যুবতীর স্তনাগ্রে বিঁধে আছে শহর। মিথিলা হেঁটে যায় উদ্ধত দেহভঙ্গিমায়। সোনালী হিলের প্রতি পদক্ষেপের সাথে মরালী গ্রীবা আগুপেছু আর ঘাড় অব্দি নেমে আসা পরিপাটি সাজের চুল বাতাসে উড়ে। মিথিলা প্রিয় নাম। মিথিলা হেঁটে গেলে তার গৌড়বর্ণে সূর্য খেলা করে। নিতম্বের ভাঁজ পেরুলে সরীসৃপের গতি নিয়েছে দেহ। এঁকেবেঁকে আরো কিছুটা এগুলে রক্তে নাচন লাগে। কোনমতে ক্লিভেজ পার হলে চিবুকের উপর কালো তিল। এর ঠিক সিকি ইঞ্চি দূরে দুটো কমলার কোয়া উপর নিচ রাখা। মিথিলা ঠোঁট মুচড়ে হাসলে শহরে চন্দ্রগ্রহণ। মিথিলা কথা বললে লোডশেডিং। মিথিলা এখন ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। সাথেসাথেই জনাছয় কলিগ তার দিকে একযোগে তাকালো। কেউ তার লাল স্কার্টের নিচে নগ্ন পা দেখলো। কেউ দেখলো উড়ো মেঘের মত চুল ঘাড় চিবুক। আবার কেউ আড়চোখে দেখে নিলো ফিনফিনে সাদা শার্টের অন্দরে লাল অন্তর্বাস।
মিথিলার ভ্রুক্ষেপ নেই। এলিভেটরে উঠে জি বোতাম চেপে দেয়। রিসেপশনে মেয়েটির সাথে কিঞ্চিৎ হাসি বিনিময়। বেজমেন্টে তুফান তুলে লাল গাড়ির দরোজা খুলে। তারপর সাঁই করে অফিসের গেট পেরিয়ে গাড়ি গিয়ে পরে উপররাস্তায়। তিন মিনিটের ড্রাইভে গাড়ি চলে আসে গুলশান অ্যাভিনিউ। সকালে ফ্রিজের ভেতর দেখে এসেছিল দৈন্যতা। স্পিড কমাতে কমাতে ল্যাভেন্ডারের সামনে এসে থামে লাল গাড়ি। গোটা দুয়েক ব্রাউন ব্রেড, ফ্রেস গ্রেপ জুস, সোডা, কিছু ফ্রোজেন ফুড আর নাশপাতি নিয়ে গাড়িতে ফেরে। গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে মনে পড়ে টপ্পার জন্য কিছু নেয়া হয়নি। আবার গিয়ে পাপ্পি ফুড কর্নার থেকে টপ্পার জন্য কিনে নেয় টিনটেড খাবার। এবার মিনিট বিশেক চালালেই বাড়ি পৌঁছে যাবে মিথিলা। শুধু রাস্তায় ট্রাফিক না থাকলেই হলো। তারপর মিথিলার একলা ঘর। শূন্যতা আর ছিমছাম বিষণ্ণভাব ছাড়াও মিথিলার অপেক্ষায় থাকে টপ্পা।
কি হোলে চাবি দিয়ে ঘুরাতেই খুঁট করে খুলে যায় ফ্ল্যাট ফোর বি’র দরোজা। ঠোঁট গোল করে চেনা আওয়াজে চুক চুক শব্দ তোলে মিথিলা। কুঁই কুঁই শব্দে নিজের অস্তিত্বকে জানান দিতে দিতে মিথিলার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় রেডিস ব্রাউন রেশমের মত কার্পেটের পশমে মোড়া ছোটখাট শরীর নিয়ে। রোজদিনের মত টপ্পাকে কোলে নিয়ে নাকে মাথায় চুমু খায় মিথিলা। আর আদুরে কুকুর ছানাটি তখন চোখ মুদে নির্জিবের মত সেঁটে থাকে মিথিলার গালের সাথে। আহা, কি মায়াময় ভালোবাসা। ডাইন টেবিলের উপর খাবারের প্যাকেট গুলো রেখে শাওয়ারে যাবার প্রস্তুতি নেয় সে। গোলাপী টিস্যুতে ঘষে ঘষে ঠোঁটের লাল লিপস্টিকের রঙ মুছে। যুবতীর শরীর থেকে মেঝেতে একে একে খসে পরে লাল স্কার্ট, প্যান্টি শার্ট আর জেসমিন ডিউয়ের সুগন্ধসহ লাল অন্তর্বাস। বাথটবে জল উছলে পরছে। প্রথমে নগ্ন পা। তারপর ট্রয় নগরীর সমস্ত সৌন্দর্য শরীরে ধারণ করে হেলেনের জলে অবগাহন। চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে জলে শুয়ে থাকে রুপবতী। শুধু একটা টিকটিকি দেয়ালের উপর বসে নির্বাক গিলে গিলে খায় নগ্নিকার অপরুপ রুপ।
এক টুকরা ব্রাউন রুটিতে এক স্লাইস চিজ তার উপর অবহেলে পরে থাকে এক টুকরো বিফ স্টেক। গ্রেপ জুসের সাথে যত্ন করে সোডা মেশালে তৈরি হয়ে যায় ডিনার। মিথিলার রাতের খাবার কখনোই ডাইনিং টেবিলে হয় না। বেডরুমের সাথে লেগে আছে এক চিলতে উত্তরমুখি বারান্দা। এখান থেকে শহর দেখা যায় আর পরিস্কার দেখা যায় আকাশ। রাত এখন নটা টটা হবে। আকাশটা আজ ভারি উজ্জ্বল। ছোঁয়ার বাইরে ঝিলমিল করছে বৃত্তের মত ষোড়শী চাঁদ। আজ জ্যোৎস্নার রাত। আজ অপ্রয়োজনীয় পৃথিবী ছেড়ে পালানোর রাত। সোডা মেশানো জুসে ছোট্ট একটা সিপ করে জুসটা গিলে না ফেলেই চোখ বন্ধ করে মিথিলা। আর মনে পরে যায় তার পূর্বজন্মের ইতিহাস।
আরো দুতিনটা জন্ম আগে আমি মহেঞ্জোদারো রাজ দরবারের নাচঘরে ছিলাম। রাত নামলে আলোয় আলোয় আমার গা ভর্তি। হীরে জহরতে আমি মুড়ানো ছিলাম। আমার নৃত্য ভঙ্গিমায় রাজপুতেদের মৃত্যু ছিলো অবধারিত। আমার বাজুবন্ধ আর চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে তোমরা আমার পায়ের নিচে লুটিয়ে পড়তে। আমি তখন নৃত্যরত সাকি। পেয়ালা ভরা সরাব অথবা হেমলক। আমার রুপের নেশায় রাজপুতেরা নিজের তলোয়ারে ঝড় তুলে নিজেরাই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। তারপর শুন্য নাচঘরে আমি পান করেছিলাম পেয়ালায় ঢেলে রাখা তরল হেমলক।
এরপর কোন একটা জন্মে আমি ছিলাম অষ্টাদশী বোহেমিয়ান। ঠিক মনে আছে, আমার নাম ছিলো ক্লারা। আমার মাথায় ছিলো চুড়ো করে বাঁধা বেণী। বেলবটম প্যান্টের সাথে লাগসই ফ্যাসনের শার্ট। আমার গলায় বাঁধা ছিলো স্কার্ফ। বোহেমিয়ান মেয়েরা এরমকমই সাজতো তখন। আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলো একটা পোলকা হারমোনিকা। আমি কী দারুণ পোলকা বাজাতাম! ঠোঁটের ফাঁকে হারমোনিকা চেপে যখন আমি বিষণ্ণ সুর তুলতাম তখন আমার ফেলোরা হুররে হুররে চিৎকারে মাতিয়ে তুলতো আকাশ বাতাস। আমার পোলকা নাচের সঙ্গী ছিলো ডানিয়েল। ডানিয়েল আমায় ভালোবেসেছিলো। ক্যারাভ্যান থামিয়ে আমার জন্য সে তুলে এনেছিলো বন্য ভোগেনভেলিয়া। বেগুনি ফুলগুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে হাঁটুগেড়ে বসেছিলো আমার সামনে। আর গাঢ় কণ্ঠে বলেছিলো, ভালোবাসি ক্লারা। বোহেমিয়ানদের ভালোবাসতে নেই। অনন্ত ছুটে চলাতেই তাদের আনন্দ। অষ্টাদশী আমি ক্যারাভ্যান ছেড়ে সন্তর্পণে পালিয়েছিলাম এক রাতে। সেরাতে আকাশে গোল একটা চাঁদ ছিলো। সেরাতে জ্যোৎস্না ছিলো আজকের রাতের মতই। তারপর সে জন্মের কথা আর কিছু মনে নেই।
রোহিত, রোহিত তুমি ভেঙ্গে দিয়েছিলে আমার ভালোবাসা এই জন্মে। ভালোবাসা কি ভাঙ্গা যায়! না বোধয়। ভালোবাসা কখনো পুরোনো হতে পারেনা, হতে পারেনা নিঃশেষ। ভালোবাসার কখনো অতীতকাল হয় না। তুমি বললেও হয় না রোহিত। দু’বছর বড় কম সময় নয়। তুমি আমায় উপহার দিয়েছিলে অনন্ত প্রেম। এন্টার্কটিকার ফেনাতোলা জলরাশির মত যা ছিলো অফুরান। তুমি আমায় নিয়ে গিয়েছিলে আলীবাবা শহর ইস্কান্দারাতে। সন্ধ্যার পর মদ আর জুয়ার আড্ডা দেখতে দেখতে আমরা যত্ন করে পুড়িয়ে ফেলা ল্যাম্ব লেগ চিবুতাম আর রাত মাতাল হলে আমি তোমার কোলে ঢলে পরতাম। তুমিও ফুরোতে আর শুন্য তোমাতে আমি। দুবছর আগের শেষ শ্রাবণে আমাদের বিয়ের কথা ছিলো। লগ্ন ঠিকঠাক। আমরা গয়নাগুলো কিনেছিলাম পি সি চন্দ্র থেকে। আমার শাড়িগুলো সব তোমার পছন্দের। একটা নীল শাড়ি কিনেছিলাম, গায়ে সোনালী জরির নক্সা আঁকা। কথা ছিলো মধু চন্দ্রমায় দূরে কোথাও যাবোনা। তোমার পছন্দ সমুদ্র। কথা ছিলো চিটাগাং পর্যন্ত আমরা ট্রেনে যাবো, পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। প্রথম শ্রেণির রিজার্ভ কামরায় তুমি আমি আর কফি, ব্যস আর কিছুনা। কথা ছিলো সন্ধ্যা নামলে আমরা কলাতলীর বিচে যাবো। আমার পরনে তখন থাকবে সেই নীল শাড়িটি, সোনালী জড়ির নক্সা আঁকা যার শরীরে।
অতিথিদের নিমন্ত্রণের কার্ডও ছাপা হয়েছিলো ঠিকঠাক। যেখানে বরের নাম রোহিত আর কণের নাম মিথিলা ছিলো। লগ্নের ছ’দিন আগে তুমি আমায় ফোন করে বলেছিলে, “ভুলে যেও।“ আমি জানতে চাইনি, কেন? তুমি ভুলে যেতে বলেছো এই ঢের। কিন্তু আমি অবাধ্য এক প্রেমাস্পদ তোমার! কথা রাখতে পারিনি। যেমন আর কখনো পিছু ডাকিনি, তেমনি ভুলে যেতে পারিনি তোমায়। মিথিলারা কখনো ভুলে যায় না রোহিতদের।
মিথিলা ধীরে সুস্থে শেষ করে বারান্দার ছোট গোল টেবিলের উপর রাখা খাবারগুলো। টপ্পা পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। মিথিলা টপ্পাকে কোলে নেয়। লোমশ গায়ে নাক ডুবিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকে। গ্লাসের তরলটা শেষ হতে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গলে আকাশে তাকায় মিথিলা। চাঁদে আজ আলোর বাড়াবাড়ি। মন হচ্ছে এক্ষুণি চাঁদ ফেটে ঝিরিঝির জ্যোৎস্না বৃষ্টি হবে। এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙয়ের উপর তলায় কেউ গান শুনছে, আম ফেডেড। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর ঢুকে পড়েছে চাঁদের আলো। উদভ্রান্তের মত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মিথিলা। চেস্ট ড্রয়ার থেকে খুলে ফুল স্লিভ একটা জামা পরে নেয়। তারপর টপ্পাকে কোলে নিয়ে নেমে আসে এপার্টমেন্টের বেজমেন্টে। গাড়ি উত্তরা পেরিয়ে আবদুল্লাহপুর। তারপর আশুলিয়া। তারপর আরো অনেক দূর। টপ্পাকে অচেনা জায়গায় নামিয়ে রেখে যখন গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছিলো মিথিলা তখন হতবিহ্বল টপ্পা ছিলো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ শব্দ তুলে গাড়ির পিছু পিছু দৌড়াচ্ছিলো টপ্পা। মিথিলা একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি।
রাত একটা পঁয়তাল্লিশে মিথিলাকে বাড়ি ঢুকতে দেখে অবাক হলো সিকিউরিটি গার্ড। ভেতরে বিস্ময় থাকলেও মুখে কিছু বললোনা। নির্দিষ্ট পার্কিং প্লেসে গাড়ি পার্ক করে মিথিলা উঠে আসে ফোর বি এপার্টমেন্টে। অভ্যাসমত ঠোঁট গোল করে শিষের মত আওয়াজ করলো মিথিলা। কিন্তু টপ্পা দৌড়ে এলোনা। মিথিলা যখন শাওয়ার সেরে শোবার ঘরে বিছানার উপর শুয়ে পরলো, দেয়াল ঘড়িতে তখন রাত দুটা বেজে দশ।
পরদিন বিকেল বেলা থানা পুলিশ দরোজা ভেঙে শোয়ার রুমে গেলো। মিথিলা তখন খাটে উপর উবু হয়ে শোয়া। বাম হাতটা বিছানা ছেড়ে খাটের পাশে ঘড়ির পেন্ডুলামের মত ঝুলছে। একজন মহিলা পুলিশ মিথিলাকে বিছানার উপর চিত করে শুইয়ে দেয়। বামহাতে বুজে দেয় খোলা চোখদুটে। সেখানে কি এক মুগ্ধতা লেগে ছিলো তখনো। এখন বিকেল সারে চার। গত চৌদ্দ ঘন্টায় এই ঘরে মিথিলার একবারও নিঃশ্বাস পড়েনি। নড়েনি একচুল।
বেডসাইড ড্রয়ারে একটা জলের গ্লাস। তাতে আধখাওয়া জল। স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস দিয়ে চাপা দেয়া একটা সিংগেল লাইনের রুলটানা কাগজে সুইসাইড নোট। তাতে লেখা ছিলো,
“শুধু বিষাদেই মানুষকে মরে যেতে হবে এমন কথা নেই। অতি আনন্দও মানুষের মৃত্যুর বিষয় হতে পারে। আমি চলে যাবার সময় জ্যোৎস্না দেখার আনন্দ নিয়ে গেলাম সাথে করে।”