আরশি

সোফায় পা তুলে বসে আজকের পেপারটা হাতে নিয়ে আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্প নাকি হিলারি কে এগিয়ে থাকবে শিরোনামে চোখ রাখতে না রাখতে দরজায় দাঁড়ানো ড্রাইভারের বগলের তলা দিয়ে, ওকে পাশ কাটিয়ে এক মহিলার সপ্রতিভ প্রবেশ। মহিলা না বলে মনে হয় মেয়ে বলাই ভাল। যেন এক অলরাউন্ডার-এর মাঠে প্রবেশ। এসেই বেশ ঝনঝনে কন্ঠে সালাম দেয় –

-আসসালামুয়ালাইকুম।
-ওয়াইলাকুমাসসালাম। ওর আপাদমস্তক যাচাই করতে করতে কিছুটা নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দেয় মেমসাহেব
-আফা, ভালা আছেন?
-স্তিমিত জবাব হু…

কিন্তু মেমসাহেবের স্তিমতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে কলকল করে ওঠে-
আফা, আপনের ডেরাইভার আমারে সব কইছে, তারপরও আফনে কন কি কি করন লাগত, আর মাসে আমারে কত কইরা দেবেন? কুন কুন টাইমে আইতে হইব? খোলাখুলি সব ফয়সালা কইরা ফেলা ভালা। পরে এইসব নিয়া খ্যাঁচাখেঁচি আমি পছন্দ করিনা। ফারাজের মা পেপার হাতে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। এ তো দেখি চোখে মুখে কথা বলে! মনোযোগ দিয়ে দেখে- বেশ স্বাস্থ্যবতী, গায়ের রঙ উজ্জ্বল, মাথার উপর চুড়ো করে চুল বাঁধা। আলগা একটা ঢলো ঢলো চেকনাই আছে…আর বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আজকাল কাজের বুয়ারা যে ময়লা ম্যাক্সি পরে ল্যাতা ল্যাতা থাকে এ তেমন নয়। মনে হচ্ছে গৃহস্ত বাড়ির বউ এখুনি একটা পান মুখে দিয়ে চুন লাগানো আঙ্গুল সামলে বড় বটি ফেলে চকচকে তাজা সরপুটি মাছ কুটতে বসে যাবে…
-আমার তো একজন চব্বিশ ঘন্টার কাজের মানুষ দরকার… ফারাজের মায়ের কথা শেষ নাহতেই সে তুফান ছোটায়…

-না আফা, আমি রাইতে থাইকতে পারুমনা। আফা, শোনেন আমার কিছু কতা আচে- কতাগুলা হইতেচে- আমি সাত বাসায় কাম করিনা, এক বাসাতেই করি খুব বিশ্বাসের সাতে যত কাম আচে সব করি, দশজনের কাম একলাই করি কাজেই আমার বেতন বেশি, আমারে টিবি দেখতে দিতে হইব, আমি রাইতে বাড়িত যামু অসুবিধা নাই, আমি খুব বিয়ানবেলা আইসা আপনের নাস্তাপানি সব টেবিলে লাগাইয়া দিমু। আসার আগে আমি গোসল কইরা পাক পরিষ্কার হইয়াই আসমু কিন্তু রাইতে আমি কুনোভাবেই থাকুম না। আফা, আমার স্বামী আছে, সে আমারে ছাড়া থাকতে পারেনা, আমিও না। আফা, ওইযে হারুন ডেরাইভার আছেনা! বলে সে খুব আগ্রহ নিয়ে আফার মুখের দিকে তাকায় তার চোখমুখ ঝলমল করতে থাকে… আফা চেনেন নাই! আরে ওইযে টেরাক চালায়, চিনছেন? সে ঠোঁট গোল করে জিভ লাগিয়ে চ্চো চ্চো একরকম আফসোসের শব্দ করে। অরে চেনেনা এমন কেউ আছে নি! হারুন ড্রাইভারকে না চেনা যেন এক বিরাট মুর্খতা, বোকামি, বা অন্যায় এমন একটা মুখভঙ্গি করে আবার বলে আফনেও হয়ত নাম শুনেচেন, এখন মনে আইতেছেনা, আইচ্ছা থাউকগা… আফা, আমি অই মরদ ছাড়া থাকতে পারিনা। পারবনা, এই আমার সাফ কতা। আফনে বেজার হইয়েন না।

দরোজার পাশে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে ছিল সে ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠে- হায়! হায়! এই মাইয়া তো কেলেঙ্কারি করে ফেলবে… মেমসাবের যা রুচি আর তিনি যে রাশভারী মানুষ এসব কথা শুনে প্রচন্ড রেগে যাবেন। ড্রাইভার তড়িঘড়ি দরোজার ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে বলেন- এ্যাই থামো, থামো, এদিকে আসো, তোমাকে না বললাম বেশী কথা বলবানা।

ড্রাইভারের কথা শেষ হবার আগেই আবার তুফান মেল-
-দ্যাখেন ভাই, অত একেবারে ছ্যা ছ্যা করনের কিছু নাই। হক কথা বাপত বড়। আমি কি খারাপ কথাকইতেছি। আমি ত আমার নিজের মরদের কতা কইতেছি। বেবাগ বেশ্যামাগি গুলা বাসা বাড়ির সাহেবসুবোদের লগে যা করে… দেখতাছি তো কত বচ্চর ধইরা… এই ঢাকা শহর বড় আজিব শহর গো …
-এ্যাই! এ্যাই চুপ! একদম চুপ! আসো আসো বাইরে আসো… মেমসাব আমি দেখি বিকেলে আরেকজনরে লইয়া আসব নে।

মেমসাব হাত তুলে ড্রাইভারকে ধীর থমথমে গলায় বললেন-
ইয়াসিন, তুমি চলে যাও। আমি এর সাথে কথা বলে নেই… তুমি যাও। হতবাক ড্রাইভার চলে গেলে দরোজা লাগিয়ে পেপারসহ হাত তুলে সঙ্গে আসার ইঙ্গিত করে মেমসাব এসে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন।

ভাদ্রের তালপাকা গরম। কেবল তালপাকা নয় একেবারে মানুষ পাকা গরম। ঘরের বাইরে এলে চামড়া ফেটে যেতে চায়। ঢাকা শহরটা যেন ইটভাটার গনগনে চুল্লী হয়ে গেছে। এবারে বৈশ্বিক উষ্ণতায় নাকি ২০১৬ সালকেই সর্বোচ্চ ঘোষনা করা হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মূল কারন হল পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। আর কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ার প্রধান কারণ বনভূমি উজাড় করা ও জ্বালানি পোড়ানো। রাত দশটার পরে ফারজানা হক আর ঘরের বাইরে আসেননা। ঘর থাকে কৃত্রিম ঠান্ডায় একেবারে ইগলু আইসক্রিমের মত। ফারজানা হক গরম সহ্য করতে পারেননা। তার বাসার প্রায় সব ঘরেই এসি লাগানো। বাসার সদস্যসংখ্যা ৩ জন, ফারজানা হকের পুত্র এবং পুত্রের বাবা। যেযার রুমে নিজ পছন্দ মাফিক এসি রিমোটের টেম্পারেচারের ডিজিট দিয়ে রাখেন। সম্ভবত ফারজানা হক একমাত্র মানুষ যিনি ডিজিটটি সব সময় একদম লোয়ার পজিশনে রাখেন। বরফঠান্ডা ঘরে ঘুমাতে তিনি ভালবাসেন। অথবা বলা যায় বরফ না হলে তার শরীর মন ধী হয়না ঘুম আসেনা।

সুর্য্যের আগে ফারজানা হক কোনোদিন জাগতে পারেন না। তার একমাত্র সন্তান ফারাজ বড় হবার পর তিনি ভোর দেখেছেন এমন বলতে পারবেন না। কিন্তু আজকাল বড্ড বেরসিকের মত ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। আর আসতে চায়না। তাই বলে এমন না যে তিনি উঠে পড়েন। মটকা মেরে পরে থাকেন। ঘুমানোর আগে এবং ঘুম ভাঙ্গার পরে তিনি এক ধরনের যন্ত্রনায় অস্থির বোধ করেন। এপাশ ওপাশ করেন। অব্যক্ত বেদনা, অতৃপ্ত তৃষ্ণার এক জলন্ত আকুতি তাকে ঘুমাতে দেয়না। তার চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত নিশপিশ করে। শুন্য বিছানায় তিনি নিবিড় আলিঙ্গনের অদৃশ্য উপস্থিতিকে বাঙময় করার কথা ভাবেন, ভাবনাটাকে জব্দ করতে করতে অজানা সময়ে বাস্তব জগত থেকে নিজেকে বিলোপ করেন।

এ বাড়ির সকাল। বাড়ির কর্তা একজন রাঘববোয়াল টাইপ কর্পোরেট অফিসার। ঘুম ভাঙ্গার পর তিনি সকল প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সেরে অফিসের জন্য পুরোদস্তুর রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসেন। লোকে বলে বিবাহিত পুরুষ মানুষ নাকি হাতের কাছে সব থাকা সত্ত্বেও কিছুই খুঁজে পাননা, রুমাল, কলম,পায়ের মোজা কিছুই না… প্রচলিত এসব কথাকে সম্পুর্ন ভুল প্রমাণিত করে তিনি একজন স্বয়ম্ভূ মানুষ হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। এটাই তার পছন্দের। টেবিলে তিনি একা খেতে পছন্দ করেন। তার পছন্দের তালিকাভুক্ত আরো কিছু নির্ধারিত বিষয় আছে সেসবই এ বাড়িতে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। তার পছন্দের বাইরে এ বাড়ির টিকটিকিটাও টিকটিক করেনা। তার স্বতঃস্ফূর্ত পছন্দের ঠিকানা অন্যত্র। এক বেকার নেশাখোর ভাইয়ের পরিবারে তার স্বতঃস্ফূর্ত পছন্দেরা ডুবসাঁতার কাটে। তার বুকপকেট কিংবা ব্রিফকেসের ভেতরে নিকাহনামা এবং নির্দেশনামা সদা জাগ্রত থাকে। নাস্তা করেই তিনি অফিসে চলে যান। গিয়ে গাড়ী পাঠান এরপর ফারাজ কলেজে যায়। ফারাজের বাবা অফিসে চলে যাবার পরে ফারাজের মা ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন। তার আগে নয়। বিগত ৭/৮ বছর ধরেই এই মিউচুয়াল সিচুয়েশন। এরপর কাজের মহিলাকে সাথে নিয়ে শুরু হয় দিনের কাজকর্ম। কাজের মানুষটি বহুদিন ধরে আছে কাজেই ফারাজের মাকে তেমন কিছুই করতে হয়না। নিত্যদিনের ছকে বাধা কাজ, কেবল কি আইটেম রান্না হবে তা বলে দিতে হয়। ছেলের পছন্দের দিকটা মাথায় রেখে ফারাজের মা খাবারের মেন্যু বাতলান। বিয়ের পর রাজিয়া নামের এই মেয়েটি ফারাজের মায়ের সাথেই এসেছিল সেই তখন থেকে এ অবধি আছে।

সেসময় মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল, বাবামা যৌতুক দিতে না পারায় রাজিয়ার সংসার হয়নি। তারা মেরে ধরে পিটিয়ে ওকে ওর বাবা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পরে ফারাজের নানা ওকে ফারাজের মায়ের সাথে পাঠিয়ে দেয় নতুন সংসারে। এই ১৭/১৮ বছর ধরে থাকার পর এখন ও আর থাকবেনা। চলে যাবে। কারন ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে আবার নতুন করে সংসার করবে। সে আর একা থাকতে চায়না। সে থাকতে থাকতেই আরেকটা কাজের মানুষ খোঁজার চেষ্টা চলছে কিন্তুঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছেনা।

দুচার জন এর মধ্যে এসেছিল কিন্তু ফারজানা হকের পছন্দ হয়নি। বিদায় করে দিয়েছেন। বাড়ির ড্রাইভার, অফিসের পিওন, অন্যান্য কর্মচারী সবাইকে বলা আছে যে একজন ভালো ভদ্র কাজের লোক দরকার। কিন্তু কিছুতেই জুটছে না। ফারজানা হক চিন্তিত। খুঁজতে খুঁজতে এক সপ্তাহ হয়ে গেল রাজিয়ার চলে যাবার দিন এসে পরেছে।

ড্রাইভার ভাইয়াকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে একজন মহিলাকে সাথে নিয়ে উপরে উঠে এলো। এসে বলল-
-মেমসাব, কথা বলে দেখেন এ মনে হয় ভাল হইবে। এ ঐদিকে এক বড় সাহেবের বাড়িতে রান্না করত। এর হাতের রান্নার খুব সুনাম আছে। একটু কথা টথা বেশি বলে। কি আর করা যাইবে মেমসাব মানিয়ে গুছিয়ে না নিয়ে তো উপায় নাই। কাল ত আবার রাজিয়া বুও চলি যাইবে কামে কাজে এক্সপাট আছে ওই মুখ চলে একটু বেশি …
-আচ্ছা, আচ্ছা ঠিকাছে ডাকো কথা বলি… তারপরেই এই অলরান্ডারের প্রবেশ …

-আফা, আফাগো আমার জেবনে ম্যালা গল্প আচে, জেবনটা বড্ড দুক্ষের গো আফা। ম্যালা দুক্ষু কষ্ট সয়া এই এখন আমি একটা ভালা জেবন পাইছি। এই জেবন আর আমি ভাঙতে চাইনাগো আফা। আমাগো তো গতর খাটাইয়াই খাইতে হইব, তয় একটু যদি আমোদ ফুর্তি না থাকে তাইলে ক্যামনে চলে আফা আপনেই কন। ফারাজের মা কোন কথা না বলে এক ধরনের আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকেন। আর ওদিকে তুফান বেগে চলে জেবনের গল্প…

বুজলেন আফা, দেশত থাকতে আমার একটা বিয়া হইচিল, ত্যাখন আমার বয়স খুব কম, এই ধরেন কেবল সেয়ানা হইচি কি হই নাই। বুকত বরাইর বিচি কেবল গুটি গুটি… ওই আমার মাসিক গুলাও ত্যাখন হয় নাই তাতেই এক ব্যাডার লগে বাপে বিয়া দিয়া দিল। না দিয়াই বা করবে কি মুরগির ছানার লাহান একগাদা ভাইবইন, তা আমার ছুডুকাল থাইকা একটু খেলাধুলা আর টিভি দেখার নেশা, সারাদিন কাম কাইজ কইরা হ্যাগো বাড়ির কয় বাড়ি পরে টিভি দেখতে যাই, কালার না আফা বিলাক এন হুয়াইট। তাও দেখি।সেই নিয়া কি কান্ড! কি কান্ড! বুড়ি শাশুড়ি মাগি রোজদিন কাইজ্জা বাঁধায়। মাগির পুতে বাড়িত আইলে নানান কতা ব্যাখ্যান করি লাগাইয়া দিয়া মাইর খাওয়ায় নেয়। এরাম কইরাই আফা কত্তগুলা বচ্চর চইলা যায়। আমি সেয়ানা হই, প্যাডে বাচ্চা আসে সেই বাচ্চাও একটু বড় সড় হয়। কিন্তুক আফা জানেন কপালের ল্যাখা বুড়ি মাগি আরো বেশি করি ক্যাচাল লাগাইতেই থাকে।একবার দুধের সাওয়াল কাইড়া নিয়া পাডায় দিল বাপের বাড়িত, সেখানে কি আর জায়গা হয় আফা! হয়না। ফির ছাইয়ের কুকুর ছাইয়ত ঘুরি আসলাম, এবারে জেবন এক্কেরে ত্যাজপাতা হয়া গেল।সেই একি ঘটনা রাইতে টিভি দেখপার যাইতে দেয়না, সারাটাদিন শতেক রকমের কাম কাইজ করায় নেয়। গরুর কাম, ঘাস কাটা, ঘুটে দেয়া, ঘর বাড়ির কাম, ল্যাপা পোছা সব একা হাতে করি। দেওর ননদ আচে সেগুলাও মায়ের লগে গলা মিলাইয়া খোঁচা মারে, গালিগালাজ করে আবার ধরি ধরি মারেও।

ঠিকমত খাবার দ্যায়না, ম্যালা রাইতে কাম থাকি ফির্যা আইলে পুতেরে দিয়া রোজ মাইর খাওয়ায়। মিছা না আফা, আল্লার তিরিশটা দিন মাইরত। একবার বুড়িমাগি বিছানা মাইনষে সামান হইয়া গেল। কঠিন দাস্ত আর বমি যায় যায় অবস্থা চকির উপর বুড়ি কোঁকায় আর চকির তলায় আজরাইল বসি দাঁত চোকায়। তা সেই আজরাইলের হাত থাকি বুড়িক বাঁচাইল কে? এ্যাই আমি। তা সেগুলা ওরা মনত থোয়না আফা। খালি অত্যাচার অত্যাচার জেবন আর চলেনা… আর একখান কতা আফা, এ্যাতে ফির শরমের কি আছে- বয়স বলি একটা কতা আচে না! গতর তো সবারি আচে, বুড়ি মাগির পুত মা বইনের কতায় খালি ওই চ্যালা খড়ি দিয়া মাইরতেই জানে আর কিছু জানে না। বিছানায় যাইয়া ন্যাতায় পরি ঘো ঘো করি নিন্দায়। আমোদ আহ্লাদ কিচ্ছু নাই। সারাদিন কাম কাইজ কইরা টিভিও নাই ফির গতরে সুখও নাই তা কিসের লাইগা হেই মরা মাইনষের সাতে থাকুম আফা কন দেহি। হেই তো কলা গাছের লাহান পইরা পইরা ঘুমায় আর আমি রাইতে খালি ছটর ফটর করি। দুই চক্ষের পাতা আফা এক হয়না, শরীল খালি জ্বলে। একদিন আফা সব ছাইড়া ছুইড়া ঢাকায় আইয়া পরছি। সাওয়াল টারে বুড়ি মাগির ধারে দিয়া আইছি। নে তোর নাতীরে নিয়া থাক। মায়া কইরা কি করুম আফা! জেবন চলেনা আর সাওয়াল! গরীবের মায়া মহব্বত সেতো স্যান্ডো গেঞ্জির বুক পকেট!অথচ এসময়ে তার চোখ দুটো স্পষ্ট মায়ায় ছলছল করে ওঠে। দুচোখ ভরে আসে মাতৃতের জোয়ার। তুফান মেইল একটু যেন দম নেয়, -আফা, কাউরে কননা এট্টু পানি খামু।

ফারজানা হক মাঝে মাঝেই মাইগ্রেনের ব্যথায় ভোগেন মনে হচ্ছে এখন ব্যথা শুরু হবে। ব্যথা শুরু হলে তার ভুবন এলোমেলো হয়ে যায় তিনি ঘর অন্ধকার করে হাই পাওয়ার পেইনকিলার খেয়ে মরার মত পরে থাকেন। তিনি ওঠে গিয়ে একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিলেন। তিনি চাচ্ছেন না ব্যথা এখনই শুরু হোক।

দরজা খুলে তিনি রান্নাঘরে গিয়ে কিছুটা তদারকি করলেন- অফিসের ভাত নিতে আসবে। ভাত দিয়ে আবার ড্রাইভার যাবে ছেলেকে আনতে। ছেলে খেয়েই আবার কোচিং এ যাবে । সব সময়মত হওয়া দরকার। ওকেও পানি সহ কিছু খেতে দিতে বললেন। পানি পান শেষে আবার তুফান মেইল–
-চইলা আসচি বইলা দ্যাশে এক্কেরে ঢি ঢি পইড়া গেল আফা। কত মাইনষের যে কত কতা… ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় কত ঘুরচি আফা, বস্তির খালায় এক বাসায় নিয়া কাম দিছিল ওমা রাইতের আন্ধারে হেই ব্যাডা আমার শাড়ি ধইরা টানাটানি করে চিল্লাইয়া হের বউরে কইয়া দিচি, এখন হুজুর বোজ ঠ্যালা… খায়া না খায়া আজ এই বস্তি তো কাল আরেক বস্তি- আহারে জেবন!

তারবাদে আরো বহুদিন পরে সবার লাত্থিগুতা খাইয়া এই ডেরাইভার হারুনের লগে দেখা। হারুনের নাম নেয়ার সময় তার চোখে মুখে এক উজ্জ্বল আভা ফুটে ওঠে–ফারাজের মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না। আফা আল্লায় আমার মনের আশা পুরন করছে আফা। কি আর কমু আফা হের মত ভালা মানুষ আর নাই। দোষ ঘাট হইলে এট্টু আধটু পিডায় তয় আফা রাইতে এক্কেরে… বলেই আঁচল মুখে চাঁপা দিয়ে একটু লাজুক হাসি হাসতে থাকে খিক খিক … খিক খিক…
-কি, থামলে কেন বল… ফারাজের মা যেন নিজের রুচি, সংস্কার, অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে সামনের বক্তার বক্তব্য গোগ্রাসে গিলতে থাকে।

-না গো আফা, আপনে হইলেন বড় বইনের লাহান। থাউকগা। আমরা গরীব, মুখ্য শুখ্য মানুষ আমাদের ফির জেবন আর তার ফির গল্প। আপনে তো স্বামী সোহাগি, রাজকপালি…কি! কি বলল! কি বলল মেয়েটা! ঘরের ভেতর ঘুরপাক খায়, গোঁত্তা খায় শব্দের ঘুড়ি…ঘুড়ি নাকি বোলতা ভোঁ ভোঁ উম্মাতাল । উড়ছে । কামড়াচ্ছে। হুল ফোটাচ্ছে।স্বামী সোহাগি- রাজকপালি… একি শ্লেষ! না ছুটে আসা তীক্ষ্ণ তির… কার শ্লেষ! কোথাকার তির! সত্যিকি কেউ সামনে বসে কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছে নাকি কাকচক্ষু জলের মত এক বিশাল আরশির সামনে বসে আছেন মিসেস ফারজানা হক! হ্যাঁ সামনে এক আরশি সেখানে প্রতিবিম্ব …
-আসলে আফা, মানুষটা বউরে আদর করতে জানে। খালি যে পিডায় তা না। আর ঐ বুড়ির পুতে আছিল ভাত দেবার ভাতার নোয়ায় কিলবার গোঁসাই। হে যদি এট্টু আমারে আদর কইরত আফা আমি সংসার ছাইড়া, পোলাডারে ছাইড়া, দ্যাশ ছাইড়া আইতামনা, কোনদিন না। হেই ছাগলডার মুখে থুক দিতে ইচ্ছে করে আফা, অবশ্য তাতে আমার থুকেরই অপমান, টিভি দেখার জইন্য সারা জেবন কত মাইর খাইছি… হে আমার জইন্যে একটা ছুডো টিভি কিন্যা দিছে, কালার টিভি। এক জীবনে আর কি চাই আফা! আর কিচ্ছু চাইনা। বলতে বলতে মেয়েটির চোখের জল টপ টপ করে পরতে থাকেচোখ মুছে আবার বলে-
সারাটাদিন মাইনষের বাড়িত হাজার মতন কাম কাইজ কইরা ঘরত ফির্যাচ আফা মানুষটার বুকত সেধাইলে আমার এক্কেরে বেহেশতের লাহান লাগে। এই দুনিয়াতেই আমি বেহেশত পাইছি গো আফা। আগের জেবনে এত কষ্ট করছি বইলাই বুঝি এই জেবনে আল্লাহ মুখ তুলে দেখছে গো আফা।

একেরপর এক বিভিন্ন চিত্র যেন ফারজানার চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতে থাকে। দৃশ্যের পর দৃশ্য… তার ব্যালকনি লাগোয়া একটি মেহগনি গাছে প্রতি বছর পাতা বদল হয়। পাতা বদলের দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত। আগে সমস্ত পাতা লাল হয়ে হয়ে যায় যেন গাছের মাথায় আগুন ধরে যায়। তারপর একসাথে সব পাতা ঝরে গিয়ে সেখানে আশ্চার্য্য সবুজ কুশি দেখা যায়। কেন যেন অকারনে মেহগনির পাতা ঝরার দৃশ্যটা জ্বলজ্বল করতে লাগল…

আচমকা তুফান মেইল হার্ড ব্রেক করে, নিশ্চুপ হয়ে যায়। গভীর দীর্ঘশাস ফেলে ধীরলয়ে বলে-
-আফা, আপনে কি আমার উপরে নারাজ হইলেন? আপনের চউখ মুখ বেজার দেখা যাইতেছে। হইলে আমার করনের কিচ্ছু নাই। আমি কি কোন খারাপ কতা কইছি কন? কোন বেয়াদবি করছি? অন্যায্য কাম অন্যায্য কতা এই বুলবুলি বেগমের কাচে পাইমেন না।

এবারে কামের কথা কন আফা…
নাকি আমারে আপনি রাখপেননা…

ফারাজের মা যেন স্তব্ধ। তিনি নিঃশ্বাস খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কথা খুঁজে বেড়াচ্ছেন কি বলবেন তিনি! এই অশিক্ষিত খেটে খাওয়া কাজের মেয়েটি একটাও অযৌক্তিক কথা বলে নাই। নিজের চাওয়া পাওয়ার জায়গায় এই নারী কত আত্মপ্রত্যয়ী, কত সাবলীল অকপট। জীবনকে যাচাই করে দেখার এই অসীম সাহস সে কোথায় পেয়েছে! কিসের তাড়নায়, কি পাওয়ার আশায় ঘর ছেড়েছে! ফারাজের মা কি কোনদিন এর মত এমন অকপট হতে পারবে! এমন সাহসী! মাঝে মাঝেই কি চিৎকার করে ঠিক এই কথা গুলোই তার বলতে ইচ্ছে করে না! করে, করে, খুব করে… পৃথিবী ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে… কিন্তু…

কিন্তু, তারপরও সামনের ফ্লাটের ভাবির সাথে দিনের পর দিন মুখোশ পরা সুখের আলাপন। অবসরে তিনি ফেসবুক ইউজ করেন সেখানে কেবল আনন্দ বিনোদন আর সুখতরীর স্বর্ণালি ছবির বর্ণীল পোষ্ট। সামনে বসা এই নারী কি জানে হিপোক্রেট বলে একটি শব্দ আছে, বা জানে শব্দটার মানে কি? রুচিশীল শিক্ষিত অভিজাত ফারাজের মা জানে, খুব ভালভাবে জানে একেবারে বানানসহ জানে…

ফারজানা হকের ভেতর থেকে এক বুলবুলি, বুলবুলি বেগমের ভেতর থেকে এক ফারজানা হক কিংবা কোথা থেকে যেন অসীম সংখ্যক কন্ঠ হিসহিস করে ওঠে –
হেই অভিশপ্ত জীবন! তোমার মুখে থুথু দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তাতে যে আমাদের থুথুরই অপমান।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত