ওয়ারিশ

ওয়ারিশ

অনেক গুলো টাকা! এই অনেক গুলো টাকা আবার বহুভাগে ভাগ হয়েও প্রস্থ মোটামুটি স্বাস্থ্যবানই আছে। চার কন্যা তিন পুত্রের গুচ্ছ গুচ্ছ সন্তানদের মধ্যে ভাগ হয়েছে মহা স্বাস্থ্যবান বান্ডিল গুলো। অংকের চুলচেরা হিসাব।

কন্যার ঘরে কন্যা হিসাবে সুরাইয়াও পেয়েছে বেশ কয়েকটা দর্শনীয় স্বাস্থ্যবান বান্ডিল। সুরাইয়ার সংসারেও তৃতীয় প্রজন্মের পদচারনা বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই। ওর পুত্র কন্যাদের মধ্যে জমি জমাগুলো, ভাগ বাটোয়ারা করে ও এখন ছাড়া হাত পা। বৈষয়িক চিন্তা মুক্ত সময়েই এলো এই উত্তরাধিকারের ভাগ।
নানীজান গত হয়েছেন তাওতো প্রায় বছর ত্রিশেক হবে। সুরাইয়ার মা বাবাও গত হয়েছেন বছর বিশেক তো হবেই। মাথার উপরের যে সম্পর্ক গুলো আশীষ ছড়াতো জীবন চলার পথ যখন চারদিক থেকে মেঘলা আঁধার ঘন হতো, তখন সঠিক পথটা চিনে নিতে সাহায্য করতো, প্রতিনিয়ত আলোক দ্যূতি ছড়াতো সে সম্পর্কগুলো প্রায় নিঃশেষ। ধুঁকে ধুঁকে আলো জ্বলা সময়েই ঝরণা ধারার মতো নেমে এলো এই প্রাপ্তি যোগ।

এটা কি নানীজানের আর্শীবাদ। যা টাকা কখনও আশীষ হয় নাকি। ভাবনাটা বিব্রত করে সুরাইয়াকে। তবে এটা যে আশীষ সেটা বুঝতে পারছে।
সকালেই সিগনেচার করতে মামাতো খালাতো ভাইবোনেরা, সাথে দুজন জীবিত দুই খালা ও দুই মামা একত্রিত হয়েছে। ভাই বোনগুলো পরষ্পর পরষ্পরকে ঠিকমত চিনতে পারছেনা। দীর্ঘ অযোগাযোগের কারনে। কবে কবে ছোট ছোট ভাই বোন গুলো বড় হয়ে এমন বদলে গেল অচেনা চেহারায়।

কোন কোন ভাই তো রিতীমত দাড়িওয়ালা ভুড়িওয়ালা কোন কোন বোন দীর্ঘ ঘোমটায় মুখের অনেকাংশ ঢেকে রেখেছে। শাশুড়ী-দাদী-নানী হয়েছেও কেউ কেউ। চাকুরী-ব্যবসার কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকার কারণেই বর্তমানের এই চেহারাটা অচেনা।
বড়মামা তার ছেলের কাঁধে ভার দিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসে। দুই অসুস্থ খালাও এসছে মায়ের ওয়ারিশ হিসাবে। ছোট মামা তুলনা মূলক ভাবে সুস্থ ও সবল।

আহাঃ কতদিন পরে দেখা হল প্রানের স্বজনদের সাথে। বয়স অনুযায়ী ভাগ হয়ে ছোট ছোট জটলা বেঁধে কথা বলছে। এগিয়ে যায় সুরাইয়া- ও সবগুলো জটলার সাথেই কথা বলবে, সবাইকে ছুঁয়ে দেখবে। কাছাকাছি দূরত্বেই জটলা-তাই পরষ্পরের কথা পরষ্পর শুনতে পাচ্ছে। সবগুলো দলেরই মূল আলোচনার বিষয় হলো কার ভাগে কত পড়লো। আজ যেন ওদের ভাগ আর টাকা ছাড়া কোন কথাই নেই। টাকার বিষয়টা যেন ওদের সম্পর্কটাকে জোড়ালো করে বাঁধছে।

যাদের ভাই বোনের সংখ্যা বেশী তারা কম ভাইবোনওয়ালাদের দিকে তেরছা করে তাকাচ্ছে। বেশীওয়ালারা নিজেদের আদরের ভাই বোনগুলোর দিকেও ভ্রæকুঁচকে তাকাচ্ছে। ভাবছে এই জঞ্জাল গুলো না থাকলে ভাগটা দর্শনীয় হতো। থোক টাকাটা হাতে পেলে বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যেত। বড় বেশী স্বার্থের গন্ধ ছড়াচ্ছে ভাবনাটা। অথচ ওরাই একদিন বেশী ভাইবোন আছে বলে আনন্দ পেত। আলো ছায়ার ভেতরটা অজান্তেই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে বড় উগ্রভাবে বাক্যে স্বরে।

-বাজার দর অনুযায়ী বিক্রি করতে পারলে কত টাকা হতো কেউ কল্পনাই করতে পারছেনা। আর যদি প্লট করে বিক্রি কতে পারতাম তাহলে একেকজনের একটা করে দামী গাড়ী হয়ে যেত।দখলইতো বুঝিয়ে দিতে পারলাম না। দখলটা বুঝিয়ে দিতে পারলেও আরো দাম উঠানো যেত।

এখন ওসব নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। যে পার্টি কিনেছে না তার সামনে দাঁড়াতে হবে না। আর দখল টখল নিয়েও ভাবতে হবেনা। ক্ষমতা টাকা এবং লাঠির জোড় সবই তার আছে।

-উফঃ বাঁচা গেল আমাদের জমি আমরা বিক্রি করছি। আবার টাকাও বুঝে নিচ্ছি এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়।
-ঊহু ঘুরিয়েছে, এই আধা তোলা মানুষদের। এবার বোঝ সেরের উপর একমন।
সবাই কথা বলছে একই বিষয়ে, সবার কন্ঠই আনন্দময় বিজয়ী।
-নানীজান সব মিলিয়ে কত পেলরে।
আচমকা সুরাইয়ার প্রশ্নে বিষম খায় সবাই।
-নানীজান। সমস্বরে বলে উঠে।
পরক্ষণেই নিজের ভেতরের বোধেই উত্তর পায় সবাই। হ্যা জমির আসল মালিক তো আমেনা বেগম। তিনি মরহুমা। তাই তার উত্তর সূরী হিসাবেই ওরা সবাই এখানে এসেছে। আমেনা বেগম কারো মা কারো নানীজান কারো দাদীজান।
সুরাইয়ার উকিল ভাই পেটমোটা কালো ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে। সোনালী চেন আঁটকানো বুকে ঝোলা চশমা চোখে এঁটে ভাল করে দেখে যে টাকার অংক বলে তাতে সুরাইয়ার ভড়কে যায়।

সুরাইয়ার খুব খারাপ ধরনের কোমরের ব্যাথা আছে। ও বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সামনের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়ে। মাথার উপর তপ্ত জ্বালা পোড়া তাতানো রোদ ঠেকাতে লম্বা ঘোমটা টেনে দেয়।

আহারে ওর চিরদুঃখী নানীজানের হতদরিদ্র নত্মুখী, অভাবে লাজ্জিত মুখটা বুকের ভেতর মাথার উপর সূর্যের মত ষ্পস্ট হয়ে ওঠে।
-নানীজান এতো ধনী ছিলেন। কখনও জানা ছিলনা। নানীজানের সস্তা মাটি ওরা বিক্রি করলো মঙ্গলগ্রহের এক টুকরো জমির দামে। মঙ্গলগ্রহ শব্দটা মনে হতেই হাসি পেল। উপমাটা কি ঠিক হল।

আজকাল ওরাইতো এমন দামেই এই শহরেই কিনেছে জমি। টাকার মূল্যমানে জমির দাম বেড়েছে। আচ্ছা নানীজান তো তার বাবার সম্পদের এই পরিমান মালিক ছিল তখনও।

তখন শুধু সুরাইয়ার প্রাপ্য টাকার পরিমান দিয়েইতো। বেশ সচ্ছল ভাবে যাপন করতে পারতেন জীবন। ঢাকায় একটা বাড়ী, মামাদের ব্যবসা, খালাদের বিয়ে, সব কিছু স্বাচ্ছন্দে বহন করতে পারতেন। তাহলে নানীজানের সংসারের নানা জটিল অনটনের যাতাকলে ক্লিষ্ট দীন হীন শান্ত মুখটার বদলে ঝলমলে চেহারা আঁকা থাকতো।

-লেগে এসে গেছে! এসে গেছে!! যিনি জমি কিনছে তিনি বোধ হয় এলো। চকচকে কালো গাড়ী থেকে নামলে এক রাজপুত্র। আপেলের মত চেহারা। অল্প বয়সে এতো টাকার মালিক। পেছনের অপেক্ষাকৃত কম দামের গাড়ী থেকে নামলো, ষন্ডামার্কা চেহারার পাঁচ ছয়জন যুবক। এরা মনে হয় আপেল মার্কার পাইক পেয়াদা। বর্তমান ভাষায় বডিগার্ড।

সুরাইয়াকে অবাক করে চলমান আপেলটা বিনয়ে নুইয়ে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলো। সুরাইয়া শুনেছে যিনি জমি কিনেছে তার ক্ষমতা আর টাকা আকাশ চুম্বি। টাকাওয়ালাদের সাথে এতো ভদ্রতা বিনয় বোধ, আশ্চর্যতো।

অফিসের ভেতরে চলে যায় সবাই। সাথে সাথে অফিসের লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। ওদের ভাইবোনেরাও বাইরে থেকে ভেতরে এসে বসে। এতোক্ষনের জোর গলার কথা গুলো ফিস ফিস শব্দে আসন গড়ে।

ঠান্ডা পানীয়র বোতল খোলা হয় সশব্দেই, সবার হাতে হতে পৌছে যায় নাশতার প্লেট পানির বোতল আর ওয়ান টাইম ইউজের গ্লাসে হীম শীতল পানীয়।
শিশির ছোঁয়া গ্লাসে হাত বুলায় সুরাইয়া। চরমে উঠা গরমে, এই পরম শীতলতা চমৎকার আবেশ এনে দেয়। পেলবতা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কেউ একজন এসির সুইচ অন করে দেয়। এবার পরিপূর্ন আরামটা ডাল পালা ছড়ায় শরীরে।

“কাঁজ সারতে দেরী হবে”। বিষয়টা নিশ্চিত হবার জন্য হাত ইশারায় ষন্ডাদের একজনকে কাছে ডাকে। ওরা আবার “সূর্যে পোড়া বালির” মত। কেমন যেন অবিনীত ভাবে হাঁটছে। মোবাইলে কথা বলছে। অবিনীত শব্দটা নিয়ে খটকা লাগে নিজের কাছেই। অবিনীত না দুর্বিনীত কোনটা ঠিক। দুর্বিনীত শব্দটায় কেমন তেজস্বী আলো আছে যার দ্যূতি বহুদুর থেকেও দেখা যায়। আর অবিনীত শব্দটা এই ষন্ডাদের সাথেই মানায়। আঁধার আঁধার কাঁটা কাঁটা।
-আজ কাজ হতোইনা লিডার এসে গেছে এখন দেখবেন কেমন কাজ হয়।

একটু পরে বোঝা গেল আগের লিডারটা আসল লিডার নয়। সে লিডারের ছায়া, মানে পুত্র।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত