দুই জগতের গল্প

গ্যালারি-ভর্তি মানুষগুলোর ভিড়ে লোকটাকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি তার। এই চেহারা, এই চুল, এই চাহনি ভুলবার নয়। বহু নির্ঘুম রাত এই লোকটার চেহারা ঘরের অন্ধকার ছাদ ফুঁড়ে ভেসে উঠতে দেখেছে সে। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছে বারবার, মনে মনে হাজারটা ভেড়া গুনেছে, তবু এই মুখ থেকে মুক্তি মেলেনি। কত রাত ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছে, জোরে জোরে শ্বাস নিয়েছে অনেকক্ষণ। ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি খেয়েছে কতবার। মনে জোর এনে আবার শুতে গেছে বিছানায়। কিন্তু তাতে কী। আবার যা ছিল তেমনই।

এভাবেই রুপার সিডেটিভে নির্ভরশীলতার শুরু। তার বেডসাইড ড্রয়ারে নানা রকমের ঘুমের ওষুধ। এক ওষুধে সব সময় কাজ হয় না, তখন একাধিক মুখে পোরে। একসময় ওষুধের কার্যকারিতায় তার চিন্তাভাবনা অসংলগ্ন হয়ে পড়তে শুরু করে, আচ্ছন্নতা ভর করে। মাথার ভেতর সব অস্পষ্ট হয়ে পড়লে তবেই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে অবশেষে।

এ মুহূর্তে এই বিরাট চিত্রশালার দক্ষিণ কোণে লোকটাকে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখে তার বুকের ভেতর ঢাক বাজতে থাকে। অবশেষে লোকটার দেখা মিলল। তার মানে লোকটা সত্যি আছে। তার মানে সে উন্মাদ নয়!

রুপা গ্যালারির কোণ থেকে সাবধানে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করে। বেশ লম্বা। মাথার সামনের দিকে চুলগুলো একটু পাতলা। হ্যাঁ, এই তো সে। যে তার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে রাতের ঘুম, তাকে সে কী করে ভোলে?

দেড় বছরে দুবার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হয়েছে ওকে। কাউন্সেলিং নিয়েছে বেশ কয়েকবার। ওষুধও খেয়েছে লক্ষ্মী মেয়ের মতো। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাকে দিনরাত তাড়া করে ফিরেছে এক ভয়ানক স্মৃতি। যে স্মৃতি, ডাক্তারদের মতে, আদৌ তার স্মৃতি নয়। কেননা এমন কোনো ঘটনা তার জীবনে নাকি কখনো ঘটেইনি। যা হয়নি, যা অবাস্তব, তাকেই নাকি গভীরভাবে বিশ্বাস করে বসে আছে সে। এ এক জটিল মানসিক ব্যাধি। রুপা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিল এ কথা। সত্যি বলতে কি, মেনে নিলে ওর জন্য বিষয়টা সহজ হয়ে যায়। লাভ হয়নি। বানোয়াট এক স্মৃতির হাত থেকে কখনো উদ্ধার মেলেনি রুপার।

এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা বানোয়াট নয়! রুপা আশ্বস্ত হয়, আবার ভেঙেও পড়ে মনে মনে। তার মানে ঘটনাটা সত্যি ছিল। তার মানে, একদিন, বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়, যখন শহরের সব আলো ঝাপসা হয়ে আসছিল, শহরের রাস্তায় জমেছিল এক হাঁটু পানি, সেগুনবাগিচার এক রেকর্ডিং স্টুডিওর ভেতর সে তাহলে সত্যিই রেপড হয়েছিল!

‘আমাদের মেমোরি এক অদ্ভুত জটিল জিনিস।’ রুপার থেরাপিস্ট রায়হান বলে কথাটা। ‘স্মৃতি কিন্তু প্রতারক। আমার মনে আছে, খুব ছোটবেলায় আমি একটা লাল গাড়িতে করে মায়ের সাথে কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলাম। গাড়িটা যে লালই ছিল, তা জোর দিয়ে কিন্তু বলা কঠিন। হয়তো গাড়ির রংটা আমার বানানো। কারণ আমার পছন্দের রং লাল। তার মানে, স্মৃতির ওপর সম্পূর্ণভাবে কখনোই ভরসা করা ঠিক নয়।’

রুপা প্রথম প্রথম তর্ক করেছে, ‘আমি ওই ভয়ানক ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত মনে করতে পারি। এর সবটাই কি বানানো? আর কেনই বা বানাব?’ রায়হান তাকে তার বন্ধু ডা. শারমিনের কাছে পাঠিয়েছিল। শারমিন গাইনোকোলজিস্ট। রুপাকে পরীক্ষা করে শারমিন নিশ্চিত করেছেন যে রুপা ভার্জিন। এমনকি দেখা গেছে সেগুনবাগিচায় ওই রাস্তায় এ ধরনের কোনো স্টুডিওই নেই। সেখানে আছে একটা বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট, একটা স্টেশনারি আর ফটোকপির দোকান। ব্যস, আশপাশের লোকজন সাক্ষ্য দিয়েছে, গত দশ বছর ধরেও এখানে তারা কোনো রেকর্ডিং স্টুডিও দেখেনি। রায়হান বলেছে, ‘রুপা, আপনি গভীর এক অসুখে ভুগছেন। আমাকে সাহায্য করতে দিন। একদিন নিশ্চয় আপনি ভালো হয়ে যাবেন। এই অবান্তর স্মৃতি আর আপনাকে জ্বালাবে না।’

লোকটা এবার চায়ের টেবিলের দিকে পা বাড়িয়েছে। নীরবে তাকে অনুসরণ করল রুপা। গ্যালারির মালিকের স্ত্রী তার পরিচিত। রুপাকে তিনি আমন্ত্রণ করেছেন গান করবার জন্য। রুপা ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়। একটা স্কুলে গানও শেখায়। আর মাঝে মাঝে কেউ ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গাইতে ডাকলে আসে। এখানেও এসেছে। ভাগ্যিস, এসেছিল। নিজের স্মৃতি-বিস্মৃতি-বাস্তব-অবাস্তব মিলেমিশে যে ভয়ানক জট পাকিয়ে গেছে তার জীবনে, আজ বুঝি তা খুলতে শুরু করবে। নিঃশব্দে লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রুপা। লোকটা চায়ের কাপে জিরোক্যাল মেশাতে মেশাতে ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল একটু। তারপর কিছুই হয়নি এমন ভাব করে প্লেট থেকে তুলে নিল একটা শিঙাড়া। তখনই জেসমিন আপা, মানে গ্যালারি মালিকের স্ত্রী, এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘অনীক, হালুয়াটা নাও।’

লোকটা, মানে অনীক, যদিও রুপা জানে এটা তার আসল নাম নয়, হেসে উত্তর দেয়, ‘না, ভাবি। আমার প্রি-ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। মিষ্টি খাব না।’

জেসমিন আপার চোখ তখন পড়ে রুপার দিকে, ‘আরে, তুমি খেয়েছ রুপা? একটু গরম চা খেয়ে নাও। গলা খুলবে।’

লোকটা কৌতূহলী হাসি হেসে বলে, ‘আপনি গান করবেন? বাহ্।’

রুপার গলার কাছে সব দলা পাকিয়ে যায়। অতীত আর বর্তমান, সত্যি আর মিথ্যে—সব কিছু কেমন গুলিয়ে যায়। এই যে লোকটা, যাকে কিনা সে দেড় বছর ধরে খুঁজছে, আজ তাকে সামনে পেয়েও সে কিছু বলে না।

জেসমিন আপা উচ্ছ্বাসমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘হ্যাঁ রে। রুপা খুব ভালো গান করে। আর রুপা, অনীক তোমার শাহিন ভাইয়ের কাজিন। কানাডায় থাকে। পাক্কা পাঁচ বছর পর দেশে ফিরল।’

প্রাণপণে নিজেকে সামলায় রুপা। আশ্চর্য! লোকটা কি ভাবলেশহীন। তার সঙ্গে জঘন্য অন্যায় করে লোকটা তা বেমালুম ভুলে গেছে? নাকি ভান করছে? আর জেসমিন আপাই বা কেন মিথ্যে বলছেন? পাঁচ বছর লোকটা দেশে ছিল না?

রায়হান হতাশ হলো। বেশ উন্নতি হচ্ছিল রুপার। রাতের ঘুম নির্বিঘ্ন হচ্ছিল আজকাল। কিন্তু হঠাৎই আবার সব ওলটপালট। রায়হান বলল, ‘রুপা, আপনি কি নিশ্চিত যে এই লোকটিই ছিল সেই লোক? যদি তা না হয়, কী হবে বুঝতে পারছেন?’

রুপা ছটফট করে ওঠে, ‘আমি কি ভুল করতে পারি ডাক্তার? এই চেহারার প্রতিটি ভাঁজ আমার মুখস্থ। এত দিন ধরে খুঁজছি। এখন কি আমি পুলিশের কাছে যাব? খুলে দেব ভদ্রলোকের মুখোশ?’

রায়হান চিন্তিত হয়। রুপার সমস্যাটা ঠিক হ্যালুসিনেশন নয়। এটা একটা ফলস মেমোরি। সেটা এমন গভীরভাবে প্রোথিত যে তা উপড়ে ফেলা যাচ্ছে না। সে রুপাকে সাহায্য করতে চায়। কোনো এক বিচিত্র কারণে রুপাকে তার আপনজন মনে হয় মাঝে মাঝে। তাই তাকে বাঁচাতে চায় রায়হান, ‘এ কাজ না করাই ভালো হবে, রুপা। আপনার হাতে কোনো প্রমাণ নেই। ডাক্তারি সার্টিফিকেট আপনার বিরুদ্ধেই যাবে। এই লোক তো ঘটনার সময় দেশেই ছিল না। সে নাকি মিউজিক ডিরেক্টরও নয়। পুলিশ বলবে, আপনি অকারণে একজন ভদ্রলোককে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছেন।’

গলা ধরে আসে রুপার, ‘তা বলে আমি ওকে ছেড়ে দেব? আপনি তাই বলছেন?’

সে রাতে রুপা অনেকগুলো ডরমিকাম আর এক মুঠো রিভোট্রিল খেল। আধঘণ্টা করল যোগব্যায়াম। তারপর কিছুক্ষণ পৃষ্ঠা ওল্টাল গীতবিতান-এর। বারান্দায় একটা বেতের চেয়ার পেতে অনেকক্ষণ আকাশ দেখল রুপা। পাতিকাকের পালকের মতো ফিকে কালো রঙের আকাশ। দূরে জ্বলজ্বল করতে থাকা হীরের নাকফুলের মতো তারা। সে গুনগুন করে গাইল, আকাশ হতে আকাশপথে হাজার স্রোতে, ঝরছে জগৎ ঝরনাধারার মতো। একসময় আকাশটা আর আকাশের তারাগুলো চোখের সামনে অস্পষ্ট হয়ে যায়। গভীর এক তন্দ্রায় তলিয়ে যেতে থাকে রুপা। আর কী আশ্চর্য, ঘুমের দোলাচলে তার মাথার ভেতর নতুন নতুন স্মৃতিরা এসে ভিড় করে। সেই স্মৃতিতে, ক্ষণিকের জন্য, ডাক্তারকে সে দেখে তার হাত ধরে বসে আছে খোলা আকাশের নিচে।

২.

‘এই বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড একটা হলোগ্রামের মতো।’ রুপা চলে যাওয়ার অনেক দিন পর একদিন রায়হান রুপাকে নিয়ে একটা কল্পগল্প লিখতে বসে। ‘এই যে গল্পটা আপনারা পড়ছেন, আপনার ব্যস্ততার মাঝে খানিক অবসর, আপনার হাতে ধরা পত্রিকা—এর সবই সেই হলোগ্রামের নানাবিধ প্রজেকশন। অন্য কোনো বিশ্বে, আপনারই মতো কেউ, এই মুহূর্তে হয়তো এ রকমই কোনো উদ্ভট গল্প পড়ছে এখন। একটা সামান্য মুহূর্তের এদিক-ওদিক, একটি ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম পার্টিকেলের দুই মাত্রায় অবস্থান সেই গল্পে আমাদের ছিটকে ঠেলে দিয়েছিল অনেক অনেক দূরে, দুই ভিন্ন সমান্তরাল বিশ্বে। সেই বিশ্বে, সেখানেও লোকে কবিতা পড়ে বইকি, কবিরাও বাস করে, সেখানেও বাতাসে মেশে দীর্ঘশ্বাস! আর আপনি এত দিনে জেনে গিয়েছেন যে বিশ্বের অন্তর থেকে সূক্ষ্ম, দোদুল্যমান সুতোর মতো, ঝরনাধারার মতো বেরিয়ে এসেছে আরও আরও বিশ্ব, অগণিত ইউনিভার্স, মিশে গেছে সমতল কসমসে। এই বিশ্বের কোনো এক পৃষ্ঠায় রুপার সঙ্গে আমার দেখা হয় তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ানক দুর্ঘটনার পর; কিন্তু অপর পৃষ্ঠায়, সুতোর অন্য প্রান্তে তাকে আমি দেখেছি পউষের শেষ রাতে, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর বেশে।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত