নেতাজি ঔষধালয়

লোকটা কি অতীত নিয়েই পড়ে থাকবে? রোজ রাতে ঘুমের মধ্যে ধস্তাধস্তি! মনে হয় কোনো মহামূল্যবান বস্তু যেন তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নীহার বানু হারিকেনের চাবি ঘুরিয়ে সলতেটা বাড়িয়ে দেন। তাতে কাজ না হলে হাত দিয়ে জোরে ধাক্কা মারেন স্বামীকে। তখন মোয়াজ্জেম হক জেগে উঠলেও তাঁর ডান হাতটা মুঠো পাকিয়ে বুকের বাম পাশে ধরা থাকে, যেখানে হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক ধুকপুক করছে।

রাতগুলি এভাবেই কাটছিল। আর দিনের বেলাটা রোগী দেখতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। বড় সন্তানের জন্মের পর নীহার বানু নড়েচড়ে বসেন। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। অর্থ-যশের জন্য ঝুঁকি নিয়েই মানুষকে কিছু না কিছু করতে হয়। এখন সে শুধু স্বামীই নয়, সন্তানের বাবাও তো। তবে তাঁর পুঁজির বন্দোবস্ত নীহার বানুকেই করতে হবে, লোকের গিবত শুনতে হলেও।

পুঁজির উৎস নীহার বানুর বাবা হাজি চানের তহবিল, তখনো যা বাড়বাড়ন্ত। একমাত্র ছেলে তিতা মিয়ার খেপে খেপে সরানোর পরও লোহার সিন্দুকের আধাটাক রুপার সিক্কা, দাদা-পরদাদার আমলের আকবরি মোহর আর গিনি-সোনায় ভর্তি। কিন্তু এ থেকে নিজের বখরা কীভাবে চাইবেন নীহার বানু? লোকে তো বলে বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের নজর পড়লেও মুরুব্বির বদদোয়া লাগে। তা লাগুক। এখন কিছু করার নেই—বাবার লোহার সিন্দুকে নজর পড়ে গেছে নীহার বানুর।

নীহার বানু ডিসপেনসারির জন্য টাকা ধার চাইতে হাজি চান মুচকি হাসেন। যে ধার কখনো শোধ হবে না, তা কে দিতে চায় একমাত্র স্নেহময় পিতা ছাড়া? তার আগে কবুল করতে হয়, তিনি অবশ্যই মেয়ের ভব্যতায় খুশি। মনে মনে বুদ্ধিরও তারিফ করেন। টাকাটা সরাসরি চেয়ে বসলে, সেদিন হয়তো খালি হাতেই ফিরিয়ে দিতেন নীহার বানুকে, যেখানে মেয়েজামাইর প্রতি নানা কারণে তিনি নাখোশ।

বিবাদটা অতি পুরোনো। মুসলমানের ছেলে কী করে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেয়—এখনো তা হাজি চানের কলজেয় সুচ দিয়ে হরবখত খোঁচায়। তা-ও যদি রশিদ আলি বা শাহনেওয়াজ খানের মতো পল্টনের কেউ হতো, যারা ব্রিটিশ জেনারেল পারসিভ্যালের কাপুরুষতায় জাপানিদের হাতে সিঙ্গাপুরে বন্দী হয়েছিল। ‘অজেয় সিঙ্গাপুর’! আপন মনে বাঁকা হাসেন হাজি চান। কিন্তু এ তো তা না! একেবারে স্বেচ্ছায় উড়ে গিয়ে আগুনে ঝাঁপ। পড়াশোনাও পণ্ড হলো। আর তাতেও যদি শিক্ষা হতো। হালে নাকি চোখের দিকে তাকিয়ে বলে বেড়ায়—পাকিস্তান আন্দোলন তামাদি হয়ে গেছে, এখন সামনের দিকে তাকাবার সময়।

এ সর্বৈব মিথ্যা হলেও, অবশ্য এর ক’বছর পর হাজি চান নিজেও সামনে তাকাতে শুরু করেন। তিনি ’৫৪-এর নির্বাচনে দোলায় শুয়ে দুলতে দুলতে মুসলিম লীগের বিপক্ষে যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিতে যান। যক্ষ্মা আক্রান্ত, শয্যাশায়ী। তখনো তাঁর রোগ শনাক্ত হয় নাই। ভুল চিকিৎসা চলছে।

নীহার বানু টাকা নিয়ে আসার পর আরও মাস ছয় অপেক্ষা করতে হয়। তবে নামী ডাক্তার নরেশ বাবুর রেডিমেট ডিসপেনসারি, মোয়াজ্জেম হক ভাবেন—হাতবদল হলেই জাঁকিয়ে বসবেন। আর সে হাতবদলে সময় তো লাগবেই। আগরতলা চলে যাচ্ছেন নরেশ ডাক্তার। এ পরপারে যাবার মতোই। বিক্রি-বাট্টা, বিলি-ব্যবস্থা করে তবে তো যাবেন!

ডিসপেনসারিটা মোয়াজ্জেম হকের হাতে আসার পর, নরেশ ডাক্তারের নেমপ্লেট আরও বছরখানেক দরজার মাথায় লটকানো ছিল। রোগীরা দেখত নাম আছে, মানুষ নাই। হেঁটো ধুতি-ফতুয়ার থলথলে শরীরটা টেবিলের পেছনের যে কাঠের হাতলচেয়ার আলো করে রাখত, ওখানে প্যান্ট বা পাজামার ওপর হাওয়াই শার্টধারী কমবয়েসী এক তরুণ। তাকে কম্পাউন্ডারই ভাবত ওরা। বা সে যদি ডাক্তারও হয়, এ ভুঁইফোড়ের চিকিৎসা নিতে তাদের বয়েই গেছে! তাই নরেশ ডাক্তার আর ফিরবেন না শুনেও ডিসপেনসারির বাইরে থেকে চলে যেত। তালাশ করত বাজারের অন্য নামী ডাক্তারের। নিজের নেমপ্লেট ঝোলাতে সংকোচবোধ করতেন মোয়াজ্জেম হক। তিনি তো ডিগ্রিধারী ডাক্তার নন। মাত্র দেড় বছর পড়েছেন, যেখানে এলএমএফ চার বছরের কোর্স। তা শেষ হলে সার্টিফিকেট। চিকিৎসা করবার ছাড়পত্র। তা ছাড়া তখনো ডাক্তার হিন্দু না হলে রোগীর গালে উঠত না।

এ নিয়ে অভিযোগ ছিল না মোয়াজ্জেম হকের। কিন্তু ধারের টাকায় কেনা ডিসপেনসারি, দেনা শোধের জন্যও তো পসার চাই! এ ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনতে পারে তাঁর ওয়ারফ্রন্টের সাশ্রয়ী চিকিৎসাপদ্ধতি। কম ওষুধ। সস্তা অথচ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের পরামর্শ। অ্যানেসথেশিয়া ব্যতিরেকে অস্ত্রোপচার। এ তৃতীয় পদ্ধতির ব্যাপারে আশপাশের দশ গাঁয়ে তাঁর হাতযশ রয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে ডিসপেনসারির একটা জুতসই নাম খুঁজছিলেন তিনি মনে মনে, যা থানা সদরের লোকের কাছে তাঁর যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার আগাম বার্তা বহন করবে। আজাদ হিন্দ ঔষধালয়? না, ভালো হোক মন্দ হোক, আজাদি তো এসেই গেছে। যে আসবে না, চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে, সে নেতাজি। নেতাজি ঔষধালয় নামে সব কূলই রক্ষা পাবে।

সুভাষ বসুর স্মৃতি তখনো জ্বলজ্বলে। তাঁর ফরসা গোল মুখ। আবেগি স্বর। জনসভা মাতানো বক্তৃতা। আজাদ হিন্দের সেনানায়ক নেতাজি—গাঁয়ে-গঞ্জে অনেকেরই অচেনা। কেউ কেউ খবরটা শুনে থাকলেও গান্ধীটুপি আর গলাবন্ধ কালো কোটের সঙ্গে হয়তো মেলাতে পারেনি। লোকের স্মৃতিতে তিনি বক্তৃতা দিতে দিতে উধাও হয়ে গেছেন ক্রমশ দক্ষিণে, দক্ষিণ-পুবে আরও পুবে। তোমরা রক্ত দাও, আমি স্বাধীনতা এনে দেব। শেষমেশ উড়োজাহাজ ভেঙে ভূপাত। মোয়াজ্জেম হকের মতো ওরাও বিশ্বাস করত নেতাজি মারা গেছেন। হিন্দুস্থানে যে ঘন ঘন তাঁর পুনরাবির্ভাবের গুজব রটে, দেশ বিভাগের ফলে তারা তা জানতে পারছে না। বা কখনো-সখনো পারলেও তা বিশ্বাসে তাঁদের ফায়দা কী। তিনি ফিরে এলেও এখন আরেক দেশের নাগরিক। নমশূদ্র নেতা যোগেন মন্ডলের মতো পূর্ব বাংলা কি তাঁর আবাস হবে? কখনোই নয়। সে ধাতের লোকই নন তিনি। আর তাঁদের রাজনীতিও আলাদা। ফলে যত বড় নেতাই হোন, ভারত-পাকিস্তান বর্ডার তাঁর জন্যও প্রযোজ্য। তা বলে নেতাজিকে নিয়ে সে সময় আগ্রহের খামতি ছিল না লোকের।

হাটের দিনে নেতাজি ঔষধালয় সাইনবোর্ডের নিচে ভিড় জমে যেত। একজনের দেখাদেখি আরেকজন, এভাবে অক্ষরজ্ঞানহীনশুদ্ধ আরও অনেক মানুষ। আগন্তুকদের বহু অর্বাচীন প্রশ্নের হাসিমুখে জবাব দিতেন মোয়াজ্জেম হক। তাতে ব্যবসা পলটি খেলেও তিনি হয়তো ভাবতেন, নেতাজির জীবনোৎসর্গের কথা তো লোকে জানতে পারছে, যা অবশ্যই মরহুমের প্রাপ্য। সেই পাওনা মেটাতে অর্থকড়ির টানাটানির মধ্যেও সুভাষ বসুর বক্তৃতারত একখানা ছবি কালো কাঠের ফ্রেমে বাঁধিয়ে আনেন। আর ঝুলিয়ে দেন ওষুধের আলমারির মাথার ওপর, ডিসপেনসারিতে ঢোকার ঠিক দরজা বরাবর। ছবিটা যে শুরুর বছরগুলিতে পসার জমাতে ম্যাজিকের মতো কাজ করবে, মোয়াজ্জেম হক তা ভাবতেও পারেননি।

যাদের হাটের দিন সদাই করে সোজা বাড়ি ফিরে যাবার কথা, ওরাও ওষুধের আলমারির ওপরের ছবিটার টানে পায়ে পায়ে ডিসপেনসারিতে ঢোকে। কাঠের বেঞ্চিতে জুতমতো বসে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে। সামনেই যে গুরুতর অসুস্থ রোগী কাতরাচ্ছে বা অচিরে তাঁকে যে টেবিলের ওপাশে ডাক্তারের হাঁটু-ছোঁয়া টুলে বসতে হবে, বাজার-খরচ থেকে কায়ক্লেশে বাঁচানো গাঁটের পয়সা গুনতে হবে, সে পরোয়া নেই। এ যেন ছবি দেখার বিনিময়ে সামান্য মাশুল। নেতাজির ছবির এ দর্শকদের মাঝে মোয়াজ্জেম হক হঠাৎ হঠাৎ কঠিন লুকোনো রোগ শনাক্ত করতেন। তখন থতমত খেয়ে যেত লোকগুলি। যেন বায়োস্কোপ দেখতে এসে হাতে হাতকড়া পরেছে বা আচমকা অন্ধকার ভয়াল গর্তে পড়ে গেছে। মোয়াজ্জেম হক তাঁদের আরোগ্য লাভের উপায় বাতলে আশ্বস্ত করতে চাইতেন। আর মনে মনে ভাবতেন, তাহলে ঝুলন্ত ছবিটা লোক ঠকানোর মামলা নয়, কারও কারও জীবন বাঁচাতেও সাহায্য করছে!

নেতাজির ছবিটা যে পয়মন্ত, স্বামীর মুখে সে গালগল্প শুনে ফিক করে হেসে দেন নীহার বানু। আখেরে তাহলে কোনো কিছুই বৃথা যায় না! তা আজাদ হিন্দ ফৌজে নাম লেখাও কি ইম্ফল অভিযান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসো। অনেক দিন পর যেন সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। তা ছাড়া তাঁর আব্বাজানকে রিলে করে শোনানোর মতো দারুণ একখানা খবরও বটে। হাজি চান হয়তো ভাবছেন, তাঁর মেয়েজামাইটা আস্ত একটা অপদার্থ বা কুফা। কতগুলো টাকা বেহুদা জলে গেল।

খবরটা শুনে আগে হলে হাজি চান নিশ্চয়ই বলতেন, ‘সরকারি দপ্তরগুলির মতো দোকানের বেড়ায় জিন্নাহ সাহেবের ছবি ঝোলাও। মুসলমানের পোলা, খালি হিন্দুর ছবি থাকব কেন তোমার দোকানে!’ কিন্তু তত দিনে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঘোষিত রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। হাজি চান মেয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে ঊর্ধ্বলোকে তাকান। অস্ফুটস্বরে বলেন, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ মহান।’

নেতাজির ছবির এই তেলেসমাতি দেশভাগের প্রজন্ম পর্যন্তই। তারপরের রোগীদের অতি কৌতূহলী কেউ কেউ ছবির লোকটা মোয়াজ্জেম হকের আত্মীয় বা স্কুলফ্রেন্ড কি না জানতে চাইত। আলমারিটা জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে ছবিটা কোণের দিকের বেড়ার গায়ে ঠেলে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে তা সিপিয়া রং ধারণ করে। ঘুণে কুটকুট করে কাটতে থাকে এর কালো বার্নিশের ফ্রেম। তা ঝুরঝুরে হয়ে খসে পড়লে ফের নতুন কালো বার্নিশের ফ্রেমে ছবিটা আটকানো হয়েছিল। তবে এর আর স্থানান্তর ঘটেনি। গোলমুখের আধাটা দেখা গেলেও ওষুধের প্যাকেটের আড়ালে চলে যায় নেতাজির মোহনীয় ভঙ্গিতে উঁচিয়ে ধরা তর্জনী।

দীর্ঘ বিরতির পর সচিত্র-নেতাজি ফের আবির্ভূত হন। ষাটের দশকের শেষাশেষি, সামরিক জান্তা আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জোয়ার বইছে। সে সময় অসুখ-বিসুখ যেন দেশ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। মোয়াজ্জেম হকের কাছে যেসব রোগী আসত, তাদের প্রায় সবাই পুলিশের লাঠিচার্জে মাথা-ফাটা, গুলি-খাওয়া, টিয়ার শেলের ঝাঁজে জর্জরিত। দেখতে দেখতে ডিসপেনসারিটা মোয়াজ্জেম হকের অজান্তেই রাজনৈতিক আড্ডাখানা হয়ে ওঠে। শহর থেকে আমদানি নতুন নতুন মুখ। বেশির ভাগই ছাত্র, বামপন্থী। শেখের ছয় দফার সঙ্গে পাঁচ যোগ করে এগারো দফা নিয়ে মাঠে নেমেছে। মোয়াজ্জেম হকের মনে হয়, এ নব্য যোদ্ধাদের সঙ্গে নেতাজির মোলাকাত প্রয়োজন। তিনি ছবিটা ঝেড়েপুছে আগের জায়গায় ঝুলিয়ে দেন। তার আগে ওষুধের আলমারির কার্নিশটা ভেঙে ঝুলে পড়ায় এর মেরামত জরুরি হয়ে পড়ে। কতগুলি দরকারি ওষুধের ঠোঙা সরিয়ে ছবিটাকে দৃশ্যমান করে তুলতে হয়।

এক দিন যায়, দুই দিন যায়—মনে হয় সব কারদানিই বৃথা। ডিসপেনসারিতে ঢোকার সময় কপাল বরাবরই তো ছবিখানা। তবু কারও নজরে পড়ে না। অবশ্য সুস্থিরভাবে দোকানে ঢুকলেই তো ওদের নজরে পড়বে—নিজেকে প্রবোধ দেন মোয়াজ্জেম হক। হয় আহত বন্ধুকে পাঁজাকোলা করে ঢুকছে, নিজের মাথা ফাটিয়ে রক্ত ঝরাতে ঝরাতে এসেছে বা হাত পুড়িয়ে মরণ চিৎকার ছাড়ছে। হাত পোড়ানোর ব্যাপারটা এ ক্ষণে খোলাসা করা দরকার। তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পাশাপাশি ব্যাপক সহিংসতাও যুক্ত হয়েছে। আইয়ুবের দলের লোক, যাদের তখন বলা হতো দালাল, তাদের বাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরাতে গিয়ে এ বিপত্তি।

তারপর ফের ছবির জায়গা বদলের কোশিশ করেন মোয়াজ্জেম হক। আহত ব্যক্তিদের মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলে বা প্রয়োজনীয় ইনজেকশন ফুটানোর পর পেছনের কামরার শতরঞ্জি পাতা তক্তপোশে বিশ্রাম নেয় ওরা। তখন সঙ্গের ছাত্ররা কম্পাউন্ডারকে চা বানাতে বলে মোয়াজ্জেম হকের মুখোমুখি বেঞ্চিতে জাঁকিয়ে বসে। কখনো কখনো আহত ছাত্রটিও বিছানা ছেড়ে চায়ের কাপ হাতে যোগ দেয়। ছবিটা যদি মোয়াজ্জেম হকের ঘাড় বরাবর কাচ-ভাঙা আলমারির তাকে রাখা যায়, নজরে ওদের পড়বেই।

সত্যি সত্যি তা পড়েও একদিন।

‘আপনে এ ছবি রাখছেন কেন, ডাক্তার সাহেব?’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা এক ছাত্র। মোয়াজ্জেম হক তখন প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন। তাঁর কাগজ থেকে কলম তোলার আগেই আরেকটা প্রশ্ন বুলেটের মতো উড়ে আসে আরেকজনের মুখ থেকে, যার কবজি ভেঙে গেছে। মোয়াজ্জেম হক বোবা চোখে তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারছেন না, কেন তাঁকে নেতাজির ছবি নামিয়ে মাওলানা ভাসানী বা বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝোলাতে বলা হচ্ছে। ‘কারণ’ যার কবজি ভাঙা, পেইনকিলার ইনজেকশন তখনো কাজ শুরু করেনি, সে যন্ত্রণায় খিঁচুনি তুলে বলে, ‘তারা দুজনই আইয়ুব শাহির বিরুদ্ধে লড়াই করছে।’

‘নেতাজিও করেছেন দুই দফায়।’ মোয়াজ্জেম হক বুঝতে পারছেন, তাঁর গলাটা কাঁপছে। অনেক দিন তর্ক-বাহাসের বাইরে তো তিনি। ‘আইয়ুবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন বর্মায়।’ তখন অবশ্য আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা ফিল্ড মার্শাল নন। বর্মা অভিযানে ব্রিটিশ পক্ষের ব্রিগেডিয়ার কর্নেল এবং সবশেষে কর্নেল।

চায়ের কাপে ঘন ঘন চামচ নেড়ে ছাত্ররা বিরক্তি প্রকাশ করছে। মুখের ওপর কিছু বলছে না, হয়তো কৃতজ্ঞতাবশত। এখানে নিখরচায় চিকিৎসা পাচ্ছে তো ওরা। মোয়াজ্জেম হক আজাদ হিন্দ সম্পর্কে লম্বা-চওড়া ফিরিস্তি দিতে গেলে সেই কবজি-ভাঙা বলে, ‘প্লেন-ক্রাশে মরে কবে ভূত হয়ে গেছেন! ওনারে আপনার কী দরকার?’

‘দরকার…দরকার।’ মোয়াজ্জেম হকের গলাকাঁপুনি শেষ, এখন রীতিমতো তোতলাচ্ছেন তিনি। সেই সুযোগে প্রথম তর্কবাজ ছাত্রটি বলে, ‘দরকার! জ্যান্ত দুজন লিডার থাকতে, মরাটারে আপনার কেন দরকার?’

একজন স্বাধীনতাসংগ্রামী নিয়ে এভাবে কথা বলে! ওরা তো মনে হয় সিপাহি বিপ্লবের মহানায়ক, শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকেও মানে না। মরে গেছে বলে সব চুকেবুকে গেছে! এ দুনিয়ায় কে অমর? তবু ভালো যে, নেতাজির প্রতি অবজ্ঞার ধরনটা হালে বদলেছে। হাজি চানের আমলের লোকেদের মতো হিন্দু হিসেবে তাঁকে দেখছে না, যুগটা যেহেতু বাঙালি জাতীয়তাবাদের।

দেশের স্বাধীনতায় নেতাজির কত বড় ভূমিকা, বুকে ফের হিম্মত জুগিয়ে মোয়াজ্জেম হক তা বলতে গেলে তর্কবাজ ধমক দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দেয়। ‘কোন দেশের স্বাধীনতা?’ এবার কবজি-ভাঙা মওকা পেয়ে বলে, ‘আমাদের স্বাধীনতা তো সামনে!’

তবে তাঁর কুঁচকির কাছের বুলেটের দাগটা কী? মোয়াজ্জেম হকের ইচ্ছা করে পায়জামা নামিয়ে দাগটা দেখিয়ে বলতে যে, এটা আইয়ুবের ফিফথ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ছোড়া গুলির দাগ। সময়টা মার্চ মাস, ১৯৪৫। পায়জামার নেয়ারে হাত দিয়েও এ কাজে বিরত থাকেন মোয়াজ্জেম হক। লহমায় বোঝেন যে, তাহলে ভাঁড়ে পরিণত হবেন।

ডিসপেনসারি বন্ধ করে মোয়াজ্জেম হক যখন বেরিয়ে আসেন, তখন রাত। রিকশায় বাড়ি ফেরার পথে বসন্তের ফুরফুরে হাওয়ায় মাথাটা পরিষ্কার হয়ে এলে ভাবেন’৪৭ সালে কি স্বাধীনতা এসেছে? না, ইংরেজদের জায়গায় বসেছে পাকিস্তানি শাসক, যারা আমাদের একই রকম ঘৃণা করে।

বিছানায় শুয়ে ছাত্রদের আস্ফালনের কথা ফের মনে পড়ে মোয়াজ্জেম হকের। যেমন একে একে চড়াও হচ্ছিল, যেন মারবে! অথচ তিনি তাদের যত্নসহকারে নিখরচায় চিকিৎসা দিচ্ছেন। সেই দুঃখে রাতে ঘুম আসে না। নীহার বানু মশারির নিচে টর্চ জ্বেলে ঘরে-বাইরে পড়ছিলেন। মোয়াজ্জেম হকের নড়াচড়া আর ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসে বিরক্ত হন খুব। কিন্তু উপন্যাসে এমন ডুবে গেছেন যে, বচসা করে সময় নষ্ট করতে চান না।

‘ওদের চোখে আমি একজন পল্লি চিকিৎসক!’ কথাটা বলতে গিয়ে মোয়াজ্জেম হকের চোখের পাতা ভিজে ওঠে। জীবনটা আগে কখনো এমন অর্থহীন মনে হয়নি।

‘তো কী?’ নীহার বানুর চোখ তখনো বইয়ের পাতায় সাঁটা।

‘ওরাই একমাত্র স্বাধীনতাসংগ্রামী, আমি তাইলে কী?’ কান্নাটা যেন অপ্রতিরোধ্য, জোরে ফুঁপিয়ে ওঠেন তিনি।

এবার ঠাস করে বই বন্ধ করে বিছানায় উঠে বসেন নীহার বানু। ‘এত ফখর কেন তোমার?’ তাঁর হাত থেকে জ্বলন্ত টর্চটা ছিটকে গিয়ে দুজনের মাঝখানে গড়াতে থাকে। ‘মুরোদ থাকলে সংগ্রামে ঝাঁপ দাও, কে মানা করছে!’

তাই সই। মোয়াজ্জেম হক সিদ্ধান্ত নেন। আগামীকাল ডিসপেনসারি তালা মেরে মশাল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তাঁর আরেক হাতে থাকবে গ্যালনখানেক পেট্রল।

সেই বচসার রাতেই আইয়ুব খান গদি ছেড়ে দিয়ে সামরিক আইন জারি করেন। মোয়াজ্জেম হকের মন খারাপ থাকায় খবরটা রেডিও খুলে শোনা হয় নাই। নিমেষে ছাত্ররা উধাও। তিনি দেখেন অগ্নিসংযোগের দায়ে মামলা খেয়ে গেছেন।

তারপর লম্বা ফেরারি-জীবন। মামলার তারিখে হাজির না হওয়ায় ঘরবাড়ি ক্রোক করে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। ডিসপেনসারিটা ছিল নীহার বানুর নামে। কম্পাউন্ডার রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ বেচত। আর নীহার বানুর কাছে অর্ধেক হিসাব দিয়ে বাকি টাকাটা মেরে দিতে। বছর শেষে মোয়াজ্জেম হক যখন জামিনে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসেন, তখন দোকান প্রায় খালি। উকিলের ফি বাবদ অনেক টাকা কর্জ হয়ে গেছে। তার এক বছর পরই তো যুদ্ধ।

তখনো গাঁয়ে-গঞ্জে পাকিস্তানি আর্মি হানা দেয় নাই। বড় বড় শহরের যে সমস্ত কথা কানে আসে তাতে মোয়াজ্জেম হকের মালুম হয়, পাকিস্তানি মিলিটারিরা এ কিসিমের নাদান যে, আজাদ হিন্দ শুনলেই ভাববে তিনি হিন্দু। সুভাষ বোসের তসবির ওদের একনজর দেখাই কাফি। মাথায় টুপি আছে। চাপায় দাঁড়ি নাই। ও হিন্দু হ্যায়। তারপর হিন্দুর তসবির ঝুলিয়েছে যে, ও বি হিন্দু হ্যায়। আভি উসকো সিনে মে গোল্লি চালাও।

’৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি থানা সদরে আর্মি ঢুকে পড়লে নেতাজির ছবি ও সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলেন মোয়াজ্জেম হক। কী করে যেন জিনিস দুটির ঠাঁই হয় বাড়ির শেষ প্রান্তের লাকড়িঘরে। তাই পাকিস্তান আর্মি বাড়িতে আগুন দিলেও লাকড়িঘরের সঙ্গে দুটি জিনিসই রক্ষা পায়। মোয়াজ্জেম হকের বড় মেয়ে রোখসানার বাচ্চারা তখন খুব ছোট। চোর-পুলিশ খেলতে গিয়ে ওরা প্রথম ঝাপসা হরফের মরচে ধরা টিনের টুকরোটা আবিষ্কার করে। কিছুদিন পর কালো কাঠের ফ্রেমটা। রোখসানার মেয়ে সুবর্ণা ফ্রেমে মাথা ঢুকিয়ে ঝুলকালি মাখা লাকড়িঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসে, ওকে কাঠের কলারবেল্ট পরা মধ্যযুগের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির মতো দেখাচ্ছিল। আর মাথায় গামছা বাঁধা ওর ছোট ভাইটা যেন কোতোয়ালের পাইক, পেছন পেছন ছোট ভাইটা মাথায় গামছা বেঁধে জংধরা টিনে এমনভাবে কাঠি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছিল, যেন ঢেঁড়া পেটাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত