শিল্পীর শখটা আজও মাঠে মারা গেল।
পরপর তিন দিন একই ঘটনা।
এখন শিল্পীকে বোঝানো যাবে না। বেচারি শখ করে মোটরসাইকেলে উঠেছে। ইচ্ছে ছিল গ্রামের শেষ মাথার মহিষডোবা বিলের পাড় থেকে একটু ঘুরে আসবে। তা আর হচ্ছে কই! মাঝ পথে বখতিয়ারের মোবাইলে ফোন। ফোনের শব্দ শুনেই শিল্পী যা বোঝার বুঝে গেছে। দু’হাত দিয়ে বখতিয়ারের কাঁধ ধরেছিল সে, ফোন আসায় হাত দুটো ইতিমধ্যে সরিয়ে নিয়েছে।
ফোন করেছে বেপারিপাড়ার জয়নাল। পোলপাড়ে তার ফ্লেক্সিলোডের দোকান। বিপদ-আপদে গ্রামের লোকজন সেখান থেকে ফোন-টোন করে। বখতিয়ার হোন্ডা থামিয়ে কথা শেষ করার আগেই শিল্পী নেমে যায়।
আমি গেলাম।
গেলাম মানে!
গেলাম মানে, বিদায়। তোমার ফোন আইছে। অহন তুমি মানুষের সেবায় ঝাঁপাইয়া পড়বা। আমি জলে ভাসা পদ্ম; ভাসতে ভাসতে বাড়ি চলে যাই।
বখতিয়ার কথা বাড়ায় না। তাকে আসলেই যেতে হবে। মিলিটারি বাড়ির সুলেমানের বাপ নারিকেল গাছ থেকে পড়েছে। অবস্থা নাকি খুব খারাপ। দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
বখতিয়ার শিল্পীর হাত দুটো ধরে বলল, আইজও হইল না। এর পরের বার ইনশাআল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ হইবো।
গরম পাতিলে ছ্যাঁক খাওয়া ভঙ্গিতে হাতটা সরিয়ে নেয় শিল্পী।
এর পরে আমি আর তোমার হুন্ডায় উঠলে তো? দুই বছর ধইরা প্রেম করি, অথচ একটা দিন হুন্ডায় চইড়া পুরা রাস্তা যাইতে পারলাম না! তোমার হুন্ডারে আমার সালাম। তুমি অহন খাড়ায়া না থাইক্যা আমার চোখের সামন থিকা যাও।
বখতিয়ার এবারও কথা বাড়ায় না। কারণ সে জানে, শিল্পী যা বলছে, কোনোটাই তার মনের কথা না। মনের কথা মানুষ বারবার বলে না। মনের কথা বলে একবার। বখতিয়ার বুঝতে পারে, তার অদ্ভুত কাজ-কারবার শিল্পী মেনে নিয়েছে। এসব কাজে তার নীরব সমর্থনও আছে। তবে মুখে সব সময় উল্টোটা বলে। একদম বখতিয়ারের মায়ের মতো।
ছেলেকে নিয়ে বখতিয়ারের মায়েরও চিন্তার শেষ নেই। এই জামানায় এমন পাগল ছেলে হয় না। দিন-দুনিয়ার কোনো খবর নাই। সারাক্ষণ আছে গ্রামের মানুষ নিয়া। কার মাথা ফাটল, হাঁপানির চোটে কার যায় যায় অবস্থা, কোন বাড়ির বুড়া চাচার হার্টের অবস্থা দুর্বল_ সব খবর আছে বখতিয়ারের কাছে। শুধু নিজের বাড়ির খবরটা তার কাছে থাকে না। তার মা কীভাবে একা একা সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বখতিয়ারের সেদিকে খেয়াল নেই। ঘরের খেয়ে মানুষের অসুখ তাড়ায় সে। মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে তাই বেশ অসহায় বোধ করেন বখতিয়ারের মা।
কী যে ভূত ঢুকছে পোলাটার মাথায়! বুঝাইলেও বোঝে না। আজ তার স্বামী বেঁচে থাকলে তাকে এত চিন্তা করতে হতো না।
বখতিয়ারের বাবা মারা গেছেন বেশ কিছু বছর আগে। যখন তার বাবা এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যান তখন কিশোর বখতিয়ারের কিছুই করার ছিল না। এখন তার করার বয়স। কিন্তু বাবার জন্য করবে, সে সুযোগ নেই। বখতিয়ার তাই গ্রামের মানুষের জন্য করে। গ্রামের কারও অসুস্থতার খবর পেলেই হোন্ডা নিয়ে ছুটে যায়। তারপর রোগীকে হোন্ডায় তুলে পৌঁছে দেয় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কখনও কখনও এমন হয়, রোগীর সাথে যাওয়ার মতো কেউ থাকে না। তখন বখতিয়ার একাই রোগীকে নিজের কাঁধে-পিঠে বেঁধে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ কাজটা বখতিয়ারের নেশার মতো। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, গ্রামের একজন মানুষকেও বিনা চিকিৎসায় মরতে দেবে না। হায়াত-মউত যদিও আল্লাহর হাতে। কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব। বখতিয়ার সেই কাজটাই করে। তার ফোন নাম্বার গ্রামের বাড়ি বাড়ি দেওয়া আছে। নাম্বার লেখা কাগজ টানানো আছে মোড়ে মোড়ে। সবাইকে বলা আছে, কেউ অসুস্থ হলে যেন তাকে একটা ফোন দেয়। ফোন দিতে না পারলে অন্তত একটা মিস্ড কল। দিন-রাত চবি্বশ ঘণ্টা গ্রামের মানুষের জন্য তার হোন্ডা সার্ভিস খোলা।
বখতিয়ারের গ্রামের নাম কাকশেয়ালি। প্রত্যন্ত এক গ্রাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। তার ওপর গ্রামে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। ছোট-খাটো অসুখ-বিসুখে লাইসেন্স ছাড়া চিনু ডাক্তার, তাও চলে। কিন্তু বড় বিপদে তিনি হাত তুলে বসে থাকেন। তখন একমাত্র ভরসা আট-দশ মাইল দূরের থানা সদরের হাসপাতাল। যাতায়াতের মাধ্যম বলতে প্রধানত ভ্যান অথবা নৌকা। আট মাইল যেতে কখনও কখনও তিন-চার ঘণ্টাও লেগে যায়।
বখতিয়ার ও তার মোটরসাইকেল তাই গ্রামের মানুষের কাছে এক প্রকার আশীর্বাদ। হোন্ডায় করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে এ পর্যন্ত বহু মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে সে। এমনকি দু-চারজন নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রীও জীবন ফিরে পেয়েছে শুধু দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কারণে। বাড়ির লোকেরা যখন ধরেই নিয়েছিল- এ মানুষ আর ফিরবে না, তখন তাদের মরা কান্নার আয়োজনকে ব্যর্থ করে দিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে তারা। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, এর সবই হচ্ছে বখতিয়ার আর তার সাইকেলের কল্যাণে। লোকজন তাই বখতিয়ারের সাইকেলের নাম দিয়েছে ‘জীবন সাইকেল’।
তবে বখতিয়ারের এই হোন্ডাগিরি ব্যাপারটা এলাকার চেয়ারম্যানের একদম পছন্দ না। গ্রামের মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে অহেতুক এত মাতামাতি, সেটাও তার ভালো লাগে না। তিনি নিশ্চিত, এ সবকিছুর পেছনে বখতিয়ারের কোনো না কোনো মতলব আছে। শুধু শুধু ঘরের খেয়ে পরের জন্য কেউ নিজের হোন্ডার তেল পোড়ায় না। বখতিয়ার তাহলে কেন পোড়াচ্ছে? এই প্রশ্নটা চেয়ারম্যান সাহেবকে ভেতরে ভেতর অনেক দিন যাবৎ পোড়াচ্ছে। কিন্তু বখতিয়ারকে যুৎমতো ধরতে পারছেন না বলে বারবার সে পার পেয়ে যাচ্ছে। তবে তিনি হাতে ছাই মেখে বসে আছেন। সুযোগ পেলেই খপ করে ধরবেন।
কই যাও বদি?
হাতের লাঠিটা উঁচু করে ধরে পথ আটকে দাঁড়ান সবুর চেয়ারম্যান।
বখতিয়ার কই যাচ্ছে, সবুর চেয়ারম্যান সেটা ভালো করেই জানেন। তারপরও প্রায় প্রতিদিন এক প্রশ্ন। আর বখতিয়ারেরও এমন কপাল, সদর হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তাটা চেয়ারম্যানের বাড়ির ওপর দিয়ে। এতে অবশ্য লাভ-ক্ষতি দুটোই আছে। লাভের বিষয় হলো, যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে শিল্পীর সাথে দেখা হয়। শিল্পী চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ে। বখতিয়ার যখন কোনো ভালো কাজ করে তখন দু’জন মানুষের মুখ তার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। এক হচ্ছে তার মা, আর শিল্পী। তবে বেশির ভাগ সময় দেখতে হয় চেয়ারম্যানের মুখ। আর শুনতে হয় তার মুখের বাঁকা বাঁকা কথা।
কথা-ই সবুর চেয়ারম্যানের প্রধান সম্বল। তিনি কথার মাস্টার। এলাকার মানুষকে কথা দিয়ে ভুলিয়ে রাখেন। কাজ-বাজ কিছুই করেন না তেমন। লোকজন তার কাছে দাবি-দাওয়া নিয়ে এলে মুখে সব সময় এক সুর বাঁধা- সবুর করো।
গ্রামে ডিপ টিউবওয়েলের সংকট? সবুর চেয়ারম্যান ঘাড় নেড়ে বলবেন, সবুর করো। পানি একটু কম খাইলেও তো পারো।
প্রাইমারি স্কুলের টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়ে? সেখানেও তার ওই একই আশ্বাস- কয়ডা দিন সবুর কর মিয়ারা। চাল গ্যাছে তো হইছেডা কী? স্কুলের পাশে বটগাছ আছে। চাইলে সেইখানেও ক্লাস নেওয়া যায়। ইচ্ছাটাই হইল আসল। বুঝলা?
এই হচ্ছে সবুর চেয়ারম্যানের অবস্থা। একবার খালের ওপর কালভার্টের দাবি নিয়ে গ্রামের কয়েকজন মুরুবি্ব গেলেন তার কাছে। কালভার্ট দেওয়ার বদলে চেয়ারম্যান সাহেব তাদের কবিতা শুনিয়ে দিলেন-
তোমাদের ছোট খাল চলে বাঁকে বাঁকে,
বারো মাস সেই খাল খটখটা থাকে।
খালে নাই পানি। তাতে আবার কালভার্ট! কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। যাও, কিছু দিন নিচ দিয়া হাঁটাচলা করো। সবকিছু নিয়া এত তরাস করলে হয় না। দ্যাশে চেয়ারম্যান খালি আমি একলাই না। চাইর হাজার ৫৫১ জন চেয়ারম্যান আছে দ্যাশে। সবাই যদি একটা কইরা কালভার্ট চায়, তাইলে কয়টা কালভার্ট লাগে, হিসাব আছে? চাইর হাজার ৫৫১টা কালভার্ট প্রয়োজন। কালভার্ট তো মুখের কথা না_ বললাম আর হইয়া গেল। আর আমিও রূপকথার আলাউদ্দিন চেয়ারম্যান না যে, প্রদীপে ঘষা দিয়া দৈত্য হাজির করব। দৈত্য আইসা খালের উপর পদ্মা সেতু বানাইয়া দেবে। যাও। কয়টা দিন সবুর করো।
সবুর করতে করতে অতিষ্ঠ গ্রামের মানুষ চেয়ারম্যানের নাম দিয়েছে ‘সবুর’ চেয়ারম্যান। যদিও তার প্রকৃত নাম ইসমাইল মৃধা।
গ্রামের মানুষ যে আড়ালে-আবডালে তাকে অন্য নামে ডাকে, এ কথা চেয়ারম্যান সাহেব জানেন। কিন্তু নাম বদলে যাওয়া নিয়ে ইসমাইল মৃধা ওরফে সবুর চেয়ারম্যান মোটেও চিন্তিত না। কারণ সবুর নামটা তার কাছে খারাপ লাগে না। তিনি খোঁজ-খবর করে দেখেছেন, সবুর নামে দেশে অনেক বিখ্যাত মানুষের নাম আছে। এমনকি আল্লাপাকের ৯৯ নামের ৩৩ নম্বর নাম হচ্ছে আল হা’লীম, অর্থাৎ অত্যন্ত ধৈর্যশীল। সবুর নামটা এসেছে সেখান থেকে। জীবনে ধৈর্যের মূল্য আছে। এই যে বখতিয়ারের ব্যাপারে তিনি ধৈর্য ধরে আছেন, এরও নিশ্চয় একটা মূল্য পাওয়া যাবে।
বখতিয়ারকে নিরুত্তর দেখে চেয়ারম্যান সাহেব হোন্ডার ট্যাঙ্কে টোকা মারেন।
কী ব্যাপার? জবানে তালা মাইরা রাখছ ক্যান? কইলা না তো, কই যাও?
বখতিয়ার মাথা তুলে বলল, আমি কই যাইতাছি- সেইটা তো আফনে জানেন চাচা।
জানি। জানলে কি আবার বলা যাবে না? বাপ-মায়ের নাম তো পোলাপান জানে। তাই বইলা তাগো নাম মুখে নেওয়া বারণ?
হাসপাতালে যাইতাছি। জয়নাল ভাই নাইরকোল গাছ থিকা পড়ছে। অবস্থা সিরিয়াস।
চেয়ারম্যান সাহেব উঁকি দিয়ে হোন্ডার পেছনে নেতিয়ে থাকা লোকটাকে দেখেন।
দামড়া ব্যাডা পড়ছে নাইরকোল গাছ থিকা! কী জন্যে পড়ছে, জানো? তরাস করতে গিয়া পড়ছে। যদি সবুর করত তাইলে পড়ত না। সবার মইধ্যে খালি তরাস। ব্যাপারটা তোমার মইধ্যেও আছে।
বখতিয়ার মাথা নেড়ে বলল, জি আছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাইতে হইবো বইলা তরাস করতেছি। আফনে যদি গ্রামে একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র করতেন, তাইলে আমাগো তরাস করা লাগত না। কতবার কইলাম আফনেরে!
বখতিয়ারের মুখে পুরনো কাসুন্দি শুনে চেয়ারম্যান সাহেব গলা খাকারি দেন।
তোমার সাথে কথা বলা মুশকিল। খালি বাসি কথা আর ত্যাড়া আলাপ। তোমার কাম-কাইজ যেমন আমার পছন্দ না, তেমনি কথাও পছন্দ না। বুঝলা?
ক্যান চাচা? আমি আবার কী করলাম?
কী করছ জানো না? আগে পুরুষ মানুষ নিয়া ছিলা; কিছু বলি নাই। ইদানীং শুনতেছি, ঘর থিকা মেয়ে-ছেলেরে টান দিয়া হোন্ডায় উঠাইতেছ। তোমার সাহস দিন দিন বাইড়া যাইতেছে বদি।
চেয়ারম্যান সাহেব গরম চোখে তাকালেও বখতিয়ার জবাব দেয় নরম সুরে।
মেয়ে-ছেলেরে উঠাইছি- এই কথা ঠিক না চাচা। আমি উডাইছি রোগী। আর রোগীর কোনো মেয়ে-ছেলে নাই। জিনে ধরার কথা কইয়া মাইয়াডারে মাইরা ফালাইতেছিল সবাই মিল্লা। আমি অরে হাসপাতালে নিয়া গেছি। এইখানে আফনে দোষের কী দেখলেন!
দোষের কী দেখলাম মানে? হাসপাতালে কি জিনে ধরার চিকিৎসা হয়? আমাগো হাসপাতাল চিনাও? আমরা সব বুঝি। এই সব বন্ধ কর তুমি। গ্রাম-গঞ্জ বাংলা সিনামার জায়গা না। এইখানে একটা সমাজ-নমাজ আছে। বেশি বাইড়ো না কইলাম। ঝড়ে পইড়া যাইবা।
চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শুনে এবার বখতিয়ার না হেসে পারে না।
কী যে কন চাচা? মানুষ বাঁচলে হের পরে না আফনের সমাজ-নমাজ। আমারে আমার কাম করতে দেন। আফনে সমাজ নিয়া থাকেন।
ত্যাড়া কথা বলবা না বদি। একদম ত্যাড়া কথা বলবা না। তোমার ত্যাড়া কথা শোনার জন্য আমি চেয়ারম্যান হই নাই।
আগের হাসিটাকে আরেকটু লম্বা করে বখতিয়ার বলল, ঠিক আছে চাচা। বলব না। এখন তাইলে আমি যাই? রোগীর অবস্থা সিরিয়াস।
যাও যাও। তয় যাইবার আগে ফাইনাল কথাডা শুইনা যাও- তোমার রোগী যেমন সিরিয়াস, আমার কথাও কিন্তু তেমুন সিরিয়াস। এইসব ছাড়ান দেও। নইলে খবর আছে কইলাম।
বখতিয়ার কথা বাড়ায় না। একটা হাসি দিয়ে হোন্ডায় টান দেয়।
চেয়ারম্যান সাহেব তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু তার চোখে লেগে থাকে বখতিয়ারের হাসি। তাচ্ছিল্যের হাসি।
চেয়ারম্যান সাহেব বিড়বিড় করে বলেন, আমারে ভূগোল পড়াও। আমি হইলাম ভূগোলের মাস্টার।
চেয়ারম্যানের সাগরেদের নাম ‘চায়নিজ চুন্নুু’। তার কাজ হচ্ছে সারাক্ষণ চেয়ারম্যানের মাথার ওপর একটা চায়নিজ ছাতা ধরে রাখা আর সময়ে সময়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে কু-পরামর্শ দেওয়া।
চুন্নু তার ছোট ঘাড়ের বড় মাথাটা চেয়ারম্যানের কানের কাছে নিয়ে জানাল, চেয়ারম্যান সাব, আর বুঝি ঠেকাই রাখতে পারলেন না।
হাঁটা থামিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব চোখ বড় করে ঘাড় ঘোরান।
কারে আবার? বখতিয়াররে। আফনের কথারে তো ও পাত্তাই দিতাছে না। গরিবের কথা বাসি হইলে ফলে। আফনের কথার হেই মূল্যও নাই।
কী কছ?
হ। আফনে বখতিয়াররে বলছেন, এইসব থামাও। হে আরও বাড়াই দিছে। সাইকেলের গতি তুলছে ঘণ্টায় হান্ডেড। গ্রামের মইধ্যে একটা ভোঁ ভোঁ শব্দ উঠছে। মানুষজন সমানে অর পিছে দৌড়াইতেছে। সবার মুখে মুখে বখতিয়ার রব। চেয়ারম্যানের নাম কেউ মুখেও নেয় না। আফনের দিন বুঝি শ্যাষ।
চুন্নুুর কথা শুনে চেয়ারম্যান সাহেব বিরক্ত হন।
তুই নামে চায়নিজ চুন্নু, কিন্তু কথার মইধ্যে মারোস বিলাতি প্যাঁচ। একদিন না কইছি, আমার লগে প্যাঁচের কথা বলবি না। কথা বলবি উদাহরণসহ।
চুন্নু ঘাড় নাড়িয়ে বলল, বলাবলির দিন শ্যাষ। অনেক বলছেন। আফনে এক কান দিয়া বলছেন, বখতিয়ারে আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দিছে। অহন যা করার প্যাট্টিকালি করতে হবে। আঙুল অনেক সোজা রাখছেন। এইবার আঙুলডারে ইস্টু্ক্র বানান। নইলে সামনের ইলেকশনে আফনের ভরাডুবুরি হবে। পানি কিন্তু গলা পর্যন্ত উইঠ্যা গেছে।
চুন্নুর কথা শুনে চেয়ারম্যান সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়ে।
কী কস তুই! বখতিয়ারে কি চেয়ারম্যান হইবার স্বপ্ন দ্যাখতেছে নাকি?
স্বপ্ন দ্যাখতে তো পয়সা লাগে না চেয়ারম্যান সাব। আফনেও বালিশে ঘুমান, হেও বালিশে ঘুমায়। বালিশ হইল স্বপ্নের কারখানা। তা ছাড়া গ্রামের মানুষজনরে বখতিয়ার য্যামনে হাত করছে, একবার দাঁড়াই গেলে আফনের বইসা যাওয়া ছাড়া গতি নাই। গ্রামে এখন মোটরসাইকেলের জোয়ার চলতেছে। মোটরসাইকেল মার্কা নিয়া একবার খাড়াইয়া গেলে অবস্থা কী হইব, বুঝতাছেন?
চেয়ারম্যান সাহেব এবার সত্যি সত্যি চিন্তায় পড়েন। তার কপালে ভাঁজ।
আমিও যে ব্যাপারটা নিয়া ভাবি নাই, তা না। ক্যান জানি মনে হইত বখতিয়ারের একটা মতলব আছে। আবার ভাবতাম, ইট্টু সবুর কইরা দেখি। সময় হইলে সবই ধরা পড়ব।
সব কামে সবুর করতে নাই চেয়ারম্যান সাব। বিলাই মারতে হয় ওপেনিং নাইটে। হুনেন, এক কাম করি . . .
কাজ করার কথা বলে চুন্নু কথাটা শেষ করে না। সে তার ছোট ঘাড়ের বড় মাথাটা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। তারপর গলাটাকে খানিক নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, যে সাইকেল নিয়া এতকিছু, সেই সাইকেলের একটা ব্যবস্থা করলে হয় না। সাইকেলও নাই মার্কাও নাই। আফনেও নিশ্চিন্ত।
চেয়ারম্যান সাহেব চুন্নুর ছোট কথার বড় মানেটা ধরতে পারেন না। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, কী করতে চাস তুই?
কাজ তেমন কিছুই না। আফনে যদি বলেন তাইলে রাইতের আন্ধারে বখতিয়ারের সাইকেলডারে নদীতে ফালাইয়া দিতে পারি। সাইকেল ছাড়া বখতিয়ার পঙ্গু। আর একজন পঙ্গু মানুষ তো ইলেকশনে খাড়াইতে পারবো না। পারবো? খিক্ খিক্ খিক্।
চুন্নুর হাসি এবার চেয়ারম্যানের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। তিনি চুন্নুর গালে আদরের চাঁটি মারেন।
আমার পিছে পিছে ঘুইরা এতদিনে তোর মাথাডা খুলছে। একটা বুদ্ধির মতো বুদ্ধি বাইর করছোস। কিন্তু হোন্ডা যে ফালাবি, পারবি তো? নাকি সব গোলমাল বাধাইয়া আমারে সুদ্ধা গাঙে ফেলবি!
চুন্নু আবারও খিক্ খিক্ হাসে।
কী যে কন চেয়ারম্যান সাহেব! আফনের কথায় কত আকাম সমাধা করলাম, আর এইডা পারব না? বখতিয়ারের হোন্ডা তো উডানেই পইড়া থাহে। আফনে বললে আইজ রাইতেই কাম সমাধা করব। গলার কাঁটা পুইষা রাখতে নাই।
কথা তুই মন্দ বলোস নাই। উন্নয়নের কামে সবুর চলে। তয় আকামে দেরি করতে নাই। হে হে হে।
হাসতে হাসতে চেয়ারম্যানের সাহেব পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢোকান। পকেট থেকে দুটো নতুন পাঁচশো টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে দেন চুন্নুুর দিকে।
এইডা রাখ। লগে আরও দুই-একজন লইয়া লইস। সাবধান, কাক-পক্ষীতেও জানি টের না পায়।
নোট দুটো পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে চুন্নুু বলে, আফনে এই চায়নিজ চুন্নুুর উপ্রে ভরসা রাখতে পারেন। আমি অর জাপানি হুন্ডার নিশানাও রাখমু না।
চেয়ারম্যান সাহেব যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার পাশে একটা খাম্বায় বখতিয়ারের মোবাইল নাম্বার লেখা একটা কাগজ লাগানো ছিল। চেয়ারম্যান সাহেব হাতের লাঠি দিয়ে কাগজটা খোঁচাতে খোঁচতে বললেন, যা তাইলে। আপদ বিদায় কর।
সেই রাতেই কাজ সমাধা করে চুন্নুু। চুন্নুর মতো ঘাগু মালের জন্য এটা কোনো কাজই না। মানুষ ফেলে দেয়ার ট্রেনিং আছে তার। এ তো মামুলি মোটরসাইকেল। তাও আবার ৫০ সিসির লক্কড়-ঝক্কড়। চেয়ারম্যান সাহেব সাথে দুজন নিয়ে যেতে বলেছিলেন। চুন্নুু গেছে একাই। সুনসান উঠান থেকে হোন্ডাটা কাঁধে তুলে প্রথমে রাস্তায় উঠেছে, তারপর নিজে ভ্যান চালিয়ে চলে গেছে নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হোন্ডাটা সে এমনভাবে পানিতে ফেলেছে যাদের কানে শব্দটা গেছে তাদের মনে হবে পাড় ভেঙে একটা মাটির বড় চাকা নদীতে পড়ল মাত্র। এর বাইরে কোনো সাড়া শব্দ হলো না। টের পেলো না কাক-পক্ষীও।
চুন্নুু যখন বখতিয়ারের হোন্ডাটা নদীর পানিতে ফেলে ঠিক একই সময়ে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে ঘটে আরেকটি ঘটনা।
চেয়ারম্যান সাহেব টেনশনে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। পাশে তার স্ত্রী বিছানায় বসে পান খাচ্ছিলেন আর সাংসারিক কিছু খুচরা কথা বলছিলেন স্বামীর সাথে। যেমনটা প্রতি রাতেই হয়।
চেয়ারম্যান সাহেব হুঁ-হাঁ করে জবাব দিচ্ছিলেন স্ত্রীর কথার। তার মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। চুন্নুু কি ঠিকঠাক কামডা করতে পারবো!
হঠাৎ কোনো রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই বুকে হাত দিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়েন চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী।
চেয়ারম্যান সাহেব প্রথমে ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারেন না। তিনি শিল্পীকে ডাক দেন। শিল্পী আসতে আসতে চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রীর মুখে ফ্যানা উঠে যায়।
মাকে দেখে চিৎকার করে ওঠে শিল্পী।
আম্মা . . . ও আম্মা। কী হইছে তোমার!
চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী অস্টম্ফুট স্বরে একবার শুধু বলেন- পানি।
এ ধরনের সমস্যায় গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা বখতিয়ার। শিল্পী দ্রুত বখতিয়ারকে ফোন করে।
শিল্পীর ফোন পেয়ে বখতিয়ার ছুটে আসে তাদের বাড়ি। তবে মোটরসাইকেল ছাড়া।
শিল্পীর মাকে একনজর দেখেই বখতিয়ার বলল, চাচির তো হার্ট অ্যাটাক হইছে মনে হয়।
কী কও বখতিয়ার ভাই! হার্ট অ্যাটাক!!
অসহায়ের মতো শিল্পী তার মায়ের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে।
হ। দেইখা তাই মনে হইতেছে। চাচিরে অহনি হাসপাতাল নিতে হইবো। দেরি করন যাইবো না। চাচা, চুন্নুুরে তাড়াতাড়ি ভ্যান বাইর করতে কন।
ভ্যানের কথা শুনে শিল্পী বলল, ভ্যানে নিলে তো দেরি হইয়া যাইবো বখতিয়ার ভাই। তুমি হুন্ডা আনো নাই?
হেইডা তো আমি জানি। কিন্তু হুন্ডাডা খুঁইজ্জা পাইতেছি না। উডানেই রাখছিলাম। তোমার ফোন পাইয়া আসার শুম দেহি, হুন্ডা নাই। আশেপাশে খুঁজলাম। পাইলাম না। তুমি কইলা- বিপদ। তাই আর দেরি করি নাই।
ও আল্লা! এইডা তুমি কী কও বখতিয়ার ভাই! অহন আমার আম্মার কী হইবো?
বখতিয়ার শিল্পীর মাথায় হাত রাখে।
তুমি অস্থির হইয়ো না শিল্পী। একটা না একটা ব্যবস্থা হইবোই।
শেষ পর্যন্ত ভ্যানে করেই হাসপাতালে রওনা দেয় তারা। চুন্নুুর ভ্যান নিয়ে ফিরতে ফিরতে দশ-পনের মিনিট লেগে যায়। এর পর শিল্পীর মাকে ভ্যানে তুলে সবাই ছোটে হাসপাতালের উদ্দেশে। দ্রুত হাসপাতালে পেঁৗছাতে হবে তাদের। কিন্তু হোন্ডার গতি আর ভ্যানের গতি তো এক না। যদিও বখতিয়ার আর চুন্নুু মিলে পুরোটা পথ ভ্যান ঠেলেছে। তারপরও হাসপাতালে আসতে আসতে রাত-ভোর হয়ে যায়।
তারা যখন হাসপাতালে পৌঁছে তখন ফজরের আজান হচ্ছে। ততক্ষণে সব শেষ।
ডিউটি ডাক্তার রোগীর নাড়ি দেখে বললেন, আহারে! আরেকটু আগে আনতে পারলে হয়তো বাঁচানো যেত!