নাসিমার হিসাব-নিকাশ

বাড়িটা বেশ বড়। আলিশান। এতো বড় বাড়ির অন্য সকল ঘর ও বারান্দা সবসময় চকচকে, মোছা আর খটখটে শুকনো থাকলেও, বাথরুমের মেঝে সর্বদাই ভেজা থাকে, যেমনটা থাকে এ অঞ্চলের অন্য প্রায় সব বাড়িতেই। এটাই যেন বৈশিষ্ট্য। বাথরুম মানেই গোসল করার স্থান শুধু নয়, মলমূত্র নির্গমনের জায়গাও বটে। অর্থাৎ অবস্থানগতভাবে বা মূল্যায়নের দিক থেকে সকলের মনেই কাজ করে যে, বাথরুম বাড়ির ভেতর অপেক্ষাকৃত কম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নিম্নমানের একটি স্থান। আর পরিচ্ছন্নতার প্রতীকই যেহেতু পানি ঢেলে সাফসতুর করা, বাথরুমে গেলেই সকলের অভ্যেস যত্রতত্র অনবরত এবং অনর্থক পানি খরচ করা। আর এ জন্যেই বোধহয় বাথরুমের মেঝে দিনরাত্র সবসময় ভেজা থাকে। কখনো সখনো, বিশেষ করে বর্ষাকালে, এখানে-সেখানে পাতলা শ্যাওলাও জমে।

বাথরুমের ভেজা মেঝেতে পিছলে পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয় নাসিমাবানুর। তবু সেদিন দুপুরে বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে পিছল মেঝেতে প্রচণ্ড চোটে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে যখন আর কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারেন না, তখনই বোঝা যাচ্ছিল সাধারণ পড়ে যাওয়া এটা নয়। পঞ্চাশ-উর্ধ্ব নারী-শরীরে হাড়-গোড় খুব ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, একথা বহুবার শুনেছেন নাসিমাবানু। কিন্তু এতটা হতে পারে তার ব্যাপকত্ব, জানা ছিল না। এক আঘাতেই পাঁজরের দুটি হাড়, ডান কণ্ঠনালীর বাঁকানো মোটা হাড়, বাঁ হাঁটুর চাকতি আর ডান হাতের কব্জির দু’খানা সূক্ষ্ম হাড় একসঙ্গে ভেঙে যাওয়া কম কথা নয়। তবু অতি আধুনিক ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় শৈল্য ক্লিনিকে যাবার চারদিনের মাথাতেই প্রায় পুরো শরীর প্লাস্টারে বাঁধা স্মিথমুখী নাসিমাবানু হুইল চেয়ারে বসে ঘরে ফিরতে প্রস্তুত। এই অঞ্চলের অন্যতম বিত্তবান ও জনদরদী ব্যবসায়ী ফজল মিঞা জাপানি এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে যৌথ উদ্যোগে তৈরি করেছেন এই বিশেষ ক্লিনিক, যা এই অঞ্চলের জনগণের জন্যে এক বিরাট গর্বের ব্যাপার। এরকম উন্নত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ সেবাদানকারীসহ এমন একটি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি এই অঞ্চলে দৃশ্যতই বেমানান লাগে। এ যেন অবারিত বালির বাঙ্গি ক্ষেতে এক টুকরো চাঁদের হাট।

স্ট্রেচারে নাসিমাবানুকে ক্লিনিকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল, তাঁর অনুপস্থিতিতে এই বাড়ি, তাঁর গোটা পরিবার চলবে কী করে? কেউ তো কিছু জানে না, সংসারের নিটিগ্রিটি। কীভাবেই না দুমরে মুচরে ভেঙে পড়বে সব। তাকে ছাড়া দৈনন্দিন কাজকর্ম সব দেখবে কে? কে ওদের বলে দেবে কী করবে, কী রাঁধবে, কাকে কতো টাকা দিতে হবে? নাসিমাবানু নিশ্চিত ছিলেন, যবুথবু হয়ে একেবারে স্থবির হয়ে পড়বে সবকিছু, বাড়ির সকল অধিবাসীসহ! তাঁর ক্লিনিকে থাকাকালীন অবস্থায় ওরা সকলে কী করে চারদিন কাটিয়েছে ঐ বাড়িটাতে, ভাবতেই পারেন না নাসিমা। বিয়ের পর থেকে জীবনে এক রাতও তিনি থাকেননি এই বাড়ির বাইরে। অফিস থেকে আইটির এক ট্রেইনিং-এ একমাত্র পুত্র ভাস্করের আবার সে সপ্তাহেই সিঙ্গাপুর যাবার কথা ছয় মাসের জন্যে। নাসিমাবানু ও ভাস্কর দু’জনেরই ইচ্ছা ছিল, প্লাস্টার করা শরীর নিয়ে ঘরে ফিরেই বাকি ও প্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপিগুলো নেবেন নাসিমা। ফজল মিঞার সারাজীবনের সঞ্চয় ও উত্তরাধিকারের শেষ কড়িটির দানে গড়া এই আধুনিক শৈল্য-ক্লিনিক ছেড়ে না যাবার জন্যে অবশ্য ফজল মিঞা নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিলেন হাশেমকে, নাসিমাবানুকে। ফজল মিঞার যুক্তি ছিল, নাসিমাবানুদের মতো মানুষ এখানে থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিলে সাধারণ মানুষের এই ক্লিনিকের ব্যাপারে উৎসাহ বাড়বে। এর মান সম্পর্কে, এর স্টেটাস নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না।

ঘরে গেলেও সপ্তাহে দু’ থেকে তিনদিন এখানে আসতেই হতো হাত-পায়ের মাংসপেশীর জোর বাড়াবার জন্যে ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ফিজিওথেরাপি নিতে। এসব যন্ত্রপাতি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে ছোটখাটো যন্ত্রসহ থেরাপিস্টের ঘরে যেতে কোনো বাধা নেই। এতে পুরোপুরি সারতে এবং কর্মক্ষম হতে সময় লাগতে পারে কিছু বেশি। তা সত্বেও দীর্ঘদিন ক্লিনিকে থাকার কথা চিন্তা করেননি নাসিমাবানু। ভাস্করেরও মনে হয়েছিল, মামণি ঘরে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। শুধু তাই নয়, বাড়িতে যেহেতু এতোগুলো মানুষ রয়েছে, মামণির দেখাশোনা, শুশ্রুষা, আদর-যত্নও ভালো হবে সেখানে। আর বাড়িতে থেকেই প্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপিও নেয়া যাবে। কিন্তু হাশেমের মত যে সেটা নয়, বিশেষ কওে ফজল মিঞার অনুরোধের পরে যে আরো নয়, সেটা বোঝা গিয়েছে আরো পরে। তবে একেবারে প্রথম থেকেই হাশেমের মনে হয়েছিল, নাসিমাবানুর সুস্থ হবার প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বীত হবে তিনি যদি ক্লিনিকে সার্বক্ষণিকভাবে ডাক্তার-নার্সদের নজর ও তত্ত্বাবধানে থাকেন। বাড়িতে গেলে সবার জন্যে সবকিছু করতে গিয়ে নিজের দেখাশোনা করতে অবহেলা করবেন নাসিমা। তবে নাসিমাবানুর দীর্ঘ ক্লিনিকবাসের ব্যাপারে কারো সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়া হাশেমের এক তরফা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুশী হননি নাসিমা। ভাস্কর তো নয়ই। কিন্তু এ নিয়ে কোনো তর্ক, অভিযোগ বা আপত্তিও তোলেননি তারা কেউ।

পাঁচমাস দীর্ঘ সময়। এই সময়ে প্রায় প্রতিদিনই ক্লিনিকে স্ত্রীকে দেখতে এসেছেন হাশেম। বিশেষ কোনো কারণে হাতে গোণা কয়েকটি দিন ছাড়া। সিঙ্গাপুর যাবার আগে যে ক’দিন এখানে ছিল ভাস্কর, সেও প্রতিদিন অর্থাৎ পর পর পাঁচদিনই এসেছে মাকে দেখতে। দু’বেলাতেই। বিকেলে প্রতিদিন তৃণাকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝেই এসেছে এই বাড়িতে বেড়ে ওঠা এবং এখন বিবাহিতা, এক সন্তানের জননী কানন। কাননের মা কুসুম একনাগাড়ে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে নাসিমার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে বিশ্বস্ত গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করার পর মাত্র কিছুকাল আগে গত হয়েছে। কাননকে নিয়ে বরাবর এ বাড়িতেই থাকতো বিধবা কুসুম। সেই ঐতিহ্য অনুসরণ করে কানন, তাঁর স্বামী বাদল ও একমাত্র শিশুপুত্র নিয়ে এই বাড়িতেই থাকে- সেই একই ঘরে, উঠোনের উল্টোদিকে, যেখানে তার মায়ের বাস ছিল এতোকাল। হাশেমের অফিসে পিয়নের কাজ করে কাননের স্বামী।

নাসিমাবানুর ক্লিনিকে থাকাকালীন শেষ মাসটাতে কানন আর একবারও আসেনি ক্লিনিকে তাঁকে দেখতে। বাড়িতে ঘর মোছা, বাসন মাজা আর কাপড় ধোবার জন্যে মাত্র বছর তিনেক ধরে রয়েছে মাঝবয়সী যে নারী, তার নাম শোভা। সেই শোভাই ক্লিনিকে সার্বক্ষণিকভাবে নাসিমাবানুর সঙ্গে থাকে, তাঁর দেখাশোনা করে। রাতেও ঘুমোয় সে এই ঘরেরই উল্টো পাশের সোফায়। তার কাছেই নাসিমাবানু শুনেছেন, কাননের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ইদানীং। সম্ভবত আবার পোয়াতি।
শেষবার যখন ক্লিনিকে নাসিমাকে দেখতে এসেছিল কানন, সঙ্গে তার স্বামী বা পুত্র ছিল না। সে একাই এসেছিল। কানন ক্লিনিকে থাকতেই ঘরে ঢোকেন হাশেম। পেছনে পেছনে তৃণা। কথায় কথায় নাসিমাবানু একসময় জানতে চেয়েছিলেন, বিকেলে হেঁটে আসার পরে আগের মতো হাশেমকে ঘরে বানানো ছানা দেয়া হয় কিনা খেতে? কানন অকারণে হাসতে হাসতে প্রায় গলে পড়ে যায়। হাসির দমক থামিয়ে কোনো মতে বলেছিল, ‘শুধু কি ছানা মামি? প্রতিদিন ছানার লগে মামা একখানা কইরা রসগোল্লা খায় আইজকাইল।’
‘সে কী?’
মুচকি হেসে তৃণা বলে, ‘শুধু কি রসগোল্লা? মামণি, বাপীর এখন প্রতি মুহূর্তে আরো কতো কিছু যে লাগে, ঘরে গিয়ে দেখবে। পকেটে রুমাল না নিয়ে বাইরে বেরোতে পারেন না। প্রতি শুক্রবার বিকেলে ঘন দুধ দিয়ে কফি খেতে হয়। চা চলে না।’ বলেই হাশেমের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে মুখ চাপা দিয়ে হাসি আটকাতে চায় তৃণা। হাশেম ভালো-মন্দ ঠিকবেঠিক কোনো কিছু না বলে, ওজর আপত্তি কিছু না তুলে চুপচাপ বসে থাকেন স্মিথমুখে। আর ঘরের চারদিকে কেমন এক তরল ভঙ্গিতে সপ্রতিভ নজর মেলে তাকান, বিশেষ কোনো কিছুর ওপর দৃষ্টিপাত না করেই।
ফ্যাল ফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন নাসিমাবানু। তার অনুপস্থিতিতে হাশেমের সঙ্গে অনেক সহজ হয়ে এসেছে ওদের আচরণ। আগে তৃণা অযথা কী ভয়ই না করতো হাশেমকে! তৃণার ভেতর এই চপল রূপটি এর আগে আর কখনো লক্ষ্য করেননি নাসিমাবানু। কানন তো হাশেমের সামনে আসতেই ভয় করতো। সেই কাননই বা কবে থেকে এতোটা মুখরা, এতোটা বেয়াদব হলো? এতো তাড়াতাড়ি এতোটা সাহসই বা পেলো কোথা থেকে ওরা?

এর কয়েকদিন আগেই কানন আরেকবার এসেছিল নাসিমাবানুকে দেখতে তার ক্লিনিকে। অঘ্রাণের এক সন্ধ্যার স্বল্প শীতে একটি বাদামী উলের চাদর দিয়ে সমস্ত মাথা মুড়ে কান ঢেকে। কানন ঘরে ঢুকতেই নাসিমাবানু কাননকে কাছে ডেকে তাঁর বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতে বলেন। কাননের গায়ের শালটা খুব পরিচিত ঠেকে তাঁর কাছে।
‘এই চাদর তুই কোথায় পেলি কানন?’
‘মামা দিল যে! খুব শীত পড়লো তো!’ বিনা দ্বিধায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল কানন। নাসিমাবানু চুপ করে থাকেন।
সেদিন বিকেলে হাশেম এলে নাসিমাবানু জিজ্ঞেস করেন হাশেমের মনে আছে কিনা তাদের বিয়ের পর পর প্রথম দার্জিলিং গেলে যে পশমী চাদরটা তিনি কিনে দিয়েছিলেন নাসিমাকে সেটা কীরকম দেখতে ছিল। কী রং! রং দূরে থাক, সেখান থেকে কোনো চাদর কেনার কথাই মনে করতে পারেন না হাশেম।
‘আজ কিন্তু সে চাদর গায়ে দিয়ে কানন এসেছিল এখানে।’ কথাটা চেপে রাখতে পারেন না নাসিমা।
ব্যাপারটা এতোক্ষণে ধরতে সক্ষম হন হাশেম। বোঝাতে চান, ওটা অনেক পুরনো একটা চাদর, স্মরণকালে নাসিমাকে কখনো গায়ে দিতে দেখেন নি তিনি। বহু বছর ধরে দলামোচড়া হয়ে আলমারির এক কোণে পড়েছিল। তাছাড়া একটা ফুটোও রয়েছে চাদরটার এক ধারে। এর কোনো কিছুই অস্বীকার করেন না নাসিমা। তবে শালের গায়ে এই ফুটোটা যে দীর্ঘ ব্যবহারের চিহ্ন নয়, কেনার দিনই হয়েছিল তা, অসাবধানতাবশত হাশেমেরই জ্বলন্ত সিগারেটের ডগায় লেগে, সেকথা মনে করিয়ে দিতে আর ইচ্ছা হয় না নাসিমার।

শুধু বলেন, ঐ চাদর অন্য কারো গায়ে তিনি দেখতে চান না, যদিও ওটা পুনরায় নিজ শরীরে তোলার কোনো বাসনাও আর নেই তার। কাননের শীত নিবারণের জন্যে নতুন একখানা চাদর সেদিনই কিনে দেবার জন্যে অনুরোধ করেন তিনি স্বামীকে।

মাত্র গতকালই ছিল পূর্ণিমা। পৌষ মাসের পূর্ণিমা। যে বাড়ি ছেড়ে গত পঞ্চাশ বছরে এক রাতও বাইরে কাটাননি নাসিমাবানু, সেই বাড়ি ছেড়ে একনাগাড়ে দীর্ঘ পাঁচমাস থেকে মাত্র আজ সন্ধ্যাতেই নিজ গৃহে ফিরে এসেছেন তিনি। বহুকালের অভ্যাস মতো দোতলায় উঠেই আজো জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ অথচ চাঁদের স্বাভাবিক কোমল ও চাপা স্নিগ্ধতায় মোড়া যে দৃশ্য তার চোখে পড়ল, তাতে চমকে ওঠা ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর। নিশ্চিত কোথাও বড় রকমের একটি ফাঁক তৈরি হয়েছে। কোথাও ভুল হচ্ছে, কিংবা বিশাল কিছু খোয়া গেছে তাঁর। ঘরে আসা অব্দি কোনো কিছুই যেন মেলাতে পারছেন না তিনি। এই মুহূর্তে দেখেন তাঁর শোবার ঘরের পাশে গোলাপ বাগানের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। গোলাপ গাছ তুলে ফেলে ওখানে কী সব অচেনা ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। সম্ভবত বিদেশী ফুল।

বোঝেন বদলে গেছে অনেক কিছুই এই বাড়িতে। মৌলিকভাবেই। এ শুধু দেয়ালে নতুন পেইন্টিং-এর সমাবেশ নয়। পারিবারিক পুরনো ছবিগুলোর এ-ঘর থেকে ও-ঘরে, কিংবা এই দেয়াল থেকে ওই দেয়ালে স্থানান্তরও বড় কথা নয়। এমনকি তাঁর নিজের পছন্দে নিয়োগ করা বহুদিনের রন্ধন সহকারিনীর রহস্যাবৃতভাবে চাকরিচ্যুতির অকস্মাৎ সংবাদ-উন্মোচনও নয়। গোটা বাড়ির আবহটাই কেমন যেন বদল গেছে। কোথায়, কেমন করে বদলেছে, চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলে নাসিমাবানু সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না হয়তো। কিন্তু টের পাচ্ছেন, তাঁর এতো দিনকার তিলে তিলে গড়া অতি পরিচিত সংসারটি এই ক’ মাসেই কেমন অপরিচিত হয়ে গেছে। নিজ ঘরে নিজেকে অতিথির মতো ঠেকছে তার। সব কিছুই কেমন যেন অন্যরকম। নতুন। অচেনা।

এই নিয়ে কারো সাথে কোনো কথা বলেননি নাসিমাবানু। জানালা থেকে সরে এসে আর একবারও সেদিকে আর ফিরেও যাননি। রাতে ঘুম আসেনি একটুও। অনেক রাতে বাইরের ঘরে তাসের বন্ধুদের বিদায় দিয়ে এক সময় পাশে এসে নিঃশব্দে শুয়ে পড়েছেন হাশেম। চোখ বুজে অসাড়, নিথর হয়ে ঘুমের ভান করে সটান পড়ে থেকেছেন নাসিমা। বহু বছরের অভ্যেস মতো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ার কথা এতো দিনের বিরতির পরে ওদের কারো মনে আসেনি, অথবা ইচ্ছে হয়নি। খাটের দুপাশে দুজন শুয়ে পড়েছেন অপরিচিতের মতো। আর শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাশেম নিশ্চিন্তে নাক ডাকতে শুরু করেন নির্দিষ্ট লয়ে বেশ জোরে জোরেই। দীর্ঘ রজনীও চোখের সামনে, অতি ধীরে, এক সময় শেষ হয়ে যায়।

সূর্য্যের আলো আকাশ ফুড়ে বেরুবার আগেই নাসিমাবানু বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। মুখ ধুয়ে, কাপড় বদলে শোভার ঘাড়ের ওপর বাম হাতখানা রেখে আর ডান হাত দিয়ে বংশ পরম্পরায় পাওয়া কারুকার্যময় সেগুন কাঠের লাঠিতে ভর করে ধীরে ধীরে হেঁটে একদা গোলাপ বাগানের কোণাটিতে এসে দাঁড়ান নাসিমা। গোলাপ নেই ঠিকই। তবে কাছাকাছি একসঙ্গে ফুটে থাকা এতোগুলো অচেনা রঙিন বিদেশী ফুল কেমন মনোরম দেখায় তাঁর চোখে। নাসিমাবানু বুঝতে পারেন, তাঁর এই প্রিয় বাগানটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে বিশেষ কাউকে নিয়োজিত করে যাননি তিনি হাসপাতালে যাবার আগে। সেসব করার মতো সময় বা মানসিক স্থিরতা ছিলও না তার তখন। বলে যাননি কাউকে তাঁর গোলাপ বাগানের চরিত্র বা চিত্র যেন কেউ কোনো পরিবর্তন করার চেষ্টা না করে। কিন্তু বলে না গেলেই তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? এভাবে? অন্য সবাই তো ছিল বাড়িতেই। সকলেই তো জানতো এই বাগান কতো প্রিয়, কতো হৃদয়ের কাছাকাছি ছিল তাঁর। অন্য সবকিছুই তো আছে। চলেছে এবং চলছে প্রবল গতিতেই, আগের মতোই, বা তার চেয়েও বেশি বেগে। রকমারী রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব। সবই। তাঁর এই ছোট্ট বাগানটিতেই কেন হুমরি খেয়ে পড়তে হলো ওদের?
প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় বাইরের ঘরে আগত স্থানীয় বয়স্ক ভদ্দরলোকদের সঙ্গে হাশেমের উষ্ণ মোলাকাত, উচ্চ হাসি, কথাবার্তা, আড্ডা, তাসখেলা, দাবা খেলা। কোনো কিছুই তো থেমে থাকেনি! বরং আরো বেড়েছে। তাহলে?

নাসিমাবানু শুনতে পান, বাড়ির ভেতর থেকেই হাশেম ডাকছেন তাঁকে চা খাবার জন্যে সামনের বারান্দায় চলে আসতে। বাড়ির দিকে পা বাড়ান নাসিমা। বারান্দায় চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখছে কানন। তার পেছনটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন নাসিমাবানু। নিতম্বজোড়া এরই মধ্যে যথেষ্ট ভাড়ি হয়ে এসেছে কাননের। চার-পাঁচমাসের গর্ভে এতোটা সাধারণত হয় না। কিন্তু কাননের গড়নই বুঝি এরকম। খুব সহজেই ভরাট হয়ে যায় শরীর। গেল গর্ভাবস্থাতেও এমন ঘটেছে। সামনে টেবিলের ওপর বাড়ানো তার স্বাস্থ্যবান গোলগাল, মোলায়েম হাত দু’খানায় ব্রোঞ্জের ওপর সোনা দিয়ে বাঁধানো পরিচিত সোনার চুড়ি (একসময় কুসুমকে দেওয়া) একগাছা করে প্রতি হাতে। কানন দু’হাতে কাপ প্লেটগুলো সাজিয়ে রাখছে টেবিলের ওপর। ওর গোটা শরীরটাই কেমন যেন কানায় কানায় ভরপুর, পরিপূর্ণ হয়ে এসেছে। এ বাড়িতে ঘোমটা দেয় না কানন কোনো দিনই, যেহেতু মায়ের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই মানুষ সে এখানে। নাসিমা লক্ষ্য করেন, কাননের হলুদ পাতলা ব্লাউজের পেছনের দিকে গোল করে কাটা বড় গলা যেখানে পিঠ পর্যন্ত নেমে গেছে, তাঁর নিচে শরীর কেটে বসে আছে চওড়া সাদা অন্তর্বাস। কানন এর আগে আর কখনো ব্রেসিয়ার পরেছে, লক্ষ্য করেননি নাসিমাবানু। ওর ভরন্ত শরীর, চব্বিশ বছরের উপচে পড়া যৌবন, কালো চকচকে গায়ের রং থেকে কেমন এক অচেনা দ্যুতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে। গতকাল রাতেই খেতে বসলে নাসিমার কাছে কাননের বর্তমান শারীরিক অবস্থা প্রকাশিত হয়ে যায়। আর তার পর থেকেই সব সংকোচ, দ্বিধা, লজ্জা যেন দূর হয়ে গেছে তার। সুতির তাঁতের শাড়িতে প্যাঁচানো উদ্ভাসিত, শূন্যে উত্থিত, ছড়ানো গোলাকার নাতিদীর্ঘ ভুঁড়ি কিছুটা গর্বের সঙ্গেই যেন নাসিমাবানুকে প্রদর্শন করছে কানন, যে অবস্থার সঙ্গে, কানন জানে, ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার সুযোগ হয়নি কোনো দিন নাসিমার।

ওদিকে একটা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে এতোক্ষণ ধরে এই সাত সকালেই কোনো একটি ইংরেজি রোমান্স উপন্যাস পড়ছিল তৃণা। বইটির নাম এতোটা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছেন না নাসিমা। তবে রঙিন প্রচ্ছদের ওপর নারীপুরুষের ছবিতে ভরা এ বই হাল আমলের জনপ্রিয় কোনো লেখকের রচিত রোমান্টিক উপন্যাস হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তর্জনী দিয়ে শেষ পঠিত পৃষ্ঠা চিহ্নিত করে বইটা আধা ভাঁজ করে বাঁ হাতের ওপর রেখে এ মুহূর্তে তৃণা কাজের ছেলেটিকে (নতুন এসেছে ছেলেটি এ বাড়িতে। ওর নামটাও এখন পর্যন্ত জানা হয়নি নাসিমার) আজকের বাজারের ফর্দ রচনায় সাহায্য করছে। কাননের স্বামী বাদলই সাধারণত কাঁচাবাজার করে প্রতিদিন। কিন্তু বাদলকে আজকাল প্রায়ই শ্রীমঙ্গলে হাশেমের অন্য অফিসে যেতে হয় কাজে। এখনো সে বাড়ি নেই; শ্রীমঙ্গলেই। বহুদিন তাকে দেখেন না নাসিমাবানু।

‘আজ কী খাবে? এতোদিন পরে ঘরে খাবে। কাননকে বলবো বেগুন আর টমেটো-তেঁতুল দিয়ে কী যেন একটা রাঁধে সে আজকাল, খুব স্বাদ হয়। রাঁধবে ওটা? খাবে?’ চায়ের কাপ থেকে এক চুমুক চা গিলে প্রসন্ন চিত্তে নাসিমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকেন হাশেম।
‘আমি তো ভেবেছিলাম ডিম-বেগুনের ভর্তা করবো। আর কাঁচামরিচ, আদা-জিরা দিয়ে কাজলী মাছের পাতলা ঝোল। তুমি পছন্দ করো।’ একটু থেমে যেন নিজের মনেই আবার বলেন, ‘তাই জানতাম।’
‘তাতো করিই। তাই বলে আজই রাঁধবে? এতোদিন পর হাসপাতাল থেকে মাত্র এলে কাল রাতে। আর আজই রান্নাঘরে ঢুকবে?’
‘না, তা হয় না।’ তৃণাও হেই হেই করে ওঠে। কানন তো আছেই সঙ্গে।

নাসিমা আর কথা বাড়ান না। ওদের সম্মিলিত ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে নেন। জীবনের অতি তুচ্ছ ব্যাপার এসব। এর চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার রয়ে গেছে মাথা ঘামাবার জন্যে। গত পাঁচ-ছ’মাস সময়ের গায়ে হাতড়ে দেখতে হবে নাসিমার, এতো যে খোয়া গেল, তার বদলে কী পেলেন তিনি, বা আদৌ কিছু পেলেন কিনা তার তিন দশকের সংসার থেকে! ব্যবসায়ীর কন্যা নাসিমা। হিসাব-নিকাশটা মোটামুটি ভালোই বোঝেন। হিসাব না মিললে কেমন অস্বস্তি লাগে তাঁর। কিন্তু আজ নিজের সংসারের যোগ-বিয়োগ মেলাতে ফলাফল যেন শূন্যের নিচে নেমে যেতে চায়। এতোদিন পর গুণতে বসে নাসিমা রীতিমতো ঘুরপাক খাচ্ছেন আজ।
তৃণাকে ডেকে বলেন নাসিমা, বাড়ির ভেতর ফুলদানীগুলোতে রাখা বাগান থেকে সংগৃহীত সব বিদেশি ফুলগুলো এক্ষুণি সরিয়ে ফেলার জন্যে।
কী জানি কেমন করে, হাসপাতালের স্টেরাইল পরিবেশে একটানা এতো দিন থাকতে থাকতেই কিনা, ফুলের রেণু-বিশেষ করে অপরিচিত ও বিদেশি ফুলের রেণু, ধুলা-ময়লা, মানুষের ভিড়, উচ্চকণ্ঠে কথা বলা সব কিছুতেই কেমন এলার্জি হচ্ছে তাঁর ইদানীং।
একটু নির্জনে, একটু নিস্তব্ধতায় সময় কাটাতে চান নাসিমা।
খুব কি বেশি চাইছেন তিনি?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত