-তনিমা,তোর ভাবির সেদিন যে যমজ সন্তান হলো তার একটির বাবা তোর ভাই আর অন্যটির বাবা বলে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি।সত্যি নাকি?
-অণু,কি সব বলিস এগুলো?
-কেনো!শুনলাম যে আমি।আমি কেনো,সবাই ই তো জেনে গেছে এটা।
-হ্যা ঠিকই শুনেছিস।কিন্তু রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এইসব কথা জিজ্ঞেস করে কেউ?আসেপাশে কত লোকজন হাঁটাচলা করছে দেখছিস না?
তনিমা খুশিও না আবার বিরক্ত ও না এরকম ভঙ্গিতে কথাটা বলল।অণু বললো তাহলে সেকেন্ড ক্লাসের পরে যে গ্যাপ আছে তখন বলবি কিন্তু।তনিমার কোনো উত্তর না পেয়েও অণু স্বস্তি পেলো।কারণ মৌনতা সম্মতির লক্ষন।যদিও মৌনতা সম্মতির লক্ষন এটা বিবাহের সময় কবুল বলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তবে অনেক ক্ষেত্রেই সেটা কাজে দেয়।
সেকেন্ড ক্লাসের পরেও তনিমার ভাবির গল্প শোনা হলো না।বায়োলজির শিক্ষক গত তিনদিন ক্লাস নিতে পারেন নাই।তাই আজ ক্লাসের গ্যাপে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে নিয়েছে।অণু ভিষণ বিরক্ত হচ্ছে এই স্যারের ক্লাসে।ক্লাসে সে অন্যদিন মনোযোগী থাকে কিন্তু আজ উশখুশ করছে।ক্লাসে বসে তার এই অস্থিরতা স্যারের চোখ একদমই এড়ালো না।
-অণু,তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?স্যার হটাৎ জিজ্ঞাসা করলো। ক্লাস নাইনে উঠে প্রথম প্রথম সাইন্সের ক্লাসগুলোতে অণুদের বেশ ঝামেলা হচ্ছে।এই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকগুলো ক্লাস নিতে তেমন পটু না।নিজেরা বুঝতে পারেন অথচ শিকার্থীদের বোঝাতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেন।অণুর বান্ধবী শর্মিলা রসায়ন ক্লাসের একটা যৌগ বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছিলো একদিন।স্যার সাথে সাথে বুঝে ফেললেন সাধারণ ছাত্রী এরকম প্রশ্ন করতে পারে না।স্যার জিজ্ঞাসা করলেন তোমার বাবা কি করেন,শর্মিলা জবাব দিলো ব্যাংকের ম্যানেজার।তার মা কি করে সে কথা জিজ্ঞেস করতেই আসল জিনিস বেড়িয়ে আসলো।শর্মিলার মা একটা কলেজে রসায়নের সহযোগী অধ্যাপিকা।রসায়নের যৌগের এই অধ্যায় শর্মিলাকে আগেই পড়িয়েছেন তার মা।এজন্য আগে থেকে সে পড়া টা পারে।কিন্তু স্যার ক্লাসে যৌগটা পড়াতে গিয়ে সেদিন গুলিয়ে ফেললেন।ক্লাসে অযথা প্রশ্ন করার কথা বলে শর্মিলাকে স্বল্প ধমকির সুরে বসিয়ে দিলেন সাথে সাথে।
-না,স্যার।মানে জ্বী স্যার আমার মাথা টা ঘুরছে।তনিমাকে নিয়ে আমি কমনরুমে যাবো,স্যার। অণু স্বর নরম করে স্যারেকে জবাব দিলো। বায়োলজির স্যার বললেন হ্যা হ্যা নিশ্চয়।তনিমাকে সঙ্গে দিয়ে তিনি অণুকে পাঠিয়ে দিলেন কমনরুমে।অণুর মাথা ঘুরার কথা যে মিথ্যা সেটা তনিমা জানে কিন্তু সে বেশি মাত্রায় ভদ্র হওয়ার কারণে কারো কোনো চাপিয়ে দেওয়া পরিস্থিতি উতরিয়ে আসতে পারে না।বাধ্য হয়েই আজকে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে আসতে হলো।কিছু কিছু মানুষ থাকে এরকম যারা কাছের মানুষের প্রতি এতই বাধ্য থাকে যে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মানুষ তাদেরকে বিষ খাওয়ার জন্য কয়েকবার অনুরোধ করলে বিষই খেয়ে ফেলবে।তনিমা সেরকমই একজন। অণু দুই তলা থেকে নামতে নামতে বললো,
-তনিমা আজকে বায়োলজির স্যার কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন যে আমার মাথা আসলে ঘুরছে না।আমি মিথ্যা কথা বলছি।তারপরও আমাদের বাইরে চলে আসার অনুমতি দিয়ে দিলেন।কেনো দিলেন বলতো তুই? তনিমা অণুর দিকে একটা সরল চাহনি দিলো কিন্তু মুখে কিছু বললো না।অণু মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে তুলে নিজেই উত্তর দিলো,
-গত মাসে শারীরিক শিক্ষার অনুপ স্যার আমাদের বয়ঃসন্ধিকালের অধ্যায় পড়িয়েছিলেন মনে আছে তোর?
তনিমা মাথা নেড়ে হু বললো।
-আমি সেইদিন ক্লাসের পরে হেড স্যারকে অভিযোগ করেছিলাম।অনুপ স্যার যে বয়ঃসন্ধিকালের অধ্যায় পড়াতে গিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি রকমের খোলামেলা কথা বলেছিলেন তাতে সব মেয়েই লজ্জা পেয়েছিল কিন্তু কেউ সাহস করে বলতে পারে নাই।আমাদের স্কুল টা গার্লস স্কুল,সবই ছাত্রী কোনো ছাত্র নেই।সেই জন্য অনুপ স্যার এই বেয়াদবি টা করেছিলেন।পরে হেড স্যার অনুপ স্যারকে ডেকে ঠিকমতো কথা শুনিয়ে দিলেন এবং বলে দিলেন আপনি ক্লাস নাইনের শারীরিক শিক্ষার ক্লাস নিতে আর যাবেন না।পরদিন থেকে অর্পিতা ম্যাম ওই ক্লাস নেবে।অনুপ স্যার মাথা নিচু করে হেড স্যারের অফিস থেকে বেড়িয়ে আসলেন।এই কথা স্যার ম্যামদের মধ্যে জানাজানি হওয়ার পর সব স্যারই আগের চেয়ে বেশি সতর্ক হয়ে গিয়েছে।এজন্য বায়োলজি স্যারও আজকে আমাদের বেশি না ঘাটিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন।
অণু নিজে নিজেই কথাগুলো বলে চলেছে।তনিমা তার কিছুই শুনছে না,সে উদাসীনভাবে রাস্তার উপর দিয়ে একটা বাবা তার মেয়ের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে সেই দিকে তাকিয়ে আছে।আর ভাবছে অনুপ স্যারের নামে অভিযোগ টা না করলেই বা সেদিন কি হতো!কারোর অপদস্ত হওয়ার দৃশ্য দেখলে তনিমার খুব কষ্ট হয়। অণু তনিমার হাতে ঝাকা দিয়ে বললো তোর ভাবির কথাটা বললি না কিন্তু!
-আজকে ভালো লাগছে না রে!বাড়িতে চলে যাবো। তনিমা উত্তর দিলো।
-তুই সারাক্ষণ একরকম রুগীদের মতো মনমরা হয়ে থাকিস কেনো!এরকম গুমড়া মুখে থাকলে কার মনের মধ্যে ভালো লাগে? তনিমা এবার উত্তর দিলো না।দুজনেই বাড়ির দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো।অণু এখন আর তনিমার ভাবির গল্প শোনানোর জন্য পিড়াপিড়ি করছে না।তনিমা নিজে থেকেই বললো,
-আমার ভাবি বিবাহের দুই মাস পরই গর্ভবতী হলেন।তার কিছুদিন পর পরীক্ষা করে দেখা গেলো বাচ্চা সুস্থ আছে।যমজ বাচ্চা।একটি ছেলে একটি মেয়ে।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো একটি জায়গায়।পরে বাচ্চার ডিএনএতে দেখা যাচ্ছে একটি বাচ্চার বাবা আমার ভাইয়া।কিন্তু অন্য বাচ্চাটির ডিএনএ’র সঙ্গে ভাইয়ার ডিএনএ মিলছে না।তিন বার টেস্ট করা হলো কিন্তু প্রতিবারই একই রিপোর্টে আসলো।
এবার আমাদের আত্নীয়দের মধ্যে একটা গুঞ্জন তৈরি হলো।তুই তো জানিস কিছু আত্নীয় থাকে যাদের কাজই হচ্ছে গুঞ্জনের অবতারণা করা,সেখানে মোক্ষম একটি ইস্যু পেলে তারা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন।আমার ভাইয়া এতে খুশি বা রাগ কিছুই প্রকাশ করলেন না।ভাবির সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেন।এই বিষয়ে আর কোনো কথাই বললেন না।
বাচ্চা ভূমিষ্ট হওয়ার কিছুদিন পর একদিন ভাইয়া কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন আমার ভাবিকে।ভাবি তখন কোনো লুকোছাপা না করে সোজাসুজি উত্তর দিলেন,
-তোমার সঙ্গে বিবাহের আগের সপ্তাহে আমি রেপ হয়েছিলাম।তার কারণে সম্ভবত আমি তখন কন্সিভ করি।কিন্ত ভয়ে কাউকে সেটা জানাতে পারি নি।তোমার সঙ্গে বিবাহের পর বাচ্চা আরেকটি কন্সিভ হয়। ভাইয়ার কাছে বিষয়টা একটু অদ্ভুত মনে হয় তখন।কিন্ত ভাবির সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে পরে যাচাই করার জন্য তাকে না জানিয়ে ভাইয়া একজন গাইনোলজিস্টের কাছে গেলেন। সবকিছু ভালোভাবে শোনার পর ডাক্তার যা বললেন তা শুনে তো ভাইয়া বেশখানিকটা অবাকই হলেন।
– শারীরিক সম্পর্কের ফলে পুরুষের সিমেনের কোটি কোটি ভ্রুণ থেকে একটি বা দুটি ভ্রুন মেয়ের জরায়ুতে টিকে থাকে।বাকিগুলো নষ্ট হয়ে যায়।কিন্তু আপনার স্ত্রীর বাচ্চা কন্সিভ করার ক্ষেত্রে খুবই কম সময়ের মধ্যে দুইজনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে।যার ফলে একটি বাচ্চা সেই ব্যক্তির ভ্রূণ থেকে জন্ম নিয়েছে অন্যটি আপনার সিমেনের ভ্রুণ থেকে।তবে আপনার ডিএনএ রিপোর্ট বলছে মেয়ে বাচ্চাটি আপনার,ছেলে বাচ্চাটি ওই ব্যক্তির। ভাইয়া তখন ডাক্তারের কথাবার্তা শুনে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন যেন সবকিছুই স্বাভাবিক।কিন্ত যখন বাসায় ফিরলেন তখন আমি তার দিকে তাকালাম।ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা মানুষের ভগ্নস্তূপ বা ধ্বংসাবশেষ।সম্পূর্ণ চেহারা মলিনতায় ছেয়ে গেছে।ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে ছেলে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলেন।কোলে নিয়ে ভাইয়া বাচ্চাটিকে আদর করতে করতে মনে মনে বললেন,
-আই এ্যাম নট ইউর ফাদার মাই বয় বাট উই আর আ ফ্যামিলি নাও। কথাটা মনে মনে আওরালেন,মুখে কোনো শব্দ করলেন না।ভাবির দিকে তাকিয়ে শুকনো মলিন একটি হাসি দিয়ে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেললেন। ঘটনাটা শোনার পর অণুর ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞাসা করতে:তোর ভাইয়া মনে মনে কি ভাবছিলেন তুই বুঝলি কি করে।কিন্তু দুজনের মনের অবস্থা পরিমাপ করে কথাটা জিজ্ঞেস করলো না শেষ পর্যন্ত।
-অণু,তুই ভাবছিস যে ভাইয়া মনে মনে কি বলেছিলেন আমার তো জানার কথা না,তাহলে কিভাবে বললাম।সেদিন জানালা দিয়ে আমি ভাইয়ার মুখটা দেখেছিলাম। তখন শুধু আমি কেনো যে কেউই সেই মুখ দেখলে বুঝতে পারতো যে ভাইয়ার মনের মধ্যে কি কথাবার্তা চলছে। আকাশে প্রচন্ড মেঘ করেছে।মেঘের দিকে তাকিয়ে অণু বললো, না।আমি সেসব ভাবছি না।আমি অন্য কথা ভাবছি।
-কি কথা? এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা চললো দুজনের মাঝে।কয়েক মিনিট পর অণু প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
-তনিমা,আমি ছেলে হলে তোকেই বিয়ে করতাম।
-এগুলো কিসব বলিস তুই সবসময়?
-হুম।সত্যি বলছি।তোর টানাটানা চোখ,চোখে মুখে স্থায়ী নিরবতা।এমনকি তোর চেহারায় একটা অতিশয় ভদ্র মেয়ের স্থায়ী ছাপ পড়ে গিয়েছে। শুনে তনিমা তার মলিন মুখে এক গাল হেসে দিলো।
অণু বললো আমাদের বাসায় চল আজকে।আম্মু অফিস থেকে আজ এতক্ষণে চলে এসেছেন।আম্মুকে বলবো সেদিনের মতো কালবাউশ মাছ শসা দিয়ে রান্না করতে।তুই সেদিনের রান্না প্রশংসা করেছিলি এজন্য আম্মু তোকে একই রান্না আবার খাওয়াবেন।তনিমা অমত করলো না।দুজনেই অণুদের বাসার দিকে রওনা করলো।রাণীগঞ্জের এই রাস্তায় একটি মানুষও দেখা যাচ্ছে না।পরক্ষণেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করলো।অণু বললো চল একটা দৌঁড় দেই। তনিমা দৌঁড় দিলো না।সেই জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।দুই মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিজে গেলো।ভিজে যাওয়ার পর তার মনের মেঘ এখন কিছুটা কেটে গেছে।
-এবার চল।
গল্পের বিষয়:
গল্প