বিদায়

রমনা পার্কের সামনে চল্লিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে রবি। হাতঘড়ির দিকে তাকায়। তিনটার সময় নিপার আসার কথা। মেয়েটা প্রায়ই এরকম করে। রবিরও প্রায়ই রাগ হয়। রাগটা বুকের মধ্যেই চাপা থাকে। নিপা সামনে এলে একেবারে ভেজা বেড়াল হয়ে যায়।

দুপুর বেলা রমনা পার্কটা ফাঁকা। দূরে বেঞ্চিতে কালো কুচকুচে একটা লোক। রবির দিকে তাকিয়ে ছিল। রবি তাকাতেই দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নেয়। লোকটার পরনে একটা লুঙ্গি, টিশার্ট। কাপড়গুলো যথেষ্ট ময়লা। বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। লোকটা কি মনে করে এগিয়ে আসে। রবির সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে। বিড়িটা জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।

‘প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করতাছেন ভাইজান?’

‘ জ্বি।’ ‘আইজ সে আইবো না।’

লোকটা যেন একটা জ্যোতিষ। সেরকম করে কথা বলে।

‘কিভাবে বুঝলেন?’ প্রশ্ন করে রবি।

‘ঐ যে………..’ পূবাকাশের দিকে আঙ্গুল উচিয়ে ইশারা করে। ‘দেখতাছেন কেমুন কালা মেঘ জমা হইছে।’

রবি আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে কালো মেঘ। ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। হোক না। ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় নিপা আসবে। নিপার সাথে তার অনেক কথা।

‘আপনার নাম কী?’

‘আমার নাম হারুন।’

‘কী করেন?’

‘চুরি করি।’

রবি চমকে ওঠে। ‘ চুরি করেন!’

‘হ’। পকেটমার, ডাকাত, চোর যা মন চায় কইতে পারেন।’

পকেটমার শব্দটা শুনে একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। রবি কলেজে যাচ্ছে। তখন ন’টা পঞ্চান্ন। বাসের মধ্যে হঠাৎ হৈ চৈ শুরু হয়। একজনের দশ হাজার টাকা পকেট মারিং হয়েছে। লোকটা হাউমাউ করে কাঁদছে। শুধু বলছে, ভাই আমার খুব বিপদ। আমার অসুস্থ মা, তার অপারেশনে অনেক টাকা লাগবে। মায়ের জন্য ধার করে আনা টাকা। ভাই আমার মা অসুস্থ, মা…।

রবির বুকের ভেতর ব্যথা করে। কষ্টের একটা স্রোত শরীরের মাঝ দিয়ে বয়ে যায়। রবির টাকা থাকলে তাকে নিশ্চই দশ হাজার টাকা দিতো। যাদের আছে তারা দেয় না। অসহায়ের কান্না দেখে তাদের বুকে ব্যথাও করে না। অসহায়ের প্রতি মমত্ব যেন আর যতো সব অসহায়ের। লোকটা প্রলাপ বকতে বকতে গাড়ি থেকে নেমে যায়। রবি নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থাকে।

‘চুরি করেন?’ ‘হ’। ক্যান বিশ্বাস হয় না?’

রবি দারুণ অবাক হয়। চোররা কখনো বলে না যে, আমি চোর। এ লোকটা বলছে।

‘আমি আপনাকে ধরিয়ে দেব।’

‘তার আগে যে আমি আফনেরে ধরায়া দিমু ভাইজান।’

‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’

লোকটা হাসে। ‘আমি ভাই ওসব লেহাফড়া জানি না। হিন্দিতে পিন-পিন, ঘিন-ঘিন করলে আমি বুঝুম না। বাংলায় কন।’

‘ননসেন্স।’

রবির কথা শেষ হবার আগেই লোকটা কোমর থেকে পিস্তল টেনে বের করে। ওর চোখ দুটো লাল হয়। চেহারায় ফুটে ওঠে হিংস্রতা।

‘যা আছে দিয়া দেন।’

আশপাশে কেউ নেই। নির্জন রমনা পার্ক। চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। শুনলেইবা আজকাল কার জন্য কে এগিয়ে আসে! রবির পকেটে দুশ’ টাকা। একশ’ টাকা তার নিজের। আর একশ’ টাকা খালুর জন্য ওষুধ কেনা বাবদ। লোকটা পকেট হাতিয়ে টাকাগুলো নিয়ে নেয়। রবি অসহায়ের মতো বলে, ‘ভাই একশ’ টাকা আমাকে দিন, খালুজানের জন্য ওষুধ কিনতে হবে। লোকটা ধমক দেয়।

‘চুপ কর ভাইজান।’

টাকা নিয়ে চলে যাবার পরও অসহায়ের মতো বেঞ্চিতে বসে থাকে রবি। মেঘগুলো আস্তে আস্তে মাথার ওপর উঠে এসেছে। সারা আকাশ জুড়ে মেঘ। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। ঢাকা শহরের ধুলা-বালি ঝড়ো বাতাসের সাথে মিশে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। চক্কর খায়। তার কিছুক্ষণ পরই ঝপ ঝপ করে নেমে পড়ে বৃষ্টি। মিনিট দশেক বৃষ্টি হয়। রবি যেখানটাতে বসে ছিল সেখানেই বসে থাকে। দশ মিনিটের বৃষ্টি ওকে গোসল করিয়ে দেয়। ভেজা গায়ে বসে বসে ভাবে বাড়ি গিয়ে কী বলবে। ওর খালুজান কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। নিয়মিত পাতলা পায়খানা করছেন। যা খাচ্ছেন পানির মতো বেরুচ্ছে। খুবই সমস্যা। খালাম্মা আসার সময় একশ’ টাকা দিয়ে বলেছিলেন, ‘রবি আসার সময় তোর খালুজানের জন্য ওষুধ নিয়ে আসবি।’

‘জ্বি, খালাম্মা আনবো।’ সেই ওষুধ কেনার টাকাটা এখন চোরটার পকেটে। টাকা দিয়ে কী করবে লোকটা? হেরোইন, মদ গিলতে পারে। বাড়ির জন্য চাল-ডালও কিনতে পারে। চাল-ডাল কেনাটা তার প্রয়োজন। মানুষকে তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য উপার্জন করতে হয়। মানুষ উপার্জন করে দুই পথে- সৎ এবং অসৎ। পাঁচটার দিকে নিপা আসে। রবিকে ভেজা কাপড়ে দেখে হাসে। ‘বাহ্ তোমাকে চমৎকার লাগছে।’ রবি জবাব দেয় না। নিপাই আবার কথা বলে, ‘জানো আজ আসতাম না, ভাবলাম যদি তোমাকে পাই শেষ দেখাটা হবে।’

রবির বুকের ভেতর ব্যথা করে ওঠে। ‘শেষ দেখা মানে!’ ‘ আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলেটা কানাডা থাকে। বিয়ের পর আমাকেও কানাডা নিয়ে যাবে।’

‘আমাকে ভুলে অন্য একজনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে নিপা?’

‘কেন নয় রবি। তোমার চেহারাটা সিনেমার নায়কদের মতো সুন্দর নয় যে আমি তোমাকে দেখে সবকিছু ভুলে যাব। তোমার নেই টাকা, নেই যোগ্যতা।’ নিপা মিথ্যা বলেনি। রবি একটা অসহায় ছেলে। গ্রামের এক কৃষক তার বাবা। ঢাকা শহরে অন্যের আশ্রয়ে লালিত-পালিত একটা ছেলে নিপার মতো মেয়েকে বিয়ে করবে! ‘তুমি ঠিক বলেছো নিপা।’ অসহায়ের মতো কথা বলে রবি। রবির কথা শুনে নিপার কষ্ট হয় কি না বোঝা যায় না। বলে, ‘রবি আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। যেখানে থাকো ভাল আর সুখে থাকো।’

‘হ্যাঁ।’ ঘাড় নাড়ে রবি।

‘খুব ভালো থাকবো নিপা।’ রবির চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নিপা বিদায় নিয়ে চলে যায়। মেয়েটা চলে যাবার পর কেমন অদ্ভুত ধরনের কষ্ট হয়। মনে মনে ভাবে, ভালোবাসা একটা পাপ। এ পাপ যারা করে তারাই শুধু এ কষ্টটা পায়। অনুভব করে। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরতেই খালাম্মা ছুটে আসেন। ‘ওষুধ কই রবি? তোমার খালুজান আরও বেশি পায়খানা করছেন।’ রবি নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকভরা তার অনেক কষ্ট। খালাম্মা খেকিয়ে ওঠেন, ‘ওষুধ কই রবি?’ রবি কথা বলতে পারে না। কী বলবে সে! আবার চিৎকার করেন ভদ্রমহিলা, ‘রবি ওষুধ আননি?’ রবি মৃদূ স্বরে জবাব দেয়, ‘না, খালাম্মা।’ ‘টাকা দাও।’ ‘টাকা একজন নিয়ে গেছে।’

‘টাকা নিয়ে গেছে মানে!’ মহিলার চোখে আগুন জ্বলে। ‘এটা তোমার বাপের হোটেল না বুঝলে। আমাদেরটা খাবে আবার আমাদেরটা নষ্ট করবে তা চলবে না।’ অসুস্থ রোগাক্রান্ত লোকটাও উঠে আসেন। লোকটা তার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করেন, তবুও তার চিৎকার জুতসই হয় না। ফ্যাসফেসে গলায় বলেন, ‘এ বাড়িতে তোমার যায়গা নেই। বেয়াদব ছেলে কোথাকার।’ রবি তার জিনিসপত্র গোছগাছ করে। জিনিসপত্র বলতে দুটো লুঙ্গি, তিনটা পুরানো প্যান্ট, দুটো শার্ট আর একটা ছেড়া ব্যাগ। ছেড়া ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রবি সামনে হাঁটে।

দরজার সামনে গিয়ে আবার পেছন ফেরে। পেছনে তার দু’জন ছাত্র। এ বাড়িতে রবি ওদের পড়াতো। ফাহিম ছেলেটা ফোরে এ পড়ে। সোহান ক্লাস সিক্সে। অশ্রুসজল নয়নে ওরা রবির দিকে তাকিয়ে আছে। রবি চোখ মুছে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত