সে থাকুক নিজের মতো

সে থাকুক নিজের মতো
বেশ কয়েকবার ফোনটা বেজে থেমে গেল। আমি শুয়ে থাকলাম। চোখ দুটো সবে লেগে এসেছিল। এমন সময় ফোন আসলে বিরক্ত লাগে। মেজাজটা মাথায় চড়ে যায়। আমারও তাই হয়েছে। এদিকে শরীরময় যেন অলসতা লেপ্টে আছে। উঠে গিয়ে ফোনটা তোলার ইচ্ছেও হলো না৷ ফোন টেবিলের উপর রাখা। বিছানা থেকে টেবিল খানিক দূরে। আমার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচে কষ্টকর কাজটি হচ্ছে এই মূহুর্তে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরা৷ আমি এই কাজটি এখন করতে চাচ্ছি না৷ আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে৷
ফোনটা আবার বেজে উঠলো৷ রিংটোনটা খুব বিরক্তিকর লাগছে৷ একদম কানের ভেতর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে৷ মাথার ভেতর যন্ত্রণার সৃষ্টি করছে৷ আমি বালিশটা মাথার উপর চেপে ধরলাম৷ এতে খানিকটা কাজ হলো৷ রিংটোনের শব্দটা পুরোপুরি কানে লাগছে না৷ অল্প অল্প আসছে৷ এই শব্দটা সয়ে নেওয়া যায়৷ আমি বালিশ চেপে রেখে শুয়ে থাকলাম। অল্প কিছু পরেই মনের ভেতর একটা খুঁতখুঁতে কৌতূহল তৈরী হলো৷ কে জানি ফোন দিয়েছে; জানার ইচ্ছে জাগলো৷ আমি তাও শুয়ে থাকলাম। যাই হোক, আজ আর উঠবো না৷ চমৎকার একটা ঘুম দিয়ে ঠিক সন্ধ্যায় উঠবো৷ মাথাটা ভার ভার লাগছে৷ যেন রাজ্যের চাপ আমার মাথায়৷ কিন্তু সেই শুয়ে থাকা আর হলো না৷ মনের ভেতর যখন কৌতূহল তৈরী হয় তখন তা নিয়ে শুয়ে থাকাটা দায়৷ এই কৌতূহল না মেটানো পর্যন্ত মনের ভেতর খুঁতখুঁত করতেই থাকবে৷ ঘুমের ঘুম কিছুই হবে না৷
আমি কোনো রকম দেহটা টেনে উঠালাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম মোবাইলের দিকে৷ ফোনটা হাতে নিয়ে দ্রুত বিছানার কাছে চলে এলাম৷ খাটের উপর শুয়ে পড়লাম। স্ক্রিনে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল৷ আমি হতভম্ব হয়ে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম৷ অয়ন চৌধুরী ফোন দিচ্ছে৷ বেশ কয়েকবার কল দেওয়া হয়ে গিয়েছে৷ আমি অতিমাত্রায় অবাক হলাম৷ অয়ন চৌধুরীর আমাকে কল দেওয়ার কথা নয়৷ কোনো মতেই নয়৷ আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাতের পর তার সাথে আমার আর যোগাযোগ হওয়ার কথা না৷ সেটিই শেষ ছিল৷ কিন্তু তিনি আজ এতো দিন পর হঠাৎ ফোন দিয়ে বসলেন যে? ঘটনা কী?
আবার কল এলো৷ আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম৷ মোবাইলটা বিছানায় রেখে চিন্তা করতে থাকলাম যে আমার এই মূহুর্তে কী করা উচিৎ? ফোন ধরবো কী ধরবো না? আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। ঠিক সে সময় আমার মিহিনের কথা মনে পড়ে গেল৷ মিহিন হঠাৎই আমার সাথে লেপ্টে যাওয়া একজন মানুষ। আমার বন্ধু। অস্পষ্ট কোনো এক কারণে আমরা অদৃশ্য প্রেমিক-প্রেমিকা। যাদের প্রেমের পদ্ম সবে ফুটে ছিল৷ অঙ্কুর করে ছিল সবে৷ সেই প্রেম অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে৷ হঠাৎ ঝড় কিংবা কিছু নির্মম সত্যের আড়ালে আমাদের সেই অস্পষ্ট প্রেমের সম্পর্কটি চাপা পড়ে।
মিহিন আর আমি খুব ভালো বন্ধু ছিলাম৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকে আমাদের কথাবার্তা না হলেও মাঝামাঝি সময়ে আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে যাই৷
সেই বন্ধুত্বটা খুব ধীরে ধীরে প্রেমের দিকে গড়াতে থাকে। গোপনে নয়৷ আমরা দুজনেই মনে মনে জানতাম আমরা একে অপরকে ভীষণ পছন্দ করি৷ ভীষণ! তার কাজল কালো চোখের প্রতি আমি কতোটা আকৃষ্ট ছিলাম তা যেন মেয়েটা আমার চোখ দেখে বলে দিতো৷ আমি তাকে টিপ পরতে নিষেধ করতাম৷ তার টিপ দেওয়া চাঁদবদন অনবদ্য সুন্দর। আমি সৌন্দর্যতার মোহে পড়ে যেতাম বলেই তাকে টিপ দিতে নিষেধ করতাম। সে তা কখনই শুনেনি৷ আড়ালে সেও যে আমায় তার মোহে ফেলার চেষ্টা করতো তা আমি বেশ বুঝতে পারতাম। সম্পর্কটা বন্ধুত্ব পর্যন্তই ছিল ততোদিন৷ এরমাঝে তার বড় ভাই অয়ন চৌধুরী ব্যাপারটা টের পেয়ে যান। বাকি সবটা যেন বাংলা সিনেমার মতো ঘটতে থাকে৷ প্রথমে তিনি আমায় হুমকি দেন৷ এরপর হুমকির পরিবর্তে টাকার অফার করেন৷ আমাকে ভাবতে সময় দেন৷ আমি তখন ভাবতে শুরু করি৷ একজন মানুষ কখনই পরিপূর্ণ হয় না৷ মিহিনও পরিপূর্ণ ছিল না৷
তার সব কিছুই আমার ভালো লাগতো৷ কিন্তু গোপনে গোপনে তার অহংকারবোধটা আমায় বেশ ভাবাচ্ছিল৷ তার অহংকারের ব্যাপারটা ধরা যেত না৷ কারণ সেটা মাঝে মাঝেই উদয় হতো৷ সব সময় না৷ এই যেমন একজন গরীব লোক এসে হাত পাতল, কিছু ভিক্ষা চাইলো, মিহিন তাকে সোজা নিষেধ করে দিলো৷ ব্যাপারটা নিষেধ পর্যন্তই যদি থাকতো তবে মানা যেত৷ কিন্তু তেমনটা হতো না৷ কিছু ভিক্ষুক থাকে গায়ে পড়া টাইপের৷ টাকা দিবে না বললেও দাঁড়িয়ে থাকে৷ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে৷ গায়ে হাত দেয়, মাথা মুছে দেয়৷ এসব মিহিন একদমই নিতে পারতো না৷ এদের স্পর্শ পেলে নাকি তার বমি পেতো৷ অসহ্য লাগতো৷ মিহিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না৷ তাই মাঝে মাঝে ভিক্ষুকদের গায়ে হাত তুলতো৷ সেটা আমার সহ্য হতো না৷ মিডেলক্লাস ফ্যামিলির ছেলে বলে আমি হয়তো ওই ভিক্ষুকদের কষ্টটা টের পেতাম৷ তাকে ছেড়ে দেওয়ার এটি একটি অন্যতম কারণ ছিল।
সে রিক্সওয়ালাদের যেন মূল্যই দিতো না৷ মুরুব্বীদের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করতে হয় এই ব্যাপারটা হয়তো তার জানাই নেই৷ তার শিক্ষায় ছিল না ব্যাপার গুলো৷ ভার্সিটির ভেতরে মতিন চাচা ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন৷ সে কখনই সেই ঝালমুড়ি খেতে চাইতো না৷ তার এসব অহস্য লাগে৷ ঘৃণা লাগে। আমি তাকে বারংবার নিষেধ করেছি৷ সে আমার নিষেধাজ্ঞা মানতে পারেনি৷ আমি তাকে এসব ছেড়ে দিতে বললাম। কিন্তু সে তা পারতো না৷ তার ভেতরটায় যে অহংকারবোধটা লেপ্টে আছে। আমি তাকে সঠিক পথ দেখাতাম। সে তা উপেক্ষা করতো৷ আমি বলতাম, “তবে আমার সঙ্গ ছাড়ো। তোমার এমন কর্মকাণ্ড আমার পছন্দ না৷” সে সেই বেলা কেঁদেকেটে পার করতো। আমি রাগ করে থাকতাম। সে রাগ ভাঙ্গানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতো৷ ক্ষমা চাইতো৷ আমি তাকে ক্ষমা করতাম। সুযোগ দিতাম এসব ত্যাগ করার। মিহিন কখনই সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেনি।
আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেদের উপর পারিবারিক চাহিদা প্রবল থাকে। তাদের পিতামাতা চান ছেলে বড় হয়ে চাকরি করবে। দুর্দিন থেকে সুদিনে ফিরবে। এছাড়াও প্রত্যেকের নানান চাহিদা৷ এসব চাহিদার ভাজে আমি একটা সময় খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার মনে হলো মিহিন আমার ওই পরিবারে টিকবে না৷ আমার মা চায় রান্না জানা বউ। অথচ মিহিনকে এখন পর্যন্ত রান্নাঘরে যেতেই হয়নি। মিহিন নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করে৷ অথচ আমাদের রিক্সার ভাড়াটাও বাঁচিয়ে চলতে হয়। কোথায় গাছ কোথায় মাছ। এই ব্যপারে আমি অত্যন্ত চিন্তায় পড়ে যাই৷ এক সময় আমি ভাবতে শুরু করি যে মিহিনের সাথে আমার কিছু হবে না৷ এসব প্রেম-ট্রেম বাদ দিতে হবে৷ আমি সেটাই করলাম। অঙ্কুরেই আমাদের অদৃশ্য প্রেম প্রেম খেলার নাশ ঘটল।
আমি তার ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিলাম। মিহিনকে বললাম, “সে অহংকারী। আমি তাকে অনেক সুযোগ দিয়েছি। আর নয়।” তাকে ছেড়ে দিলাম। তার ভাইয়ের সাথে কথা ছিল তিনি এই টাকার ব্যাপারটা গোপন রাখবেন। কিন্তু অয়ন চৌধুরী তা করলেন না৷ তিনি এখানে একটা গেম খেললেন। আমাকে টাকা দেওয়ার সময় তিনি মিহিনকে আড়ালে ডেকে রেখেছেন। তা আমি জানতাম না। আমি যখন টাকাটা নিতে যাবো তখনই মিহিন আমার সামনে চলে আসে৷ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টিতে এতো ঘৃণা ছিল যা বলার মতো না৷ আমি সেই ঘৃণায় ভরা চোখ দুটোর কথা কল্পনা করলেই শিউরে উঠি৷ ফোনটা আবার বেজে উঠলো৷ হঠাৎ শব্দে ঘোর ভাঙ্গল আমার। আমি ধরবো না ধরবো করেও ধরে ফেললাম। কল রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই অয়ন চৌধুরীর আহত স্বর শুনতে পেলাম,
-হ্যালো, তাসফি বলছো? আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। তিনি আবার মলিন স্বরে বললেন,
-তাসফি?
আমি খানিকটা অবাক হলাম। এই লোকের আবার কী হলো? সব সময়ই তো তার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত কঠিন থাকে। এখন এমন বিমর্ষ লাগছে কেন? আমি নেহাত অনিচ্ছার স্বরে বললাম,
-বলুন।
-তুমি কোথায়?
-কেন?
-তোমাকে খুব প্রয়োজন।
-আপনার মতো মানুষের আমার কাছে কী প্রয়োজন থাকতে পারে?
-প্লীজ, এভাবে লজ্জা দিও না৷ প্লীজ৷
আমাকে এবার যেন আরো হতভম্ব হতে হলো। নিষ্ঠুর এই মানুষটার স্বরে এতোটা কোমলতা কেমন জানি বেমানান লাগলো। বললাম,
-কী হয়েছে? তিনি দ্রুত বললেন,
-তোমাকে একটা এড্রেস মেসেজ করেছি। হাসপাতালের এড্রেস। একটু আসতে পারবে? তোমাকে এখানে খুব প্রয়োজন৷
এবার আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো। আমার ভয় হতে থাকলো মিহিনকে নিয়ে। মেয়েটা কিছু করে বসলো না তো? আমি ভয় পেয়ে গেলাম। শরীর যেন শীতল হয়ে এলো। হাত-পা অবশ অবশ লাগছি৷ আমার বারবার মনে হচ্ছিল মেয়েটার খারাপ কিছু হয়েছে৷ অবশ্যই খারাপ কিছু৷ আমার ভেতরটা কেমন কুকড়ে উঠলো৷
মেয়েটা শেষ যেদিন আমার কাছে এসেছল আমি মোটামুটি তাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম৷ মেয়েটাকে উন্মাদের মতো লাগছিল৷ তার উসকোখুসকো চুল, ফ্যাকাসে চেহারা, খাদে ডুবে থাকা চোখ দুটো দেখে আমি যেন আৎকে উঠছিলাম। আমার ভেতরটা একদম নড়ে উঠছিল৷ আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মেয়েটাকে এমন অবস্থায় দেখতে হবে৷ আমি কিছু বলতে পারলাম না। চুপচাপ বসে থাকলাম। সে আমার কাছে এসে কেমন মলিন স্বরে বলল,
-এমন করবে আমার সাথে?
আমার মনে হলো মেয়েটার কান্না গলা পর্যন্ত এসে জমে আছে। কথাও ঠিক মতো বলতে পারছে না। সে কান্না চেপে কথা বলছে। মেয়েদের কান্না চাপা স্বরটা এতোটা শক্তিশালী যে সামনের মানুষটার কঠিন মনটা মূহুর্তে গলিয়ে দিতে পারে৷ আমার মনটা অনেক আগেই গলে গিয়েছে। আমি কেবল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার ইচ্ছে হলো আমি মেয়েটাকে এখনই জড়িয়ে ধরি৷ তাকে আমার বুকের সাথে মিশিয়ে রাখি৷ তাকে আঁকড়ে ধরে বলি, “আমি হারিয়ে যাইনি৷ আমি আছি।” অথচ আমি এমন কিছুই করতে পারলাম না৷ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটা আবার বলল,
-এমন কেন করছো? দেখো আমার দিকে! আমার অবস্থা দেখছো? আচ্ছা, আমার জন্যে কি একটু মায়াও হয় না তোমার? আমি চুপ করে থাকলাম। এমন একটা ভাব করলাম যে আমি তার কথা যেন পাত্তাই দিচ্ছি না। মিহিন আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আমি একবার আড়চোখে তাকে দেখলাম। তার চোখ জলে ছলছল করছিল৷ এক ফোটা টুপ করে পড়লো তার গাল বেয়ে৷ আমার ভেতরটা যেন নিমিশেই পানি হয়ে গেল। আমি বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলাম। মেয়েটা ভেজা স্বরে বলল,
-তুমি জানো, আমার মা নেই৷ বাবা থেকেও নেই৷ ভাইয়া আর বাবা মিলে নিজেদের কোম্পানি দেখছেন। তাদের লক্ষ্য কোম্পানিকে ডেভলপ করা। আমার দিকে তাদের খেয়ালই ছিল না যেন। তাসফি, আমাকে সেভাবে কখনই গড়ে তোলা হয়নি৷ আমি নিজের মতো গড়ে উঠেছি৷ নিজে যা ভালো মনে করেছি সেটা এ যাবত ভালো মনে করে এসেছি। যা খারাপ তাকে এ যাবত খারাপই ভেবেছি৷ আমাকে কখনও বলা হয়নি এটা খারাপ, এটা করো না৷ এটা ভালো, এটা করো। তুমি বুঝতে পারছো আমার অবস্থা? আমি কীভাবে মানুষ হয়েছি? ছোট বেলা থেকে কীভাবে বড় হয়েছি? এসব তো তুমি জানো। তারপরও আমাকে কেন আরেকটা সুযোগ দিচ্ছো না? তুমি সাহায্য করলে আমি অবশ্যই এই অভ্যাসটা ত্যাগ করতে পারবো। আমাকে আর কেউ অহংকারী বলবে না৷ এই ব্যাপারটাতে আমারো যে খারাপ লাগে!
আমি চুপ করে থাকলাম৷ কিছুই বলার ছিল না আমার। আমি তার ভাইয়ের কাছ থেকে অর্ধেক টাকা নিয়ে নিয়েছিলাম ততোদিনে। বাকিটা মিহিনের সাথে আমার পরিপূর্ণ বিচ্ছেদের পর পাওয়া যাবে৷ আমি বললাম,
-মিহিন? তোমাকে আমি কি সেই সুযোগ দেইনি?
-দিয়েছো৷ অনেকবার দিয়েছো। এই আমার শিক্ষা হয়েছে৷ এই যে রাত জেগে থাকি আজকাল, ঘুম হয় না, খাওয়া দাওয়া ঠিক ভাবে হয়, এসব থেকে আমি শিখছি৷ নিজের শাস্তি হিসেবে মাথা পেতে নিচ্ছি৷ তুমি জানো না, তোমার সাথে কথা না বলে আমার পাগলের মতো লাগে৷ দম বন্ধ হয়ে আসে যেন৷ হাসফাস লাগে৷ মনে হয় কী যেন নেই৷ কিছু একটা যেন হারিয়ে গেছে৷ ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে উঠে তাসফি। মনের ভেতরের ব্যাথাটা এই পৃথিবীর কেউ দেখে না৷ কেউ না৷ কতোটা কষ্ট সেখানে জমে আছে তা যদি তুমি দেখতে তাহলে আমার সাথে এমন করতে না৷ তবুও এসব সয়ে নিচ্ছি আমি। শাস্তি পাচ্ছি। তোমার যা ইচ্ছে শাস্তি দাও৷ আমি মাথা পেতে নিবো৷ তবে তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো না প্লীজ৷ আমার বুকের ভেতর যেন ঝড় বইছিল৷ আমি সেই ঝড় আগলে রেখে খুব নীরবে রুক্ষস্বরে তার পাশ কাটিয়ে এসেছি। তার পিছু ছাড়িয়েছি৷ সেই সময়ই আমার মনে হচ্ছিল মেয়েটা কিছু একটা করবে৷ তাকে আমার ঠিক লাগছিল না৷ আমি মলিন স্বরে বললাম,
-মিহিনের কিছু হয়েছে?
অয়ন চৌধুরী প্রথমে জবাব দিতে পারলেন না৷ ফোনের ওপাশে খানিকটা নীরবতা নেমে এলো যেন৷ উনার মুখ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছিল না৷ আমি আবার বললাম,
-ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না ভাই। তিনি কেমন ধরে আসা স্বরে বললেন,
-প্রেশার একদম লো৷ খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করছিল না৷ ঘুম হয় না৷ আজ দুপুরে অনেকক্ষণ তার রুমের দরজা বন্ধ ছিল৷ আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। অনেক ডাকলাম, দরজা খুলছিল না৷ বাধ্য হয়ে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকলাম। তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেলাম বিছানার উপর৷ তাসফি, ওকে যদি তুমি একবার দেখো, তবে তুমিও ভয় পেয়ে যাবে৷ চেহারার সমস্তা কোমলাতা যেন রুক্ষতায় পরিনত হয়েছে। তুমি চলে এসো প্লিজ৷ আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।
আমি বললাম,
-ও ঠিক আছে?
-হ্যাঁ। কন্ডিশন ভালো৷ কিন্তু গায়ে বেশ জ্বর। ঘুমের ঘোরের তোমার নাম নিচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে তুমি এখানে থাকলে ভালো হবে। ওর মন কিছুটা ভালো হবে৷ আমার বুকটা কেমন পাতলা হয়ে এলো৷ চাপা চাপা ভাবটা হাওয়া হয়ে গেল। এতোক্ষণ মনে মনে হচ্ছিল শ্বাস নিতে পারছি না৷ অক্সিজেনের যেন ভীষণ অভাব৷ একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
-আপনার কেন মনে হচ্ছে আমাকে দেখলে ওর মন ভালো হবে?
-ওর তোমার নাম নিচ্ছে৷ তোমাকে ডাকছে৷ তোমাকে সে ভালোবাসে!
-ভালোবাসার বিপরীত জিনিসটা হচ্ছে ঘৃণা৷ যতো বেশি ভালোবাসা হবে বিপরীতে ততো বেশি ঘৃণা জন্মাবে৷ আপনিই তো আমাকে তার সামনে ধরিয়ে দিলেন। ঠিক সেই মূহুর্তে কী হয়েছে জানেন? তার সমস্ত ভালোবাসা বিপরীত হয়ে গিয়েছে৷ সেগুলো এখন ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়েছে৷ সাধারণ ঘৃণা নয়৷ মারাত্মক ঘৃণা৷ এসব আপনি বুঝবেন না ভাই৷ আবেগ অনুভূতি যে আপনার মাঝে নেই তা বেশ বুঝা যায়৷
-আমি সে ব্যাপারটার জন্যে লজ্জিত৷ প্লীজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার জীবনের মহা ভুল ছিল এটি৷ এর জন্যে আমি যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত।
-আপনি যে কোনো কিছু করতে পারবেন? আপনি পারবেন তার ভেতরে ঘৃণা গুলো আবার ভালোবাসায় রূপান্তরিত করতে? পারবেন আমার ভেতরের অপরাধবোধটা মুছে দিতে? এসব এতো সহজ না৷ মানুষ হারানো সহজ৷ তবে সেই হারানো মানুষটিকে ফিরে পাওয়া কষ্টকর। সেই কষ্টটা কেবল যে হারায় সে-ই বুঝে৷
-আই বেগ ইউ৷ প্লীজ।
-ক্ষমা করবেন আমায়৷ আমি ওখানে গেলে হয়তো ও আরো অসুস্থ হয়ে যাবে৷ আমাকে দেখে রেগে যাবে৷ আমি তা চাই না৷ আর কতো ক্ষতি করবো ওর?
আমি ফোনটা রেখে দিলাম। ফোন বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম আবার৷ শুয়ে থেকে লাভ নেই জানি। ঘুম আর আসবে না৷ তবুও আমি শুয়ে থাকলাম। শরীরটা কেমন জানি অসাড় লাগছিল৷ আমার সমস্ত কিছু ভেঙ্গে আসছিল যেন৷ মাথার ভেতরটা যেন ভোঁ ভোঁ করছে৷ মিহিনকে দেখার ইচ্ছে হলো ভীষণ। কিন্তু তাকে এই চেহারা দেখাবো কীভাবে? এই দালাল রূপ দেখে সে নিশ্চয়ই আঁৎকে উঠবে? আমি আবার উঠে বসলাম। আমার অস্থির লাগছে৷ হার্টবিট যেন বেড়ে যাচ্ছে৷ গলা শুকিয়ে আসছে যেন৷ মিহিনেরও নিশ্চয়ই এমন হয়েছে৷ বেচারি কতো কষ্ট পেল আল্লাহই ভালো জানে৷ আমি নিজেকে কখনই ক্ষমা করতে পারবো না৷ কখনই না৷ আমি উঠে গিয়ে পানি খেলাম। ঠিক সে সময় সাদিক এলো রুমে। সে আমার রুমমেট, বন্ধু, ভাই। আমার সম্পর্কে সব কিছুই জানা তার৷ সে এসেই আমাকে ডাকতে থাকলো। আমি বিছানার কাছে এলাম। সাদিককে কেমন ক্লান্ত লাগছে। হাঁপাচ্ছে সে৷ দৌড়ে এসেছে যেন। আমাকে কিছু বলতে হলো না৷ সে নিজেকে সামলে বলল,
-মিহিনের ভাইয়া তোকে ফোন দিচ্ছেন। ধরছিস না কেন? আমি বিছানায় গিয়ে বসলাম। বললাম,
-তোকেও ফোন দিয়েছে নাকি?
-হ্যাঁ৷ আমাকে অনুরোধ করেছেন৷ আমি যেন তোকে নিয়ে হাসপাতালে যাই৷ আচ্ছা, মিহিনের খবর পেয়েছিস? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
-পেয়েছি৷ সাদিক অবাক স্বরে বলল,
-পেয়েও এভাবে বসে থাকবি তুই? যাবি না? চল? আমি চুপচাপ বসে থাকলাম বিছানার উপর। আমার মাঝে কেমন অনাগ্রহ ভাব। সে ভ্রু কুচকে বলল,
-কী ব্যাপার?
-কই কী ব্যাপার?
-মিহিন অসুস্থ। তোকে হাসপাতালে যেতে হবে৷ এটাকে তুই এতো নরম্যালি নিচ্ছিস কীভাবে? আমি খানিকটা চুপ থাকলাম। তারপর মৃদু হেসে বললাম,
-তাহলে কীভাবে নিবো বল? আমার কীভাবে নেওয়া উচিৎ?
-ওকে তুই ভালোবাসিস৷ তোর ভালোবাসার মানুষ অসুস্থ আর তুই সেখানে স্বাভাবিক বিহ্যাভ করছিস?
-তোর কী ইচ্ছা? আমার এখন অস্বাভাবিক বিহ্যাভ করা উচিৎ? আমি ওখানে গেলে ও ঠিক হয়ে যাবে?
-রাগছিস কেন? তোর যাওয়া উচিত। তাই বারবার বলছি৷
-যাওয়া উচিৎ তখন হতো যখন তার মনে আমার জন্যে ভালোবাসা থাকতো। যেই মন্যে রাজ্যের ঘৃণা, সেই মনের মানুষ যদি ঘৃণার কারণটিকে সামনে দেখে তবে তার রেগে যাওয়া কি স্বাভাবিক নয়?
-তোর মনে হয় মিহিন তোকে ঘৃণা করে? তোকে দেখে রেগে যাবে?
-সেদিন আমাকে যখন চড় দিয়ে আমার সামনে থেকে বিদায় নিয়েছিল তখন আমি তার চোখ ভরা ঘৃণা দেখেছি৷ এতো ঘৃণা আমি এ যাবত কারো চোখে দেখিনি। সাদিক চেহারাটা খানিক সরল করে বলল,
-মিহিন তোকে চড় দিয়েছিল?
-হ্যাঁ৷ লজ্জায় তোকে বলিনি। সেদিন ওর ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সময় সে দেখে যায়। এগিয়ে এসে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে কষিয়ে একটা চড় মারে। তারপর চলে যায়৷ আমি তখনই ভেবে নিয়েছিলাম। তার এই যাওয়া শেষ যাওয়া৷ সে আর কখনই আমাকে চাইবে না৷ আর চাইলেও আমি কোন মুখে তার সামনে যাবো?
-কোন মুখে মানে? আমি হাসলাম। বললাম,
-আমি তো একজন বিক্রেতা। অনুভূতি বিক্রি করে টাকা নিয়েছি। আমাদের প্রেমকে নিলামে উঠিয়েছি৷ এটা ভাবতেই আমার নিজের প্রতি ঘৃণা যাবে৷ ছিহ! কী করলাম এটা?
-তুই তো আর সে টাকা নিজের জন্যে নেসনি। সেগুলো তুই দান করে দিয়েছিস।
-কিন্তু অনুভূতি তো ঠিকই বেচে দিয়েছি৷ সেই অপরাধবোধটাই আমাকে এক দিক দিয়ে মারছে৷ অন্যদিকে মিহিন হারানোর বেদনা। সাদিক, আমি মনে হয় জলদিই পাগল হয়ে যাবো রে।
-বাজে বকিস না।
-বাজে বকছি না৷ আমার তাই মনে হচ্ছে। মাথার ভেতর গণ্ডগোল দেখা দিচ্ছে৷ আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিতে চাচ্ছিলাম। সাদিক সেই প্রসঙ্গ আবার টেনে বলল,
-তাহলে তুই যাবি না?
-আমি আমার এই চেহারা কখনই তাকে দেখাবো না৷ আমার চেহারা নষ্ট চেহারা৷ আমি নষ্ট মানুষ। পৃথিবীর সবচে খারাপ মানুষ।
দু সপ্তাহ পর থেকে মিহিন নিয়মিত ভার্সিটি আসা শুরু করে দেয়৷ তাকে যেন পুনরায় সতেজ দেখায়৷ পূর্বের সেই উচ্ছ্বসিত যুবতি তার নতুন রূপ ফিরে পেয়েছে৷ আড়ালে আমি তার এমন রূপে সত্যিই বেশ আনন্দিত। মিহিনকে না হয় আমার পাওয়া হলো না, আমাদের না হয় একসাথে সন্ধ্যা দেখা হলো না, কিংব আমরা ভোরে উঠে একসাথে হাঁটিনি, তবুও স্বল্প সময়ে মেয়েটা তার অনুভূতি দিয়ে আমাকে যতোটা ছুঁয়ে দিয়েছে, যতোটা আনন্দ দিয়েছে এর জন্যে আমি সারা জীবন তার কাছ ঋণি থাকবো৷ সব প্রেমের যে মিলন হতে হবে তা তো নয়৷ কিছু কিছু প্রেম অধরাতেই অনিন্দ্য হয়৷ আমি এসব ভেবে নিজেকে শান্তনা দিতাম৷ কিন্তু মেয়েটাকে দেখলেই আমার পুরনো স্মৃতি গুলো কেমন সতেজ হয়ে যায়৷ আমি তাকে ভীষণ করে চাইতে শুরু করি। অন্যায় চাওয়া৷ মন সব সময় অন্যায় চাওয়ার প্রতিই বেশি প্রলুব্ধ হয়।
আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় লেগে যাই৷ মিহিনকে দূরে দেখলেই আমি মাথা নিচু করে নেই। কিংবা এমন একটা ভাব করি যেন মিহিন নামের কোনো মেয়েকে আমি চিনি না৷ আমার সামনে দিয়ে এই নামে কোনো মেয়েই হেঁটে যাচ্ছে না৷ কে জানি সেই অভিনয়টা কেমন হয়৷ তবে আমি নিত্য সেটা করে যাই৷ আরো একটা বছর এই ভার্সিটিতে থাকতে হবে৷ আমি চাই শেষ বছরটা অন্তত শান্তিতে যাক। একদিন সন্ধ্যার কথা বলে গল্প শেষ করছি৷ সেই সন্ধ্যায় আমি একা একা বের হয়েছিলাম। আমার বের হওয়ার মূল উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে নিজের ভেতরের তোলপাড় কিছুটা লাঘব করা৷ এই কোলাহল, গাড়ির হর্ণের শব্দ, আকাশের চাঁদ কিংবা মৃদু বাতাস যেন মনটাকে অন্যদিকে খানিকটা ব্যস্ত করে তোলে৷ আমি কিছুটা সময় শান্তি অনুভব করতে চাই৷ আমার মনে হয় বাইরে এসে হাঁটলে তা সম্ভব।
ফুটফাত ধরে হাঁটছিলাম৷ এর পাশে পার্ক। অনেক প্রেমিক-প্রেমিকারা এখনও ঘরে ফেরেনি৷ কেউ রাস্তার ধারে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কেউবা ফুটফাতে বসে গল্প করছে৷ পার্কের ভেতর কী ঘটছে কে জানে৷ আমি সেদিক খেয়াল দিলাম না। সোজা হাঁটতে থাকলাম। ঠিক এমন সময় দেখলাম মিহিন দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি হঠাৎই থমকে দাঁড়ালাম। আমার সমস্ত পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়ালো। মেয়েটা আমার থেকে কয়েক হাত দূরে। বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। আমার মনে হলো ওর চোখের দিকে তাকালেই ঝামেলা হবে। আমি আর চোখ সরাতে পারবো না৷ আমি কী করবো ভেবে পেলাম। চট করেই পেছন ফিরে গেলাম৷ সামনে পাঁ বাড়াবো ঠিক তার আগেই তার স্বর ভেসে এলো,
-দাঁড়াও। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম৷ আমার মনে হলো আমি বরফ হয়ে গিয়েছি। জমে গিয়েছি একদম। গা শীতল হয়ে আসছে। মিহিন আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার চোখ চোখ রাখলো। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। মেয়েটার গা থেকে কেমন মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে। মিহিন বলল,
-এমন লুকোচুরি খেলা কতোদিন চলবে? আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। আমার কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই৷ থাকলেও আমার পক্ষে জবাব দেওয়া সম্ভব না৷ মিহিন আবার বলল,
-আমার একটা খুন করতে ইচ্ছে করছে৷ হাতের ধারে কিছু নেই৷ তা না হলে এক্ষুনি খুনটা করে ফেলতাম। মিহিন হঠাৎই কেমন জানি ফোস ফোস করতে থাকলো। রাগে তার শরীর কাঁপছে যেন৷ নাকের ডগাটা লালচে হয়ে আছে৷ আমি বুঝতে পারলাম না হঠাৎ এতো রাগের কী ঘটলো৷ মিহিন বলল,
-হাসপাতালে আমাকে দেখতে এসেছিলে কেন? আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে৷ বললাম,
-কই? আমি তো দেখতে যাইনি।
-মিথ্যা বলা কবে শিখছো? অবশ্য ইদানীং তো তুমি অনেক কিছুই শিখে যাচ্ছো৷ আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মিহিন বলল,
-তুমি কী ভাবছো? আমি টের পাবো না? আমি ঠিকই টের পেয়েছি। দরজার আড়ালে যে কেউ আমাকে দেখছিলো। সাদিককে ফোন করে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি৷
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। এভাবে ধরা খেয়ে যাবো ভাবিনি। সাদিকের উপর খুব রাগ হলো। ব্যাটাকে পেলে দিতাম ক’টা। ওকে সাথে নেওয়াই ভুল হয়েছিল। মিহিনকে আমি সত্যি সত্যিই দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যার দিকে আমার মনে হচ্ছিল আমি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো৷ মিহিনকে না দেখলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। আমার অস্থিরতা কিছুতেই কমছিল না৷ সব কিছু কেমন এলোমেলো লাগছিল৷ পরে আর সাতপাঁচ না ভেবে চলে গেলাম হাসপাতালে। এমন ভাবে গেলাম যেন মিহিন কেন, তার ভাইও যেন টের না পায়৷ কিন্তু এই মেয়ে কীভাবে জানি টের পেয়ে গেল৷ আশ্চর্য ব্যাপার৷ টের পাওয়ার তো কথা না? মিহিন বলল,
-মুখটা এমন করে নিলে কেন? আমি জবাব দিলাম না। মিহিন আবার বলল,
-তা হাসপাতালে আমাকে দেখতে এসেছিলে কেন? আমি কী জবাব দিবো ভেবে পেলাম না৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়েটা এবার কঠিন স্বরে বলল,
-জবাব দাও? আমি ভীতু স্বরে বললাম,
-পরিচিত একজন অসুস্থ ছিল৷ তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন ভাবলাম তোমাকে দেখে আসি। মিহিন দু’হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
-তাহলে আমার বাড়িতে তোমার কোন পরিচিত অসুস্থ ছিল যে প্রায়ই আমার বাড়ির আশেপাশে তোমাকে দেখা যেত? তাও আবার লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে। কাহিনী কী? আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমার কাছে এসব প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট জবাব নেই৷ মিহিনের বাড়ির আশেপাশে আমি গিয়েছি কেবল তাকে এক নজর দেখতে। কিন্তু এসব এই মেয়ে টের পেল কীভাবে? আমি তো যথার্থ লুকিয়ে থাকতাম৷ সে জানলো কীভাবে? মিহিন বলল,
-তা আজ যাচ্ছো কই? আমার বাড়ির ওইদিকেই? আমি মাথা নিচু করেই রাখলাম। আমি আসলেই মিহিনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। ভাবলাম হাঁটতে হাঁটতে সেদিকটা ঘুরে আসা যাক৷ মনটাও খানিকটা দ্রুত ফ্রেশ হবে৷ মিহিন আমার জবাবের আশা না করে বলল,
-এসব কেন করো শুনি? করে কী লাভ? তুমি কি ভাবছো আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো? আমি অন্যদিকে তাকালাম। নিজেকে বোবা মনে হচ্ছিল। কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলাম না৷ মিহিন আবার বলল,
-এদিকে, আমার চোখের দিকে তাকাও। দেখো কী পরিমাণ ঘৃণা আমার চোখে৷ তারপরও কেন বারবার সেদিকে ছুটে যাও? কিসের আশায়? আমি এবার মুখ খুললাম। বললাম,
-কোনো কিছুর আশাতে আমি যাই না৷ আমার ইচ্ছে হয়৷ তাই যাই৷
-কেন? আমার বাসার ওদিকেই কেন তোমাকে যেতে হবে?
-ওখানে আমার খুব কাছের কেউ থাকে?
-হাহা, কাছের? এই শব্দটা তোমার মুখে মানায় না।
-আমার মুখে অনেক কিছুই মানায় না৷ এই যে হাসি দেই না? এটাও মানায় না৷ তাই বলে কি আমি হাসা ছেড়ে দিবো? কক্ষোনো না।
-তোমাকে হাসা ছাড়তে বলিনি৷ বলেছি আমি যাতে তোমাকে ওইদিকে আর যেতে না দেখি।
-কেন?
-আমার অসহ্য লাগে। আমি চুপ হয়ে গেলাম। মিহিন আবারও বলল,
-এসব ন্যাকামো আর ভাল্লাগে না। অসহ্য লাগে। আমি চুপ করে থাকলাম। মিহিনও চুপ থাকলো। আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। অনেকটা সময় বেশ নীরবতায় কাটল। শেষে মিহিন বলল,
-আমি টিপ দেয়া ছেড়ে দিয়েছি। কাজল দেওয়াও। লিপস্টিক দেই না অনেকদিন। এসবের সাথে আমি একজনকে প্রচণ্ডরকম ভালোবাসাটাও ছেড়ে দিয়েছি। তার ভাবনা ত্যাগ করেছি। মানুষটাকে ঘৃণা করতে শুরু করি। আমার ভীষণ ঘৃণা হয়৷ একটা ছোট লোককে ভালোবেসেছি আমি যে আমার অনুভূতি বিক্রি করে দেয়৷ আমার আবেগের মূল্য দেয় না৷ আমাকে কষ্ট দেয়৷ কিন্তু এসবের পরে যখন আমি জানতে পারলাম মানুষটা এসব কেন করেছে, টাকা গুলো নিয়ে গিয়ে যে গরীবদের দান করেছে, আমি যে ভিক্ষুকদের চড় দিয়েছিলাম তাদেরকে খুঁজে টাকা গুলো দিয়ে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়েছে তখন আমি ভীষণ আনন্দ অনুভব করি। হঠাৎই আমার মনে কেমন জানি এক আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়৷ যে কাজটা আমার করা উচিৎ সেই কাজটা সে করে দিয়েছে৷ প্রবল আনন্দে আমার চোখে পানি চলে আসে। অনেকদিন পর আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদি আমি। মানুষটার প্রতি কেমন একটা টান আমার সব সময়ই ছিল৷ সেই টানটা যেন মূহুর্তে আরো অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়৷ আমার সমস্তা ঘৃণা পানি হয়ে যায়৷ আমি যেন আবার নতুন করে বাঁচতে শুরু করি৷
নতুন করে প্রেম জাগে৷ ভালোবাসা আঁকড়ে ধরে আমায়৷ অনেকদিন পর আমি শাড়ি পরি। কপালে টিপ দেই। চোখে কাজল মাখি৷ ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়ি৷ আমি এতো কিছু করলাম, এতো ভালো করে সেজে আসলাম অথচ যার জন্যে এসব করেছি সে আমার দিকে তাকাচ্ছে না। একটু দেখছেও না৷ এ যে কি যন্ত্রণার তা কি তুমি বোঝো ছেলে? আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম কেবল। অনেকক্ষণ পর চোখ রাখলাম তার চোখে৷ আমার গা কেমন শিরশির করে উঠে। তাজা এক গুচ্ছ শীতল অনুভূতি আমার সমস্ত দেহ ছুঁয়ে আমার হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করে যেন। মেয়েটাকে কেমন অন্য রকম লাগছে। অদ্ভুত এক প্রশান্তির ছায়া তাকে ঘিরে আছে যেন৷ চেহারা উজ্জ্বল। প্রচণ্ড খুশিতে যেমন উজ্জ্বল হয়৷ তার চোখ জোড়া চিকচিক করছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মিহিন আবার বলল,
-ভাইয়া না হয় ভুল করেছিল। কিন্তু তাসফি, তোমার তো বোঝা উচিৎ ছিল৷ তুমি তো আমাকে বুঝতে! তুমি তো জানতে তোমায় ছাড়া কষ্টরা আমায় কেমন কামড়ে ছিড়ে খায়? কী এক ঘোর লাগা কষ্ট আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল তা যদি বোঝাতে পারতাম তোমায়! মেয়েটা যেন চট করেই কান্না করে দিলো। আমার ভেতরটা একদম নাই হয়ে গেল। বুক কাঁপছিল৷ অনেকক্ষণ পর কাঁপাকাঁপা স্বরে বললাম,
-অপরাধবোধ কেমন হয় জানো? যখনই তোমার অপরাধটির কথা মনে পড়বে তুমি সেটা ভেবে কষ্ট পাবে। এমন কষ্ট যেন তুমি চোখের জলও ফেলতে পারবে আবার ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ব্যাথাও পাবে। আর যখন এটি মস্তিষ্কে ছেপে যায় তবে সারা বেলা তোমাকে একটু একটু করে মারবে৷ মারবে তবে মেরে ফেলবে না৷ মিহিন, আমি সেই কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি৷ আমার কষ্ট গুলো কেউ দেখেনা৷ আমি কাঁদিনা৷ পুরুষদের নাকি কাঁদতে হয় না৷
আমার চোখ ঘোল হয়ে আসে যেন৷ আমি ডান হাতে উল্টা পিঠ দিয়ে চোখের কোনা মুছে নেই৷ মিহিন চট করেই আমার হাত ধরে ফেলে। বলে,
-একটা নতুন শুরু চাই৷ স্নিগ্ধ ভোরের মতো একটা সতেজ শুরু৷ আমি শুরুটা তোমার সঙ্গে করতে চাই৷ কেবল তোমার সঙ্গে৷ তাসফি, তুমি কি আমার হবে? হুট করেই তোমাকে জড়িয়ে ধরার অনুমতি চাই আমি। দিবে অনুমতি? আমার পাগলামি গুলো তোমার সাথে করতে চাই৷ তোমাকে জ্বালাতে চাই৷ তোমাকে কষ্ট দিতে চাই৷ তোমাকে ভালোবাসতে চাই৷ আমার চাওয়া কি পূর্ণ হবে?
মিহিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল৷ আমিও তার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ কেউ কোনো কথা বলি না৷ তবুও যেন অনেক কথা বলা হয়ে যায়৷ অনেক অনেক গোপন কথা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটা অনুভূতির কথা খুব গোপনে চোখে চোখে বলা হয়ে যায়৷ বলাবলির শেষ পর্যায়ে সেই কাঙ্খিত জড়িয়ে ধরাটি সমস্ত কিছুর পূর্ণতা এনে দেয়৷ বিষাদ ভরা বুকে অজস্র ভালোবাসার পদ্ম ফোটায়। অনুভূতির রাজ্যে শীতল কিছু শিরশিরে অনুভূতির প্রবেশ ঘটে৷ এই অনুভূতি গুলো একদম নিষ্পাপ। প্রচণ্ড আনন্দ ঘন। মিহিন আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। আমিও তাকে নিজের বুকে সাথে মিশিয়ে রাখলাম। সে সেখানে থাকুক নিজের মতো। এটা তারই জায়গা। তারই সম্পদ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত