কয়েক দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি; আজকে সামান্য বিরতি দিলে একটা গামছা বুকে-পিঠে এক প্যাঁচ দিয়ে লুঙ্গিটা হাঁটু বরাবর তুলে উঠোনের চিপচিপে কাদা মাড়িয়ে পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়িয়ে যখন মকবুল মাঠের দিকে তাকায়, তখনই বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকা বিস্তৃত ফসলের মাঠের কথা ভেবে তার বুকের ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে।
চারপাশে বন্যার পানি থৈ থৈ করছে। আউশ ধান গেল তো গেলই, আমন ধান লাগানো যাবে কি-না, তা নিয়েও অন্তহীন দুশ্চিন্তা। শ্রাবণ গেল। আমনের চারাও পানির তলে বিনষ্ট; পচেগলে কাদা। গ্রামের কারো কারো বাড়িও তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে।
এই সময় পাশের বাড়ির আলেক এসে মকবুলের পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘বাচনের আর উফায় নাই। ফসল সব বিনাশ অইয়া গেছে।’
মকবুলের বুকের ভিতর থেকেও তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বের হয়। সে বলল, ‘দুইডা বছর অইলো মাত্র দেশটা স্বাধীন অইলো, আর…’ কথাটা শেষ করতে পারেনি মকবুল। বুকের ভিতরের হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে চোখে-মুখে এবং কিছুক্ষণ পরে বাক্যটি শেষ করে, ‘আহা রে, একটা যুদ্ধ শেষ অইতে না অইতেই আরেকটা যুদ্ধ! দেশের মানুষকে আর বাঁচানি যাইবো না রে আলেক!’
‘ধান গেল, ফাট গেল। আমনের জালাও গেল। জালাফাটও বন্যায় খাইলো। রোয়া লাগাইবো; এই যোগালও শেষ।’
‘ভাদর মাসে জালা ফালাইয়া রোয়া লাগাইলে কি আর ধান অইবো?’
‘অ, ধান অইবো? নাবালক ছেড়ির পোলাপাইনের মতো তো টেনটেইন্যা লাইগ্যা থাকব। আর যদি কাতিমারায় ফায় তাইলে তো আমও গেল ছালাও গেল।’
আলেক আস্তে আস্তে সামনের দিকে হেঁটে যায়। এ সময় দেখা যায় মাঠে একটি বড় নৌকা। আলেক চিৎকার করেই বলে, ‘ভাইছাব দেওকখাইন, কত বড় নাও।’
মকবুল আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘এইহানে নাও আইয়ে এই আলামতও আল্লাহ দেহাইলো!’
এই এলাকার মানুষ এই সুবিস্তৃত সমতল ফসলের মাঠে কখনও নৌকা দেখেনি। এই গ্রাম তো গ্রামই, আশপাশের দশ গ্রামেও নদী-নালা-খাল পর্যন্ত নেই যে নৌকা দেখবে। বন্যার কল্যাণেই এত বড় নৌকা দেখে বিশ-ত্রিশটি ছেলেমেয়ে ‘বড় নাও, বড় নাও’ বলে চিৎকার করতে করতে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এসে গ্রামের শেষ প্রান্তের ‘জাঙ্গালের’ ওপর দাঁড়ায়। অনেক বাড়ির বউ-ঝিরা দেউড়ির ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে। রঙিন পাল তোলা এত বড় নৌকা দেখে কেউ কেউ ফিসফিস করে বলে, ‘কত বড় নাও গো! মাগো!’
বড় নৌকাটি দেখে বনাডি গ্রামের মানুষেরা উল্লাস প্রকাশ করলেও সব মানুষ আসন্ন ভয়াবহ দিনের কথা ভেবে শঙ্কিত। তাদের অন্তরাত্মায় হাহাকার আর হতাশা ক্রমেই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পরপর তিনটি ফসল শেষ; গ্রামের কৃষকের চোখে-মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। গত মাস থেকেই কোনো বাড়িতে তিন বেলা খাওয়া নেই। গরিবরা একবেলা খাবারের জোগাড় করতে পারে; আর দুবেলা অর্ধাহার। একবেলা মিষ্টি আলু আর কেউ কেউ খেসারি-কলাই ভাজা খেয়েই দিন পার করে।
গ্রামের আরও কয়েকজন মকবুলের পাশে দাঁড়িয়ে বড় নৌকাটি দেখে। রহমতউল্লাহ নৌকাটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাজনের নাও, আইছে ফানির তামশা দেখতো। রঙের শইল কাডল দেয়া খাউজ্জায়।’
মকবুল আক্ষেপ করে বলে, ‘ভাতের অভাবে মানুষ মরবে আর হেরা নাও লইয়া আছে তামশা দেখতো। মানুষ বড় আচার্য জিনিস!’
রহমতউল্লাহ বলল, ‘বড় লোকরা গরিবের তামশা দেইখ্যাই মজা মারে। আলু আর খেসারি-কালাই খাইতে খাইতে জীবন শেষ অইয়া যাইতাছে; আর হেরা আইছে তামশা মারতো। আল্লাহর দুনিয়ার রীতি-নীতি এমুনই।’
নৌকাটি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করে এক সময় পুবদিকে অদৃশ্য হয়। কোনো পাটের মহাজন হয়তো নৌকা নিয়ে বের হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ কর্মহীন, ঘরে বসে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই। সবার দৃষ্টি পানির দিকে। কখন নামবে এই সর্বনাশা পানি!
বন্যার পানি নামতে নামতে ভাদ্র মাস পার। যাদের উঁচুতে জমি আছে তারা কেউ কেউ আমনের চারা লাগিয়েছিল তবে তা দিয়ে আগামী আউশ পর্যন্ত চলার মতো কারো ঘরেই ধান ওঠেনি। হতাশাগ্রস্ত মানুষেরা কী খাবে, কোথা থেকে খাবার পাবে, বাল-বাচ্চাকে কী করে বাঁচাবে- এসব নিয়েই সারাক্ষণ আলোচনা করে। অনেকই ফসলের জমি, টিনের ঘর বিক্রি করার জন্য খরিদ্দার খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। জীবন বাঁচানো বড় ধর্ম, আর তখন জমির দামও নেমে আসে অর্ধেকের চেয়ে কমে।
২
সারা দেশে দুর্ভিক্ষ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাবান, পিঁয়াজ, মরিচ, লবণ, কেরোসিন, তেল, গুড়, চিনি ও তেলের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়াতে গ্রামের মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে অর্ধেকে বা তারও কমে নামিয়েছে। অনেকেই পেঁয়াজ, মরিচ, গুড় ও চিনি খাওয়া বাদ দিয়েছে। চারদিকে হাহাকার- খাবার নেই। যারা দু’বেলা ভাত খেত তারা একবেলা ভাত খায়, একবেলা খেসারি-কলাই ভাজা, শাকসব্জি সিদ্ধ বা মিষ্টি আলু। অনেক দরিদ্র মানুষ ভিক্ষায় নেমেছে। নিজের এলাকায় মানসম্মানের ভয়ে দূর-দূরান্তে গিয়ে ভিক্ষা করে ওরা। সড়কের পাশে বুনো কচুগাছ কেটেকুটে সাফ। এসবও এখন মানুষের খাবার। সরিষার তেল বাদ দিয়ে সয়াবিন তেল দিয়ে রান্না শুরু হয়েছে অনেক আগেই। মেয়েদের রুক্ষ চুলে নারিকেল তেলের ছোঁয়া পড়ে না। গায়েমাখা সাবান, যাকে ওরা ‘বাসের সাবান’ বলে, সেসব সাবানের নাম-গন্ধও ভুলে গেছে। তিব্বত ৫৭০ সাবান গায়ে মাখে, আর কাপড় কাচে কলাগাছের ক্ষার অথবা ‘বাংলা গোলা সাবান’ দিয়ে।
প্রতিটি ইউনিয়নে একটি লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। এসব লঙ্গরখানায় একবেলা রুটি দেওয়া হয় গরিব মানুষদের। জনপ্রতি দুটি রুটি। রুটিগুলো কাগজের মতো পাতলা। দশ-বারোজনে রুটি বানায় আর চার-পাঁচজনে একটি বিশাল তাওয়ায় স্যাঁকে। আধা স্যাঁকা রুটির জন্যই শত শত মানুষ সকাল থেকে ভিড় জমায়। ভুখা, জীর্ণ-শীর্ণ, ছেঁড়া কাপড় জড়িয়ে মানুষের ফ্যাকাসে রুগ্ণ হাত বাড়িয়ে হাহাকার করে। এদের সামলানোর জন্য গ্রাম-পুলিশ মাঝে মাঝে লাঠিপেটা করে। মানুষকে কত সামলানো যায়? বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে আবার মাঝে মাঝে রুটি দেওয়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভুক্ত মানুষগুলো না খেয়েই দিন পার করে।
একরাতে একটি করে রুটি খেয়ে শুয়েছে মকবুলের পরিবারের সবাই। মকবুলের তিনটি মেয়ে একটি ছেলে। সবার বয়স ১০ বছরের নিচে। বড় মেয়ে আমেনার বয়স ৮। তারপর ছেলে দুলাল। তার বয়স ৭ বছর। পরের দুটি মেয়ের বয়সও এক বছরের ব্যবধান, মায়মুনা আর শেফালি। বছর বছর বাচ্চা হওয়ার খেসারত কম দিতে হয়নি অল্পবয়স্ক রাহেলার। সূতিকা রোগী, হালকা-পাতলা রাহেলার শরীরটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েও মায়ের মতোই রোগা, শুকনো আর প্রাণচঞ্চলহীন। মাথার চুল খড়ের মতো শুকনো কড়কড়ে। সবার চোখও কোটরাগত।
রাতে রাহেলা বলল, কাল থাইক্যা ঘরে আর একটা দানাও নাই। কী করবা অহন করো। আমার আর ভাল্লাগতাছে না।
চার চারটি সন্তানের মুখের দিকে তাকানো যায় না। এরপর দুলালের দুইদিন পাতলা পায়খানা হওয়াতে শরীর অর্ধেক হয়ে গেছে। বুকের হাড় গোনা যায়। খেসারি-কালাই ভাজা খেয়ে হজম করতে পারে না দুলাল। কিন্তু আর কী খাওয়াবে? গ্রামের তিনটি শিশু কলেরায় মারাও গেছে। পাতলা পায়খানা হলেই এখন মৃত্যুর ভয় তাড়া করে। দুলাল মারা যায়নি, বেঁচে থেকেও মরার মতো পড়ে থাকে অসাড় শরীর নিয়ে।
পৌষ গেল, মাঘ গেল; পেট সামলাবে, না ঘর মেরামত করবে! খড়ের ছাউনি বদলানো হয়নি। চৈত্র-বৈশাখ মাসে ঝড়-তুফানের ভয়ও মাঝে মাঝে মকবুলকে তাড়া করে। কালবৈশাখীতে ঘরটি টিকে থাকবে কি-না, কে জানে!
মকবুলের ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। মকবুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কী করব? জমিডা বেচতে চাইলাম, গাউক নাই। গরু দুইডা বেইচা খাইলাম। অহন মরণ ছাড়া গতি নাই।’
রাহেলা হয়তো আক্ষেপ করেই বলে, ‘তুমি না মুক্তি আছিলা! তোমার কি কুনো দাম নাই? দেশ সাদিন (স্বাধীন) করলা, অহন রিলিফ দিতাছে, লঙ্গরখানা অইছে। তারা তোমারে কিছু করবো না? চেয়ারম্যানের বোহালে একবার গিয়া দ্যাহো। কষ্টের কথা কও।’
‘কিছু ফাওনের লাইগ্যা তো যুদ্ধ করি নাই। আর চেয়ারম্যান কী করবো? কতজনই তো যুদ্ধ করছে। সরকার কয়জন্রে দিবো?’
‘তেও, তুমি যাও। বড় কষ্ট। আর ভাল্লাগে না। চেয়ারম্যানের কাছে গিয়া কও, তুমি যুদ্ধ করছ। অহন না খায়া মরণের দশা। একটা বিহিত অইতেও তো ফারে।’
‘মনে তো অয় না। তুমি যহন কইতাছো, কাইল বেয়াইনোক্ত যাইয়াম নে।’
মকবুলের ঘুম আসে না। মনে মনে বলে, ‘পেটে ক্ষিধা থাকলে ঘুমও আইয়ে না।’ রাতের মাঝামাঝি এক সময় সে বিছানা ছেড়ে খড়ম পায়ে হুঁকোটা নিয়ে গোয়ালঘরে গিয়ে ঢোকে। গোয়ালটা শূন্য। গোয়ালের দরজার পাশে বসে তামাক টানে মকবুল। মনে মনে বলে, ‘গরু দুইডাও বেইচ্যা খাইলাম। আহা! এই অভাব কোনদিন শেষ অইবো?’
অভাব যখন আসে তখন বন্যার পানির মতোই চারপাশ দিয়ে আসে। মকবুলের গরু দুটিও পানির দামে বিক্রি করেছে। দায়দেনা শোধ করে এক মাসও চলেনি সংসার। ছেলেটার অসুখেও গেল কিছু টাকা। এখন দিন মজুদদারদের। সস্তা দামে কিনে কত কিছু দিয়ে গুদাম ভরছে! এক বছরেই তাদের সম্পদ হয়ে যাবে কয়েক গুণ বেশি। আর গরিব মানুষের হাঁড়ি-পাতিলসহ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কত সম্পদ!
তামাক টেনে পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ায় মকবুল। দূরের গ্রামগুলো আবছা দেখা যায়। ফসলের মাঠ খাঁ খাঁ করছে। হু হু করে খোলা বাতাস বইছে, জোছনা খেলছে শূন্য মাঠে। নির্ভার উদাস দৃষ্টি মেলে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে মকবুল কিছুক্ষণ। অন্তহীন হিমশীতল আকাশের মতো মকবুলেরও ভাবনা অন্তহীন। কত কথা আসে মনে! দু’চোখ ভরে স্বপ্ন দেখে- স্বাধীন দেশে একদিন সুখ আসবে। আবার শূন্য মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হবে সোনালি ফসলে। দূর হবে অনাহার-অর্ধাহারের দিন। শেষ হবে এক-কাপড়ের দিন। সে মনে মনে বলে, ‘একদিন এই দ্যাশে সোনার ফসিল ফলবো। একদিন এই দ্যাশ সোনার দ্যাশ হইবো। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হইবে- একদিন হইবে।’
এই সময় দেওয়াডি গ্রাম থেকে চিৎকার ভেসে আসে- ‘ডাহাইত আইছে গো, ডাহাইত। সবাই বাড়িততো বাইর অও। ডাহাইত আইছে গো ডাহাইত।’
মকবুলও চিৎকার শুরু করে- ‘ডাহাইত আইছে গো ডাহাইত। দেওয়াডি গেরামে ডাহাইত আইছে।’
মকবুলের চিৎকার শুনে মানুষ ঘুম থেকে জেগেই দৌড়াতে শুরু করে। সাহসী যুবকরা বল্লম, কাতরা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দেওয়াডি গ্রামের দিকে ধাওয়া করে। মকবুলও দৌড় দেয়; চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যায়- ‘ডাহাইত আইছে গো, ডাহাইত।’
তেলিগাতি থেকেও মানুষ দৌড়ে আসছে। এই চাঁদনী রাতে ডাকাতরা যদি গ্রামের বনজঙ্গল ছেড়ে কোনোভাবে খোলা মাঠে এসে পড়ে, তাহলে ওরা পালানোর পথ পাবে না। চারদিকেই খোলা মাঠ। ডাকাতের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সব মানুষ বিস্টেম্ফারণোন্মুখ হয়ে আছে। হাতের নাগালে পেলে জাম-ভর্তা না করে ছাড়বে না।
চারদিকে মানুষের চিৎকার আর ধাওয়ার শব্দ শুনে ডাকাতরা ভীত-সন্ত্রস্ত। নিজে বাঁচার জন্য অন্যকে খুন করতে ওদের হাত কাঁপার কথা নয়। হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। মকবুল স্পষ্ট বুঝতে পারে- এটা রাইফেলের গুলি। ওরা কোথায় পেল রাইফেল? থমকে যায় মানুষের কোলাহল, চিৎকার আর ধাবমান মানুষের স্রোত।
আরেকটা গুলির শব্দে নিস্তরঙ্গ বাতাসে কম্পনের তরঙ্গ ওঠে। কানফাটা শব্দে খন্দকারবাড়ির দিকে ধাওয়ারত দেশীয় অস্ত্র হাতে উদ্ধত মানুষগুলো আতঙ্কিত; স্থির দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। হালকা কুয়াশার আস্তরণে আবছা আঁধারে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে আসে। তৃতীয় গুলির শব্দটি হওয়ার পর মানুষ আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করে।
দেওয়াডি গ্রাম থেকে মেয়েদের বিলাপের সুর বাতাসে ভেসে আসে কিছুক্ষণের মধ্যেই। কেউ খুন হয়েছে?
দুর্ভিক্ষের কারণে অনেকেই ডাকাতি শুরু করেছে। ওরা আশপাশের গ্রামেই ডাকাতি করে। কেউ ডাকাতদের চিনতে পারলেও ওদের নাম প্রকাশ করে না। ভয় হয়- প্রতিশোধ নিতে পরে কোনো সময় হত্যা করে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু শান্ত হয়ে পড়ে। ডাকাতরা বাধাহীন, প্রতিরোধহীন পথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
বাতাসের বেগেই খবর ছড়িয়ে পড়ে- মফিজ খন্দকারের বড় ছেলে কামালকে হত্যা করেছে ডাকাতরা। কামাল এক ডাকাতকে জাপটে ধরেছিল, আর ওরা সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। বাড়ির কয়েকজনকে কুপিয়ে জখমও করেছে।
মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ম্লান জোছনা রাতের স্নিগ্ধ বাতাস ভারী হয়। ক্রমে খন্দকারবাড়িতে মানুষের ভিড় শুধু বাড়তেই থাকে। ভিড়ের মানুষের সবারই জানার আগ্রহ- ডাকাতকে চেনা গেছে কি-না। চেনা গেলেও কেউ কি মুখ খুলবে? খুলবে না। হয়তো থানায় কেসও করবে না।
বনাডি, তেলিগাতি ও দেওয়াডি গ্রামের মানুষের সারারাত ঘুম নেই। এখানে সেখানে বসে নানা রকম গল্প করে কাটিয়ে দেয় রাত। কামালের সাহসের প্রশংসা, তার শিক্ষা-দীক্ষা, মার্জিত আচার-ব্যবহার সবদিক নিয়েই তুমুল আলোচনা হয়। আক্ষেপ, ক্রোধ আর কষ্টের মিশ্র ক্রিয়ায় সবার স্নায়ুজাল আড়ষ্ট হতে থাকে।
পরদিন ভোরে বাসি মুখেই মকবুল গামছাটা গায়ে জড়িয়ে বানাইলের বাজারে গিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু চেয়ারম্যানের কাছ থেকে তেমন আশ্বাস মেলেনি। চেয়ারম্যান সরাসরি বলেছে, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ নাই। তুমি মিয়া আইছো, লিস্টিতে নাম লেখাও। তারপরে লাইনে দাঁড়াইয়া রুডি চাইড্যা লইয়া যাও। লঙ্গরখানার রুডি বানানি শুরু অইবো দশটার পরে।’
মকবুল আশাহত। চেয়ারম্যানের তাচ্ছিল্যভরা কথা তার কাছে গ্লানিকর মনে হয়। চেয়ারম্যানের রুম থেকে মকবুল বের হতে হতে চেয়ারম্যান সম্পর্কে ভাবতে থাকে-‘কী কইরা চেয়ারম্যান অইলো? মুক্তিযুদ্ধের সময় তো হে গেরামে নাগরা জুতা ফায় দিয়া ঘুর্ইযা বেড়াইছে। কেমনে চেয়ারম্যান অইলো?’ মকবুল যোগ-বিয়োগ করে মিলাতে পারেনি বলে তার ভাবনা থিতু হয় ক্ষণকাল পরেই।
বাজারের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় মকবুল। অনাহার-অর্ধাহারে থাকা কঙ্কালসার স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে পড়ায় মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে এবং কাজের সন্ধানে পাট গুদামে গিয়ে হাজির হয়। মকবুলের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্ব সম্পর্কে ভাবার ফুরসৎ নেই পাটগুদামের মালিক আজহার মহাজনের। কিংবা কে যুদ্ধ করেছে আর কে মরেছে- এসব ভেবে দেখার মানুষও সে নয়। মকবুলকে একজন শ্রমিক হিসেবেই সে কিছু কাজ দেয়। কুলির কাজ। মুক্তিযোদ্ধা মকবুলও ভুলে যায় যুদ্ধজয়ের সময়কার বীরত্বের আত্মশ্নাঘার কথা। সে ভাবে, এইটুকুই তার প্রাপ্তি।
সারাদিন কাজ শেষ করে মকবুল পাওনা নিয়ে যখন আটা কেনার জন্য দোকানের দিকে যাচ্ছিল, তখনই বাড়ি থেকে খবর আসে- মায়মুনা মারা গেছে। সকাল থেকে কয়েকবার পাতলা পায়খানা আর বমি করে বিকেলের দিকে সে নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মকবুল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সারাদিনের মজুরির টাকা দিয়ে মায়মুনার কাফনের কাপড় কিনে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
রাতেই মায়মুনার সৎকার করা হয়।
ক্ষুধার্ত মানুষ কাঁদতে পারে না। মকবুলের পরিবারের সবাই এত ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত যে, কান্নার শক্তিও তাদের ছিল না।
রাতে আলেক সামান্য খাবারের ব্যবস্থা করেছিল। গ্রামের রীতি অনুযায়ী কেউ মারা গেলে চারদিন পর্যন্ত সে বাড়িতে রান্না হয় না; পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজন খাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু এখন আর সেই সময় নেই; বড়ই দুঃসময়। মকবুলের পরিবারের জন্য কেবল আলেকই একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে।
শোক কিছুটা থিতু হলে মকবুল আবার কাজে যায়। যেখানে যে-কাজ পায় সে কাজই করে। একদিন বাজারের চায়ের স্টলে বসে চা খাচ্ছেন থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমির হোসেন। তিনি মকবুলকে দেখে ডেকে কাছে বসালেন। জানলেন তার জীবনের কথা। তিনি রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়লেন এবং মকবুলকে নিয়ে গেলেন চেয়ারম্যানের কাছে।
চেয়ারম্যান দশ সের গম দেওয়ার জন্য বলল। সারাদিনেও মকবুলের পেটে দানা পড়েনি। রাগে, ক্ষোভে ও উত্তেজনায় সে চেয়ারম্যানকে বলল, ‘আপনার গম আপনিই খাইনযে, চেয়ারম্যান সাব। আমি দয়া-দক্ষিণা লইয়া বাঁচতাম চাই না।’
চেয়ারম্যান বলল, ‘ঠিক আছে, আরও পাঁচ সের গম লইয়া যা।’
তখন মকবুল চরম উত্তেজনায় ফেটে পড়ে এবং বলতে শুরু করে, ‘রিলিফের কম্বল সব চুরি কর্ইযা ফেডে ঢুহাইছুন। আডা, গম, চিনি তাও নিজেরা ভাগাভাগি কর্ইযা খাইতাছুইন। খাওয়াহাইন। আফনে ফারেন নাই মুক্তিযোদ্ধা না হোক, একজন গরিব মানুষ মনে কর্ইযাই আমারে এক মণ গম দিতাইন। চোরের গুষ্টির কাছ থাইকা আমি কিছু চাই না। হা।’ মকবুল গজ-গজ করতে করতে চেয়ারম্যানের রুম থেকে বের হয়ে যায়।
চেয়ারম্যান এই অপমান সহজে মেনে নিতে পারেনি। একটা বড় মজলিশে, গণমান্য ব্যক্তিদের সামনে এই অপমান হজম করা তার পক্ষে সত্যিই কঠিন। চেয়ারম্যান ভাবল, ‘একটু সামান্য শিক্ষা না দিলে এই বিচ্ছু ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি হতে পারে।’
চেয়ারম্যান আঙুল বাঁকা করে এবং খন্দকারবাড়িতে ডাকাতি ও কামালের হত্যা মামলায় তাকে ঢুকিয়ে দেয়।
এক মাস পরেই শুরু হয় রক্ষীবাহিনীর ধরপাকড়। গ্রামে গ্রামে ডাকাতি, চুরি, দুর্নীতি এসব বন্ধ করার জন্য তারা সন্দেহভাজন ও সুনির্দিষ্ট মামলার আসামিকে ধরে নিয়ে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়। বাদ পড়েনি মকবুলও। খন্দকার কামালের খুনের আসামি হিসেবেই গ্রেফতার করে মকবুলকে নিয়ে যাওয়া হয় জেলা সদরে।
বাড়িতে থাকে তার অসহায় স্ত্রী তিন সন্তানকে নিয়ে। খেয়ে-না খেয়ে ওদের দিন চলত মকবুলের রোজগারেই। এখন কী করবে ওরা? মকবুলের স্ত্রী বিভিন্ন বাড়িতে কাজের সন্ধান করে। দুলালও মানুষের বাড়িতে ফুটফরমায়েশ খাটা শুরু করে। আমেনাকে নিয়ে যায় ওর এক মামা।
শারীরিক নির্যাতনের ফলে মকবুল মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং স্বীকার করে- তার কাছে একটি এলএমজি আছে। একদিন রক্ষীবাহিনীর কিছু সদস্য তাকে নিয়ে আসে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য। মকবুল মানসিক বিকারগ্রস্ত। সে অস্ত্র খোঁজে চকির নিচে। কখনও বলে, শিকের পাতিলের ভিতর, ভাতের হাঁড়ির ভিতর, পানির কলসে, বদনার ভিতর।
মকবুলকে পুনরায় জেলা সদরে নেওয়ার পর আবার কয়েক দফা শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এক সময় ধরা পড়ে, সে পূর্ণ মানসিক বিকারগ্রস্ত। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন, মকবুলকে ষড়যন্ত্রমূলক আসামি করা হয়েছে। কিন্তু ততদিনে মকবুলের জন্য তাদের আর কিছুই করার রইল না।
একদিন মকবুল ছাড়া পায় যেদিন সে শুধু অস্ত্র খোঁজে পথে-ঘাটে, পাতার ফাঁকে, পাতার আড়ালে, ভাতের হাঁড়িতে। তার শরীর ফুলে ঢোল। যে মকবুলের শরীর ছিল পাথরের মতো সুগঠিত, বিয়াল্লিশ ইঞ্চি বুকের খাঁচায় ছিল অদম্য সাহস; সেই মকবুলের শরীর এখন কদুর মতো ঢিলেঢালা। বুকের ভিতরে বাসা বেঁধেছে ভয় আর আতঙ্ক।
মকবুল কখনও ছাড়া পাবে না- এমন মনে করেই রাহেলা সন্তানদের নিয়ে শহরে চলে যায়।
বাড়িতে এসে মকবুল স্ত্রী-সন্তানদের পায়নি। তারা কোথায় গেছে, তা জানতেও পারে না। ওদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন- এমন বোধও নেই মকবুলের। সে পথে পথে সারাদিন হাঁটে। কেউ দয়া করে খাবার দিলে খায়; না হয় উপোস। কোথা থেকে কোথায় যায় সে নিজেও জানে না। মাঝে মাঝে উদাস দৃষ্টিতে বিস্তৃত ফসলের মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে; তার চোখ দুটি স্বপ্নাচ্ছন্ন। দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে, ‘একদিন এই দ্যাশে সোনার ফসিল ফলবো। একদিন এই দ্যাশ সোনার দ্যাশ হইবো।’