আধো আলো ছায়ার ভিতরে জাঁকজমক ঘরের আর সব চকচকা ও বিলাস বস্তুগুলি তেমন দেখা যাচ্ছে না। প্রায় মধ্যরাতের পূর্বমুহূর্তে এসে হিরণের সিগারেট শেষের দিকে চলে এসেছে। প্যাকেটে তিন শলাকা আছে। আরও রাত শেষ হওয়ার অনেক বাকি। তবে হিরণের অনুভূতিতে প্রতিটা মুহূর্ত জীবনের সমাপ্তির এক প্রস্তুতি। যে কোন সময় নিজের ভিতরটা মরে যেতে পারে। চলে যাবে এসব চকচকা ও বিলাস বাসস্থান ছেড়ে। যার সারজীবনের স্বপ্ন ছিল এমন পরিবেশে জীবন কাটাবে তার আজ সব কিছু ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। নিঃসঙ্গতা তার চারপাশ অন্ধকার করে ফেলছে।
নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তুলে সে একদিন খুব ধনী হবে। তার ঘরের দেয়ালে সাঁটানো বিল গেটস, আমানচিও ওরতেগা, মার্ক জুকারবার্গ, ল্যারি এলিসন, মাইকেল ব্লুমবার্গদের ফটো। এরা বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওদের ফটোর সামনে গিয়ে একা একা কথা বলত আর হাসতো। তার ভিতর ওদের মত টাকা কামানোর ইচ্ছে পুষে রাখে সবসময়। কিন্তু পারেনি। তবে সে এখন যে অবস্থানে আছে অনেক ভাল, এটুকুই তার জীবনে হওয়ার কথা ছিল না। কোন এক উপায়ে আজকের দিনে পৌঁছেছে। কিন্তু আজ রাতে তার কাছে সব কিছুই দুর্বিষহ, বিরক্ত ও মূল্যহীন হয়ে গিয়েছে । মার্বেল পাথরে আবৃত মোজায়িক করা ঘরের আস্তর । দেয়ালে উজ্জল কালার। দামি ফার্নিচারে ঘরের ডেকুরেশন সব কিছুই ছিল শৌখিনতার চাহিদা। ভাল লাগছে না এসব। ভিতরের ইচ্ছে মরে গেছে। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।
একটা সময় অধিক শৌখিনতার ভিতরে থেকে চারপাশের সব কিছুই নোংরা মনে হত। সেসবের মোহে মস্তবড় ভুল ও অপরাধ করে ফেলেছে সেটা আজ উপলদ্ধি করছে আর পৃথিবীর চরম যন্ত্রণা তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
হিরণের হাতে যে সিগারেট সেটা গাঁজা পাতায় মোড়ানো কঠিণ এক শিল্পকর্মে ব্যস্ত। বিছানায় কোলবালিশের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে মুখ থেকে ঘন ধোঁয়া বের করে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী হেলেদুলে সিলিং ফ্যানের বাতাসে সারা ঘরে কুয়াশার ভাব করে ফেলেছে। হাতের ডান পাশে একটা ওয়াইনের বোতল খালি পড়ে আছে, আরেকটা প্রায় শেষের দিকে চলে গেছে। প্রচুর নেশায় আজ মাতাল খেলায় লিপ্ত সে। তবুও তার যন্ত্রণা কমছে না। চোখ লাল হয়ে গেছে। এই চোখ তার বউ দেখলে ভয় পাবে।
হিরণের বউ তার পাশের রুমে তিন মাসের মেয়ে বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। আজ একবারের জন্যও তার মেয়েটা কান্না করেনি। মা মেয়ে শান্তির ঘুমে মগ্ন। হিরণের চোখে তো ঘুম নেই। তবে চিরকালের জন্য ঘুমানোর আয়োজন করছে। পৃথিবীর আর কিছুই ভাবতে পারছে না। এক বারও চিন্তা করেনি পাশের রুমের দুইটা মানুষের জন্য। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। এই অপরাধ বোধ পৃথিবীর সব কিছুই ভুলিয়ে দিয়েছে। সে এখন মৃত্যুকেই সমাধান মনে করে এবং এটাই তার পুরস্কার হিসেবে মেনে নেয় । সামনের টেবিলে এক গ্লাস দুধে বিষ মেশানো সে বারবার দেখে তার মাতাল চোখ দিয়ে।
তিন বছর পূর্বে বিধবা মাকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে টঙ্গীর আরিছপুরে আসে হিরণ। চারপাশে উচু বিল্ডিং এর নিচে বস্তির মত ঘন বসতির ভিতরে একটি ছোট ঘর ভাড়া করে তাদের মা ছেলের সংসার শুরু করে। ঘরের ভিতর তেমন কিছু নেই অভাব ছাড়া। জরাজীর্ণ স্যাঁতস্যাঁতে আঁশটে গন্ধের ভিতরে তার দিন রাত কাটে। বাসার সামনে ড্রেনের গন্ধ তার কাছে অসহ্য লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে এমন অবস্থা। তবুও এখানে থাকতে হবে, কিছুই করার নেই। এর থেকে ভাল জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও অর্থ সাপোর্ট তাকে আটকিয়ে রাখে। তার মাকে তেমন কিছুই করতে দেয় না। আবার ভিতরের আগ্রহটা মাঝে মধ্যে তাড়িত করে বাইরে থেকে মা টাকা উপার্জন করে নিয়ে আসুক। কিন্তু কোথায় কি করবে সেটা ভাবে আবার মায়ের প্রতিও তার বিশ্বাসটা কম। এই জীবনে অবিশ্বাসের অনেক কিছুই দেখেছে সে, তবে কিছুই বলেনি। ভিতরকার রাগের আভাসে লাল চোখ দিয়ে মাকে অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছে, তবে মা তাতে অনেক স্বাভাবিক এবং ছেলেকে সে অনেক ভালবাসে সেটাই তার আচারনে বোঝা যায়। তবে ভিতরের চাওয়াটার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে না। হার মেনে যায় যৌনতার বেহায়া উত্তেজনার কাছে, তখন ভুলিয়ে দেয় ছেলের রক্তচক্ষু রাগের কথা। সহ্যের বাইরে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ছেলের মুখটা চোখে ভাসে, পরে একটু এদিক সেদিক হয়ে যায়। কিন্তু পরে ঠিকেই ফিরে আসে, ছেলেকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। একবারে ছেড়ে চলে যাওয়ার মত অনেক সুযোগ এসেছে মায়ের, কিন্তু যায়নি। যেতে পারে না, ছেলে তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তার জন্য উন্মাদ। না পেলে মৃত্যুকে বেছে নিবে সে ধারনা মায়ের।
হিরণের দু’বছর থাকতেই মা বিধবা হয়। বয়স তখন সতের। ফর্সা একহারা গঠনে শরীরের ভিতর অনেক কিছুই ত্যাগ দিয়ে কষ্টকে কামড় দিয়ে হিরণকে বড় করে। এবং কোথাও তাকে ছেড়ে একে বারে যায়নি। সে নিজের সমস্যা নিয়ে অপরাধবোধ করে। এটা তার কাছে স্বাভাবিক চিন্তায় চলে গিয়েছে, হিরণের মুখের দিকে তাকালে পৃথিবীর সব ভুলে যায়। তার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে পারবে। আর সে ক্ষেত্রে হিরণের রাগের লাল চোখের সামনে বেহায়ার অবয়ব প্রদর্শন করে। হিরণের উত্তেজিত মানসিকতা তখন সময়ে এটুকেই শান্ত রাখে, কারণ বেশি হলে মাকে হারিয়ে ফেলবে। মা চলে যেতে পারে যে কোন সময় এমন ধারণা তাকে যন্ত্রণা দেয়। এবং সে বিশ্বাসও করে। কিন্তু মাকে ছাড়া তো থাকতে পারবে না, তার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে। মা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই। যাই করুক মেনে নিতে বাধ্য হয়ে যায়। তবে মাঝে মধ্যে চাপা মানসিকতা তাকে খুব যন্ত্রণা দেয়। খুব দূরে গিয়ে রাগে চিৎকার দিয়ে কান্না করে। মুখ দিয়ে পাগলের মত প্রলাপ ছাড়ে, সে সব কথার মাঝে মায়ের মৃত্যুও কামনা করে এবং নিজের। চোখের পানি ফুরিয়ে গেলে মায়ের কথা ভেবে কষ্ট পায়। দৌড়ে বাসায় চলে আসে মাকে দেখার জন্য।
আরিছপুর এলাকায় সারে চার বছর ধরে থাকছে। এই শহরেই গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে হিরণ। মেধাটা ভাল, তবে কোন চাকরির সুযোগ এখনো পায়নি। তার ভিতর ধনাঢ্য-শৌখিন হবার চাহিদা তাকে যন্ত্রণা দেয়, তার সাময়িক ব্যর্থতা অস্থিরতায় ভোগায়। তখন চিন্তার জায়গা সহ্যের বাইরে চলে যায়, মেজাজ খারাপ হয়ে উঠে। চারপাশের কিছুই ভাল লাগে না। কিভাবে ভিতরের চাওয়াটা হাসিল করবে এমন মানসিক পীড়ায় ভোগছে সে। এমন অস্থিরতার সময় বাসে চড়ে উত্তরায় চলে যায়। জাঁকজমক এলাকায় ঢুকে আশপাশের ধনী পরিবারের রঙ তামাশা দেখে। নির্যাস নেয় প্রাণ পুরে। দামি পার্ফিউমের ঘ্রাণে নিজেকে সাজিয়ে নেয় ঐ সব ধনী মানুষদের মত করে। ওরা কিভাবে কথা বলে, হাঁটে, চলার ভঙ্গি, হাসি, উল্লাস সব কিছু নিখুঁত ভাবে রপ্ত করে। আর উত্তরার মার্জিত ছায়াযুক্ত ফাঁকা রাস্তা দিয়ে সেরকম ভাবে হাঁটে, কথা বলে একা একা। এসব করে ভিতরে শান্তি পায়, কিছুক্ষণের জন্য ধনী ধনী ভাবটা তার ভিতর প্রচুর আশা জাগায়। এসবেই জীবনের সুখ অনুভব করে। শান্তি খুঁজে পায়। পৃথিবীতে তার আর কিছুই চাওয়ার নাই, যে কোন মূল্যেই এমন পরিবেশের কেউ হতে চায়। এমন মানসিকতা তার ভিতর খুব মজবুত ভাবে জায়গা করে নিয়েছে, বিস্তার করে আছে অনেকটা জুড়ে, বহু দিনের পুষে রাখা স্বপ্ন গুলি তিল তিল করে এমন একটা স্থানে তার ইচ্ছেকে নিয়ে গিয়েছে, সে চাইলেই ফিরে আসতে পারে না। ফিরে আসার কথা চিন্তা করলেই যন্ত্রণা পায়। যদিও সে ফিরে আসার কথা চিন্তাও করে না, তবে তার বর্তমান অবস্থা ইচ্ছেকে মাঝে মধ্যে বাধ্য করে। তখন পৃথিবীটাকে ফ্যাকাসে মনে হয়। যদি এই জীবনে এমন না হতে পারে তাহলে মৃত্যু হয়ে যাক তাও ভাল। তার মানসিকতায় ধনী হওয়ার স্বপ্নটা এমন ভাবেই বিঁধে আছে।
খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গে হিরণের। ভিতরে একটু আনন্দের জন্ম দিয়েছে গতরাতের একটি ফোনকল। রাতেও ভাল করে ঘুম হয়নি। সারারাত ভাবনায় কেটেছে। আনন্দের খবরটা তার অধিক স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর সিঁড়ি হতে পারে বা সাময়িক অভাবটা তো মোচন হবে বা ঐ খানে ভাল কিছু করতে পারলে তো ধনীও হয়ে যেতে পারবে। এমন ধারণা ও চিন্তা করতে করতে ভোর বেলা একটু ঘুমিয়ে হঠাৎ উঠে পড়ে। মা এখনও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে মশারির নিচে। উপরে সিলিং ফ্যান তারপরেও চিকন গরমটা অসহ্য করে তুলেছে। শরীরে লেপ্টে থাকা ঘাম থেকে গন্ধ বের হচ্ছে হিরণের। খালি গায়ে লুঙ্গি পড়া, চিকন ফর্সা লম্বা শরীর, বুকের হাড় গুণা যাবে। লম্বা মুখ, সমান পাটি দাঁতের মাঝখানে ফাঁকা। কোন নেশা করে না লাল বর্ণ ঠোঁট। গোল মাথার চুল গুলি কোনদিন আঁচড়াতে পারে না, কাঠালের কাঁটার মত শক্ত দন্ডায়মান। শরীর ও মাথার সমস্ত রাগ চুলেই প্রদর্শন করে। হিরণ একটি টি-শার্ট পরে বগল শুঁকতে শুঁকতে বাইরে বের হয়ে যায়।
চায়ের দোকানে বসে। কোনদিন এভাবে এসব দোকানে বসেনি। আজ মনের আনন্দে চা পান করবে। পাশের লোকজন সিগারেট টানছে আর তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই তাকে চিনে সেও চিনে, কিন্তু কোনদিন কথা বলেনি। ওদের চিন্তা নোংরা ও অভাবে ভর্তি। তার সাথে কোন মিল নাই চিন্তার দিক দিয়ে। তাই এত বছরেও ওদের সাথে মিশে নাই, শুধু বাধ্য হয়ে এই এলাকায় আছে। আর থাকবে না এই এলাকায়, তার দিন পরিবর্তন হবে। আজ নতুন একটি চাকরিতে জয়েন করতে যাবে। অফিস গুলশানে।
এই দোকান থেকে উঠে সামনের রাস্তা ধরে আরেকটা দোকানের উদ্দশ্যে হাঁটতে থাকে, ঐ খানে দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট ডানহিল পাওয়া যায়। এই সিগারেট এক ধরনের শৌখিন ধনী মানুষেরা টানে। ওদের কোন কিছুই তার অজানা নেই, তাই আজ সেও টানবে। চিন্তা করে রেখেছিল ধনী হওয়ার মুহূর্তে সিগারেট ধরবে। আজ তার ভিতরে সেরকম কিছু মনে হচ্ছে। বর্তমান অবস্থার সাথে মানসিকতার একটা মিল খুঁজে পেয়েছে। আর এদিক সেদিক কিছু ভাবার সময় নাই। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর দূর থেকে একটা ফুটবল এসে বুকে লাগে। রাস্তার পাশে বস্তির ছেলেরা খেলছিল। ওরা তাকিয়ে আছে তার দিকে যেন বলটা দিয়ে দেয়। সে রেগে আছে, ভিতরে যে ভাবের অহংকার সেটার চোখ দিয়ে ওদেরকে দেখছে। শালারা নর্দমার কীট, হারামজাদা কাজটা কি করল, মনে মনে এমন জবে সে কাছে গিয়ে থাপ্পড় মারে যে লাথি দিয়ে বলটা মেরেছে সে ছেলেকে। আরও ফকিন্নির পুত বলে গালি দেয়। ঐ খানের হট্টগোলের শব্দ শুনে বস্তি থেকে ছেলেটার মা বের হয়। মোটা বেঁটে কালো মহিলা, মুখের ভিতর কয়লা, আঙ্গুল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে হিরণকে বলে,” কোথাকার কোন লাট সাহেবরে তুই, আমার পোলারে ফহিন্নি কছ। তরে আমি চিনি না, মনে করছছ।”
আস্তে আস্তে ঝগড়াটা বড় হয়ে যায়। অনেক লোকজন চলে আসে। হিরণ ঐ মহিলাকে অনেক কথা বলে। মহিলাও তাকে ছাড়ে না। হিরণের ভিতরে বর্তমানে যে অহংকার ছিল সে মাত্রা অনুযায়ী এতক্ষণ পর্যন্ত ঝগড়া সামঞ্জস্য না। তার আসল ব্যক্তিত্বের স্বভাবের কারনেই ঝগড়াটা এত সময় গড়িয়েছে। কেউ একজন সমাধান করতে আসে। প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হিরণের রাগের অশ্লীল গালাগাল ঠিক চলমান থাকে। হুট করে মহিলাকে বলে বসে, ‘তুই তো এই বস্তির বেশ্যা। না হলে পুরুষের সাথে এমন করে কোন মহিলা।’
এতক্ষণ ঝগড়ার ভিতরে হিরণের মুখ থেকে এমন কথা অনেকবার বের হয়েছে। তার তুলনায় ঐ মহিলা এতটা কড়া কথা বলেনি। তবে এই কথা শোনার পর মহিলাটা যে কথা বলে তাতে হিরণ চুপ হয়ে যায়।
মহিলা বলে,‘বেশ্যা কাকে বলছ, তর ঘরে খুঁজ্জায়্যা দেখ বেশ্যা কারে কয়। তর মারে এই বস্তির সবাই চিনে।’
হিরণ চুপ হয়ে যায়। আশপাশের মানুষদের মুখে দেখতে পায় ওদের ভিতরের তাচ্ছিল্যের চিকন হাসি। কেউ লজ্জায়, কেউ বড় চোখের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সেসব চোখের দিকে সে তাকাতে পারছে না। নিচু করে দিয়েছে কিছুক্ষণ আগের ধনাট্য অহংকারকে। পরক্ষণেই মানসিকতায় পুরনো অসহ্য রাগটা খোঁচা দেয়। মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। চোখ লাল হতে থাকে। দ্রুত বাসার দিকে যায়। মনেই নাই দামি ব্র্যান্ডের সিগারেটের কথা। ধনী হওয়ার পূর্বমুহূর্তকে রাগের বাষ্প উড়িয়ে দেয়।
খুব যত্ন করে গরম ভাত ও আলুর ভর্তা নিয়ে মা বসে আছে। ভাত থেকে দ্রুত ধোঁয়া উপরের দিকে উঠছে। মা জানে না আজ হিরণের চাকরির প্রথম দিন। হঠাৎ হিরণ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। সে মায়ের দিকে তাকাবে না এমন ভাব নিয়ে আসে। টি-শার্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারে। মা তখন বোঝতে পারে ছেলের ভিতরের অবস্থা। সে কিছু বলে না, স্বাভাবিক শরীরী ভাবটা বজায় রাখে। হিরণ গোসল করতে যাওয়ার পূর্বে মায়ের দিকে তাকায়। মা তার চোখ দেখে অন্যদিকে তাকায়, সেদিকে গরম ভাতের ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আর আলুর ভর্তাকে মনে হচ্ছে নিরিহ স্তম্ভ।
চাকরির দু’মাস পরে এসে হিরণ বুঝতে পেরেছে তার ভিতরের চাওয়াটা এখানেই পূরণ করা সম্ভব। এমন একটা সুযোগের মুহূর্তের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষার প্রহর গুণেছে। তার ভিতরে ভাল লাগতে শুরু করে আবার আরেকটা বিষয় চিন্তা করে খারাপও লাগে। সেই খারাপ লাগা চিন্তার বিষয়টা বিণিময় করেই তার পুষে রাখা স্বপ্নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে, তা ছাড়া উপায় নাই। ধনী তাকে হতেই হবে, এর ব্যর্থতার কথা সে মানতে পারে না। তখন তার মানসিকতায় সব খারাপ লাগার কথা ভুলিয়ে দেয়। প্রস্তুত হতে থাকে সীদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
অফিস করার শুরু থেকেই কোম্পানির মালিকের সাথে তার সম্পর্কটা ভাল হয়ে উঠে। পোশাকে, কথাবার্তায় সব কিছুতেই মার্জিত ভাব চলে আসে। কাজের গতিও তার ভাল। পঞ্চাশঊর্ধ্ব বয়সের মালিকের সাথে প্রায় গাড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করে। খুব চকচকা পরিবেশে উপস্থিত থাকে। ওদের পরিবেশের সাথে সে নিজেকে মানিয়ে নেয়, কারণ তার ভিতরটা তো প্রস্তুত হয়েই ছিল। এসব জায়গায় চলাফেরা করে তার স্বপ্নের চিন্তাটা এমন ভাবেই মজবুত হয়েছে, তাকে প্রচুর লোভী করে দিয়েছে এই মোহের প্রতি।
মালিকের ভাল আস্থাভাজন হওয়ার পর তার কাছে অনেক কিছুই শেয়ার করে। বসের বউ নেই, এখন সে একটা বিয়ে করতে চায়। তার শরীর এখনও যথেষ্ট শক্ত, ফর্সা লম্বা, দেখতে স্মার্ট। বউ মারা গিয়েছে অনেক আগেই। দুই ছেলে বড় হয়েছে, নিজেকে নিসঙ্গ লাগে এখন। যথেষ্ট ভদ্র ছেলেরা, বাবার ব্যবসা ধরার মত করে যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাই তার চিন্তাটা কম, এখন বিয়ে করবে। এসব কথা হিরণকে বলে এবং সুন্দরী নারীর সন্ধান দেওয়ার জন্য তাকে তাগিদ দেয়। হিরণ ব্যাপারটা নিখুঁত ভাবে নেয়। বসের আগ্রহের ভিতেরে ঢুকে অনেক কিছুই ভাবে। সে এখানে স্বার্থ খুঁজে পাবে এমন কিছু দেখে এবং সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
দুদিন পরে তার বসের সাথে একটা নারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পৃথিবীর আর কিছুই চায় না এমন উন্মাদনা লক্ষ্য করে বসের। এমন সময় বসে পড়ে বসের সাথে আলোচনায়। নারী সম্পর্কে অনেক কিছুই বলে। এখানে তার কিছু স্বার্থের শর্তগুলি বসের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। তারপর প্যাঁচার মত বসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ও ভিতরে তৈরি করা চাপা আনন্দ হ্যাঁ সূচক শব্দের অপেক্ষায় থাকে, না করলে আনন্দটা মরে যাবে সাথে তার মানসিক অবস্থা উন্মাদ হয়ে পড়বে। তার শরীরময় অস্থিরতায় ভোগছে। এখন কিসের বিনিময়ে কি পেতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তার কোন চিন্তা করা সময় নাই। কোন মায়া হচ্ছে না কারও জন্য, ধনাট্য অহংকার সব খেয়ে ফেলেছে। একটা হ্যাঁ সূচক শব্দ তার পৃথিবীকে পাল্টে দিবে। এমন মুহূর্ত তার ভিতর বিরাজ করছে। অস্থিরতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বসের মুখ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে পৃথিবীটা পেয়ে গেছে এমন চাপা উল্লাস তার চোখে মুখে উদ্ভাসিত হয়। সে উড়তে থাকে স্বপ্নের দুনিয়ায়। ডুবে যায় আকাঙ্ক্ষার বস্তুগুলির ভিতরে।
আজ সেসব দিনের কথা কিছুই মনে নেই। শুধু চোখের সামনে তার মায়ের মুখটাই ভাসছে। সারা ঘরময় নেশা দ্রব্যের ভিতরে তার মাতাল চিন্তার মধ্যে মাকে হরানোর যন্ত্রণাটা হানা দিচ্ছে। কোন কিছু মানতে পারছে না, বড় অপরাধ করে ফেলেছে এই ভাবনায় তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। সেদিন এই কাজটা কিভাবে করতে পারল সেই ভাবনা কলিজার মধ্যে সুঁইয়ের আঘাত করছে।
মধ্যরাত পর্যন্ত সজাগ ছিল হিরণ তার মাকে একটা কথা বলার জন্য। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে দুইজন দুই বিছানায় শুয়ে আছে। মা তখনও ঘুমায়নি। সে বুঝতে পারছিল বসের সাথে দেখা করার বিষয়টা। ছেলের ভিতরে লালন করা স্বপ্নের কথা সম্পর্কে সে জানে। ছেলে ভাল থাক ও নিজের প্রতিও ঘৃণা চলে আসছিল। আর কত এভাবে থাকবে। তাই ওপাশ ঘুরে শুয়ে ছিল। হিরণ বুঝতে চাইছিল তার মা সজাগ আছে কিনা, তাই একা একা জোরে জোরে কথা বলতে থাকে। মা তখন এদিকসেদিক নড়াচড়া করে বুঝিয়ে দিল। হঠাৎ হিরণ মাকে কথাগুলি বলতে শুরু করে। মা একটাও কথা বলেনি চুপ হয়ে ওপাশ ফিরেই থাকে। হিরণের শেষ সংলাপটা ছিল এমন, ” মা তুমি রাজি আছ? তোমার রাজি হওয়াতেই আমি কিন্তু অনেক কিছুই পেয়ে যাব।”
এই কথা বলে হিরণ শুয়ে পড়ে। রাতটা সুন্দর না ভয়ংকর ছিল সে চিন্তা তার মাথায় ছিল না। ভোর বেলায় মা হিরণকে তার প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিয়ে জড়িয়ে ধরে। এক বিন্দুও কান্না করেনি, যদি ছেলে মায়ের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তার সিদ্ধান্ত যেন শক্ত থাকে।
গত সপ্তাহে যখন তার মাকে নিয়ে বস চিরজীবনের জন্য আমেরিকা চলে যায় তখন থেকেই তার ভিতরে হারানোর যন্ত্রণাটা কষ্ট দেওয়া শুরু করে। সে উন্মাদ হয়ে উঠে, তার পৃথিবীটা ফাঁকা হয়ে যায়। মা যাওয়ার পূর্বে দেখা করার কোন প্রয়োজন বোধ করে না। কারণ সে হিরণকে কখনও হারাতে চাইছিল না। আজ তার সুখের বিণিময় হয়ে তাকে ছেড়ে চিরজীবনের জন্য চলে যেতে হবে সেটাও কোন দিন ভাবেনি। বিমানে উঠার আগে একবার ফোন দিয়েছিল। মাতৃত্বের টানে কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে এমন অবস্থাতেও মা স্বাভাবিক কথা বলে হিরণের সাথে। হিরণ বাচ্চাদের মত কান্না শুরু করে দেয়। মায়েরও অনেক কষ্ট হয়েছিল, তবে সেটা সহ্য করার মত প্রস্তুতি নিয়েই ফোন দিয়েছে ছেলেকে। মায়ের শেষ সংলাপটা এমন ছিল, “তুমি তো আমার বিনিময়ে অনেক কিছুই পেয়েছ, তাহলে হারানোর কষ্টটা কেন তোমার। সেদিন আমার সম্মতি না থাকলে তো এর থেকেও বেশি কষ্ট পেতে।”
হিরণ স্থির থাকতে পারছে না। তার মায়ের মুখ ও কথাগুলি কোন ভাবেই ভুলতে পারছে না। সে বিষ মেশানো দুধটা খাবে এর প্রস্তুতি নেওয়া শেষ। তার ভাবনাতে কিছুই নাই, বউ বাচ্চার কথাও মনে পড়ছে না। হাতে দুধের গ্লাসটা নেয়, মাতাল ভাবে ঘুমন্ত লাল চোখ দিয়ে গ্লাসে তাকিয়ে আছে। ঝাপসা দেখছে, খুব ঢলছে শরীর। প্রায় ভোর হয়ে আসছে পৃথিবী। মুখে গ্লাসটা তুলে নিল, ঠোঁটে কাচের গ্লাস স্পর্শ করা মাত্রই পাশের রুম থেকে তার মেয়ে আৎকা সজোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে যায়। পরক্ষণেই পৃথিবীর ধ্যানে চলে আসে। এদিক সেদিক তাকায়, নিজের শরীর দেখে। কান্নার শব্দে বেঁচে থাকার একটা চিকন অনুভূতি তার ভিতরে আশা জাগায়। দৌড়ে পাশের রুমে চলে যায়।