একটি ছিনতাই কেসের পেছনের ইতিহাস

মারুফ বন্ধুর মেয়ের জন্মদিনে কাজিপাড়া যাবে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে একটুখানি হেঁটে ফার্মগেটে এলো বাস ধরতে। একটু সান্ধ্য ভ্রমণের মতো হলো আবার রিকসা ভাড়াটাও বাচল- এ রকম ভেবেছিল। মাত্র বিশ-পঁচিশ মিনিটের পথ; কিন্তু গরমের দিন বলে ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠল। শার্টটা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে, ভিজে গেছে বুক পকেটে রাখা এনভেলাপটা- যার ওপর লেখা : তিতলিমণির জন্মদিনে মারুফ চাচ্চু। মারুফ ভাবল কাজটা মোটেও ভাল হয়নি- একটা রিকশা নিলেই পারত, ঘামে ভেজা শরীরটা কেমন ঘিনঘিন করছে।

আনন্দ সিনেমা হলের সামনে তাকাতে দেখল, হাজার খানেক লোকের একটা মানব-মাকড়শার জাল তির-তির করে কাঁপছে। অদূরে এয়ারপোর্ট রোডে স্থির হয়ে আছে কয়েকশ গাড়ি- একেবারে স্ট্যান্ডস্টিল। অধিকাংশের স্টার্ট বন্ধ, বাকিগুলোর শরীর থেকে শুধু গুগুগুগুগুগুর মতো অদ্ভুত এক শব্দ বেরুচ্ছে।
সন্ধে হয়েছে একটু আগে। বহুতল হোটেল-রেস্তোরাঁর মাথার নিয়নসাইন নিবনাব করছে- রাস্তাঘাট আর মানুষজনের অবস্থা দেখে চোখ পিটপিট করে হাসছে যেন। মারুফের গন্তব্যে যেতে আধা ঘণ্টার বেশি লাগবে না। হলে কী হবে? এই তীব্র যানজটে বাসের চাকা ঘুরবে কী করে? সিএনজি নেবে? কিন্তু তাকেও তো একই পথে যেতে হবে। তাহলে উপায়? এ কথা ভাবতে-ভাবতে কাছের বটগাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। অনেকেই ধূমপান করছে। তার ভেতরও পানের ইচ্ছে চাগাড় দিয়ে উঠল; কিন্তু প্রকাশ্যে ধূমপানে আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকায় সে ইতস্তত করল, সেটা ক্ষণিকের জন্য, তারপর সে-ও একটা সিগারেট ধরিয়ে ধুম্র ছড়াল যা অচিরেই মিলিয়ে গেল বটের পাতায়। তার পাশেই ফুটপাথে মুচিদের জুতা পলিশের ধুম। নিজের জুতার দিকে তাকিয়ে দেখল তার মুখ একদম ভার। মাসে একবারও কালি করা হয় না। ও দিকে পা বাড়ালেই বিশ টাকা। থাক না, নিচে আর কার চোখ, সবার দৃষ্টি উপরে।

এসময় আনন্দ হলে ইভনিং শো চলছিল। একেবারেই ভিড় নেই। লোকজন এখন বাড়িতে বসে সিনেমা দেখে। মারুফ এক সময় সিনেমার পোকা ছিল, হলে গিয়ে দেখত নতুন ছবি এলেই। এখন যা দেখার বাসাতেই দেখে।

আজ কি তাহলে বন্ধুর বাসায় যাওয়া হবে না? কাছের পথ হলে হেঁটেই যেত। হাঁটার অভ্যাস আছে তার। খুব হতাশা বোধ করল। দু’হাত তুলে আড়মোড় ভাঙল। এখন কী করলে এই হতাশা থেকে বেরিয়ে আসা যায়? এক কাপ চা খেলে কেমন হয়? কিন্তু ফুটপাথের টং দোকানের চা তার কাছে ঘোড়ার পেচ্ছাব বলে মনে হয়, খামোখা পকেট থেকে আটটি টাকা খসে যাবে। তাহলে?

ওখান থেকে সরে এসে আনন্দ হলের সামনে ‘এখন চলিতেছে’ সিনেমার বিশাল হোর্ডিং-এর দিকে চোখ রাখল বিরক্তি কাটানোর জন্য- নায়ক নায়িকাকে চুমু খেতে উদ্যত, অদূরে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে ভিলেন। এসব দেখে মারুফ সিদ্দিকীর বিরুক্তি তো গেলই না বরং বাড়ল। পাশেই ফালি আনারস বিক্রি করছিল এক বুড়ো, তার ধরানো বিড়ি থেকে বিশ্রি গন্ধ আসছে। দু’তিনজন পুলিশ ওমুখো হলে বৃদ্ধ বিড়ি সমেত পাগাড় পাড় হলো।

মারুফ গাছ তলায় ফিরে গেল। যানযট পরিস্থিতির তখনও কোনো উন্নতি হয়নি। গুগুগুগুগুগুর শব্দটা তখনও বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ সময় একটা লোক কাটা মোরব্বার ডালা নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। দু’টাকা করে পিস, বিয়ে বাড়ির জর্দার ভেতর পাওয়া যায়। মিষ্টিমুখ করলে শুভযোগ ঘটে এ রকম একটা কুসংস্কারের ভেতর পড়ে মারুফ দু’পিস কিনল। খুবই মিষ্টি, তবে একেবারে শুকনো কচকচে, চিনি সব রস শুষে নিয়েছে। দু’পিস নিমেষেই শেষ হয়ে গেল।

তখন মারুফের অবস্থা এমন করুণ হয়ে উঠল যে, আর একটা সিগ্রেট না-ধরিয়ে পারল না। ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে ধোয়া ছাড়লে তা সরাসরি এক মহিলার চোখ-মুখ আচ্ছন্ন করে ফেলল। বাঁ হাত দিয়ে ধোয়া তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে মহিলা মারুফের মুখের দিকে তাকাল। চেনা মহিলা। ফার্মগেট এলাকায় প্রায়ই দেখে, অন্য দিনের মতো মিষ্টি করে হাসল। বাতাসে চুল উড়ছে এলোমেলো। পরনে হালকা বেগুণি জর্জেট শাড়ি। ডান হাতে ফিতেওয়ালা লেডিজ ঘড়ি।

ভ্যানিটি ব্যাগটা পিঠের উপরে ছড়ানো। ক্লান্ত অফিস-ফেরতা নারী? বাসের অপেক্ষায় বোধ করি। সিগ্রেট ফেলে দিয়ে মারুফ বললো, ‘কেমন আছেন?’ গত দু’বছরে এই প্রথম কুশল জিজ্ঞাসা। কথা বলার দূরত্বে কখনো পায়নি। দূর থেকে মহিলা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছে, সে-ও একটুখানি হেসে তার জবাব দিয়েছে- ওইটুকুই। আজ তাকে ভীষণ পরিশ্রান্ত লাগছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মারুফের দিকে। তাতে সে একটু অস্বস্তিতে পড়ে। মহিলার দিকে তাকায়।

‘একটা কথা বলবো আপনাকে?’

‘বলুন না।’

‘সারাটা দিন কেটে গেল, একটা টাকাও রোজগার হলো না। তার ওপর ছোট মেয়েটার জ্বর। আজ বোধকরি উপোষই দিতে হয়। আচ্ছা আপনি কোথায় থাকেন? নিয়ে চলুন না আমাকে। অবশ্য অসুবিধা থাকলে আমার ওখানেও যেতে পারেন- মিরপুর দশ।’

মারুফ আনপ্রেডিকটেবল স্বভাবের মানুষ। কাজকর্ম কখন কী করে ঠিক নেই। চাকরি-বাকরিরও কোনো ঠিক নেই তার। এ মাসে আছে তো ও মাসে নেই। চাকরি না থাকলে টুকটাক ব্যবসা করে। এতে যে আয় উন্নতি খুব হয় তা-ও নয়। তবে তার বউটা খুব ভাল। সর্বংসহা টাইপের। দু’ছেলে-মেয়ে আর স্বামীর সংসারটা কোনো রকমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। মারুফ অবশ্য খুব বড় হৃদয়ের মানুষ, যদিও হৃদয়ের বিশালত্ব দেখাবার সুযোগ তার কমই মেলে। মহিলার কথা শুনে বলল, ‘চলুন সামনের ওই রেস্তোরাঁটিতে গিয়ে বসি।’

মহিলা ঘাড় কাত করল। পর্দা ঘেরা কেবিনে গিয়ে বসতে-বসতে মারুফ বলল, ‘কী খাবেন?’ মহিলা ইতস্তত করতে লাগল। এরই মধ্যেই বেয়ারা এসে হাজির হলে মারুফ দুটো স্পেশাল নান, হালিম আর চায়ের অর্ডার দিল। তারপর আয়েশ করে সিগ্রেট ধরাল।

ওয়াশরুম হয়ে কেবিনে ফিরে টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে মহিলা মারুফের দিকে তাকাল। একেবারে ছিপছিপে না হলেও স্লিমই বলা যায়। টিকলো নাক। টানা টানা চোখ। রংটা হলদে-ফর্সা, রোদে ঘুরে খানিক তামাটে। বেশ যত্ন করে খাচ্ছিল। হয়ত দুপুরে খাওয়াই হয়নি। বেগুনি ভয়েলের ব্লাউজের উপর দিয়ে ব্রেসিয়ারের কালো ফিতে দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর সব পুরুষের মতো সে-ও মহিলার বয়স নির্ধারণে ব্যর্থ হলো। অনুমান করল বয়সে তার ছোট-ই হবে। এই তিরিশ-বত্রিশ। তার পঁয়ত্রিশ। বাম ঠোঁটের ওপর বড় একটা তিল। কী যেন ব্যাখ্যা আছে এর, মারুফ ভুলে গেছে। মহিলা ঢক ঢক করে বেশ ক’গ্লাস পানি খেল। চায়ের কাপে চুমক দিয়ে বলল, ‘আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি…..’

‘না ধুর কী যে বলেন।’

দু’বছর ধরে দেখে আসছে। একদিনও মনে হয়নি মহিলা ওরকম। দেখলে মনেও হয় না। অবশ্য দেখে আর মানুষের কতটা বোঝা যায়। তখন তার মানুষের মুখোশের কথা মনে হলো। মুখোশের সঙ্গে শয়তান ও শয়তানির সম্পর্ক আছে। ওই মহিলার নিষ্পাপ চেহারাটা নেহাতই চামড়ার। তার ওপর কোনো মুখোশ নেই। মুখোশধারী হলে এত সহজে বলতে পারত না- নিয়ে চুলন আমাকে।

হাত মুখ ধুয়ে এসেছিল বলে বেশ একটু ফ্রেশ লাগলেও দুঃশ্চিন্তার গুড়ো তার চেহারাখানা মলিন করে রেখেছিল। চা খাওয়া শেষ হলে মারুফের দিকে তাকাল। তার চোখে চোখ রেখে বলল ,‘কিছু বললেন না যে!’

‘না, কী বলব?’ যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে জেগে উঠে বলল মারুফ।

‘ওই যে আমাকে আপনার সঙ্গে…’

মারুফ কিছু একটা বলতে গিয়ে ঈষৎ তোতলালো তারপর নিজেকে খানিকটা তৈরি করে নিয়ে বলল, ‘আপনাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তবে একটা কাজ আমি করব, একটা উপহার দেব আপনাকে।..’

এ কথা বলে পকেট থেকে ঘামে ভিজে যাওয়া খামটা বের করল। বলল ,‘কলম আছে আপনার কাছে?’

‘না তো।’

‘ঠিক আছে, আনাচ্ছি।’

বেয়ারাকে ডেকে ক্যাশ কাউন্টার থেকে কলম আনালো। খামটার উপরে যেখানে লেখাছিলো ‘তিতলিমণির জন্মদিনে মারুফ চাচ্চু’ সেখানে কেটেকুটে লতাপাতার একটা ডিজাইন বানিয়ে বলল, ‘আপনার নামটা বলবেন, যদি আপত্তি না থাকে?’
‘নাম দিয়ে কী করবেন?’

‘বা রে যাকে উপহার দিচ্ছি তার নাম লিখব না?’

‘আপনার ইচ্ছে মতো যে কোনো একটা নাম বসিয়ে নিন।’

মারুফ তখন লিখল- ছবিতুল নাহার শোভনাকে প্রীতি ও শুভেচ্ছাসহ- মারুফ সিদ্দিকী।

মহিলা বলল, ‘এটা কার নাম?’

‘আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিল এক সময়।’

‘কিন্তু আমি তো আপনার প্রিয় মানুষ নই।’

‘অপ্রিয়ও তো নন।’

‘ও তাই নাকি?’ এ কথা বলে মহিলা এলোমেলো হাসল।

মারুফ দেখল মহিলার মুখের ওপর থেকে দুঃশ্চিন্তার গুড়ো ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখে তার খুব ভাল লাগল। মহিলা বলল ,‘এটার ভেতরে কী?’

‘এক হাজার টাকা।’

‘ও আচ্ছা।’ এনভেলাপটা খানিকক্ষণ হাতে ধরে রেখে বলল, ‘এ-টাকা আমি ফেরৎ দেব আপনাকে।’ তার এ রকম ধারার আত্মমর্যাদা বোধে খুব খুশি হলো মারুফ। বলল, ‘বেশ তো ফেরৎই না হয় দেবেন, যদিও উপহার ফেরৎ দেওয়ার নিয়ম বোধ করি নেই।’

দু’জনে উঠে বাইরে এলো। বিল পরিশোধের সময় দু’জনই কাউন্টারে রাখা প্লেট থেকে গুয়োমুড়ি নিয়ে এমনভাবে মুখে পুরলো যেন চাকরিজীবী বউকে রেস্তোরাঁয় খাইয়ে-দাইয়ে স্বামী বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।ততক্ষণে যানজট কেটে গেছে। মনুষ্য সৃষ্ট মাকড়শার জাল ভেঙে গুড়ো-গুড়ো হয়ে গেছে। জোরে-জোরে হর্ন বাজিয়ে গাড়িগুলো এয়ারপোর্টের দিকে ধেয়ে চলছে।

মহিলা দৌড়ে গিয়ে মিরপুরের বাসে উঠলে মারুফ একটা রিকশা ধরল বাসায় ফেরার জন্য। ফুরফুর করে হাওয়া বইছিল। তার গায়ের শার্ট ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে। বাসায় ফিরে মারুফ হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘একটা ব্যাপার ঘটে গেছে আজ জানো?’

তার বউ বলল, ‘আজ আবার কী কেস, পকেটমার না অন্য কিছু?’

‘কী যে বল না, সবদিন পকেটমার হয় নাকি? আজ হয়েছে ছিনতাই, বুঝলে ছিনতাই। ওই যে গার্ডেন রোডের অন্ধকার গলিটার ভেতর। তিনজন এসে ধরল। দু’জনের হাতে চাপাতি আর একজনের হাতে রিভলবার, একেবারে চকচকে। ব্যাটারা বুঝল কী করে এনভেলাপের ভেতর টাকা?’

‘আমি কী করে জানবো। তবে আজ কিন্তু কেস ভাল না। হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই।’ এ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল মারুফ।

জামাকাপড় খুলে সটান হয়ে শুয়ে মোবাইল ফোনে বন্ধুকে একটা খুদে বার্তা পাঠাল : তিতলিমণিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। অনিবার্য কারণে আসতে পারলাম না বলে দুঃখিত, ক্ষমা করে দিস।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত