পাট গাছগুলো থেকে থেকে কাঁপছে

পাট গাছগুলো থেকে থেকে কাঁপছে

পাটখেতে পাটগাছ দুলবে নাতো কি আমড়াগাছ দুলবে? যুক্তিবিদ্যা কী বলে? বলে, পাটখেত থাকলে সেখানে পাটগাছ থাকবে। আর বাতাস ছাড়লে অবধারিতভাবেই সেই গাছ দুলবে। সে বাতাস দখিনা নাকি উত্তরা তার ধার সে ধারবে না। হেলে দুলবে। দুলে দুলবে।

প্রকৃতির এই চিরায়ত নিয়মানুবর্তী নীতির কথা ক্যাড়া লিটুর মতো ছেলে জানবে না তা হয় না। সে জানে। জানে বলেই তার চোখ আটকে গেছে। ঝড় নেই, বাতাস নেই। খেতের মাঝখানে হঠাৎ করে কিছু পাটগাছ অযথা দুলে উঠছে। খানিক বিরতি নিচ্ছে। আবার নড়ে উঠছে। আবার থামছে। আবার নড়ছে। মাঝে মাঝে ঝাঁকি দিয়ে কাঁপছে। এটা তো পাটগাছের প্রথাবিরোধী আচরণ। ক্যাড়া লিটু জানে, আবহমান গ্রামবাংলায় এটা মোটেও ভদ্রস্থ কথা নয়। ভারি অশ্লীল ইঙ্গিতবাহী প্রাকৃতিক দৃশ্য।

অন্য কারও চোখে পড়লে হয়তো বিষয়টি অত দূর গড়াত না। কিন্তু লোকটা যেহেতু ক্যাড়া লিটু; সেহেতু তিলটা তাল হতে এবং সেই তালের শেষ পর্যন্ত আধমনি কুমড়ো সাইজে চলে যেতে দেরি হয়নি।

স্তব্ধ গোধূলিতে বাতাসবিহীন মাঠের মাঝখানে নির্জীব পাটগাছের এই বিক্ষিপ্ত নড়াচড়াকে ক্যাড়া লিটু মুহূর্তেই সামাজিক অবক্ষয়ের অবধারিত ফল বলে সাব্যস্ত করেছে। তারপর আর সময় লাগেনি। দশ মিনিটের মধ্যে সে শ’ খানেক অতি উৎসুক ও সমাজ সচেতন লোক জড়ো করে ফেলেছে। তারা মহা উৎসাহে মানববন্ধন করে পাটখেতের চারপাশটা ঘিরে ফেলেছে।

মানববন্ধনে এখন বক্তৃতাপর্ব চলছে। একজনের পর একজন বক্তৃতা দিচ্ছে। বক্তাদের মধ্যে কম বয়সী যুবক থেকে শুরু করে ৭০ বছরের লোকও আছে। তারা বাংলার মাটি থেকে পাটগাছের অহেতুক অশ্লীল নড়াচড়া এবং কাঁপা কাঁপি চিরতরে বন্ধ করার দাবি তুলছে। সেই দাবি অল্প সময়ের মধ্যে পূরণ করা হবে বলে নিজেরাই আশ্বাস দিচ্ছে। এই মহা আমোদের খবর দেওয়ার জন্য প্রত্যেক বক্তাই ক্যাড়া লিটুকে সমানে সংগ্রামী শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তবে ভেতরে আসলে কারা; সেখানে আসলে কী ঘটছে তা চাক্ষুস দেখার জন্য কেউই পাটখেতে ঢুকতে রাজি হচ্ছে না।

কেন রাজি হচ্ছে না সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জাতির বিবেকের সামনে তারকাচিহ্নিত জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘কে এই ক্যাড়া লিটু?’ তার নাম তো শুধু লিটুই হতে পারত। সঙ্গে আবার ‘ক্যাড়া’ কেন?

আসলে এলাকায় মোট চারজন লিটু। বাজারে এক লিটুর বাবার আটা ময়দার দোকান আছে; কাজেই কে বা কারা তার নাম দিয়েছে ‘আটা লিটু’। ওই নামেই সবাই চেনে তাকে। একজন গড়নে লম্বা বলে তার নাম ‘লম্বু লিটু’। সিনেমার প্রয়াত ভিলেন জাম্বুর মতো টাক বলে আরেক জনের নাম ‘জাম্বু লিটু’। এই তিন লিটুর নামকরণের শানে নুজুল নিয়ে কোনো মতান্তর নেই। কিন্তু ক্যাড়া লিটুর নামের উৎস নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়ে থাকেন। অনেকগুলোর মধ্যে দুইটি মত মেনে নেওয়ার মতো। প্রথম মত হলো, ক্যাড়া লিটুর দেহের প্রকৌশলগত অবকাঠামো অতি হ্যাংলা পাতলা; অনেকটা ডোবায় থাকা ছোট চিকন ক্যাড়া বাইন মাছের মতো। ক্যাড়া বাইন ধরতে গেলে যেমন পিছলা খেয়ে আঙুল গলে বেরিয়ে যায়, এই লিটুও তেমন ধূর্ত স্বভাবের। তাকে কোনোভাবে আটকানো যায় না। এই কারণে তাকে ‘ক্যাড়া লিটু’ নামে ডাকা হতে পারে।

দ্বিতীয় মত হলো, তার মতো ঝামেলাবাজ ছেলে এতদঞ্চলে পাওয়া যাবে না। সে ‘ক্যারা ব্যারা’ বাধানোর ওস্তাদ। এর কথা তার কাছে; তার কথা তাহাদের কাছে পাচার করে একটা ‘মহা ক্যারা ব্যারা’ লাগিয়ে সটকে পড়া তার প্রাত্যহিক কাজের অংশ। সেই সূত্রে ‘ক্যারা’র অপভ্রংশ হিসেবে সে ‘ক্যাড়া’ উপাধিটা পেয়ে থাকতে পারে।

অন্যদিন ‘ক্যারা ব্যারা’ বাধানোর পর সটকে পড়লেও আজ ক্যাড়া লিটু জায়গা থেকে সরছে না। কারণ সামনে ব্যাপক বিনোদন। পাটখেত থেকে কাদের পাকড়াও করে বের করা হবে; তারপর তাদের শালিস বৈঠকে কী শাস্তি দেওয়া হবে সেই চিন্তায় সে ব্যাপক আমোদে আছে। আজকের ঘটনার মূল নায়ক যে সে-ই হতে যাচ্ছে তা সে দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সবাই বক্তৃতাবাজি করলেও পাকড়াও অভিযানে যেতে চাইছে না কেউ। কারণ অনেকগুলো। প্রথম কারণ হলো, চেয়ারম্যানের ছেলে ত্যাড়া আজিজকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। অনেকের সন্দেহ ভেতরে আজিজ আছে। তাকে ধরতে গেলে সবাইকেই পরে কমবেশি ফাপরে পড়তে হবে। এদের মধ্যে অনেকের কাছেই আবার আজিজ মোটা অংকের টাকা পায়। সুতরাং এ চাচ্ছে সে যাক। সে চাচ্ছে ও যাক। এই নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে।

আরেকটা আছে ডাকাতের ভয়। এলাকায় মাঝে মাঝে ডাকাতি হচ্ছে। হতে পারে বাইরে থেকে আসা একদল ডাকাত পাটখেতে ঢুকে আছে। রাত নামলেই বের হবে। তাদের হাতে বন্দুক-টন্দুক কী পরিমাণ আছে তা তো বোঝা যাচ্ছে না। কাজেই সেখানে জানের ভয় থেকেই যাচ্ছে।

আবার অনেকে ভাবছে, ঘটনায় যদি নিজের বোন বা কাছের আত্মীয় জড়িত থাকে তাহলে এক মহা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতে পারে। সব মিলিয়ে গবেষণা চলছে। অভিযান শুরু হচ্ছে না।

মাগরিবের আযানের আগে আগে চেয়ারম্যান ওয়াদুদ সাহেব ঘটনাস্থলে এলেন। তাঁর সাথে মসজিদের ইমাম সাহেব। ভেতরে যে নিজের ছেলে আজিজ থাকতে পারে সেই বিষয়টা ওয়াদুদ চেয়ারম্যানের মাথায় আসে নাই। তিনি জ্বালালি বক্তব্য শুরু করলেন, ‘দ্যাখো বাপুরা, আমার এলাকায় আমি ফষ্টিনষ্টি সহ্য করব না। আমার নিজের ছেলে হলেও আমি ক্ষমা করার পক্ষে না। আর চোর ডাকাইতও তো থাকপার পারে। আমি অডার দিচ্ছি, তোমরা ভিতরে যাও। যে-ই হোক, ধইরা বাইন্ধ্যা নিয়া আসো। রাম দা, সড়কি যা লাগে নিয়া যাও।’ এই কথা বলে চেয়ারম্যান পাটখেতের সেই স্থানে চোখ রাখলেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে হাজেরানে মজলিশও সেদিকে নজর বুলালো। তখনই আবার কয়েকটা পাটগাছ সাংঘাতিক বেগে আন্দোলিত হয়ে উঠল। সহসাই ওয়াদুদ মিয়ার কলিজাটা কেমন শির শির করে উঠলো। তিনি এটা কি বলে বসলেন, আজিজও তো হতে পারে। তার নিজের চরিত্রের ওপরই ভরসা নাই, আর তো ছেলে! তবে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেন তিনি।

চেয়ারম্যানের কথা শেষ না হতেই ক্যাড়া লিটু বলে ওঠে, ‘এইডাই চাচ্ছিলাম চাচাজান। আপনে অডার দিছেন। আপনার ডিউটি শ্যাষ। এইবার আমাগো ডিউটি। আমরা দ্যাখতেছি। এই মিয়ারা আসো তুমরা…!’ লিটু একটা লাঠি হাতে নিয়ে সামনের পাটগাছগুলোকে দুই হাতে সরিয়ে বিলি কেটে এগোতে শুরু করে। এবার অতি উৎসাহীদের আর কিছু বলতে হয় না। তারা রাম দা, লাঠি-সোটা নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে।

কৌতুহলী মেয়েরা লজ্জায় এদিকটায় আসতে পারছে না বটে। তবে দূর থেকে তারা দৃশ্যপটের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে। কার মেয়ে আর কার ছেলে সেখানে অভিসার করতে গিয়ে থাকতে পারে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই মেয়েদের দুই পক্ষের মধ্যে এক দফা ঝগড়া এবং চুল ছেঁড়াছিড়ি হয়ে গেছে। এখন সশস্ত্র অবস্থায় ছেলেদের ভেতরে ঢুকতে দেখে তারা ঝগড়াঝাটি বন্ধ করেছে। মূল মুহূর্তের আশায় কান চোখ খাড়া করে আছে তারা।

আদিম শিকারিদের মতো লিটুসহ অন্যরা পাটগাছ সরিয়ে ভেতরে যাচ্ছে। কারও হাতে রাম দা, কারও হাতে ছ্যান, কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে বল্লম। একটু ভেতর যেতেই কেমন ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ শোনা যায়। কেমন যেন হুটোপুটির শব্দ। সঙ্গে অস্ফুট গোঙানিরও আওয়াজ।

সবাই সতর্ক হয়ে ওঠে। কান খাড়া হয়। কারও কারও মাংসপেশী টান টান হয়। সবাই একযোগে ‘ধর! ধর!’ বলে প্রায় দৌড়ে সেদিকে ছুটে যায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তারা পৌছে যায় মঞ্জিলে মকসুদে। কিন্তু একি! সামনে কালোমতো ওটা কী পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাড়া লিটুর অতি আদরের বিরাট রামছাগলটা পড়ে আছে। ছাগলটার গলায় দড়ি পেঁচিয়ে গেছে। অনেকগুলো পাটগাছ ভেঙে বৃত্তাকারে এক দক্ষযজ্ঞ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ আওয়াজ করার ক্ষমতাও ছাগলটার নেই। জিহ্বা বের হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর সে হাত পা ছুড়ছে। লিটু দৌড়ে কাছে গিয়ে গলার ফাঁসটা খুলে দেয়। ছাগলটা আর্তনাদ মেশানো মুক্তির আনন্দ ভরা গলায় ডেকে ওঠে ব্যাঁ…ব্যাঁ…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত