শাহানা শুয়ে ছিলো। ক্লান্তিতে চোখ খুলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। ঘুম আর জাগরণের মধ্যবর্তী একটা অবস্থায় আছে সে। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা বিষাক্ত কীটের মতো উরুসন্ধি বেয়ে ক্রমশই মস্তিষ্কে উঠে আসছে আর নেমে যাচ্ছে। ঘুমালেও এড়ানো যাচ্ছে না সেই ওঠা-নামা।
আস্তে আস্তে চোখ খুলল শাহানা। ছোট্ট আঁতুড়ঘরে তার পাশে শুধু ধাই। শ্বশুর কিংবা শাশুড়ি কেউই নেই। তারা কি আর আসেনইনি?শাহানাকে চোখ খুলতে দেখেই ধাই আর্তনাদ করে উঠল, অ শাহানা! অ কপাল পোড়া বেটি! তোর স্বামী তোরে তালাক দিছে তো! অ শাহানা!
শাশুড়ি, যাকে শাহানা আম্মা বলে ডাকে—বাচ্চা প্রসবের সময় ধাইয়ের সাথে তিনি ছিলেন। বিড় বিড় করে সূরা পড়ছিলেন। ধাই তাকে ধমকও দেন একটা, এদিক খেয়াল দেন। অন্য দিকে তাকায়া থাকেন ক্যা? —তিনি কি চলে গেছেন?
শাহানা এদিক ওদিক তাকায়। পাশের টেবিলে এক বাটি গরম পানি। একটি মালসায় জ্বলন্ত নারকেলের ছোবড়া থেকে উপচে উঠছে ধোঁয়া। এই ধোঁয়ায় হাত সেঁকে ঢুকতে হয় আঁতুড়ঘরে। নইলে বাচ্চা কিংবা মায়ের ছুঁৎ লাগে। অবশ্য এখন ওসব বাহুল্যমাত্র। এ ঘরে আসতে কাউকেই হাত সেঁকে নিতে হবে না। গত বছরেও দরকার হয়নি…তার আগের বছরেও না!
শাহানা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্যালেন্ডারে বাচ্চা একটা ছেলের ফটোগ্রাফ। গত মাসের কাগজটা আর ওল্টানো হয়নি। কাউকে বলে ওল্টাতে হবে। নাহ, তার হাত না পড়লে সংসারটা কেমন মরা গরুর ঘানি হয়ে যায়!… কিন্তু ধাই কী বলল! ‘স্বামী তালাক দিছে’ মানে? প্রসবকালীন ব্যথা না-হয় আছে, কিন্তু সেই পুরনো ঘোর কি এখনও কাটেনি? নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে শাহানা। নাকি স্বপ্ন? হয় অনেক সময় এমন!
শাহানা বুকে হাত রাখে। বুকটা কেমন ভারী হয়ে আছে। চাপা একটা ব্যথা। শরীর, মন—উভয়েই বহন করছে মৃত বাচ্চা প্রসবের ধকল। আহা, বাচ্চাটা যদি মৃত না হতো! এখন নিশ্চয়ই তার পাশে শুয়ে থাকত। শাহানা মাঝে মাঝে বাচ্চার পাতলা ঠোঁটে হাত রাখত। আলগোছে! শিশুটি বার বার রক্তিম পাতলা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাত, আর সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। শিশুদের লাল জিভের চেয়ে আকর্ষণীয় কোনো বস্তু নেই পৃথিবীতে। সুতীব্র লাল জিভে ছোট্ট একটি চুমু খেয়ে সবুজ উপশিরা ফুটে ওঠা ঠোঁট ফাঁক করে গুঁজে দিত স্তন। শিশুটি চুকচুক করে খেতো ঈষৎ হলুদ শালদুধ… এভাবে ভারী হয়ে থাকত না বুক।
ব্যথাটা আবার পাঁক দিয়ে ওঠে শাহানার। দেয়ালের দিকে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকায় সে। প্রথম বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে। মেয়ে বাচ্চা। প্রথম যখন ‘বাচ্চা আসা’র সন্দেহের কথা বলেছিল সে মনিরকে, মনির—শাহানার স্বামী, খুব ছেলেমানুষ হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল যেনো কোনো সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোর ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হওয়ার ঘোষণা শুনেছে। খেলনা এনে ঘর ভর্তি করে ফেলতে লাগল। ঝুড়িভর্তি মেয়েদের কাপড়। বাচ্চা হওয়ার দিন যখন তাকে ঘর থেকে বাইরে যেতে বলল ধাই, সে বের হবেই না। পরে শাহানার শাশুড়ি তাকে অশ্রাব্য সব গালাগাল দিয়ে বের করে দেন। বের হওয়ার আগ মুহূর্তের মনিরের সেই মুখ এখনও বর্শার রাজকীয় ফলার মতো গেঁথে আছে বুকে। কী অসহায় মুখ তার! আহা! সেই মুখটুকু কল্পনা করে মনিরের যে-কোনো অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারে শাহানা।
প্রথমবার মৃত বাচ্চা প্রসবের খবর শুনে শাহানার যতোটা কষ্ট হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি ভয় হয়েছিল মনিরের কথা ভেবে। এতোদিনের এতো আনন্দময় প্রস্তুতি, মনির কিভাবে নেবে এই ব্যাপারটা? না, মনির শাহানাকে বুঝতে দেয়নি তার অনুভূতি। বরং শাহানার জন্যই সে উদ্বিগ্ন ছিলো। সত্যিকারের উদ্বিগ্ন! এটা টের পাওয়া যায়। মনিরের জন্যই প্রথম বাচ্চাটার শোক সে বহন করতে পেরেছিল। মাঝে-মধ্যে শুধু হাহাকার উঠত হৃদয়ে। সেটা তীব্রভাবে ফুটে উঠত চোখে। মুহূর্তেই বুঝে ফেলত মনির। টানা ছয় মাস বাবার ব্যবসা ফেলে সারাক্ষণ পাশে পাশে থেকেছে সে স্ত্রীর।
ধাই মহিলাটি আবার নিম্নস্বরে, অতি করুণ ভঙ্গিতে সুর টেনে বলতে থাকে, অ শাহানা, এইডা কী অইল রে! অ বেটি, তুই তো শ্যাষ অইয়া গেলি—
শাহানার বুক ধক করে ওঠে। তবে কি সে ঠিকই শুনেছিল? কিন্তু মৃত বাচ্চা প্রসব করার অপরাধে কি কেউ কাউকে তালাক দেয়?তাও মনির? যার সমর্থনে দু-দুটো মৃত বাচ্চা প্রসবের পরেও সে এখনও বেঁচে আছে! যে তাকে বিশ্বাস জুগিয়েছে, ইচ্ছে করে কেউ মৃত বাচ্চা প্রসব করে না। তাছাড়া শাহানা তো বন্ধ্যা নয় ! চাইলে চতুর্থবার কি আরেকটা বাচ্চা নেওয়া সম্ভব হবে না? আহ, কেন এমন হয়!
শাহানা ধাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার অবাক লাগে। সামান্য নারীদের দুঃখে সামান্য নারীদেরই চোখ ভেজে—এই ব্যাপারটিতে এখনও অনভ্যস্ত সে। ব্যথাটা আরও মোচড়াতে থাকে বুকে। ভারী বোধ হয় বুক। অবচেতনভাবে একটা হাত চলে যায় পাশে। মনে হতে থাকে, এই তো, বাচ্চাটা পাশেই শুয়ে আছে। হাত-পা ছুঁড়ছে। যেনো তার কান্নার আওয়াজও শুনতে পায় শাহানা। অদৃশ্য একটি শিশুকে আদরের ভঙ্গি করে হাত বুলোতে থাকে আলগোছে…
একসময় আঁতুড়ঘরের বেড়ার ফোকড় গলে বাতাস আসে। বাতাসে ভেসে আসে হাস্নাহেনার ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে দুই অনাত্মীয় নারী নেশাতুর হয়ে যায়। জড়াজড়ি করে কাঁদে। ক্যালেন্ডারের ছবি বাতাসে উড়তে থাকে। শাহানার কাছে সেটা অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শাহানা বড় হয়েছে ফুপার কাছে। মায়ের দিক থেকে আর কোনো আত্মীয় বেঁচে ছিলো না। পিতৃকুল থেকে ছিলেন একমাত্র ফুপু—তিনিও মারা যান অনেক আগেই।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে শাহানা ফুপার কাছে এসে ওঠে। ফুপার আর কোনো ছেলেমেয়ে ছিলো না। তিনি শাহানাকে কন্যাজ্ঞানে বড় করেন। সম্ভবত শাহানার জন্যই তিনি আর বিয়ে করেননি।
শাহানার বিয়ের মাসখানেক পরে ফুপা মারা যান। শেষ দেখাটাও দেখতে পায়নি শাহানা। এ নিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তীব্র আক্ষেপ আছে তার। কেন হয় এমন? কেন তার সংস্পর্শে যারা আসে তাদেরই অকল্যাণ ঘটে? নেমে আসে বিপর্যয়? নিজেকে বড় অভিশপ্ত মনে হয়! কে জানে, হয়তো বিয়েটা না হলে ফুপা এক মাসের মাথায় মারা যেতেন না! —হতেও পারত! পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর! ফুপার মুত্যুর ব্যাপারটায় নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় তার!
প্রথম বাচ্চাটার শোক যাতে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে সে জন্যই তড়িঘড়ি করে দ্বিতীয় বাচ্চাটা নেওয়া হয়। এবারও উৎফুল্লের সামান্যও ঘাটতি ছিলো না মনিরের। গতবারেরগুলো ছিলো, তবুও আরও আরও খেলনা এনে ঘর ভরতে থাকে সে। আর শাহানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রসব করে মৃত বাচ্চা। এবার অনেকদিন অচেতন অবস্থায় থাকে শাহানা। মাঝে মাঝে যখন জ্ঞান হতো, দেখতে পেত মনিরকে—পাংশু মুখে পাশে বসা। চোখের নিচে কালি। বড় মায়া হতো। একজন মহিলা ডাক্তারকেও দেখা যেত। অনুভব করত তার নরম স্পর্শ। এতোকিছুর পরেও তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। এখান থেকে হাসপাতাল বেশ দূরে। তাছাড়া সেখানে পুরুষ ডাক্তার আছে। তাই শ্বশুর-শাশুড়ি সম্মত ছিলেন না হাসপাতালে নিতে। এমনকি, তৃতীয় বারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি তাকে। ডাক্তারের বদলে ডেকে আনা হলো পুরনো ধাইকে। পিতামাতার বিরুদ্ধে যাওয়া মনিরের পক্ষে অসম্ভব। সে বড় নরম মানুষ;লাজুক স্বভাবের। প্রতিবাদ করা তার ধাতে নেই।
তালাকের ব্যাপারটা শাহানার কাছে রহস্যময় মনে হয়। নিশ্চয়ই রাগের মাথায় দিয়ে ফেলেছে। সব সময় কি নিয়ন্ত্রণ মানুষের নিজের হাতে থাকে? এখন নিশ্চয়ই কোথাও লজ্জিত ভঙ্গিতে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদছে বেচারা। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে মনিরের সামনে না পড়তে হয়—শাহানা প্রার্থনা করে। দু-জনেই লজ্জায় পড়ে যাবে তাহলে।
সৃষ্টিকর্তার প্রতি এক তীব্র রাগ লাগে শাহানার। সৃষ্টিকর্তা তাকে একা রাখবেন বলে ঠিক করেছেন! আচ্ছা, সে একাই থাকবে। না খেয়েই থাকবে না-হয়। কিন্তু যাবে কোথায়?
থাকার জায়গা একটা আছে শাহানার—ফুপার বাড়ি। ফুপার মৃত্যুর পর এখন সেখানে ঘুঘু চরে। সেখানেই যাবে। বেঁচে থাকবে সে। একাই বেঁচে থাকবে। বেঁচে থাকার চেয়ে জরুরি আর কিছু নেই পৃথিবীতে।
আহ্! একটু পরপরই ভরাট বুকে হাত বুলোতে হয় তার। বড় ব্যথা! বড় ভারী বুক! এই বুকে-ব্যথার রহস্য বোধগম্য হয় না তার কাছে। আগের দুবার তো এমন ব্যথা হয়নি! মনে হচ্ছে যেনো তিনবারের যন্ত্রণা সব এসে জমা হয়েছে।
দুই.
ফুপার বাড়িতে এসে শাহানা দ্রুত গুছিয়ে নিলো সবকিছু। সব কেমন এলোমেলো হয়ে ছিলো। আশ্চর্যের বিষয়, এ-বাড়িতে আর কেউ আসে না। সবাই তাকে কেমন এড়িয়ে যায়। কারও কাছে গেলে এমন দৃষ্টিতে মানুষ তাকায় যেনো সে রাবণের বোন। শাহানাও পারতপক্ষে অন্যদের এড়িয়ে চলে। নিজেকে এখন আর আগের মতো তুচ্ছও মনে হয় না। একাকীত্বকে সুতীব্র প্রেমেই কাছে টেনে নিলো শাহানা। পৃথিবীতে মানিয়ে নেওয়ার মতো সহজ কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই। শুধু কখনও একা মনে হলে চারপাশে একধরনের কুয়াশার আস্তর দেখতে পায় শাহানা। সেই সূচিভেদ্য কুয়াশার আস্তর চিরে ভেসে আসে মৃত তিনটি বাচ্চার কান্নার সমন্বিত আওয়াজ। শাহানা সে আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পায়। আর তখনই জেগে ওঠে সেই পাশবিক ব্যথা।
একদম কেউ এ-বাড়িতে আসে না বললে অন্যায় হবে। মাঝে মধ্যে দু-একটা বাচ্চা ছেলে পেয়ারা খেতে চলে আসে। চুপি চুপি এসে পেয়ারা চুরি করে পালায়। লুকিয়ে লুকিয়ে সেসব দেখে শাহানা। ভেতরে লালরঙের পেয়ারাগুলির দিকেই বাচ্চাগুলোর ঝোঁক বেশি। শাহানার ওসব ফল-টলের দিকে লোভ নেই।
লোভের বয়স সে ফেলে এসেছে। তাছাড়া প্রকৃতি অনেক সময় প্রেম কিংবা ঘৃণাই নষ্ট করে না, এসব লোভও নষ্ট করে দেয়। এমন সব পরিস্থিতিতে এসেই মানুষ হয়তো সব পাপকাজ বাদ দিয়ে ধর্মেকর্মে মনোযোগ দেয়। আবার নতুন করে পাপ করা শুরু করে কিছুদিন পরেই, পূর্ণ উদ্যমে। বড় বস্তুর লোভ থেকে মুক্তিলাভ ফাল্গুন মাসের মতো ক্ষণস্থায়ী। তবে পেয়ারার মতো ছোট বস্তুর লোভ আর ফেরত আসে না বোধ হয়। একদিন কৌতূহলবশত শাহানা একটি পেয়ারা ছিঁড়ে এনেছিল। আধ কামড় মুখে নিয়েই থু থু দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। ভেতরের তীব্র লাল তার অনাগত সন্তানদের জিভকে মনে করিয়ে দিয়েছিল বিদ্যুচ্চমকের মতো। সেই আধকামড় দেওয়া পেয়ারাটা সে ঘরের এক কোণে রেখে দিয়েছে। পাংশু হয়ে এসেছে সেটা শুকিয়ে।
মনে মনে শাহানা একটা খেলা খেলে পেয়ারা খেতে আসা বাচ্চাগুলোর সাথে। একেকজনকে তার একেকটা বাচ্চা ভেবে নেয়। একেকটা নাম দেয়। ফিসফিস করে ডাকে। সে ডাক তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না!
একদিন বছর সাতেকের একটা বাচ্চা ছেলেকে মনে মনে নিজের তৃতীয় ছেলে ভেবে নিলো শাহানা। আর অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো, অ্যাই, অ্যাই মুকুল—
মুকুল নামটা মনে মনে ভাবা সেই খেলার অংশ।
ডাক দিয়েই নিজের ভুলটা বুঝতে পারল শাহানা। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। ভেবেছিল ছেলেটা দৌড়ে পালাবে। পালাল না। থতমত খাওয়া ইঁদুরের মতো এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। শাহানা আবার ডাক দিল, অ্যাই পোলা, এদিক আসো।
ছেলেটা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে। হাতে নিদাগ দুইটি পেয়ারা। শাহানা নরম সুরে বলল, আরও পেয়ারা নিবা? আসো, ঘরে আসো।
ছেলেটা মাথা নাড়ায়, ঘরে যাবে না। শাহানা আরও নরম স্বরে ডাকে। এই ভঙ্গিতে কবুতর তার পনের দিন আগে জন্মানো ছানাদের ডাকে। বাচ্চা একটা ছেলে, একটি পেয়ারার লোভ তার কাছে নিতান্ত কম নয়। গুটি গুটি পায়ে শাহানার পিছু নিয়ে আসে সে। শাহানা তাকে হাত ভর্তি করে পেয়ারা দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, আর নিবা?
ছেলেটা মাথা নাড়ায়, আর নেবে না। আর তখনি বুকের ব্যথাটা আবার জেগে ওঠে। দলা পাকিয়ে পাকিয়ে বুক ফেটে বের হয়ে আসতে চায়। অকস্মাৎ মুকুলের একটা হাত চেপে ধরে শাহানা। তৃষ্ণার্তের মতো বলে ওঠে, দুধ খাইবা, বাজান?
কী বুঝল কে জানে—মাথা নাড়িয়ে দৌড়ে পালাল মুকুল। শাহানার বুকে তখন ব্যথা নিরাময়ের প্রবল লোভ। চোখ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে জলে। বুকে আলতো হাত রেখে চাপ দিতে থাকে শাহানা। সেই চাপ আস্তে আস্তে বাড়ায়। আধভাঙা আয়নার সামনে গিয়ে বুকের কাপড় সরিয়ে সজোরে দুহাত চেপে ধরে নিজের স্তন—এমন ভঙ্গিতে, যেনো অদৃশ্য কারও মাথা চেপে আছে স্তন্য পান করাবে বলে। প্রতিবিম্বের ওই রমণীর প্রতি এক বুক মমতা এবং করুণা বোধ হয় শাহানার।
তিন.
মুকুলের ভয় কেটে গেছে। সে প্রায়ই আসে। শাহানা ভেবেছিল অনেক অনেক বাচ্চা আসবে পেয়ারার লোভে। বাচ্চারা হলো পিঁপড়ের ঝাঁকের মতো, একজন খবর পেলেই সব চলে আসে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হলো না। খুব বেশি কেউ সেভাবে আসে না। ঘুরেফিরে চার-পাঁচটি শিশুই আসে। সবাই চুপি চুপি আসে, চুপি চুপি চলে যায়। কেউ ধরা দিতে চায় না। শাহানার সাড়া পেলেই দৌড়ে পালায়। আসে মিহির, জুয়েল, ময়ূর (এগুলিও মনে মনে দেওয়া নাম)। শাহানা প্রত্যেককেই ডেকে দেখেছে, কেউ আসে না।
শুধু মুকুলই আসে। যখন তখন ঘরে আসে। শাহানা তাকে পেয়ারা খেতে দেয়। বর্ষাকালে জামরুল গাছে জামরুল এসেছে, জামরুল খেতে দেয়। এর মধ্যে আরও বেশ কিছু ফলের গাছ এনে বাগানে লাগিয়েছে সে। খাক বাচ্চারা!
একদিন লিচুর খোসা ছাড়িয়ে দিতে দিতে আবার কথাটা তোলে শাহানা, ও বাজান ! মুকুল বাজান! দুধ খাইবা?
মুকুল প্রথমে কিছু বলে না। অবাক হয়ে তাকায়। শাহানা আবার জিজ্ঞেস করে, খাইবা দুধ?
মুকুল দ্বিধামিশ্রিত মাথা দোলায়—খাবে। শাহানা পাগলের মতো হেসে উঠে তার দু-হাত চেপে ধরে। তারপর আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেলে বুকের কাপড়। বাচ্চা ছেলেটা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এমন একটি দৃশ্যের কোনো প্রস্তুতি তার ছিলো না।
শাহানা স্নেহপূর্ণ দুটি হাত রাখে মুকুলের মাথায়, তারপর চেপে ধরে বুকের সাথে। হতভম্ব মুকুলের মুখ নির্জীব লেপ্টে থাকে তার বুকে। দ্বিধা কাটিয়ে একসময় আস্তে আস্তে স্তন চুষতে শুরু করে মুকুল—শাহানার মনে মনে ঠিক করা তৃতীয় শিশুটি—অমরার জলে সাঁতরে সাঁতরে ক্লান্ত হয়ে মারা গেছে যে। এখনও যার আওয়াজ মাঝে মধ্যে শোনা যায় কুয়াশা ঘনীভূত হলে। পাতলা ঠোঁট,কোঁকড়া পাতলা চুল। আহা! এক বুক থেকে ঝরনার মতন জ্বলুনি নেমে যাওয়া টের পেতে থাকে শাহানা। আহ, কী কষ্ট, কী যন্ত্রণা সে পুষে রেখেছে এতোগুলি দিন!
ভেজা চোখ মুছতে গিয়ে শাহানার হাত ভিজে যায়। সেই ভেজা হাত সে ঘসতে থাকে মুকুলের মাথায়, কোঁকড়া চুলে।