কিন্তু মনির বাহার এবং ফরিদের বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল।
ফরিদ এডভেঞ্চার-প্রিয় যুবক। আমি জানি তার খারাপ লাগছে না। বাহারেরও বোধ হয় ভালোই লাগছে। শুধু মনির বিরক্ত। থেকে থেকে গজ গজ করছে। ধুৎ এমুন রাস্তায় হাঁটন যায় না কি!
বাহার তাকে একটু খোঁচাচ্ছিল। দেখো মনির, আছাড় খাইয়ো না।
আমার সামনে হেকমত খুবই নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটছে। সবার পেছনে রফিকেরও একই অবস্থা।
পাহাড় পিছনে। সকাল ফুরিয়ে আসা রোদ পড়েছে বনের গাছপালায়। দুর্ভেদ্য বনের ফাঁকফোকর দিয়ে, বাঁশঝাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে কোথাও কোথাও রোদ পড়েছে বর্শাফলার মতো।
যত এগুচ্ছি বুনোফুলের গন্ধ তত তীব্র হচ্ছে, গাছের পাতার গন্ধ তত তীব্র হচ্ছে। পাখির ডাকে খান খান হচ্ছে নির্জনতা। জীবনে এই ধরনের পরিবেশে কখনও আসিনি। পায়ের তলার পিচ্ছিল পথের কথা ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁটতে থাকি।
একটা জায়গায় পথ বেশ সমতল। পথের একপাশে ঝোপজঙ্গল নেমে গেছে খাদে। খাদের তলায় চিরল একখানা জলধারা। এতটা দূর থেকেও তার স্বচ্ছতা চোখে পড়ে।
জলধারার গা ঘেঁষে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়। পাহাড়ের দেয়াল ছেঁয়ে আছে ঝোঁপঝাড় আর লতাগুল্মে। মাথার ওপর ছাতার মতো অচেনা এক গাছ। সেই গাছের দিকে তাকিয়ে মনটা কেন যে খুব অন্যরকম হয় আমার। জীবনে কখনও কবিতা লিখিনি কিন্তু কবিতার মতো দুটো লাইন মনে আসে।ৎ
নির্জন প্রান্তরের একাকী বৃক্ষ
তুমি কার কথা ভাবো!
পথের উল্টো পাশের দৃশ্য একেবারেই অন্যরকম। ছবির মতো পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম বিশাল একখানা পেয়ারা বাগান। প্রায় একই সাইজের সবুজ সতেজ পেয়ারা গাছ ঢালু থেকে ক্রমশ উঠে গেছে ওপর দিকে। গাছতলায় মখমলের মতো ঘাস। রোদ ঝিমঝিম করছে পেয়ারা বনে। হাওয়া বইছে, পাখি ডাকছে।
খানিক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর অপূর্ব সুন্দর, ছোট্ট এক পুকুর। পুকুরের জল চোখে দেখা যায় না, পদ্মপাতায় জলের ওপর তৈরি হয়েছে নিখুঁত এক আবরণ।
পাহাড়ের ওপর পুকুর হয় কী করে?
ফরিদ বলল, জায়গাটা আসলে চারদিক বন্ধ খাদ। বৃষ্টির পানি জমে জমে পুকুর হয়েছে।
যেকোনও নদী কিংবা স্বচ্ছ জলের পুকুর দেখলেই তার জলে হাত ভেজাতে ইচ্ছে করে আমার। এই পুকুরের জল কি একটু ছুঁয়ে দেখব না!
কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ করেই পুকুরের দিকে নেমে যাই আমি। উবু হয়ে বসে দুহাতে পুকুরের জল তুলি। পদ্মপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা জল কী স্বচ্ছ! দুহাতে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে মুখ ধুই আমি। সঙ্গীরা ভাবে এ আমার পাগলামো।
পুকুর পাড় থেকে উঠে আসার সময় পেয়ারা বাগানে লাল শাড়ি পরা আবছা মতন কাউকে যেন পলকের জন্য একটু দেখি। দেখে একটু চমকে উঠি।
সত্যি কি কাউকে দেখলাম, নাকি এ আমার দৃষ্টিভ্রম!
এ রকম নির্জন বনবাগানে কোন নারী আসবে লাল শাড়ি পরে? হঠাৎ করে এসে হঠাৎ কোথায়ইবা উধাও হয়ে যাবে। এখানে তো কোনও ঘরবাড়ি নেই। পেয়ারা বাগানের শেষ মাথায় কলাগাছের বন। সেই বনের দিকে যেন আড়াল হলো সে।
অবশ্য কেউ যদি দেখে থাকে তাহলে ব্যাপারটা সত্য। দৃষ্টিভ্রমের প্রশ্নই ওঠে না।
আমি ফরিদের দিকে তাকালাম। বাহার এবং মনিরের দিকে তাকালাম। কারও মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। ফরিদ শুধু বলল, আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল পুকুরে বোধ হয় ঝাঁপিয়েই পড়বেন।
আমি কথা বললাম না। বুঝে গেলাম, লাল শাড়ির ব্যাপারটা চোখের বিভ্রমই। এই নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলার মানে হয় না।
হাঁটতে শুরু করব, দেখি পুকুর ধারে অজস্র নীল অপরাজিতা ফুটে আছে। এত ভালো লাগল দেখে! কী মূল্যবান ফুল কত অযতেœ ফুটে আছে!
কেন যে ফুলের দিকে তাকিয়ে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে!
এতক্ষণে আবার উপরে উঠতে শুরু করেছে পথ। দূরে ফুটে উঠেছে প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
ফরিদ মুগ্ধ গলায় বলল, এই তো আমরা এসে পড়েছি! এই তো মন্দির!
মন্দিরের সামনে সবুজ ঘাসের এক চিলতে মাঠ। রাস্তা যেখান থেকে মাঠের দিকে উঠেছে তার দক্ষিণে ছোট্ট একখানা মঠ কিংবা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। উত্তরে বোধ হয় পুজোর ঘর ছিল। একেবারেই ধসে গেছে সেই ঘর। শতাব্দী প্রাচীন পাতলা ইট আর ইট রঙের সুরকির স্তূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘর। এক দিককার দেয়ালের কিছুটা এখনও আছে। সেই দেয়াল ফুঁড়ে আকাশে মাথা তুলেছে অশথের চারা।
মাঠের পুবদিকে বারবানল কুমারীকুণ্ড। আজকালকার দিনের দেড়তলা দালানের সমান উঁচু একখানা দালান। কপাটহীন দরজা দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল। সামনের অংশটা মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। দেখে বোঝা যায় মানুষজন কখনও কখনও এই ঘরে বসে।
ঘরের পুবদিককার দেয়ালে আরেকটা দরজা। সেই দরজারও কপাট নেই।
হেকমত বলল, ওই ঘরের ভেতর কুণ্ড।
আমরা সবাই সেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
দরজা থেকে কয়েকটা সিঁড়ি নেমে গেছে। তারপর চারিদিক বাঁধানো হাউজের মতো একটা জায়গা। সেই জায়গায় উঁকি দিয়ে ফরিদ বলল, এই সেই উষ্ণ ঝরনাধারা।
সিঁড়ি দিয়ে জলধারার দিকে তাকাই। উত্তর দিক থেকে মৃদু একটা জলধারা বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। জলটা খুবই স্বচ্ছ। দালানটির তলদেশ দিয়ে কোথা থেকে কেমন করে এসে বইছে কে জানে! জলধারার চারদিককার উঁচু বেদিতে পোড়া মোম, দেশলাইয়ের কাঠি, ভাঙাবাক্স পড়ে আছে। মোমের শিখায় পুড়ে পুড়ে কালো হয়েছে চারদিককার দেয়ালের বিভিন্ন অংশ। উত্তর পশ্চিম দিককার দেয়াল ফুটো করে একটা পথ উঠে গেছে ওপর দিকে। চামচিকার মলে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সেই পথ।
আমি এবং ফরিদ জলধারার পুবদিককার বেদিতে এসে দাঁড়ালাম। এদিকে কয়েকটা সিঁড়ি আছে, জলধারার কোন অতলে চলে গেছে কে জানে! সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ফরিদ বলল, ম্যাচ আছে কারও কাছে?
হেকমত বলল, আমার কাছে আছে সাহেব।
দাও।
দেশলাই হাতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল ফরিদ। জলধারার সামনে বসে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে জলের ওপর ধরল। প্রথমবারে কোনও কাজ হলো না। দুবারের বার ফুস করে জ্বলে উঠল জল। প্রথমে নীল তারপর আগুন রঙা আগুনে ছেঁয়ে গেল জলধারা। আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
কিন্তু আগুন আর নেভে না। এক মিনিট, দুমিনিট করে সময় যায়। আগুনের শিখা বেড়ে ওঠে। আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়ি। সর্বনাশ! এ আগুন নিভবে কী করে?
ফরিদ হাসিমুখে বলল, সবাই হাত লাগান। চারদিক থেকে পানি ছিটালে নিভে যাবে।
চারদিক তো নয়, আমরা পানি ছিটাতে লাগলাম দুদিক থেকে। পুবদিককার সিঁড়িতে আমি আর ফরিদ, পশ্চিমের সিঁড়িতে বাহার, মনির এমন কি রফিক, হেকমতও। তারপরও মিনিট তিনেক লাগল আগুন নেভাতে।
জলধারার পাশ থেকে উঠে এসেছি, দেখি সামনের ঘরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। গেরুয়া ধূতি পরা, খালি গা, গলায় পৈতে। রোগা লিকলিকে শরীরে যতটা না লম্বা সে, তারচে’ অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছে। মুখে ঝিমকালো গোঁফদাড়ি। কোটরে বসা চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল। কোত্থেকে, কখন এখানে এল সে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি কে?
সে বিনীত গলায় বলল, এই মন্দিরের পুজারি।
এখানেই থাকেন?
দিনেরবেলায় থাকি।
অন্য সময়?
বাড়িতে।
বাড়ি কোথায়?
কাছেই। বাজারের দিকে।
কী নাম আপনার?
মৃগাঙ্কলাল ভারতী।
নাম শুনে আমি অবাক। বাপরে বাপ, দুর্দান্ত নাম তো!
পুজারি হাসলেন।
তারপর ঘুরে ঘুরে সব দেখি আমরা। উত্তর থেকে এসে দক্ষিণে যাচ্ছে জলধারা। যে ঘরের তলদেশ দিয়ে বইছে বাইরে থেকে তার কোনও রহস্য উন্মোচন করা যায় কী না ভেবে দক্ষিণ দিকে নেমে গেলাম আমরা।
বাইরে থেকে জলধারা বরাবর সরু একখানা সুড়ঙ্গ। চওড়া একখানা ড্রেন মতো আছে। কী রকম গা ছমছমে পরিবেশ। পুব, উত্তর, দক্ষিণ তিনদিকে পাহাড়। রোদ ভালো করে পড়তে পারে না মন্দির ঘরে। গাছপালার ছায়ায় এবং হাওয়ায় মনে হয় অশরীরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফিসফিস করছে।
তীক্ষ্মচোখে চারদিক তাকিয়ে ফরিদ বলল, এখানে নিশ্চয় এক সময় ব্ল্যাক আর্টের চর্চা হতো। পরিবেশটা দেখেছেন? কেমন ভয় ভয় লাগছে না?
কথা না বলে মন্দিরের মাঠের দিকে উঠে আসি আমি। উঠেই চমকে উঠি। মন্দির চত্বর থেকে নেমে যাওয়া পথের মুখে ভেঙে পড়া মঠ কিংবা মন্দিরের ছায়ায় লালশাড়ি পরা এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে।
খেটে খাওয়া গ্রাম্য যুবতী। সরল নিষ্পাপ মায়াবী ধরনের মুখ। চোখ দুটো ডাগর। রোদে পোড়া কালো রঙ গায়ের। মাথায় কাঁধ ছাপানো চুল। বন পাহাড়ের হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছিল তার চুল।
এখানে এই মেয়ে এল কোত্থেকে?
আমরা সবাই বেশ কৌতূহলী হয়েছি। মৃগাঙ্কলাল ভারতী বললেন, এদিককারই মেয়ে। আমাদের বাড়ির কাছে বাড়ি। পুকুরের ওদিকটায় ওদের একটা পেয়ারা বাগান আছে। ও আর ওর ভাই মিলে সারাদিন পেয়ারা বাগান পাহারা দেয়। ভাইটা বাগানে আছে। ও বোধহয় আপনাদের দেখতে এসেছে। দর্শনার্থীরা এলে মেয়েটা তাদের দেখতে আসে।
বুঝে গেলাম তখন দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি আমার। মুহূর্তের জন্য এই যুবতীকেই দেখেছিলাম।
ফরিদরা তখন আবার ঢুকেছে সেই ঘরে। আবার যাবে জলধারার পাশে। আমি আর ওদের সঙ্গে যাই না। যুবতীর সামনে এসে দাঁড়াই। তোমার নাম কী?
এই ধরনের যুবতীরা অচেনা মানুষের সঙ্গে সহজে কথা বলতে চায় না। আড়ষ্ঠ হয়ে থাকে। সে একদমই আড়ষ্ঠ হলো না। সরল গলায় বলল, চম্পা।
বাগানের দিকে তোমাদের বাড়ি, না?
জ্বি।
সংসারে কে কে আছে?
আমরা দুই ভাই বইন আর মা।
বাবা নেই?
না।
মারা গেছে?
না। আরেকখান বিয়া কইরা অন্যখানে চইলা গেছে।
তোমাদের সংসার তাহলে চলে কী করে?
মায় কাজ করে, আমি আর আমার ভাইয়ে কাজ করি। নিজেদের ছোট্ট একখান বাড়ি আছে। ওই যে পেয়ারা বাগানটা দেখতেছেন ওইটা আমাদের। আমি আর আমার ভাইয়ে বাগান করি। দিন চইলা যায়।
তোমার ভাই বড়, না তুমি?
আমি।
গ্রাম এলাকায় তোমাদের বয়সি মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। তোমার কি হয়েছে?
জ্বি না।
মৃদু হাসল চম্পা। বিয়া হইলে কী আর ভাইর সঙ্গে বাগান করতাম?
তা ঠিক। বিয়ে হয়নি কেন?
চম্পা চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকাল। মা ভাইয়ে দিতে চায়। আমি রাজি হই না।
কেন?
আমার বাপরে দেইখা আর একটা সিনেমা দেইখা পুরুষ মানুষের ওপর আমার খুব রাগ।
আমি বেশ একটা ধাক্কা খাই। বলো কী? ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!
জ্বি। আমার মায় বহুত ভালো জানত আমার বাপরে। জানটা দিয়া দিত আমার বাপের লেইগা। সেই মারে ফালাইয়া আমার বাপে গিয়া আরেকটা বিয়া করল। এখন আর আমার মারে চিনে না, আমাগ চিনে না। আমার লগে যার বিয়া হইব সেও তো এমুন করতে পারে!
সবাই যে এক রকম হবে তার কোনও মানে নেই।
আমার মনে হয় সব পুরুষ মানুষই এক রকম। আমি দেখতে ভালো না, আমার সঙ্গে বিয়া হওনের পরও যদি আমার চেয়ে সোন্দর কোনও মাইয়া পায় আমার জামাই, তাইলে সে আমারে ফালাইয়া চইলা যাইব।
বিষয়টা নিয়ে ইচ্ছে করলেই চম্পার সঙ্গে তর্ক করতে পারি। করি না। কী দরকার! চম্পা থাক তার মতো করে।
তারপর সিনেমার প্রসঙ্গটা তুললাম। সিনেমার কথা যে বললে, তুমি কি খুব সিনেমা দেখ, চম্পা?
চম্পা ম্লান হাসল। না, বেশি সিনেমা দেখুম কেমনে? এত পয়সা পামু কোথায়? বছরে দুই একটা দেখি।
তোমার নামে যে বাংলাদেশে একজন নায়িকা আছে, জানো?
চম্পা এবার সুন্দর করে হাসল। জানি। যেই সিনেমাটার কথা বললাম সেইটা তারই সিনেমা। চম্পা যেই সিনেমায় থাকে আমার ইচ্ছা করে সেই সিনেমাগুলি দেখি। সব দেখতে পারি না।
যে সিনেমাটার কথা বলতে চাইলে সেটা কোনটা?
পদ্মানদীর মাঝি।
তোমাদের এখানে এসেছে ওই ছবি?
না। ভাইরে লইয়া চিটাগাংয়ে গিয়া দেইখা আসছিলাম। এখান থেকে চিটাগাং বেশি দূর না।
জানি। এই ছবি দেখে কেন পুরুষ মানুষদের ওপর তোমার রাগ হলো?
কুবের মাঝিরে এত ভালোবাসে চম্পা তারপরও চম্পারে রাইখা আপন শালী কপিলার লগে গিয়া পিরিত করে মাঝি। কপিলার লগে রঙ্গরস, ঢলাঢলি। শেষমেষ কপিলারে লইয়া যায় ময়নাদ্বীপে। ক্যান, চম্পারে লইয়া যাইতে পারল না? চম্পার পাওটা খোড়া দেইখা তারে ছাইড়া যাইতে হইব?
পদ্মানদীর মাঝির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো বুঝতে পারেনি চম্পা। সে বুঝেছে তার মতো করে। আমার ইচ্ছে করে কুবের কপিলার ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে বলি তাকে। তারপর মনে হয়, কী দরকার! চম্পা তার নিজের বোধবুদ্ধি নিয়েই থাক, নিজের বিচার বিবেচনা নিয়েই থাক। সে জীবন কাটাক তার ভাবনা মতো।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চম্পা বলল, নিজের বাপ আর ওই কুবের মাঝিরে দেইখা পুরুষ জাতের উপরে আমার খুব রাগ, আমার খুব ঘেন্না। আমি কোনওদিন বিয়া করুম না।
পেয়ারা বাগানের দিক থেকে কে যেন তখন চিৎকার করে ডাকল, চম্পা, এই চম্পা, কই গেলি রে?
এই ডাকে চমকে উঠল চম্পা। আমার ভাইয়ে ডাকতাছে। আমি এখন যাই।
চম্পা আর দাঁড়াল না। শাড়ির আঁচল উড়িয়ে হরিণের মতো ছুটতে লাগল পেয়ারা বাগানের দিকে।