নীল জোস্না

নীল জোস্না
ওই কাকা আপনার হাতটা বার বার মেয়েটার গায়ে লাগে ক্যান?? সইরা বহেন”, কথাটি কানে যেতেই চমকে উঠে তাকালাম মানুষটার দিকে, একটা তেইশ চব্বিশ বছরের একটা ছেলে আমার সামনের সিটে বসা মধ্যবয়সী একটা লোককে উদ্দেশ্য করে কথাটি বললো, কাকার বয়সী মানুষটার পাশে বসে আছে একটা মেয়ে, মনে হলো গার্মেন্টস এর কোন মেয়ে। মেয়েটাকে সাধারন মনে করেই সুযোগ এর সদ্ব্যবহার করছিলেন কাকার বয়সী লোকটা, হয়তো হাত দিয়ে মেয়েটার শরীর স্পর্শ করছিলেন, সেটা মনে হয় দেখে ফেলে সেই ছেলেটি।
লোকটা যুবকটির কথায় প্রথম চমকে গেলেও পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে উল্টা জোড় গলায় বললেন “ওই বেটা তুই দেখছোস আমি কি করছি?? আমার নামে অপবাদ কেন দেছ,” ঠাস করে একটা চর বসিয়ে দিলো লোকটার গালে ছেলেটা, একটা গালি দিয়েই বললো “আমি দেহিনাই তুই কি করছোচ?? “নাম গাড়ি থেকে, মেয়ে দেখলে হুশ থাকেনা,আবার নিজেরে নির্দোষ প্রমান করিস” লোকটা চর খেয়ে কিছুক্ষন থ হয়ে গেলো,এরপর কারো দিকে না তাকিয়ে গাড়ির দরজায় এসে লাফ দিয়ে আসাদ গেটের আগেই নেমে পড়লো, গাড়ির লোকজন কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই লোকটি নেমে চলে গেলো। খেয়াল করলাম ছেলেটা মেয়েটাকে বলছে “বইন আপনে কিছু মনে কইরেন না এমন জানোয়ার থাকেই দুই একটা” এরপর আসাদ গেটে গাড়িটা থামলে পাশের যাত্রিটা নেমে গেলে পাশেই এসে বসলো ছেলেটি। রেজা ভাইয়ের সাথে ওই ছিলো প্রথম পরিচয় আমার।
চেহারাটা ভাঙা আর উচু নাকের মানুষটির সাথে এরপর গাড় বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমার। ঠিক বলা যায় বড় ভাই ছোট ভাই বন্ধুত্ব রেজা ভাই ঢাকা কলেজ এ পড়তেন, থার্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়তে পারছিলেন এরপর পড়াশুনা টা আর চালিয়ে যেতে পারেন নি, জীবন যুদ্বে জরিয়ে পড়েন। সংসারে এক মা ছারা কেউ নেই। রেজা ভাইয়ের বাবা বিহারী, মা বাংলাদেশী। বাবা তার মাকে ছেরে দেওয়ায় মাকে নিয়েই তার জীবন। একটা বোন ছিলো কিন্তু স্বামীর ঘর করতে গিয়ে যৌতুকের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে মৃত্যুকেই গ্রহন করে মেয়েটি। আস্তে আস্তে বুঝলাম রেজা ভাইয়ের আয়টা ছিলো মূলত সন্ত্রাসী নির্ভর মোহম্মদপুর ক্যাম্পের বাজারে বিহারী ক্যাম্পের পাশেই ওনাদের বাসা, সন্ত্রাসী বলতে ওই এলাকার বিহারীদের ট্যাকেল দিতে রাজনৈতিক নেতাদের হয়ে কাজ করতেন, এর জন্য কিছু পারিশ্রমিক ও পেতেন।
তার একটা গ্যাং তৈরী হয়েছিলো ক্যাম্পের বাজারে,রেজা ভাইয়ের সাথে প্রায়ই আড্ডা দেওয়া হতো ক্যাম্পের বাজারের সামনে। আমাকে ছোট ভাই হিসাবে প্রায়ই তার বাসায় নিয়ে যেতেন। দেখতাম একটা রুমে তার মা থাকেন আর অন্য রুমে উনি, সন্ত্রাস এর সাথে কারবার আর কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা রেজা ভাইকে ওই এলাকার সবাই খারাপ ভাবলেও আমি ভাবতে পারতাম না। ম্যাক্সিমাম মাদক ব্যাবসায়ীরা আর বাজে লোকেরা ক্যাম্পের বাজারে মেয়েদের নিয়ে কারবার করতো, রেজা ভাই এর সাথে কেউ না চললে কোনদিন বুঝবেনা এই মানুষটা মেয়েদের নিয়ে কারবার করা তো দুরে থাক মেয়েদের দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতেন না নামাজের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো চোখে পড়ার মত, আজান হলেই সব কাজ ফেলে মসজিদের দিকে চলে যেতেন, আমি প্রায়ই বলতাম ভাই আপনি মানুষটা যেমন তার সাথে এগুলো তো যায় না, আপনি নামাজ আর এই মেয়েদের এত গুরুত্ব দেন কেন??
রেজা ভাইয়ের উত্তর ছিলো “দেখ মুসা নামাজ হলো আল্লাহর কাছে পৌছানোর সবথেকে ভালো উপায়, আমি যতই খারাপ হইনা কেন নামাজ কে ছেরে দিলে আমি আমার রবকে ছেরে দেওয়া হয়ে যাবে যেটা আমার অস্তিত্যই হারিয়ে যাবে। আর মেয়েরা হলো আমাদের মত পুরুষদের কাছে আমানত ওদের প্রতি ভালো ব্যাবহার না করলে তাইলে এত নামাজ রোজা কইরাও আমি ভালো মানুষ হতে পারলাম না, ওদের মারা অত্যচার করা ওদের অধিকার আর মর্যাদা না দেওয়াটা খুব সহজ কিন্তু এগুলো করে যতই নামাজ রোজা করি না কেন আমি ভোগাস। কারন উত্তম তো ওই ব্যাক্তি যে তার পরিবার এর কাছে উত্তম” হতভম্ব হয়ে পড়ছিলাম একজন সন্ত্রাসীর মুখে এমন কথা শুনে। জীবনের কত বড় বাস্তবতা এক কথায় আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যা হয়তো আজকাল খুব কম মুসলিমই বুঝবে। রেজা ভাইকে সেদিন নতুন করে উপলব্দী করলাম।
এপ্রিলের কোন এক সন্ধায় রেজা ভাইয়ের মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তার মায়ের শিয়রে বসে কথা দেন সব ধরনের খারাপ কাজ মাদকের আনা নেওয়া সব ছেরে দিবেন। তার মা সেবারের মত সুস্থ হলে তাকে নীলফামারীতে তার দুর সম্পর্কের একজন খালার বাসায় রেখে পাড়ি জমান দেশের বাইরে জীবিকার উদ্দেশ্য। তুরস্ক হয়ে অবৈধ পথে ভূমাধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করেন ইউরোপের ঝাকজমক দেশ ইতালীতে। ওখানে কিছুদিন থেকে এক বন্ধুর সহায়তায় চলে আসেন জার্মানির ফিলিপসবার্গে, রাইন নদীর তীরে একটা সুন্দর শহর ফিলিপসবার্গ, খুব কষ্ট করে ওখানকার একটা রেষ্টুরেন্টে চাকরী নেন ওয়েটার হিসাবে। মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন মায়ের কাছে। ভালোই চলছিলো জীবনের এই দিনগুলো, হঠাৎ একদিন একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয় রেজা ভাইয়ের, ওই রেস্টুরেন্ট এ প্রায়ই আসতো মেয়েটি। নাম ছিলো ক্যাথরিন, আমেরিকান বাবা আর জার্মান মায়ের একমাত্র সন্তান ক্যাথেরিন, ক্যাথরিনের মাকে ডিভোর্স দিয়ে আবার আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন ক্যাথরীনের বাবা।
মেয়েটি রেজা ভাইয়ের রেষ্টুরেন্টে প্রায়ই আসতো মদ খেয়ে বারে শুয়ে থাকতো একদিন রেষ্টুরেন্ট বন্ধ হলে ক্যাথরিনকে পড়ে থাকতে দেখে নিজের বাসায় নিয়ে যান রেজা ভাই। সকালে উঠে অপরিচীত একজন মানুষকে নামাজ পড়তে দেখে মেয়েটি চিৎকার করে উঠলে রেজা ভাই বলেন ভয় পাবেন না আমি আপনাকে কাল রাতে নিয়ে এসেছি রেষ্টুরেন্ট থেকে। আপনার কোন ক্ষতি আমি কারিনি আর করবোও না। মেয়েটা হতভন্ব হয়ে পড়ে, একটা বাসায় একা পেয়েও কোন তরুনীকে কোন ছেলে কিছুই করেনি এটা ভেবে। ইউরোপিয়ান পুরুষদের চোখ কি চায় আর তাদের কামনা ভালই বুঝতে পারে সে। কিন্তু উচু নাক আর মায়বী চোখের রেজা ভাইকে দেখে সে বুঝতে পারে এ আর আট দশটা মানুষের মত না। এরপর প্রায়ই রেজা ভাইয়ের সাথে দেখা করতো মেয়েটি।
হয়তো মানুষটির বৈশিষ্ট আর চারিত্রিক গুনাবলি মেয়েটাকে দুর্বল করে ফেলে, প্রচন্ড রকম ভালোবেসে ফেলে মানুষটিকে ক্যাথরিন। রেজা ভাইকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে রেজা ভাই জানান উনি মুসলমান, আর মুসলমান হয়ে উনি ক্যাথরিনকে বিয়ে করতে পারেন না। এরপর সেপ্টেম্বর এর কোন এক সকালে ক্যাথরিন মুসলিম হয়ে গেলে রেজা ভাই তার নাম রাখেন আয়েশা, দুইদিনের মাথায় রেজা ভাইয়ের সাথে ক্যাথরিনের বিয়ে হয়ে যায়। রেজা ভাইয়ের সাথে আবারো দেখা হয় তিনবছর পর সেই ক্যাম্পের বাজারে। পড়াশুনার সুবাদে ওখানেই থাকতাম তখন। একটা চায়ের দোকানে সিগারেট হাতে চিরচেনা রেজা ভাইকে দেখে দৌড়ে গেলাম, রেজা ভাই যে জার্মান প্রবাসী এটা জানতাম, কথায় কথায় সব খুলে বলেন তিনি।
একটা বাচ্চাও আছে তার। নাম রাখছেন আব্দুল্লাহ। বেশ ভালো টাকা কামান, বছরের শেষ দিকে দেশে এসে এক মাস মায়ের সাথে থাকেন। তার মাকে নিয়ে যেতে চান কিন্তু তার মা যেতে চান না।তার মায়ের ধারনা তিনি যে কোন সময়ই মারা যেতে পারেন। উনি চান না অন্য কোন দেশে মারা যান। এই জন্য তাকে দেখতেই প্রতি বছর ১ মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। রেজা ভাইকে ক্যাথরিন ভাবি খুব ভালোবাসতো তা বুঝছিলাম, রেজা ভাই প্রায়ই বলতেন আমি যখন এক মাস পর আবার জার্মানিতে ফিরে যাবো ও ওই দিন রাইন নদীর তীরে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমি জাহাজ থেকে নামলেই ও ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি চুপচাপ শুনতাম তার গল্প, এরপর কিছুদিনের মধ্যেই চলে যান আবার জার্মানীতে। তিনমাসের মাথায় আবার যোগাযোগ করেন । আমাকে বললেন “মুসা আমার জন্য দুয়া করিস রে ভাই, আমি মনে হয় বেশি দিন বাচবোনা”।
কথায় কথায় জানতে পারলাম কোলন ক্যানসার আক্রান্ত উনি, শেষ ধাপে আছেন। এরপরের ঘটনা গুলো যেন ছায়ছবীর মতই ঘটতে থাকে, রেজা ভাইকে নিয়ে জার্মানির বড় বড় হসপিটালে গিয়েছিলেন ক্যাথরিন ভাবি। কিন্তু শেষ আশা কেউ দিতে পারেনি। খুব অমায়িক আর অসাধারন ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষটিকে আমি খুব পছন্দ করতাম। রাতের অন্ধকারে জায়নামাজে দাড়িয়ে একদিন কেদেও ছিলাম ভাইয়ের জন্য। কিন্তু নিয়তি আমাদের কথা কখনই শুনেনা। সে চলে তার আপন নিয়মে। রেজা ভাই ক্যান্সারে আক্রান্ত এটা শুনে তার মা স্টোক করে মারা যান আমি প্রায়ই ক্যাম্পের বাজারে যাই, এক দৃষ্টিতে সেই টং এর দোকানটা দেখি, কল্পনায় ভেসে উঠে এক অসাধারন ব্যাক্তিত্ব নিয়ে দারিয়ে থাকা রেজা ভাইকে, এক কাপ চা নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। যিনি নামাজের সময় হলেই চুপচাপ সব কিছু ফেলে মসজিদে চলে যেতেন।
পরিশিষ্ট :- ২০১৭ সালের নভেম্বরের কোন এক শীতের রাতে রেজা ভাই মারা যান। তাকে কবর দেওয়া হয় রাইন নদীর তীরে ক্যাথরীনদের বাড়ির পাশে পাহাড়ের কোল ঘেষা এক বাগানে।
তার ফলকের সামনে লেখা রয়েছে “এখানে ঘুমিয়ে আছে কোমল হৃদয়ের এক বাঙালী যুবক, তাকে শান্ততে ঘুমাতে দাও কেউ তাকে বিরক্ত করোনা” আয়েশা ভাবি এখনো সেই রাইন নদীর তীরে বসে থাকেন ছেলে আব্দুল্লাহকে নিয়ে, প্রতি ডিসম্বর আসলে ওখানে যান, সন্ধা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বসে থাকেন, হয়তো আশা নিয়ে থাকেন কোন এক সন্ধায় রেজা ভাই আবার জাহাজ থেকে নামবেন, আয়েশা ভাবি হয়তো বলবেন “কি গো কেমন আছোগো তুমি,” রেজা ভাই হয়তো বলবেন “আমি খুব ভালো আছি আয়েশা, দেখো আকাশের জোস্নটা কত সুন্দর,” আয়েশা ভাবিও বলবেন “হ্য তাইতো খুব সুন্দর এতক্ষন তো চোখে পড়েনি”, কিন্তু তেমনটা আর হয় না এরকম কোনদিন ই আর হবে না,
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত