মা একটা ভূত পোষেণ

ঘটনা মোটামুটি নিশ্চিত। কয়েক দিন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে; মাথা চুলকে, ঠোঁট কামড়ে, থুতনিতে হাত দিয়ে ভেবে ভেবে নাজিফ এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, ওর মা একটা ভূত পোষেণ!

ভূতটা মোটামুটি লক্ষ্মী-টাইপ, কারও কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু বাসার ভেতর একটা ভূত থাকবে, আর ওর সঙ্গে নাজিফের পরিচয় হবে না, তা কি হয়? মা কেন নাজিফকে ভূতটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন না, সেটাও একটা রহস্য। মা যেহেতু নিজে থেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন না, তাই নাজিফ আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। বলতে গেলেই হয়তো মা দুম করে সেই কথাটাই বলবেন, যেটা তিনি সবচেয়ে বেশি বলেন, ‘আগে বড় হও, তখন…।’

তাই নাজিফ ঠিক করেছে, ভূতটাকে সে হাতেনাতে ধরবে। মুখোমুখি বোঝাপড়া হবে। বুঝবে মজা!

কিন্তু ব্যাটা থাকে কই?

খাটের নিচে? ওয়ার্ডরোবের ভেতর? বুকশেলফের পেছনে? রান্নাঘরের পাতিলগুলোর আড়ালে? নাকি নাজিফ যেমন মায়ের জামার কোনা ধরে ঘুর ঘুর করতে থাকে, ভূতটাও তা-ই করে? এটা ভাবলে অবশ্য নাজিফের একটু একটু রাগ হয়। মনে মনে সে বলে, ‘আমার আম্মুর জামা ধরে আমি ঘুরব। তুমি ব্যাটা কোথাকার কে!’

কিন্তু এ কথা ভূতটাকে বলতে হলে আগে ওর মুখোমুখি হতে হবে। মুশকিল হলো, ওকে দেখা যায় না। ও অদৃশ্য।

ভূতের অস্তিত্ব সম্পর্কে নাজিফ নিশ্চিত হয়েছে কয়েক দিন আগে। সেদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সে। ড্রয়ারের ভেতর আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখল, মোজা একটা আছে আরেকটা নেই। নাজিফ চিৎকার করে ডাকল, ‘আম্মুউউউ! আমার একটা মোজা খুঁজে পাচ্ছি না।’

মা বললেন, ‘কোন মোজাটা রে?’

‘ওই যে ভালুকের মাথা আঁকা, সেটা।’

এবার মা নিজেই এলেন। তিনি ড্রয়ারের ভেতর হাত ঢোকালেন, আর অমনি মোজাটা বেরিয়ে এল। তাজ্জব ব্যাপার! অথচ ঠিক এই জায়গাটাতেই নাজিফ কতবার ঘাঁটাঘুঁটি করে দেখেছে, পায়নি। মা হাত দিতেই মোজাটা কোথা থেকে চলে এল!

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। নাজিফের ইরেজার, আব্বুর পেনড্রাইভ, দাদুর পানের কৌটা, দাদার চশমা, ফুলি বুয়ার গুঁড়া সাবান…যখন যা খুঁজে পাওয়া যায় না, মা হাত বাড়ালেই কোথা থেকে যেন সব চলে আসে। নাজিফ আগেও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। কী অবাক কাণ্ড! নিশ্চয়ই পোষা ভূতটা মাকে সাহায্য করে।

যদিও ভূতটার সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি, তবে নাজিফ মনে মনে ওর একটা নাম দিয়েছে। ভূতের নাম খোঁজা ভূত! সে তো সব হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে দেয়, তাই এই নাম। ভূতটাকে নিয়ে নাজিফ নিজে নিজে একটা ছড়াও বানিয়েছে।

ছড়াটা এমন—

‘খোঁজা ভূত খোঁজা ভূত,

বাঁকা ত্যাড়া সোজা ভূত।

খোঁজা ভূত খোঁজা ভূত,

বাঁকা ত্যাড়া সোজা ভূত।’

মাঝেমধ্যে সে বিড়বিড় করে এই ছড়া আবৃত্তি করে আর এ ঘর-ও ঘর ঘুরে বেড়ায়। ছড়া শুনে যদি ভূতটার মন গলে, যদি দুম করে সে দেখা দেয়, এই আশায়।

কিন্তু এভাবে ছড়া বলেও যখন কাজ হলো না, তখন নাজিফ কড়া নজরদারি শুরু করল! মাকে চোখে চোখে রাখতে শুরু করল। ঘরের জিনিসপত্রগুলোও সে দেখে দেখে রাখতে শুরু করল। দুটো মোজা সে ইচ্ছে করে ড্রয়ারের দুই কোনায় লুকিয়ে রাখল। দাদির পানের কৌটা, ফুলি বুয়ার গুঁড়া সাবান, দাদার চশমা, বাবার পেনড্রাইভ…কোনটা কোথায় রাখা হয়, সব সে দেখেশুনে রাখতে লাগল। খোঁজা ভূতের সঙ্গে টক্কর দিতে হলে সে কীভাবে সব খুঁজে বের করে ফেলে, আগে সেটা বুঝতে হবে।

কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই নাজিফ হতাশ হয়ে গেল। কোথায় খোঁজা ভূত? তার টিকিটিও নেই; বরং বাসার সবকিছু দেখে রাখতে রাখতে নাজিফ নিজেই যেন ‘খোঁজা ভূত’ হয়ে গেল। বাবা যখন তাঁর পেনড্রাইভটা খুঁজে পান না, দাদি যখন পানির কৌটা খোঁজেন, ফুলি বুয়া যখন গুঁড়া সাবান খুঁজতে থাকে, দাদা খোঁজেন চশমা, তখন আর মাকে ডাকতে হয় না। নাজিফই এটা-ওটা এগিয়ে দেয়। সে তো জানে, কোথায় কী আছে। এখন নাজিফও মায়ের মতো বাসার সবাইকে এটা-ওটা খুঁজে পেতে সাহায্য করে, দেখে মা আদর করে ওর কপালে চুমু খান।

কিন্তু ভূতটা গেল কই? তাহলে মা যা বলেন, তা-ই কি সত্যি? ভূত বলে কিছু নেই? মাথা চুলকে, ঠোঁট কামড়ে, থুতনিতে হাত রেখে নাজিফ আবারও ভাবতে বসে…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত