পেতনিরা ইলিশ মাছ ভাজা খেতে খুব পছন্দ করে। শুনে আমরা দাদির দিকে তাকালাম। বাইরে বৃষ্টি। সকাল থেকে আকাশ কালো হয়েছিল। ১০টার দিকে নামল বৃষ্টি। চারদিক একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। এখন তিনটা বাজে। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। তবে অন্ধকার আগের মতোই। বাড়ির প্রতিটা রুমে আলো জ্বলছে।
আজ ছুটির দিন। আমাদের স্কুল নেই। বৃষ্টিতে ঘরে বন্দী হয়ে নানা রকম দুষ্টুমি করেছি। দুপুরে খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে খিচুড়ি করা হয়েছে। সঙ্গে ইলিশ ভাজা। ছুটির দিনে বাবাও বাড়িতে থাকেন। তিনি আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেডমাস্টার। আমাদের সঙ্গেই খেতে বসেছিলেন বাবা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ছোটরা সবাই আমার রুমে। লুডু খেলার আয়োজন চলছে। এ সময় দাদি এসে ঢুকলেন। আমার খাটে বসে ওই কথা বললেন। দাদির মুখে পান।
আমরা গল্পের গন্ধ পেলাম। লুডু বাদ দিয়ে দাদিকে ঘিরে বসলাম। তুমি জানলে কী করে?
মুখের পান গালের এক পাশে নিয়ে দাদি বললেন, শুনবি গল্পটা?
শুনব না মানে? বলো বলো। তাড়াতাড়ি বলো।
এ রকম বর্ষাকালের গল্প। তবে সেদিন বৃষ্টি ছিল না। ঝকঝকে রোদের দিন। তার আগে তোদের বলি, গল্পটা আমার মনে পড়ল কেন জানিস?
আমার মেজ বোন মৌ বলল, কেন?
ছোট মিলি বলল, আমি বলতে পারব। আজ যে ইলিশ ভাজা খাওয়া হয়েছে এ জন্য। ঠিক না দাদি?
দাদি হাসলেন। ঠিক একদম ঠিক।
আমাদের তিন বোনের এক ভাই। সে সবার ছোট। তার নাম অন্তু। সে বলল, গল্পটা তাড়াতাড়ি বলো দাদি। ভূত-পেতনির গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।
আমি বললাম, আমাদের সবারই ভালো লাগে। বলো দাদি, বলো।
মুখের পান গালের এক পাশ থেকে আরেক পাশে আনলেন দাদি। জানালার ওদিকে পিরিক করে পানের পিক ফেলে বললেন, এক গরিব চাষি ছিল, বুঝলি? সংসারে সে আর তার বউ। বাচ্চাকাচ্চা নেই। দুজন মানুষের সংসার চালাতেই হিমশিম খায় লোকটা। যেটুকু ধান চাষ করে তাতে টেনেটুনে দিন চলে যায়। গ্রামের এক কোণে নির্জন ছোট্ট বাড়ি। গাছপালা ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি। আশপাশে বাড়িঘর তেমন নেই। বাড়িতে একটা কুঁড়েঘর আর ভাঙাচোরা একটা রান্নাঘর। বিকেলের দিকে কিষান গিয়েছে নদীতীরের বাজারে। সস্তায় বড় একটা ইলিশ মাছ পেয়ে কিনে এনেছে। অনেক দিন ইলিশ খাওয়া হয় না। আজ রাতে ভাজা ইলিশ মজা করে খাবে। বাড়ি এসে বউকে বলল, ইলিশটা বড় বড় টুকরা করো। কড়কড়া করে ভাজো। আমার খুব ভাজা ইলিশ খাওয়ার সাধ হয়েছে। চাষির বউ ইলিশ কেটেকুটে রান্নাঘরে গিয়ে ভাজতে বসল। ততক্ষণে কিছুটা রাত হয়ে গেছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বর্ষার হাওয়ায় নড়াচড়া করছে গাছের পাতা। ঝোপ-জঙ্গলে একটানা ডেকে চলেছে ঝিঁঝি পোকা। আর কোনো শব্দ নেই।
মুখের পানে কয়েকটা চিবান দিলেন দাদি। আগের মতোই পিক ফেললেন জানালার দিকে। তারপর বললেন, চুলায় কড়াই বসিয়ে, তাতে তেল ঢেলেছে চাষির বউ। লবণ মাখানো ইলিশের টুকরাগুলো হাতের কাছে। চুলায় গনগনে আগুন। ভাজা মাছ তুলে রাখার জন্য একটা মাটির বাসন আছে ভাঙা বেড়ার ধারে। চাষির বউয়ের হাতে লোহার খুন্তি। কড়াইয়ের তেলে ভাজা হচ্ছে মাছ। খুন্তি দিয়ে সময়মতো মাছ উল্টে দিচ্ছে সে। দু-তিন টুকরা মাছ ভাজা হওয়ার পর তুলে রেখেছে বাসনে। নতুন করে কাঁচা টুকরা ছেড়েছে কড়াইতে। এ সময় দেখে ভাজা মাছের টুকরাগুলো নেই। বাসন খালি। চাষির বউ অবাক। আরে, ভাজা মাছ গেল কোথায়? এখনই না বাসনে রাখলাম? কোথায় উধাও হয়ে গেল?
আমরা চার ভাইবোন দম বন্ধ করে আছি। এই তো শুরু হয়েছে রহস্য। দেখি এখন কোনদিকে যায় ঘটনা? বাইরে বৃষ্টি তখন বেড়েছে। বড় বড় ফোটায় নিবিড় হয়ে নেমেছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। সেদিকে আমাদের কারও খেয়াল নেই।
দাদি বললেন, চিন্তিত মুখে চাষির বউ পরের দু-তিন টুকরা ভাজা মাছ রাখল বাসনে। কাঁচা মাছ কড়াইতে ছাড়ার ফাঁকে আড়চোখে খেয়াল রাখল ভাজা মাছ রাখার বাসনের দিকে। কুপি জ্বলছে তার হাতের কাছে আর চুলার আগুনের আলো তো আছেই। সেই আলোয় সে দেখে ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বড় মাকড়সার পায়ের মতো লিকলিকে একটা হাত এসে ভাজা মাছের টুকরাগুলো নিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যা বোঝার বুঝে গেল চাষির বউ। আরে, একটা পেতনি এসেছে তো ভাজা ইলিশ খাওয়ার লোভে! ওর হাত থেকে ইলিশ রক্ষা করা তো খুব কঠিন হবে। ওদিকে চাষি কুঁড়েঘরে বসে অপেক্ষা করছে। ইলিশ ভাজা হলে মজা করে খাবে।
অন্তু বলল, পেতনির হাত দেখেও ভয় পেল না চাষির বউ?
দাদির হাসি হাসি মুখ। না না, গ্রাম এলাকার মানুষ ওসব ভূত-পেতনি ভয় পায় না। শোন না তারপর কী হলো। চাষির বউ একটা বুদ্ধি বের করল। পেতনিটাকে বড় রকমের একটা শাস্তি দিতে হবে। ইলিশ ভাজা খাওয়ার লোভ ইহজনমের মতো ভুলিয়ে দিতে হবে। হাতের খুন্তি চুলার আগুনে গুঁজে দিল সে। ইলিশের কাঁচা টুকরাগুলো হাতের কাছে। মাত্র একটা টুকরা কড়াইতে ছেড়েছে। একদিকে ভাজা হচ্ছে সেই টুকরা, অন্যদিকে চুলার আগুনে লোহার খুন্তি পুড়ে লাল হচ্ছে। কড়াইয়ে ভাজা হওয়া টুকরার দিকে সে মন দিচ্ছে না। তার মন পড়ে আছে খুন্তির দিকে। ওটা পুড়ে লাল হলো কি না? একসময় দেখে, হ্যাঁ, লাল হয়েছে। কড়াইয়ের তেলে একটু বেশি ভাজা হয়ে গেছে মাছের টুকরাটা। মাটির বাসন সামনে এনে দুই আঙুলে ভাজা টুকরাটার, কী বলব ওটাকে, ওই যে ইলিশের টুকরায় লম্বা কাঁটার দিকটা থাকে, ওই জায়গাটা ধরে কোনো রকমে কড়াই থেকে টুকরাটা তুলে বাসনে রাখল। যেন কিছুই সে টের পায়নি এমন ভঙ্গিতে বাসনটা রাখল আগের জায়গায়। পুড়ে লাল হওয়া খুন্তি রাখল হাতে। ভাঁজা মাছ নেওয়ার জন্য বেড়ার ফাঁক দিয়ে যেই পেতনি তার লিকলিকে হাত ঢুকিয়েছে, অমনি চাষির বউ লাল টকটকে খুন্তি চেপে ধরল সেই হাতে। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ার পেছনে একটা আর্তনাদ। চন্দ্রবিন্দু লাগানো মিহি সুরের মরণ কান্না। বাঁবাঁ রেঁ মঁরঁছিঁ রেঁ, মঁরঁছিঁ রেঁ…
আমার সেজ বোন লিলি বলল, তারপর, তারপর?
স্বামীকে কিছুই বলল না চাষির বউ। মাছটা বড় ছিল বলে চাষি বুঝতেই পারল না যে তার মাছের কয়েক টুকরা গেছে পেতনির পেটে। পরদিন সকালবেলা চাষির বউ ভাবল, আচ্ছা দেখি তো খুন্তির ছ্যাঁকা খাওয়া পেতনিটার অবস্থা কী? সেটা কি রান্নাঘরের পেছনেই পড়ে আছে না পালিয়েছে? ওদিকটায় গিয়ে চাষির বউ দেখে কোথায় পেতনি? এ তো একটা দাঁড়কাক! বড় একটা দাঁড়কাক বসে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
অন্তু বলল, তার মানে পেতনি মরলে দাঁড়কাক হয়ে যায়?
দাদি পান চিবাতে চিবাতে বললেন, হ্যাঁ। এ জন্য গ্রাম এলাকার মানুষ বাড়িতে দাঁড়কাক দেখলে হুর হুর করে তাড়িয়ে দেয়।