আত্মহত্যার পরে

আত্মহত্যার পরে

খবরটা গ্রামের সীমা ছাড়িয়ে পুরো রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ল! আর সেই খবরে লোকাল এমপি ও মন্ত্রী আবু মকসুদের বিরোধী শিবিরে খুশির বন্যা বয়ে গেল, পুরো জাতি হয়ে পড়ল বিস্ময়ে হত-বিহ্বল! অথচ খবরটা শুরুতে এমন বড় কিছুই ছিল না, নিদেন পক্ষে মিডিয়ার সংবাদ গুরুত্বের বিবেচনায়।

হ্যাঁ, কয়েকটা জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বহীনভাবেই ছাপা হয়েছিল সংবাদটা। দুইয়ের পৃষ্ঠার আটের কলামে ছোট্ট একটা সংবাদ: ‘লোহাগাড়া থানার রশীদপুর গ্রামে বখাটের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সখিনা খাতুন (১৬) নামে এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে! এ ধরনের সংবাদ তো আমাদের দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠা উল্টালেই চোখে পড়ে, কই আমাদের মধ্যে কোনরকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে বলে তো মনে হয় না, বরং এই সংবাদগুলো দেখতে দেখতে আমরা এতো বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি যে, চোখে পড়লেও বরং গুরুত্বহীন সংবাদ হিসেবে এড়িয়ে যাই। অথচ আজ ক’দিন ধরে দেশবাসী মনোযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সিরিজ বিজয়ের সংবাদের মতো করে পড়ছে। আসলে এই ছোট্ট ঘটনাটাকে বড় সংবাদ বানিয়ে দিলো রিকশাচালক রইসউদ্দীনের বউ জমিলা খাতুন, অর্থাৎ সখিনা খাতুনের মা।

মন্ত্রী আবু মকসুদের মাথায় কোন ভূত চেপেছিল খোদা মালুম! সখিনা খাতুনের আত্মহত্যার চারদিন পর দলবল আর সাংবাদিকের বিশাল বহর নিয়ে মন্ত্রী আবু মকসুদ সখিনা খাতুনের মা জমিলা খাতুনকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিলেন তার বাড়িতে। সেদিন দরিদ্র রিকশাচালক রইসউদ্দীনের বাড়ির ছোট্ট উঠান ভরে উঠেছিল ভদ্রলোকদের ভিড়ে। রইসউদ্দীনের ছোট্ট ঘরে এত মানুষ তো আর ধরবে না, তাই মন্ত্রী সাহেব সাথে থানার ওসি আর মন্ত্রীর পিএ মোট তিনজনে ঢুকলেন রইসউদ্দীনের ঘরের ভেতর। মিনিট পাঁচেক পর জমিলা খাতুনকে সাথে নিয়ে বেরিয়েও আসলেন তারা। তার বেরিয়ে আসার সাথে সাথে ডজন খানেক টিভি ক্যামেরা ওই চারজনের মুখের উপর পড়ল। সমান সংখ্যক মাইক্রোফোন আবু মকসুদের মুখের উপর চলে এলো: আবু মকসুদ শুরু করল তার ব্রিফিং: ‘এই সন্তানহারা মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই, আমিও সন্তানের পিতা, তাই জানি সন্তান হারানোর বেদনা কত কঠিন, আমি এই গ্রামবাসীর সামনে অঙ্গীকার করছি, অপরাধী যেই হোক, ছাড় দেওয়া হবে না, উপযুক্ত শাস্তি তাদের পেতেই হবে।’

এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল, ঘটনার সূত্রপাত ঘটল যখন সাংবাদিকরা জমিলা খাতুনের প্রতিক্রিয়া জানতে গেল: অদ্ভুত! চোখে মুখে শোকের চিহ্ন মাত্র নেই, সিনা টান টান করে সাংবাদিকদের উদ্দেশে আঞ্চলিক আর প্রমিত মিশ্রণে অদ্ভুত ভাষা ভঙ্গিতে যা বলল, তার অর্থ দাঁড়ায় মোটামুটি এরকম: ‘এমপি সাব কিছুক্ষণ আগে আমার আতে ৫ হাজার টেকা দিয়ে বলেছে যে, যেসব বেয়াদবের কারণে আমার মাইয়্যা আত্মহত্যা করছে তারা বিরোধী দলের মানুষ ছিল যে, কিন্তু আসল কতা হলো যে, আমার মাইয়্যারে যখন ডিসটার্ব দিতে ছিল তহন আমি মেম্বারের কাছে গেছিলাম যে, মেম্বার আমারে বলেছে যে, ওরা মন্ত্রী সাহেবের পোলাপান আমার পক্ষে বিচার করা সম্ভব না যে, তুমি বরং চেয়ারম্যানের কাছে যাও, চেয়ারম্যানও আমারে একই কথা বলে পাঠাইছে থানার ওসি সাবের কাছে, ওসি সাব বলেছে যে, ওরা মন্ত্রী সাবের লোক, মন্ত্রী সাবের অনুমতি ছাড়া ওদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেওয়া যাবে না যে, আমি যেন এমপি সাবের কাছ থেকে মামলার অনুমতি নিয়ে আসি যে, আপনারাই বলেন যে, আমি এমপি সাবরে কই পাই? শেষে আমার মেয়ে চোখেমুখে কোন পথ না দেখি আত্মহত্যা করছে যে।’

কথাগুলো জমিলা খাতুন একটানা বলে একটু থামল, কিন্তু ততক্ষণে সাংবাদিকসহ উপস্থিত সকল মানুষই বিস্ময়ে হতবিহ্বল, তবে তারা তখনও জানতো না, এর থেকেও বড় বিস্ময় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। জমিলা খাতুন কথায় কিছুক্ষণ বিরতির ফাঁকে একবার বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে মন্ত্রী আবু মকসুদের দিকে তাকাল তারপর আবারও বলতে শুরু কলল: ‘আমি জানি আমার মাইয়্যার আসল খুনি এই মন্ত্রী সাব যে, এই মন্ত্রী সাবের বিচার কোনদিন হবে না যে, তাই আমার বিচার আমারেই করতে হবে যে…’

কথাটা বলেই মুহূর্তের মধ্যে পা থেকে একটা স্যান্ডেল খুলে সজোরে বসিয়ে দিল মন্ত্রী সাহেবের ডান গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় খেই হারিয়ে ফেলেছে উপস্থিত সবাই! কিংবা মনে হলো এই মাত্র রিক্টার স্কেলে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেল। তবে এত কিছুর পরও ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিলা খাতুন! আর তার মুখের উপর অনবরত আলো ফেলছে টিভি আর প্রিন্ট মিডিয়ার ক্যামেরাগুলো!

দৃশ্যপট: দুই

মন্ত্রী জুতোপেটা হবার খবর বিরোধী পক্ষের কাছে এক বিশাল উৎসবের উপলক্ষ। আর এই উৎসবের আমেজটা সবচেয়ে বেশি দেখা গেল লোহাগাড়া থানাতেই। গত নির্বাচনে আবু মকসুদের কাছে পরাজিত বিরোধী দলের সাবেক এমপি আবদু রশীদ ফারুকী ও তার দলের কাছে এটা তো রীতিমত কিশোর বয়সে ঈদের আনন্দের মতই মনে হচ্ছে! তাই স্বাভাবিক নিয়মেই মিষ্টির দোকানগুলোতে মিষ্টির দাম গেল বেড়ে আর টি-স্টলগুলো হয়ে উঠল বেশ জমজমাট! একই সাথে এতদিন ধরে মন্ত্রী আবু মকসুদের দাপটে যেসব বিরোধী পক্ষের কর্মী-সমর্থক কোণঠাসা হয়ে ইঁদুরের মতো গর্তে ঢুকেছিল তারাও দলে দলে বেরিয়ে এসে উৎসবে শরিক হলো। আর মন্ত্রী সাহেবের নিজ এলাকার এতদিন ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য মুহূর্তের মধ্যে যেন বিলীন হয়ে গেল।

এটাতো মন্ত্রীর নিজ এলাকার চিত্র মাত্র, সমগ্র দেশে তো অন্যরকম ঘটনা ঘটে যাচ্ছে! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রধান আলোচনার বিষয় এই ঘটনা, সেই সাথে একই বিষয়ের উপর অনবরত ব্লগ পোস্ট দিয়ে হঠাৎ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন সত্যবাদী বেয়াদব নামে এক ব্লগার। অন্যদিকে প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রধান শিরোনাম অনেকটা এই রকম: ‘এক গ্রাম্য অবলা নারীর হাতে মন্ত্রী লাঞ্ছিত!’ টিভি মিডিয়াগুলো আরেক ধাপ এগিয়ে মন্ত্রী সাহেবকে জমিলা খাতুনের জুতা মারার ভিডিওসহ পরিবেশন করল সংবাদটা। আবার কোন কোন অতি উৎসাহী মিডিয়া সংবাদটার সাথে যুক্ত করল সংবাদ বিশ্লেষণও। যথারীতি টিভি মিডিয়ায রাত বারোটা বাজে উপস্থিত হয়ে গেল একদল টক-শো-বাজ বুদ্ধিজীবী। এই টক-শো-বাজ বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ জাতির সামনে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখালেন: ভদ্রমহিলা আসলে অপ্রকৃতস্থ, বিশ্বস্তসূত্রে তারা খবর পেয়েছেন জমিলা খাতুন নামক এই মহিলা দীর্ঘদিন মানসিক চিকিৎসা করিয়েছেন, একজন পাগলির পাগলামিকে আসলে বিরোধী পক্ষ বড় করে দেখাচ্ছেন। আরেক অংশের বুদ্ধিজীবীরা এই মতের তীব্র বিরোধিতা করে বলছেন: সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটেছে জমিলা খাতুনের আচরণে, এই নারী বাংলার বীর নারী, কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে বলছেন, এই দেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে অমরত্ব পেয়ে যাবেন এই জমিলা খাতুন।

তবুও ভাল হতো, যদি এই দুই তথ্যের মধ্যেই ঘটনাটা সীমাবদ্ধ থাকতো, কিন্তু তা তো হবার নয়, আমরা দেখছি, নতুন আরেক তথ্য হাজির হচ্ছে হোম মিনিস্টারের মিট দ্য প্রেসে: এটা বিরোধী দলের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার অংশ, এর সাথে বিদেশি ষড়যন্ত্র যুক্ত আছে, মহিলাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে দিলেই নাটের গুরুরা সব বেরিয়ে আসবে! এমন বিস্ফোরিত মন্তব্য শোনার পরও বিরোধী দল চুপ করে বসে থাকবে এমনটা আশা করা যায় না, সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা তথ্য নিয়ে হাজির হলো বিরোধী দল: এই জমিলা খাতুন এমনই নারী- যার সাথে তুলনা করা যায়, মাদার তেরেসার সঙ্গে! সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলের নেতাকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করে বসলেন: মাদার তেরেসা কি কাউকে কখনও জুতা মেরেছেন? বাকপটু বিরোধী দলের নেতা উত্তরটা যেন আগ থেকেই বানিয়ে রেখেছিলেন, আর সেটাই উগলে দিলেন সব সাংবাদিকদের কাছে: না, মারেন নি, তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, আর আমাদের মাদার তেরেসা জমিলা খাতুন জুতা মেরেছে দেশে শান্তি আনার জন্য, আমরা দাবি করছি মাদার তেরেসার মতো তাকেও নোবেল পুরস্কার দেওয়া হোক! মিডিয়ার এই মহা গর্জনের মধ্যেই ব্লগার সত্যবাদী বেয়াদব লিখছেন: একজন জমিলা খাতুনের ক্ষোভ এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি, গুণ্ডাতন্ত্রের বিরুদ্ধে! অথচ উভয় পক্ষ তার রাগ-ক্ষোভটাকে উপলব্ধি না করে তাকে নিয়ে বরং রাজনীতি করছে!

দৃশ্যপট: তিন

এদিকে লোহাগাড়া থানার অন্তর্গত গরিব রিকশাচালক রইসউদ্দীনের বাড়িতে ঘটে চলছে অন্য ঘটনা! বিরোধী পক্ষের নেতা ও সাবেক এমপি আবদু রশীদ তার লোকজন নিয়ে এক সন্ধ্যায় রইসউদ্দীনের ঘরে উপস্থিত হলো জমিলা খাতুনের সাথে দেখা করতে। জমিলা খাতুন তখন মাটির চুলাতে লেপ দিচ্ছিল। আবদু রশীদ ও তার লোকজন সোজা জমিলা খাতুনের ঘরে ঢুকে শুরু করল মায়াকান্না। রইসউদ্দীন ঘরে ছিল না, তাই জমিলা খাতুন এত মানুষ দেখে একটু ভড়কে গিয়ে ছিল বটে, মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে- আবদু রশীদের মুখের উপর বলে বসল: ‘এত অভিনয়ের দরহার নাই বাজি কি হয়বা তারাতারি হ।’ আবদু রশীদ কিছুক্ষণ সাঙ্গদের মুখের দিকে তাকিয়ে, এবার ঝেড়ে কাশতে শুরু করল: ‘আপনে যে কাজ করেছেন এ এক বিরাট বিপ্লবী কাজ, আপনার এই কাজের জন্য পুরো লোহাগাড়াবাসী গর্বিত, সমস্ত লোহাগাড়াবাসীর পক্ষ থেকে আপনাকে একটা সংবর্ধনা দিতে চাই।’

জমিলা খাতুন একথার কোন জবাব না দিয়ে আবদু রশীদের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর আবদু রশীদের এক সঙ্গী কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল: সার আপনার কথা মহিলার মাথার উপর দিয়ে গেছে, আরো সহজ করে বলে দেন। আবদু রশীদ বলা কথাগুলো এবার সংক্ষিপ্ত ও সহজ করে বলতে লাগল: ‘ওবা হালা, আঁরা উগ্যো মিটিং ডাককি, যে হতা তুঁই এমপিরে হই জোতা মাইজ্য, একই হতা আঁরার মিটিং-এ হইত পারিবা না?’ জমিলা খাতুন এবার চোখ বড় করে তাকাল, তারপর মুখে বিরক্তের চিহ্ন এঁকে বলল: ‘যা হনের হই দি বাজি, নয়া গরি কিছু হইত পাইত্তাম নো।’ এভাবে মুখের উপর না করে দেওয়াতে আব্দুদু রশীদ প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে, মনে মনে বলছে: দুই পয়সার মানুষ, অথচ ভাবখানা….! বহু কষ্টে সেই রাগ চেপে রেখে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল: ‘ভাবিচঅ, তোঁয়ারে এমপি দিয়ে ৫ হাজার আর আঁয় দিয়ম ৫০ হাজার। জমিলা খাতুন এবার একটু ঢোক খিঁচল, তারপর নরম স্বরে বলল: ‘তোঁয়ারা এহন য বাজি, আঁয় ইক্ষীণি ভাবি চাই।’

রশীদ স্পষ্টত বুঝতে পারল জমিলা খাতুন টোপ গিলতে শুরু করেছে, আবার ভাবতে গিয়ে যদি মন্ত্রীর লোকজন আরো বেশি টাকা দিয়ে জমিলা খাতুনের মাথায় ভিন্ন ভাবনা ঢুকিয়ে দেয়! সে ভাবনাও তাকে ভাবিত করছে, তাই জোর দিয়ে বলে বসল: ‘বাজি ভাবা-ভাবির হাম নাই, যা হনের এহন হই দঅ, আঁরাতে অনুষ্ঠানের আয়োজন গরন লাইবো, শত শত সাংবাদিক আইবো, তুঁই বক্তৃতা দিবা আঁয় বক্তৃতা দিয়ম বৌত হাম বাকি আছে।’ জমিলা খাতুন এবার আগের থেকে স্বর একটু নরম করে বলল: ‘তা তো বুঝ্যি কিন্তু ইক্ষীণি মাইয়্যার বাপতে ফুস গোইত্যাম।’ রশীদ এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল: ‘রইস্যারে আঁরা বুঝায় হইয়ম, তুঁই ঠিক থাকিলে ওইয়ে।’ জমিলা খাতুন এবার আর কোন কথা বলল না, আর রশীদ বুঝে নিল এটা জমিলা খাতুনের পূর্ণ সম্মতির লক্ষণ। অবশ্যই মিডিয়াতে সংবাদ হিসেবে ততদিনে জমিলা খাতুন কিছুটা গুরুত্ব হারাচ্ছে আর ব্লগার সত্যবাদী বেয়াদব তখনও অনলস লেখে যাচ্ছেন: জমিলা খাতুনকে বিরোধী দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, এই হতদরিদ্র অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলাটা সত্যিই এখন বিপদের মুখে আছে!

দৃশ্যপট: চার

লোহাগাড়া থানার রশীদপুর গ্রাম আবারও সাজ সাজ রব রব! এক জনসভা হবে সেই সভাতে বক্তৃতা করবে হঠাৎ আলোচিত হয়ে ওঠা এক গ্রাম্য নারী জমিলা খাতুন। জোর প্রচারণা চলছে, সাংবাদিকরাও এসেছেন। মানুষের কৌতূহলের সীমা পরিসীমা নেই। অনেকে কাজকর্ম বাদ দিয়ে উপস্থিত হয়েছেন সেই জনসভাতে। এই বীর সাহসী ও হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা নারীকে এক নজর দেখার জন্য শুধু পুরুষ নয়, অনেক নারীও উপস্থিত হয়েছেন। যা হোক জনসভা যথারীতি শুরু হলো। অনেক নেতা পাতি নেতা বক্তৃতা করার পর মাইক্রোফোনের সামনে এলো আবদু রশীদ। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথমে উপস্থিত মানুষদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তার মনটা একেবারে ভরে গেল। অনেকদিন এত মানুষের সামনে তাঁর বক্তব্য দেওয়া হয় না, বুঝতে বাকি রইলো না, এই উপস্থিতি আসলে তার জন্য নয়, জমিলা খাতুনের জন্য, তাই জনতার মেজাজ ধরেই তিনি বলতে শুরু করলেন: ‘ভাইসব আমি জানি আপনারা আমার কথা শোনার জন্য এখানে আসেননি, এসেছেন সন্তানহারা মায়ের আহাজারি শোনার জন্য, তাই আমি আমার বক্তব্য দীর্ঘ করব না, শুধু বলব এই জালিম মন্ত্রী ও তার পোষা গুন্ডাদের হাতে কোন মা বোনের জীবন নিরাপদ নয়, অথচ আমি যখন এমপি ছিলাম তখন কোন মেয়ের দিকে কোন ছেলে কু’নজরে দেখার সাহস পায় নাই! তাই, এই এমপির বিরুদ্ধে আপনারা সংগঠিত হন, আন্দোলন গড়ে তোলেন, আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই।’

এতটুকু বলে আবদু রশীদ মাইক্রোফোন ছেড়ে তার নিজের আসনে গিয়ে বসলেন। তারপর সঞ্চালক মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে একের পর এক বিশেষণ আওড়াতে শুরু করল: মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর, বীর নারী, সংগ্রামী নারী ইত্যাদি রকমের ডজন খানেক বিশেষণ উচ্চারণ করে ঘোষণা করলেন এখন বক্তব্য দেবেন জমিলা খাতুন। সেই রিকশাওয়ালা বউ জমিলা খাতুন আজ তার সবসময়ের ময়লা ছেঁড়া শাড়িটা ফেলে নতুন একটা শাড়ি পড়ে এসেছে, যারা সবসময় তাকে কাছ থেকে দেখেছে তাদের কাছে ব্যাপারটা বড্ড বেমানান লাগছে, তবে সবচেয়ে বেশি অপরিচিত হয়ে উঠেছে তার চোখ দুটো, যেন আগুন ঝরছে! কোন রকম জড়তা ছাড়াই এসে দাঁড়াল, মাইক্রোফোনের সামনে: উপস্থিত সকলের দিকে এক পলক তাকিয়ে: ‘আমি আপনাদের কি বলব যে বা-জি?’ কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে আছে জমিলা খাতুন।

তারপর শারীর আঁচল দিয়ে চোখ মোছে আবারও বলতে শুরু করল: ‘অনেক কষ্ট করে আল্লাহর কাছ থেকে আমি আমার মাইয়্যাটারে খুঁজি নিছিলাম যে, বিয়ার ১০ বছর পর মাইয়্যায়টা আমার পেটে আসছিল যে, এর জন্য মসজিদ-মাজারে কত মানত-চিনত করছি যে। এই ১০ বছর মানুষের কম কথা শুনতে হয় নাই যে, মানুষ বলতো আমি বাঁজা, আমার মুখ দেহে কামে গেল ফল ভাল হবে না যে। তখন কি কষ্ট লাগতো আমার সখিনা খাতুন পেটে আসার পর সেই কষ্ট থেকে আছান পাইলাম। আল্লাহ সখিনা খাতুনরে আমার কাছে ১৬টা বছর রাখল মাত্র। লেখা-পড়ায় আমার মাইয়্যার মাথা খুব ভাল আঁচিল যে, তাই সারেরা তারে খুব আদর করত যে। আগামী বছর মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার কতা আছিল, কিন্তু ওই বদমাইশরা দিতে দিল না যে, ত্যাক্ত বিরক্ত করি মাইয়্যাটারে মরার পথে ঠেলি দিছে যে।’

এই পর্যন্ত বলে জমিলা খাতুন একটু থামল, তারপর ইতিউতি দেখে নিল একবার, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মঞ্চে থেকে কেউ একজন এসে তার দিকে এগিয়ে দিল একটা পানির বোতল। জমিলা খাতুন এবার পানির বোতলটা মুখে দিয়ে ঢক ঢক করে অর্ধেক পানি এক নিশ্বাসে শেষ করল। পানি শেষ করে জমিলা খাতুন একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। মুখে এক ধরনের পরিতৃপ্তির ভাব। মনে হচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া আত্মাটা পানি পেয়ে যেন নতুন ভাবে জেগে উঠেছে। এবার কণ্ঠস্বর আরো ভারী করে: ‘এই লোকগুলা আমারে এখানে টাকার লোভ দেখাই জোর করে আনছে যে, আচ্ছা টাকা দিয়ে কি আমার মাইয়্যা ফেরত পাওয়া যাবে? আর এই মানুষগুলাও কত ভালা আমি চিনি যে, যে বদমাইশদের জন্য আমার মাইয়্যা মরছে, এগুলা আগে এই মানুষের দলে আছিল যে, এখন ওরা আরেক দলে গেছে যে, গদিতে আসলে এই বদমাইশরা আবার ওই তাদের পিছনে দেখা যাবে যে! জোতার বাড়ি আমি একটা দিছি আরেটা বাকি আছে যে! কথাটা বলেই মুহূর্তের মধ্যে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে নিয়ে মঞ্চে বসা রশীদের মুখের উপর ছুঁড়ে দিল জমিলা খাতুন।

বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য ভেদ করে স্যান্ডেল গিয়ে পড়ল রশীদ সাহেবের ঠিক মুখের উপর! উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ বিস্ময়ে হত বিহ্বল। জমিলা খাতুনের প্রথম জুতা নিক্ষেপের ঘটনা যারা লাইভ দেখতে পারেনি, তাদের জন্য জুতা নিক্ষেপের দ্বিতীয় ঘটনাটা হলো পরম আত্মতৃপ্তির। এই আত্মতৃপ্তি নিয়েই যার যার ঘরে ফিরে গিয়ে বসল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সামনে, কিন্তু তারা চরম হতাশ হয়ে দেখল প্রথম ঘটনার মতো করে দ্বিতীয় ঘটনা মোটেও উত্তাপ ছড়াল না! এই হতাশাগ্রস্ত অতি উৎসাহী কেউ কেউ সকালে ঘুম থেকে উঠেই রওনা দিল বাজারের উদ্দেশে, গাটের পয়সা খরচ করে কিনে আনল হাতের কাছে যতরকমের সংবাদপত্র আছে তার সবগুলো থেকে একটা করে কপি। কিন্তু সেখানেও তারা আশাহত হলো, অধিকাংশ সংবাদপত্রই খবরটা এড়িয়ে গেল, যে দু’তিনটা পত্রিকা গুরুত্বহীনভাবে সংবাদটা ছেপেছে তাদের মধ্যে থেকে একটা পত্রিকা অবশ্যই জমিলা খাতুনকে উপাধি দিলেন জুতা পাগলি নামে! তবে সত্যবাদী বেয়াদব তখনও অনলসভাবে লেখে যাচ্ছেন: ‘জমিলা খাতুন এখন মিডিয়া থেকে হারিয়ে গেছে, বাস্তব জীবনে কি সে এখনও বেঁচে আছে? এক শয়তানের বিরুদ্ধে যখন জমিলা যুদ্ধ করতে নেমেছিল, তখন আরেক শয়তান তার মিত্র হিসেবে ধরা দিয়েছিল, কিন্তু দুই শয়তানের বিরুদ্ধে যখন সমান তালে যুদ্ধ শুরু করল তখন তো তার বেঁচে থাকার উপায় রইল না, এখন আমরা শুধু এতটুকু আশা করতে পারি, জমিলা খাতুন যেন মরার পরও আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকে!’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত