হেমন্তের জোছনাভেজা রাত

হেমন্তের এই নির্জন সাঁঝবেলায় কী যে হয় মাসুকের! খুব আনমনা লাগে। অতীতের কোনো এক শৈশব-কৈশোরের সাঁঝবেলার স্বপ্ন এসে তাকে আচ্ছন্ন করে। সেসব স্বপ্ন যার কিছুই তার জীবনে সত্যি হয়ে আসেনি। বাবা-মা বেঁচে থাকতে যেসব স্বপ্ন তাকে অনাগত দিনগুলো নিয়ে উচ্ছ্বসিত করত, জীবনের অনেক অনেক দিনের পরিভ্রমণ শেষে সেই স্বপ্নের মাঝে কেমন বিষণ্ণতা ভর করেছে! মা-বাবার স্মৃতি ভেসে উঠলেই তরুণ বয়সের স্বপ্নকে এখন দূরাগত কোনো অচেনা জগতের হাতছানি মনে হয়। হেমন্তের জোছনাভেজা রাত অচেনা জগতের সেই হাতছানি হয়ে তার সাথে কী এক মরীচিকার খেলা হয়ে তার দীর্ঘশ্বাসকে নিরাসক্ত করে তোলে। স্ত্রী-কন্যার পরবাসী হওয়ার পর এই জীবন নিয়ে তার ঘোর যেন আর কাটছেই না। জলছবির মতো তার অতীতটুকু মাসুকের মানসপটে মায়ার কুহেলিকা হয়ে খেলা করে।

পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে মাত্রাকে নিয়ে তার স্ত্রী মৌরি কানাডায় পাড়ি জমাল। আর সাহিত্যের একজন অধ্যাপক ও লেখক হয়ে দেশ ছেড়ে গেলে, মাতৃভূমির মায়াকে অতিক্রম করে গেলে ‘শব্দ’রা তাকে ছেড়ে যাবে বলে মাসুক দেশেই পড়ে থাকলেন। যে স্বপ্নকে লালন করার জন্য তিনি দেশে থাকলেন সেই স্বপ্নগুলো তাকেই ছেড়ে পরবাসী হয়ে রইল। স্ত্রী-কন্যা কিছুদিনের জন্য না থাকলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না বলেই তিনি ধরে নিয়েছিলেন। নির্জন নীরবতায় তিনি গড়ে নেবেন তার একান্ত ভুবন। নিজের সময়কে গুছিয়ে ব্যবহার করবেন- এমন কল্পনা করে তিনি বরং এ নিয়ে নির্ভার ছিলেন। ভেবেছিলেন, লেখা আর পড়ার ভেতর ডুব দিয়ে কখন পার করে দেবেন পাঁচটা বছর! কিন্তু পড়াশোনা ও পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্নের জন্য মৌরি পাঁচ বছরের কথা বলে গেলেও বছর যেতে না যেতেই তার মনে হলো, মৌরি আর মাত্রা তাকে ছেড়ে গেছে কয়েক যুগ আগে। কোনো কাজ গুছিয়ে করা তো পরের কথা, রাতে কী খাওয়া যায়; এই চিন্তাতে কখন সন্ধ্যাপ্রহর পার হয়ে যায়! এত এলোমেলো লাগে সবকিছু যে, কোনো গ্রন্থ অথবা লেখার ভেতর গভীরভাবে তিনি আর আগের মতো মগ্ন হতে পারেন না। কোনো দৃশ্য আর চরিত্রকে ধারণ করতে যে ভালোবাসার প্রয়োজন, তার জন্য মগ্ন হতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হন। স্রষ্টার মতো নির্মোহতায় কোনো আর্তিকে খুঁজতে গিয়েও দু’চোখ জলে ভিজিয়ে ফেলেন। ছিঁড়ে ফেলে দেন অনেকক্ষণ ধরে লেখার পাতা। তারপর এক রাশ গ্লানি আর অতৃপ্তি নিয়ে বিছানায় এসে অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেন। মধ্যরাতে কোনো বাদুড়ের পাখা ঝাপটানো, বর্ষার কদমফুলে জেগে থাকা টলটল বৃষ্টিফোঁটা অথবা ভোরের পাখিগুলোর আড়মোড়া ভাঙা কিচিরমিচির কল্পনা না করে তিনি ঘুমাতে পারেন না। কলেজে যেতে দেরি হয়। দিনকে মাস, আর সপ্তাহকে বছর মনে হয়।

কয়েকবার প্রিন্সিপালের কাছে বিলম্বের কারণে লিখিত কৈফিয়ত জমা দিতে গিয়ে একদিন হঠাৎ তার মনে হলো, এই কলেজে তিনি গত ৪০ বছর ধরে চাকরি করছেন। অধ্যাপনাকে তার চাকরি বলেই মনে হলো। কেননা, ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মননটাকে তিনি গরু-ছাগলের চেয়ে আজকাল উন্নততর বলে ভাবতে পারেন না। তার মনে হলো, তিনি দীর্ঘকাল এক ক্লান্তিকর জীবন যাপন করছেন। এই জীবন থেকে তিনি মনে মনে মুক্তি চাইলেন। অধ্যক্ষের স্বাক্ষর করা দেরিতে ক্লাসে আসার কারণ দর্শানো নোটিশে তিনি দীর্ঘ ‘৪০ বছর’ অধ্যাপনার কারণে তার ক্লান্তির কথা উল্লেখ করলেন এবং অবসর চাইলেন। তার কাছ থেকে এমন বিভ্রান্তিকর জবাব পেয়ে অধ্যক্ষ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্নজনের কাছ থেকে অধ্যাপক মাসুকের মাথার গণ্ডগোলের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদনপত্র পাঠালেন। শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জনকারী একজন মেধাবী অধ্যাপককে মাত্র ১৬ বছর চাকরিতেই কেন অবসর দিতে হবে- এমন পত্রের জবাবে এবার অধ্যক্ষ সরাসরি মাসুককে একজন ‘পাগল’ বলে আখ্যা দিলেন। তার সপক্ষে কলেজের অনেকের জবানবন্দি গ্রহণ করে পত্রের সাথে সেসব মূল্যবান নথি সংযুক্ত করে পুনরায় মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিলেন। আর এ সবকিছুই ঘটল মাসুকের অজান্তে।

মাত্রা, মৌরি কেউ নয়; তার বসবাস এখন সারাজীবন ধরে লেখালেখি করা পাণ্ডুলিপির সাথে। অর্থ ছাড়া যার কোনোটাই এ দেশের প্রকাশকরা প্রকাশ করতে আগ্রহী নয়। দিগন্ত এবং নদীর দিকে মুখ করা শহরতলিতে তার ছিমছাম একতলা বাড়িতে তিনি ছাড়া একটা কুকুর, কুলসুম নামে একজন কাজের মানুষ, দুই বিড়াল থাকার পরও কিছু ইঁদুর, একটা করে বাতাবিলেবু, সুপারি ও নারিকেল গাছ আছে। বাড়িতে থাকার চেয়ে তিনি খালের মতো সরু হয়ে যাওয়া নদীটার পাড়ে, রাস্তার ধারে তার লাইব্রেরিতে গিয়ে বই খুলে বসে থাকতে ভালোবাসেন। অর্ধেক বিক্রি করা পেনশনের সব টাকা দিয়ে পৃথিবীর সেরা সেরা গ্রন্থ জোগাড় করে এক লাইব্রেরি নির্মাণ করেছিলেন। ভেবেছিলেন, মহান গ্রন্থগুলো বিক্রির মাধ্যমে নিজের রোজগারের পাশাপাশি তিনি এই শহরতলি ছাড়িয়েও পুরো এলাকার তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এমনকি সব বয়সী মানুষের মনোলোক আলোয় ভরিয়ে তুলবেন। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়; এমনকি চলে যায় বছর। তবু তার কষ্টে সংগ্রহ করা বইগুলোর একটা কপিও আর বিক্রি হয় না। যতবার কেউ বই কিনতে এলো ততবার তিনি আশান্বিত হয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে জানতে চাইলেন, কী বই প্রয়োজন, বলুন? বই কিনতে আসা ক্রেতারা যা চাইলেন তার জন্য তার মরে যেতে ইচ্ছা করল। বেশিরভাগের চাহিদা পাঞ্জেরী গাইড হলেও একদিন এক এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রীর পিতা এসে ফিসফিস করে বললেন, ফাঁস হওয়া অংক আর বিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র আপনি কত টাকায় বিক্রি করছেন? মাসুক হতভম্বের মতো তার মুখের দিকে অনেকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। লোকটি যখন কয়েকবার তার কাছ থেকে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র বিক্রির আরও বেশি টাকার বিনিময় প্রস্তাব পেলেন, তখন তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। হুঙ্কার দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিয়ে রাস্তার দিকের ফটক বন্ধ করলেন। গ্রন্থাগারের পেছনের নদীর দিকে পুরো থাই গ্লাস খুলে হতাশ আর উদাসীন দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

সুতরাং পেনশনের সামান্য টাকায় জীবন চললেও লাইব্রেরির পরিবৃদ্ধি আর হয় না। বইগুলো পুরাতন হতে হতে পোকার খাদ্য হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। শব্দের সাথে, কল্পিত জীবনের সাথে এত মগ্ন থেকে তিনি লেখক উপাধি পাওয়ার পরিবর্তে সমাজের এলিটদের কাছে ‘সিজোফ্রেনিক’ এবং আমজনতার কাছে ‘আধ-পাগল’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।

২. আজ সন্ধ্যায় হেমন্তের চাঁদটা তার ময়দামাখা আলো নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। নদীর কিনার ধরে জেগে ওঠা কুয়াশা সেই আলো শরীরে মেখে আর রহস্যময়। মাসুক নদীর কিনারে সেই রহস্যময়তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ঠিক সেই সময় অচেনা নাম্বার থেকে তার মুঠোফোনে কে যেন ফোন করল,

মাসুক, আমি মৌরি। কেমন আছ?

মৌরি? কোন মৌরি? মাসুক কি তাকে চেনে? তার মনে পড়ল ২৫ বছর আগে ২০ বছরের এক মৌরির সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের ঠিক ৭ বছর পর সে তার ৫ বছর বয়সী মাত্রাকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তার পর তার জীবন একা কাটল; অবসর এলো তাদের পথ চেয়ে থেকে থেকে।

মাসুক, শোনো, আমি একেবারে দেশে ফিরে যাচ্ছি… আর বলো না, এই দেশে অনাচারের শেষ নেই; ১৩ বছরের মেয়ের ছয় মাসের বাচ্চা। মেয়ে বড় হওয়ার আগেই আমি ভাগ্যিস ফিরে যাচ্ছি।

মেয়ে বড় হওয়া বলতে মৌরি কী বোঝাতে চাইল তা মাসুকের কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি শুধু বলতে পারলেন,

আসছ তবে?

হ্যাঁ, আসছি। তোমার জন্য কী নেব, বল তো?

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর মাসুক খুঁজে পেলেন না। চাওয়া-পাওয়াকে সীমিত করতে করতে এমন হয়েছে যে, এই বয়সে তার কী প্রয়োজন তা তিনি ঠিক অনুমান করতে পারলেন না। তবে হ্যাঁ, তার একচালা রান্নাঘরের পাশে নদীর দিকে মুখ করে বসে থাকার জন্য যে ঘরটা তিনি বানিয়েছেন, তার জন্য একটা রোলিং চেয়ার হলে ভালো হয়। আর সাথে ওই যে, ডাক্তার বলছিল, কী যেন ট্যাবলেটগুলোর নাম? যা খেলে দারুণ ঘুমে তলিয়ে যায় মানুষ! কিন্তু কোন ডাক্তার তাকে ট্যাবলেটগুলোর কথা বলেছিল, তা তার মনে পড়ল না। রোলিং চেয়ারে বসে হেমন্তের চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি অতল ঘুমে তলিয়ে যাবেন- এই বয়সে এই তার একমাত্র স্বপ্ন। হেমন্ত বড় যন্ত্রণার মাস। হৃদয়ের ভেতর কী সব নস্টালজিয়ার কেমন তোলপাড় অনুভূতি তাকে কুরে কুরে খায়। তরুণ বয়সে এই হেমন্ত এলেই কত কবিতা এসে তার হৃদয়কে উদ্ভাসিত করত! হেমন্ত তার জন্ম-মাস কিনা!

মৌরির ফোন পাওয়ার পর সেই ট্যাবলেটগুলো জোগাড় করার তাড়না তার বেড়ে গেল। হ্যাঁ, এ বছর একা একা হলেও তিনি তার জন্ম-মাসটা উদযাপন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুই দিন পরই ভরা পূর্ণিমা। সেই সন্ধ্যায় চাঁদের ময়দা মাখানো রহস্যময় আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি অতল ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে চান। তিনি চেয়ার থেকে উঠলেন এবং গলির মোড়ে ওষুধের দোকানে গিয়ে দোকানদার ছেলেকে ডেকে নিরিবিলি এক স্থানে নিয়ে তার হাতে সারা জীবনের জমানো কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেন। তারপর ফিসফিস করে তার কানে কথাগুলো বলতেই ছেলেটা বলল, স্যার, আপনাকে এমন পাগলামি করা মানায় না। এমন কোনো ট্যাবলেট আমার এখানে নেই, যা খেলে আজীবন চাঁদের আলোর ভেতর ঢুকে যাওয়া যায় অথবা তার মধ্যে সারাজীবন ধরে ঘুমানো যায়।

মাসুককে এই সমাজ সহায়তা যে করবে না, তা তিনি জানতেন। তিনি ফিরে আসার পথে নদীর কিনারে ঝোপঝাড়ের নির্ধারিত স্থানে গেলেন। অনেক দিন ধরে ধুতরা গাছকে তিনি সেখানে বড় হতে দেখছেন। এবং চাঁদের রৃপালি আলোয় সবুজ ঝোপঝাড়ের ভেতর সবুজ এই গাছটাকে দেখলেই তার সংবেদি স্নায়ুতন্ত্র সজাগ হয়ে ওঠে।

৩.চৈত্রের ভোররাত। ধানক্ষেতে সেচের শ্যালো মেশিনগুলো সরব। এই সময়ে ঘুমের চেয়ে তার ঘুমের ঘোরটুকু ভালো লাগে। তন্দ্রাচ্ছন্নতায় স্মৃতিচারণের উষষ্ণতা তার কাছে মধুর মনে হয়। যদিও এই আচ্ছন্নতা কেটে যাওয়ার পর প্রতিদিনের ভোর তার কাছে আনন্দের পরিবর্তে বিষণ্ণতা আর একাকিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। ভোর রাতের এই শীত শীত আবেশে পূর্ণিমার আগের রাতে তার ভালো ঘুম হলো। পরেদিন ৫ চৈত্র বুধবার ভরা পূর্ণিমার রাতে তিনি অনন্ত ঘুমের কাছে, চাঁদের কুয়াশামাখা আলোর রহস্যময়তার মাঝে ডুব দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠলেন।

নদীর অন্য প্রান্তে চাঁদের আলোয় মায়ার কুহেলিকা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠল। আজকাল একটু শীতেই তার গলা ব্যথা করে। কিন্তু একটা মাফলার কয়েক বছর ধরে কিনব কিনব করেও আর কেনা হলো না। তাই তিনি গলার কাছে অনেক পুরনো পাতলা এক তোয়ালে জড়িয়ে ছিলেন। সেই তোয়ালে দিয়ে তিনি চোখ মুছলেন। তার পর ঘরে ফিরে মায়ের হাতে সেলাই করা এখানে সেখানে ছেঁড়া নকশিকাঁথা বের করে তা জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। কাঁথার ভেতর এখনও সেই পুরনো ঘ্রাণ। মায়ের ঘ্রাণ, সময় নামক এক যাযাবর ও কিশোর মাসুকের ত্বকের ঘ্রাণ কাঁথার উষষ্ণতায় মিলেমিশে এক নস্টালজিক মুহূর্তকে ছলকে তুলেই কেন যেন পলকে পলকে তা হারিয়ে ফেলছে। কিশোরবেলায় কাঁথাটা গায়ে দিলেই তার অনাগত আগামী দিনগুলো স্বপ্নের চোখ মেলে তার বর্তমানকে উঁকি দিয়ে দেখত যেন। সেই বয়সে মাসুক জানত না, স্বপ্ন আর কিছুই নয়; তারা চাঁদের রহস্যময় আলোয় লুকিয়ে থাকা মায়ার কুহেলিকা- এমন অনুভব নিয়েই তিনি বিছানায় এলেন। চাঁদের আলোয় সবুজ ধুতরা গাছকে তিনি প্রতিদিন একটু একটু করে পরিণত হতে দেখেছেন। গাছটার ফল থেকে অনন্ত ঘুমের সাদা পাউডার তৈরি করার কৃতিত্বময় পরিতৃপ্তি নিয়ে তিনি খাটের পাশের টি-টেবিলে রাখা গ্লাসে জল ঢাললেন। তারপর তাতে পাউডারটুকু মিশিয়ে ঢক-ঢক করে জলটুকু পান করে নকশিকাঁথার ঘ্রাণের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে তার মহার্ঘ্য ঘুমটুকুর প্রত্যাশায় চোখ বন্ধ করলেন।

ভোর রাতে ঘুমের ঘোরেই মাসুক পাশ ফিরলেন। কিন্তু তার শরীর একটুও নড়ল না। যেভাবে শুয়ে ছিলেন, সেভাবেই তিনি অসাড় শুয়ে থাকলেন। কাঁথাটা তার বুকের কাছে লেপ্টে আছে। খোলা পায়ে হালকা হলেও শীত এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে, তার নখগুলো দেখলে মনে হবে তার চামড়ার নিচে বরফকুচি দিয়ে তা শক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সেচযন্ত্রের শব্দ নিঃশব্দ প্রকৃতির মাঝে তরঙ্গ তুলে দূরাগত আভাসের মতো ভেসে ভেসে আসছে তার কানে।

মাসুকের মনে হলো, এটা ভোর রাত নয়। এটা সেই রাতের প্রথম প্রহর, যখন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মাসুক মাত্র ৯ বছর বয়সী ঘুমানোর আগে মাছের মাথা দিয়ে মুগডালের ঘণ্ট খেয়ে তারা ঘুমিয়েছে। একটু আগে হারিকেনের আলোয় মা-বাবার সাথে রেডিওতে তারা সোহরাব-রুস্তমের নাটক শুনেছে। নাটকে রুস্তমের মৃত্যুর সময় বাবার চোখের অবাধ অশ্রু দেখে শিশু মাসুকের কান্না পেল না বরং দ্রুত ঘুম পেয়েছিল। এখন কি মধ্যরাত তাহলে? ঘরের টিনের চালে কি বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর শব্দ হলো? শিরীষ আর বকুল কি বাড়ির মাঝের হাসনাহেনার ঘ্রাণে অন্ধকারের মধ্যে আরও গোপন হয়ে যেতে চাইছে? বাবাকে তার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করল- বাবা, কেন তুমি অমন করে কাঁদলে? এবং কোনো দ্বিধা ছাড়াই ছোট্ট মাসুক বাবাকে প্রশ্ন করতেই ধড়মড় করে জেগে উঠলেন স্মৃতিতে জেগে ওঠা সেই মুহূর্ত থেকে আরও ৩৫ বছর অতিক্রম করা আজকের প্রৌঢ় মাসুক। কিন্তু তার শরীর অসাড় পড়েই থাকল। বুকের কাছে লেপ্টে থাকা কাঁথা আর পায়ের শক্ত হয়ে যাওয়া নখগুলোতে হিম শীতলতা। তন্দ্রার ঘোর কাটলেও মাসুক অনুভব করলেন, ৩৫ বছর আগে এক চৈত্রের রাতে নয়, বরং গতকাল রাতে মুগডাল আর মাছের মাথার ঘণ্ট তিনি খেয়েছিলেন। এবং এমন অনুভূতির পক্ষে তার শরীরও সায় দিল। গলা থেকে যে ঢেঁকুর বের হলো, তাতে স্পষ্টত তিনি ৪০ বছর আগে এক রাতে খাওয়া সেই খাবারটিরই গন্ধ পেলেন, যে রাতে তার বাবা রেডিওতে সোহরাব-রুস্তমের নাটক শুনে চোখ ভিজিয়েছিলেন।

মাসুক জানালা খুলে দিলেন। কিন্তু তার শরীর তখনও অসাড় পড়েই থাকল বিছানায়। বাইরে সেচযন্ত্রের শব্দ আরও জোরালো হয়ে তার কানে ছন্দ তুলেই চলল। টিনের চালে এই বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর শব্দও শোনা যাচ্ছে। এটা সুব্‌হে সাদেক, নাকি প্রথম রাত্রির প্রহর? বাবা কি সোহরাবের মৃত্যুতে এখনও কাঁদছেন? সময় সম্পর্কে অনিশ্চয়তা এবং এই দোলাচল তাকে অস্থির করছে। তার পিপাসা বেড়ে যাচ্ছে। অস্থিরতা কাটাতে তিনি গলায় শক্তি এনে বাবাকে ডাকতে চাইলেন। কিন্তু তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো- মৌরি?

গত রাতেই মৌরি যে তাকে ফোন করেছিল, তা তার স্মৃতি থেকে চিরতরে মুছে গেছে। বাস্তবকে মাসুকের স্মৃতিভ্রম আর স্মৃতিকে বাস্তব বলে মনে হওয়ার এই প্রবণতা তৈরি হয়েছে মৌরি আর মাত্রার অনুপস্থিতির দিন থেকেই। তিনি আবার ডাকলেন-

মৌরি!

কিন্তু মৌরির কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তার ঘোর কাটতে গিয়ে তা আরও গভীর হয়ে গেল।

৪.মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল। তিনি উঠলেন এবং হাত-মুখ ধুয়ে এই ভোরেই আগপিছ না ভেবে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বাইরে এসে নদীর দিকে মুখ করে বসলেন। কিন্তু তার শরীর অসাড় পড়েই থাকল বিছানায়। বুকের কাছে লেপ্টে থাকা কাঁথা আর পায়ের শক্ত হয়ে যাওয়া তার নখগুলোতে হিম শীতলতা।

চাঁদটা এখনও রহস্যময়, যেন মাসুকের কানে কানে সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু শেষরাতের জোছনায় লুকানো কুহেলিকার চেয়েও তিনি এক রহস্যময় দৃশ্য দেখলেন। তা আর কিছু নয়; একটা কার এসে তার বাড়ির দরজায় থামল। ওহ, তাই তো। মৌরির তো আজই আসার কথা। আহা, মৌরি, তুমি এলে এমন সময়, যখন আমার মনে হলো, এই পৃথিবীর সব জঞ্জাল পায়ে ঠেলে আমি একটা সুরের পাখি হয়ে যেতে চাই। যে ভালোবাসাকে নেওয়ার জন্য এই সমাজ প্রস্তুত নয়, তাকে মহার্ঘ্য ভাবার অপরাধে, আমার মৌরি; আমি তোমার কাছ থেকেও পালাতে চাই।

কার থেকে নেমে মৌরি প্রায় দৌড়ে মাসুকের ঘরের দিকে গেল। বুকের কাছে লেপ্টে থাকা কাঁথা সরিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। বারবার তাকে ডাকল-

মাসুক, মাসুক! আমার পিএইচডি করা শেষ হয়েছে। দেখ, এই ৫ বছরেই তোমার মাত্রা কত বড় হয়েছে! ১০ বছরের মাত্রা তার ঝাপসা স্মৃতি থেকে বাবার মুখটা মেলাতে গিয়ে দু’চোখ টলটল অশ্রুতে ভরিয়ে ফেলল। বাবা মাত্র ৫ বছরেই এমন বুড়িয়ে গেছেন! তার মাথায় এলোমেলো চুলে এত শুভ্রতা এসে ভর করেছে! তিন বছর আগে তারা যখন একবার বেড়াতে এসেছিল, সেই সময়ের কথা তার মনে পড়ল। বাবা তখনও এমন বিশুস্ক হয়ে যাননি। মা তখন বাবাকে কানাডায় নিয়ে যেতে চাইলে তিনি হেসে বলেছিলেন,

আমার একটা গল্প নিয়ে খুব শিগগিরই একটা মঞ্চনাটক হবে। আর হ্যাঁ, একজন প্রকাশক খুব তাগাদা দিচ্ছেন …

ঠিক আছে, তারা তাদের কাজ করুক। তোমার কাজ লেখালেখি; তাই না? সেটা কানাডা থেকেও করা যাবে।

না, না। তা কীভাবে হবে? ওরা একগাদা ভুল বানানে আমার পা ুলিপি প্রকাশ করবে, মৌরি। তুমি তো জানো, বানান ভুল করা ব্যাপারটাকে আমি কী পরিমাণ ঘৃণা করি!

একটা বই প্রকাশ করা মাত্রা আর মৌরির চেয়েও তোমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল?

না, না। তা নয়। এই একটা স্বপ্নকে … মানে আমার জীবনের সব স্বপ্নকে… এই চাঁদনী রাতের মায়াবী রহস্যালোকে খুঁজে ফেরা এই মানব জীবনকে এই গ্রন্থের ভেতর আমি গেঁথে নিয়েছি। একটাই কাজ করছি জীবনভর… এটা হয়ে গেলেই… আমার মুক্তি।

কিন্তু তুমি নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ?

একটা সুযোগ পেলাম। পেনশন দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা আমার কত উপকার করল! গরু-গাধা পড়িয়ে লাভ নেই, বুঝলে? ভালো একটা বইয়ের নাম বললে যারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, ওদের চোখে চোখ রেখে আমি বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছিলাম। লেখা-জোকা কিছুই হতো না। তার চেয়ে নদীটা আর তার ওপারে যে অশ্বত্থতল, জোছনার মায়াবী বিহার- তার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার আত্মা কত তৃপ্ত হয়, বল। কিন্তু তুমি এতদিন পর এলে!

কতদিন আর! তিন বছরে দুইবার এসেছিলাম। কত কষ্টে বিমান ভাড়া জোগাড় করে তবেই না আসা।

উদ্ভাসিত ভোরের আলোয় মাসুক মাত্রা আর মৌরির মুখটা দেখে তার যে পিপাসা লেগেছিল, তা তিনি ভুলে গেলেন। মাসুকের মনে হলো, অদ্ভুত এক সোনালি আলোয় তার জীবন ভরে গেছে। তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মাত্রাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে টুলের ওপর ফেলে রাখা একটা পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে বললেন-

দেখেছ মা, ওটা আমার লেখা পাণ্ডুলিপি। প্রকাশক দেখার জন্য ফাইনাল প্রুফ পাঠিয়েছেন। তোমার মাকে বোঝাও, এ দেশের মানুষের জগাখিচুড়ি মার্কা পচনরত মননটাকে পরিশীলিত করা এ দেশে জন্মগ্রহণ করা মানুষের কাছে মাতৃঋণ পরিশোধের সমতুল্য। বিদেশ তো পরের কথা, মাতৃঋণ পরিশোধ ছাড়া মাসুকরা কি অনন্ত ঘুমে তলিয়ে যেতে পারে? বলো, মা!

মাসুক অনুভব করলেন, মৌরি তার স্বামীকে এতদিন পর কাছে পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তবে, মাসুকের অসাড় শরীরের ঘুম মাত্রা আর মৌরির কান্নাতেও ভাঙল না। মৌরির হাত-মুখে শ্যামল কোমলতায় বুঝি কানাডার বরফ-শুভ্রতার সাথে ভোরের আলোর রক্তিমাভা ভর করেছে! তাই তো, তার বয়স একটুও বাড়েনি। ২৫ বছর আগের ২৭ বছর বয়সী, ৫ বছরের কন্যার মা মৌরির চেয়ে তার বয়স যেন কমে গেছে। এত লাবণ্যময়ী, এত মমতাময়ী নারী তাকে ছেড়ে দীর্ঘ ২৫ বছর কীভাবে দেশের বাইরে কাটাল তা নিয়ে সন্দিহান না হলেও মাসুক ভেবে পেলেন না, তাকে সম্মান করতে গিয়ে মৌরি তার পা কি ছুঁয়ে দিল?

মৌরি এবার মাসুকের জামার নিচে তার খোলা দুই পায়ে হাত রাখল। কানাডার শুভ্র বরফ যেমন প্রকৃতিকে তার হিমশীতল বরফের শক্ত আবরণে মুড়িয়ে রাখে, মাসুকের শক্ত হয়ে যাওয়া তার নখগুলোতে এমন হিম শীতলতা! নিজেকে সামলে মৌরি খাটের পাশে টি-টেবিলে রাখা জগ-গ্লাসের পাশে এক টুকরো খোলা কাগজে চোখ রাখল। সেখানে সাদা সাদা পাউডারের অবশিষ্টাংশ তাকে চিন্তিত আর অস্থির করে তুলল। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে ফিসফিস করে সে নিজেকেই বলল,

জানি, মাসুক। তুমি খুব অভিমানী। তোমার অনুমতি নিয়ে ৭ বছরের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলাম, ৫ বছর পরই তো ফিরলাম… তবু, আমার সব স্বপ্ন যে মিথ্যা হয়ে গেল! মাসুক মৌরির উষষ্ণ হাতের স্পর্শ পেয়ে বলল,

আহা মৌরি, স্বপ্ন নিয়ে আর বলো না। আমাদের মতো সামান্য মানের এক আবেগপ্রবণ মানুষদের কাছে ওরা অধরা। শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন মানে আমার মতো সামান্যদের মৃত্যু। তবে, অনন্ত ঘুমের জন্য স্রষ্টা নদীর পাড়টাকে কত উর্বর করে সৃষ্টি করেছেন! জন্ম-প্রতিভাবান শিল্পীর মতো তার সংকেত আমি আবিস্কার করেছি…

৫.এই হেমন্তেই টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরছে। মৌরি প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনকে ডেকে যখন পরবর্তী করণীয় বুঝিয়ে দিল, ঠিক তখন মাসুক তার কাঁধে হাত রেখে বলল,

অনন্ত জীবনকে আস্বাদের জন্য নদীর পাড়ের ঝোপঝাড়টা মোক্ষম একটা জায়গা। চাঁদের আলোয় কত ছায়া সেখানে ঘোরাফেরা করে! আমার সাংকেতিক স্নায়ুতন্ত্র আমাকে বলে; ছায়াগুলো অনন্ত পরমায়ুপ্রাপ্ত।

তার তিন রাত পর এক মধ্যরাতে মৌরি ঘর ছেড়ে বাইরে এলো। নদীর পাড়টার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। এই হেমন্তের চাঁদের আলোয় মায়ার কুহেলিকাগুলো সত্যিই ছায়া হয়ে ঘোরাফেরা করছে। মাসুক তার কাঁধের পাশে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,

অনন্ত পরমায়ু নিয়ে আমার সাথে ছায়া হয়ে ঘুরতে, ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের ফাঁস থেকে বাঁচতে পাউডার মেশানো এই জলটুকু তোমাকে পান করতে হবে।

মৌরি মাসুকের চোখে চোখ রেখে অনেক দিন পর হাসল। তারপর দ্বিধা ছাড়াই মাসুকের সাংকেতিক স্নায়ুতন্ত্রের একমাত্র আবিস্কার সেই পাউডার মেশানো জলটুকু ঢক-ঢক করে পান করল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত