একদা এই দেশে ল্যান্ড টেলিফোন নামে এক মহার্ঘ বস্তু ছিল। এই বস্তুকে স্ট্যাটাস সিম্বল বলে গণ্য করা হতো। বড় লোকদের বাড়ি আর অফিসে শোভা পেত। এই বস্তু জোগাড় করার জন্যে তখন কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হতো।
দেশে এখনও অবশ্য ল্যান্ড ফোন আছে, তবে আগের মতো কদর নেই; কারণ মোবাইল ফোন নামে একটা বস্তু এখন লোকে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পানের দোকানদার থেকে শুরু করে দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে সহজে বহনযোগ্য ওই বস্তুটি আছে।
আমাদের এই গল্প এক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলকে নিয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যাদের পরিচয় বাস্তবে তাদের দেখা হয়নি। এখানে একটা প্রেমের কাহিনী আছে- ওই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির মধ্যে প্রেম হয় ল্যান্ড ফোনে।
গল্প কথক ছেলেটার নাম দেই এ, মেয়েটার বি। একদিন এ এবং বি কথা বলতে বলতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ওঠে; কিন্তু ওই বিরক্তির কথা কেউ প্রকাশ করে না। তখন বোরডোম কাটাতে এ বি-কে বলে এসো একটা গল্প শোনাই তোমাকে। গল্পটার নাম দিতে পারি- মোবাইল ফোনে ল্যান্ড ফোনের গল্প। গল্পের পটভূমি আশির দশকের ঢাকা। রং নাম্বার থেকে আসা কল ছিল ওটা। ল্যান্ড ফোনে রং নাম্বার ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
গল্পের প্রটাগোনিস্ট একরাম আলি নেত্রকোনার খালিয়ামুড়ি থেকে ঢাকা আসে ভাগ্যান্বেষণে ও পড়াশোনা করতে। টাকা-পয়সা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অতঃপর একটা দুটো টিউশনি করে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালায়। কখনো ফুটপাতে, কখনো কমলাপুর রেলস্টেশনে রাত কাটায়। বড় লোকের বখে যাওয়া কিছু ছেলে ছোকরার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটে।
এদের মধ্যে আবদুল কুদ্দুস হাওলাদার নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিল। অফিসের কাজে তাকে একবার চট্টগ্রাম যেতে হয় বলে থাকবার লোকের অভাবে একরাম আলিকে তার অফিসে রেখে যায় দিন সাতেকের জন্যে। ফলে একরামের হাতে যেন গোটা একটা সাম্রাজ্য চলে আসে। মানুষ হিসেবে একরাম আলির কিছু চাহিদা ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় চাহিদা কিছু খাদ্য ও মাথা গুঁজবার মতো একটা ঠাঁই। একরাম আলির তৃতীয় ও শেষ চাহিদা তার মনের। গুনগুন করে গান, উর্দু গজল আওরানো কিংবা মনের মতো একটা গ্রন্থ পাঠ। এটাকে সে অবশ্য বিলাসিতা বলে গণ্য করে। কোনো একটা বিলাসিতা ছাড়া নাকি মানব সন্তান জীবনধারণ করতে পারে না। বড় এক লেখকের ভাষায়: ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্যে যেমন ডাল-ভাত, আশ্রয়ের জন্যে যেমন ঝুপড়ি, অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে তেমনি প্রয়োজন ন্যূনতম একটি বিলাসিতা। অনেকে কুকুর-বিড়াল কিংবা পাখি পোষে, গান-বাজনা করে কেউ কেউ। একেক জনের বিলাসিতা একেক রকম। বই কেনার মতো পয়সা একরামের হাতে কদাচিৎ থাকে; কিন্তু তাতে কী নীলক্ষেতের ফুটপাত তো আছে! হাত সাফাই করে গাপ করলেই হলো, টাকা-পয়সার প্রয়োজন পড়ে তা।
দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা সে মতিঝিলের ওই অফিসের অধিশ্বর হয়ে বসে থাকে আর একটা বই ক্রমাগত পড়তে থাকে। এর মধ্যেই বার দশেক পড়েছে। ক্লাসিক ফ্লাসিক কিছু নয়, নিতান্ত সাধারণ একটা বই- আলবের্তো মোরাভিয়ার রোমান টেলস। শপকিপার, ট্রাক ড্রাইভার্স, ওয়েট্রেসেস, টেডসম্যান, স্পাইজ অ্যান্ড প্রোসটিটিউটস নিয়ে সব গল্প। একেক গল্পের একেক মজা। একটা পড়ে হাসতে গিয়েও প্রায়ই চোখের জল ফেলেছিল একরাম: একটা পরিবারে অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা দেখে ইনফ্যান্ট ওয়েলফেয়ার সোসাইটির এক মহিলাকর্মী পরিবারের কত্রীকে বললেন, এতো ছেলেপুলে কেন আপনাদের?
কত্রী সত্যি কথাটাই বললেন, আমোদ প্রমোদের আর কী-ই বা আছে আমাদের বলুন, টাকা-পয়সা থাকলে রাতের শোতে সিনেমায় যাওয়া যেত। তা যখন নেই, আমরা বিছানায় চলে যাই আর ওরা পয়দা হয়। শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন বাচ্চা হলে ফেলে দেবেন। কথা মতো ওই দম্পতি তাদের হওয়া সর্বশেষ বাচ্চাটা একটা তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে জনাকীর্ণ স্থান, মার্কেট প্লেস কিংবা গির্জার কাছে রেখে আসতে চাইলেন, কিন্তু শত চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পারলেন না।
একরামের একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। রিসিভার তুলে গতানুগতিক কণ্ঠস্বরে সে উচ্চারণ করল, হ্যালো টু থ্রি ওয়ান নাইন টু টু, …। অপর প্রান্ত থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর বলল, সরি রং নাম্বার। বিরক্ত হয়ে একরাম বই পড়ায় মন দিল। কাজকর্ম কিছু না করলেও একরাম শান্ত স্বভাবের মানুষ। দেখতে সে সুপুরুষ। মাথায় ঝাকড়া লম্বা চুল, উচ্চতা প্রায় ছ ফুট, হালকা পাতলা গড়ন, শ্যামলা রং। চুপচাপ থাকতে ভালোবাসে। জীবনে তার কোনো দুঃখ নেই। তবে বেদনা আছে- কোনো মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসা হলো না আজ অবধি। বন্ধুদের সবসময় বলে বেড়ায়- যদি কোনো মেয়ের ভালোবাসা পাই তাহলে জীবনটা একেবারে পাল্টে ফেলব। বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলেছে, তবু তুমি কোনো কাজকর্ম করে খাবে না, তাই না? দীর্ঘশ্বাস ছেলে একরাম বলেছে, আমি নিজেই তখন কাজ হয়ে দাঁড়াব। বন্ধুরা তখন বলেছে, আহা হা তাহলে দুগ্গা বলে ঝুলে পড়ছ না কেন?
একরাম বলেছে, সেটি হচ্ছে না বাপু, পুরুষ মানুষ, আগ বাড়িয়ে প্রেম নিবেদন করতে যাব কোন দুঃখে?
তখন দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছিল আর ক্রিং ক্রিং বেজে উঠেছিল ফোনটা। একরাম যথারীতি ফোন ধরে তোতা পাখির মতো বলে উঠল, হ্যালো টু থ্রি ওয়ান নাইন টু টু, কার সঙ্গে কথা বলতে চান? জবাবে নারী কণ্ঠ বলল, আপনি কে বলছেন?
একরাম খুবই বিরক্ত হলো, কিন্তু নিজের নাম বলতে দ্বিধা করল না। জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা বলতে চান। উত্তর এলো আপনার সঙ্গেই। বিব্রত একরাম বলল, স্ট্রেঞ্জ! আমার সঙ্গে?
জি হ্যাঁ, আপত্তি আছে নাকি আপনার? কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর একরাম বলল, না তা নেই। বলুন কী বলতে চান।
আপনিই বলুন না। একথা শুনে রাগ হলো তার। ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই রিসিভারটা রেখে দেয়। কিন্তু অজানা এক আকর্ষণে কথা চালিয়ে গেল। বলল, আমি আর কী বলব? নাম তো বলেছিই। ঠিকানা? কদিন আগেও ফুটপাতে ছিলাম, এখন মতিঝিলের একটা অফিসে থাকি। রাতে টেবিলে ঘুমাই।
অপর প্রান্ত থেকে ঝনঝন করে উচ্চহাস্য ভেসে এলো। ফুটপাতে কি মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতেন? বেশ, একটা কথা শুনে রাখুন, আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনে। ফুটপাতে ঘুমানোর ব্যাপারটা একশ ভাগ সত্যি। এখানে কোনো কাজকর্ম না থাকায় আলস্য প্রিয় হয়ে উঠেছি।
আবারও হাসির শব্দ। তারপর কণ্ঠস্বর জানতে চাইল, সেটা কী রকম?না, শুয়ে-শুয়ে একটা বই-ই বারবার পড়ছি। হাতে পড়ার মতো অন্য কোনো বই নেই। কম করে হলেও দশবার পড়েছি। কী বই? মহাভারত টারত নাকি?আরে নানা একটা গল্পের বই।
তা জনাবের কী করা হয়?
ভবঘুরে। ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াই, খিদে লাগলে খাই, রাত হলে ঘুমিয়ে পড়ি।
তারপর একটা সিরিয়াস প্রশ্ন আসে- জীবন আপনার কেমন লাগে?
একরাম আলি ভাবনায় পড়ে যায় জীবন কেমন লাগে ভেবে দেখেনি সে! গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসে। তার ডান কানে ধরা রিসিভার থেকে মেয়েটার শ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদু শব্দ ভেসে আসে।
কী হলো কথা বলছেন না যে?
দাঁড়ান একটু ভাবতে দিন। কিছুক্ষণ পরে আবার তাড়া-কী ভেবেন ভেবে পেলেন কিছু?
জীবনটা তো ভালোই লাগে।
ফুটপাতে ঘুমিয়েও? মেয়েটা খিল-খিল করে হেসে ওঠে। একরাম বলল, আপনার হাসিটা ভারি মিষ্টি তো! টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ছোট্ট একটি শব্দ ভেসে এলো ধন্যবাদ। তারপর একটুখানি খড়খড় শব্দের পর লাইন কেটে গেল।
পরদিন সকালে আবার ফোন এলো। একরাম তখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। ফোন তুলে হ্যালো বলতেই মেয়েটি বলল, এখনও ঘুমুচ্ছেন নাকি?
কী আর করব, কাজকর্ম নেই।
কাল আমার হাসির এতো প্রশংসা করছিলেন কেন?
সুন্দর হাসলে প্রশংসা করব না? আমি কৃপণ নই। না করবেন না। কেন? আমার ওপর কিন্তু শর্ত আরোপ করছেন আপনি। শর্তটর্ত আমি বরদাস্ত করি না মিস।
তাহলে আমিও ফোন রেখে দেব।
সে আপনার ইচ্ছে।
আমার অসন্তুষ্টিতে কিছু যায় আসে না আপনার?
তা ঠিক জানিনে। তবে নিজেকে অসুখী করতে পারিনে, চাই-ও না।
মেয়েটি বলল, কৌতূক করতে কিন্তু ভালোবাসেন আপনি। তা আপনার কোনো হবিটবি আছে নাকি?
তেমন একটা কিছু নেই। একসময় ফটোগ্রাফির শখ ছিল।
আপনার ক্যামেরা নিশ্চয়-ই খুব দামি?
আমার ক্যামেরাই নেই। হা হা হা। তবে একটা চয়েস করে রেখেছি। হাতে টাকা এলে কিনে ফেলব।
কোন ব্র্যান্ড?
আশাহি পিনট্যাক্স। আমার খুব প্রিয়।
মেয়েটি বলল, আপনি কিন্তু এখনও আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি।
দরকার আছে বলে মনে করিনি।
কেন বলুন তো?
একরাম বলল, না আমার নাম্বার তো আপনার কাছে আছেই। অবশ্য আপনি চাইলে আমিও রিং করতে পারি। নাম আর নাম্বার বলুন।
বলব না।
ক্ষতি নেই।
আপনি তো দেখছি সাংঘাতিক অহংকারী লোক।
কেন কেন?
ততক্ষণে মেয়েটা লাইন কেটে দিয়েছে। একরাম আপন মনে একটুখানি হাসল তারপর রিসিভার রেখে দিল।
একটু পরেই ফোন বেজে উঠল। একরাম ধরতেই মেয়েটা বলল, নাশতা করতে বসে মনে হলো আপনার ওপর রাগ করা আমার উচিত হয়নি।
শুনে খুব খুশি হলাম।
ভালো কথা আপনি নাস্তা করেছেন তো?
তা আর হলো কই, …
না না আমি রাখছি, আপনি নাশতা করে আসুন।
পকেটে পয়সা নেই। আজ হয়তো নাশতা করা হবে না।
কী যে বলেন না, শুনলে কষ্ট হয়।
দেখুন এসব আমার গা সওয়া হয়ে গেছে।
একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না তো? কিছু টাকা পাঠিয়ে দেই আপনাকে?
বেশ দিন, ঋণ দাতাদের তালিকায় আপনার নামটাও না হয় যুক্ত হবে।
মেয়েটা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, না পাঠাব না।
আপনার ইচ্ছে …
একরাম হাসতে হাসতে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।
তারপর সারাদিন সে মেয়েটার কথা খুব ভাবল। কথাবার্তা শুনে মনে হয় চটপটে, শিক্ষিত আর রোমান্টিক মনের অধিকারী। সে টেবিলে সটান শুনে পড়ে আর ঘুমানোর চেষ্টা করে। তখনই ফোন বেজে ওঠে।
আজ বেশ কবার ফোন করেছি। কোথায় ছিলেন বলুন তো?
বেকার হলেও কাজ থাকে মাঝে মধ্যে।
কী কাজ?
টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর কাজ। হা হা হা।
কী করছিলেন?
আপনার কথা ভাবছিলাম আর আপনার একটা ছবি আঁকতে চেষ্টা করছিলাম মনে মনে।
পেলেন ছবিটা?
একরাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নাহ।
ভুলেও ওই চেষ্টা করবেন না জনাব, দেখতে কিন্তু ভারি বিশ্রী আমি।
মাফ করবেন বিশ্রী হলে দয়া করে লাইনটা কেটে দিন।
কুৎসিত চেহারা আমি সহ্য করতে পারি না।
এই কথা? তাহলে আমি সুন্দরী। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
তারপর এক প্রান্ত নীরবতা। একরাম বলল, কী ভাবছেন?
না কিছু না?
তারপর গুনগুনিয়ে গান ভেসে এলো। রবীন্দ্রনাথের-
মনে রবে কিনা রবে আমারে, …
প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে একরাম বলল, বাহ্ কী চমৎকার! তারপর ছোট্ট একটা শব্দ- ধন্যবাদ।
সারাদিন মেয়েটার গানের রেশ থেকে গেল। সকাল, দুপুর গেল, বিকেল এলো, তারপর রাত নামল, একরামের কণ্ঠে একই সুরের অনুরণন- মনে রবে কিনা রবে আমারে, …
মেয়েটার ফোনের অপেক্ষায় একরামের পাগল হওয়ার দশা। প্রত্যাশিত ফোনটা এলো রাত দশটা নাগাদ। গল্পের বইটা পড়তে পড়তে সে তখন ঝালাপালা।
ফোন ধরে চিৎকার করে বলল, সারাদিন ছিলে কোন চুলোয়? প্রতীক্ষা আমি সইতে পারি না। একেবারেই না। ফোন করতে হলে একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে নাও।
আজকের মতো ক্ষমা কর। রোজ সন্ধ্যে সাতটায় ফোন করব। মাথার দিব্যি। গান শুনবে?সে গালিবের একটা গজল ধরল। গানের রেশ শেষ হতে না হতে দুজনে কথার জাল বুনল। কথা যেন শেষই হতে চায় না।
মেয়েটা অভিমানের স্বরে বলল, তুমি আমার নাম জিজ্ঞেস কর না কেন?
তোমার কণ্ঠস্বরই তোমার নাম।
একরাম কখনো কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছো?
এককথায় এর উত্তর দেওয়া যাবে না। আমার জীবন কাহিনি তোমাকে বলতে হবে।
কোনো উত্তর না পেলে কিন্তু কষ্ট পাব।
তখনই চট্টগ্রাম থেকে বন্ধুর ফিরে আসার সময় হলো।
মেয়েটি একদিন বলল, তোমার বা তোমার পরিচিত কারও ফোন নেই?
আছে কিন্তু দেব না। আমি চাই না তোমার কণ্ঠস্বর আর কেউ শুনে ফেলুক।
এতো ভারি বিপদের কথা। যেদিন তোমার সাম্রাজ্য শেষ হবে আমি আমার ফোন নাম্বার তোমাকে দেব। ঠিক আছে?
একরামের মনের কোণে তখন শুধু মেয়েটার ছবি। পরের দিন ফোনটা ধরেই সে বলল, তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
ঠিকানা দিচ্ছি, আজই চলে এসো।
আজ তো পারব না। ভালো কাপড় চোপড় পরে তোমাকে দেখতে যাব। এক বন্ধুর কাছে স্যুট ধার চেয়েছি।
তুমি না একরাম বড্ড ছেলে মানুষ।
পরের দিন ঘর থেকে বেরুল না একরাম। দুপুরের দিকে তার জ্বর এলো। মারাত্মক জ্বর। সারা শরীর একেবারে পুড়ে যাচ্ছিল। তেষ্টাও পেয়েছিল খুব। উঠে যে পানি খাবে সেই শক্তিও ছিল না শরীরে। সন্ধ্যার দিকে তার বুক ভারি হয়ে এলো। নিশ্বাসের কষ্ট শুরু হলো একটু পর। উঠে বসার শক্তি হারাল সে। কল্পনায় শুধু সেই মেয়েটি।
সন্ধ্যার দিকে তার অবস্থা খারাপের দিকে চলে গেল। কানে এক ধরনের ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছিল। চোখে ঝাঁপসা দেখছিল। তখনই ফোনটা বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং করে। কোনো মতে রিসিভারটা তুলল একরাম। কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু হ্যালো শব্দটা বলতে পারল। ওপাশ থেকে মেয়েটি বলল, কী হলো তোমার একরাম, কথা বল।
একরাম কোনো মতে বলল, আমার বাদশাহি শেষ। তারপর ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত। মেয়েটা চিৎকার করে বলল, আমার ফোন নাম্বার টুকে নাও- থ্রি ওয়ান টু টু ফাইভ। কী শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? মাথা ঘুরে টেলিফোন সেটের ওপর পড়ে গেল একরাম, আবারও মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত।
এই মর্মান্তিক ঘটনার বয়ান শেষ হলে বি এ-কে বলল, আমাদের জীবনে যাতে এরকম কোনো ঘটনা না ঘটে সেজন্যে বলছি, এখনই আমার বাসার ঠিকানা লিখে নাও- ১০১১২, গুলশান অ্যাভিনিউ, গুলশান-১, ঢাকা। তোমার ঠিকানাটা দাও।
এ বলল, কেয়ার অব মুন্সী আবুল হোসেন, ৫/এ-১২, মনেশ্বর লেন, আজিমপুর, ঢাকা। আবুল হোসেন আমাদের বাড়িওয়ালার নাম।
বি বলল, আর শোন, এই এতো দিনেও আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হলো না। আমার আর অপেক্ষা ভালো লাগছে না। কালই আমরা দেখা করব। বনানীতে নতুন একটা রেস্তোরাঁ হয়েছে- এসো নীপবনে। আতার্তুক অ্যাভিনিউ থেকে একটু এগিয়ে বামে। একটা টেবিল বুক করে রাখব।এ বলল, কাল নয় লক্ষ্মীটি, দিন তিনেক পরে কর। আমার কিছু জরুরি কাজ আছে।
ঠিক আছে, তা-ই হবে।
গুলশানের ঠিকানা দেখে এ-র সব কাজ মাথায় উঠল। ঠিকানা যাচাই করতে পরের দিন সকালে গুলশান গেল সে। বি-দের বাড়িটা বিশাল। গেটে উর্দি পরা দারোয়ান। নামধাম সব মিলে গেল। আর আপামণি? তার নাম মুশফিকা সুলতানা। সকাল তখন ১১টা, ঘুম থেকেই ওঠেনি।
বারোটায় ঘুম থেকে উঠল, নাশতা করল, ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে বেরুল মনেশ্বর রোডের খোঁজে। পিলখানা অবধি ভালোভাবেই এলো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকল দুর্গন্ধে ভরা এদো একটা গলিতে। ঠিকানাটা খুঁজে পেল। একটা মেস বাড়ি। এর তিন বাসিন্দার একজন হচ্ছে বি। তার নাম আবদুল জলিল মৃধা- ইসলামপুরের একটা কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। বেতন যা পায় তা বাড়িতে বাবা-মাকে পাঠিয়ে নিজে চলতে পারে না বলে সন্ধ্যায় একটা টিউশনি করে আজিমপুর কলোনিতে।
মুশফিকা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। কী করবে ভেবে পেল না। দুপুরের খাবার না খেয়েই সে ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেলের দিকে হাত-মুখ ধুয়ে এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীকে ফোন করল। আদ্যপান্ত সবকিছু তাকে জানিয়ে বলল, একটা কাপড়ের দোকানের কর্মচারী অথচ কথাবার্তায় একটুও আঁচ করা যায়নি। কী দারুণ স্মার্টলি কথা বলত আমার সঙ্গে।
বান্ধবী বলল, বড্ড বাচা বেঁচে গেছিস। মন থেকে সব ঝেটিয়ে বিদেয় করে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যা। মুশফিকা বনানীর রেস্তোরাঁয় ফোন করে বুকিং ক্যান্সেল করতে ভুলে যাওয়ায় নির্দিষ্ট দিন রেস্তোরাঁ ম্যানেজার প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলকে স্বাগত জানানোর জন্যে বুক করা টেবিলে এক গুচ্ছ শ্বেতশুভ্র গোলাপ সাজিয়ে রাখল। গোলাপগুলো ওই যুগলের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে একটুখানি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ল; কিন্তু শুকাল না। তাজা গোলাপ অনেকক্ষণ ধরে সুবাস ছড়ায়- ওই গোলাপগুলোও ছড়াল।