হারানো সময়

হারানো সময়

শাপলা চত্বরে এসে দাঁড়িয়ে মনে হলো, বিষয়টি ঠিক, আমার জীবন থেকে একটা জিনিস হারিয়ে গেছে। নাম তার সময়। ঠিক হারিয়ে যায়নি। তার প্রবহমানতা হয়ে গেছে নিস্তরঙ্গ, অনুভূতিহীন। একেবারে সমতল। আই মিন ফ্ল্যাট হয়ে গেছে পুরো ব্যাপারটা। না হলে এত বড় ভুল হওয়ার কথা নয়। সাতসকালে এনসিটিবির অডিটরিয়ামে গিয়ে দেখি, দরজায় বড় একটা তালা ঝোলানো। ওপাশে এক আনসার পাছা বেরিয়ে আসা সেকেলে একটা টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখছে। ভাবলাম, সবাই আসতে হয়তো দেরি করছে। নিজের অবস্থানটা পোক্ত করতে ফোন দিলাম একে-ওকে। ওরা জানাল আজ নয়, কাল অনুষ্ঠান। এক সপ্তাহ ধরে এই বিভ্রাট চলছে। মিস হয়ে গেছে দু-দুটো ক্লাস। সহকর্মীদের সহমর্মিতায় ওপর পর্যন্ত যায়নি বিষয়টা। নইলে সাদা কাগজের দাপটে উড়ে যেত কয়েক দিনের শান্তি।

একটা সময় ছিল সপ্তাহের প্রতিটি দিন নিজস্ব রূপমাধুরী নিয়ে হাজির হতো জীবনে। প্রতিটি বৃহস্পতিবার ছিল আনন্দের। সুহৃদের ভালো ঘুম হলে সেদিন মলিকে পাওয়া যেত বুকের ভেতরে গলে যাওয়া একটা শনপাপড়ির মতো করে। দুজনের উষ্ণ নিশ্বাসে বর্ণিল হয়ে আসত বন্ধের দিনটা। সকালে নিউ মার্কেট থেকে ইচ্ছেমতো সদাইপাতি করে দুপুরে ভরপেট খাওয়া। তারপর ইউটিউবে কোনো পুরোনো দিনের সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া। সন্ধ্যার আগে আগে ফুলার রোডে গিয়ে সুহৃদকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়ানো। শনিবার থেকে আবার ক্লাস। মধ্যে মঙ্গলবার একটু গ্যাপ দিয়ে পুরোটা সপ্তাহ নাভিশ্বাস ওঠা ব্যস্ততা। সন্ধ্যায় বাসায় এলে সুহৃদের যন্ত্রণা। অফিসে বারোভাজরা ঝামেলা। পরিবারের ছোট-বড় চাহিদাগুলোর পরিপূরণ। তার মধ্যে আঙুলের কড়ায় বৃহস্পতিবারের জন্য অপেক্ষা। অপেক্ষা সুহৃদের সুস্থ হয়ে ওঠার। কখনো কেউ যদি বলত, ৮-১০ বছর হতে হতে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আপনাদের বংশে তো এ রকম সমস্যা কারও ছিল না, অতএব চিন্তার বিশেষ কোনো কারণ নেই; পুরোটাই সান্ত্বনার আবরণ দিয়ে মোড়ানো। কিন্তু মনে হতো খুব স্বস্তির একটা বিকেল এসে উঁকি দিচ্ছে আমাদের জানালায়। সুহৃদ তার বয়সী আর দশটা বাচ্চার সঙ্গে হইহই করে খেলতে যাবে মাঠে। মলি খুব স্বাভাবিক আচরণ করবে। কলোনির অন্য মহিলাদের সঙ্গে সিরিয়াল আর রান্নার গল্প করে করে হাঁটবে বিকেলে। সন্ধ্যায় টিভি দেখবে।

স্বস্তির সময় এল। যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে নয়। আহত পাখির দুটো ডানা ছেঁটে দিয়ে সুস্থ করে তোলার মতো। বাকিটা জীবন হয়তো সুস্থই থাকবে, কিন্তু স্বছন্দ পাবে না। ব্যাপারটা সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম না। মলি চলে যাওয়ার পর দুই মাস আজিমপুরের ফ্ল্যাটটা আটকে রেখেছিলাম। এই দুই মাসে চায়ের কেটলি থেকে শুরু করে বড়-ছোট সব জিনিস বিক্রি করে দিলাম। লাখ দুয়েক টাকা ব্যাংকে রেখে বানপ্রস্থ যাত্রা করলাম। আর সংসারের ঝুঁট-ঝামেলায় জড়াব না। একটা উন্মাদ বাচ্চাকে পালার ধৈর্য বা শক্তি কোনোটাই দেয়নি আমাকে ঈশ্বর। তার ওপর মলির অত্যাচার। অকারণে মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠা। যেকোনো বিষয়ে নিরাসক্ত। কাল-পাত্র বিবেচনা না করে এর-ওর সামনে যা-তা বলে ফেলা। আর পারছিলাম না সম্পর্কটা বয়ে নিতে। আমাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হলো না। মলি নিজ থেকে গুটিয়ে নিল নিজেকে। একদিন সকালবেলা অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ানের ডেকে আনা অটোরিকশায় মলি সুহৃদকে নিয়ে চলে গেল। আগের রাতে আমাদের অনেক কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। নিজের চাপা দুঃখবোধটা আর সংবরণ করতে পরলাম না, ‘দ্যাখো মলি, তোমাকে বিয়ে করে আমি কী পেলাম? ভার্সিটির মেধাবী ছাত্রী হিসেবেই তোমাকে ঘরে তুলেছিলাম। আশা ছিল, একটা ভালো চাকরি পাবে। আমার টানাপোড়েনের সংসারে সচ্ছলতার দিন নিয়ে আসবে। কিসসু হলো না তোমাকে দিয়ে। একটা সন্তান জন্ম দিলে, তা-ও এবনরমাল।’

মলি ধুপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। থরথর হাতে এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে নিল মুখের সামনে। তারপর সারা রাত ডাইনিং স্পেসের লাইট জ্বালানো ছিল। সুহৃদ ঘুমিয়ে ছিল স্নায়ু অসার করা ওষুধের প্রভাবে। আমি তার পাশে এক কাত হয়ে শুয়ে রইলাম। সারা রাত মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে। হুট করে এভাবে না বললেও পারতাম। কিন্তু আরেকটা মন তখন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, মলির স্বেচ্ছাচার আর কত মুখ বুজে সইবে?

মলি চলে যাওয়ার পর আমার হাতে অখণ্ড অবসর। অফিস থেকে এসে টানা ঘণ্টা ছয়েক কিছুই করার থাকে না। টিভিতে টক-শো, নাটক, সিনেমা এসব দেখে দেখে কেমন অরুচি ধরে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কতক্ষণ একনাগাড়ে বসে থাকা যায়? মাথা ঝিমঝিম করে। অনেক দিনের বিরতিতে আবার কবিতা লেখা শুরু করি। স্রোতস্বিনীর ওপর থেকে বাঁধ তুলে নিলে যেভাবে জলের ধারা বইতে থাকে, সেভাবেই কবিতা আসতে শুরু করল কলমের ডগায়। এত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা সব স্টাবলিশড হয়ে গেছে মিডিয়ায়। তাদের একটা হাই-হ্যালো করলেই সপ্তাহে দু-চাট্টা কবিতা এসে যায় পত্রিকায়। মাঝে মাঝে এখান-ওখান থেকে কাব্যসভায় আমন্ত্রণও আসে। জীবনটাকে উপভোগ করতে শুরু করলাম আবার নতুন করে। আজিজ মার্কেটে একটা কামরা নিলাম। রাতে একটা ছেলে রুমে খাবার দিয়ে যায়। সকালে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু খেয়ে নিই। আর দুপুরে তো অফিসের ক্যানটিন। জীবন কত মসৃণ!

মলির খোঁজ আর নেওয়া হয় না। কিন্তু খবর ঠিকই আসে। মলি চলে যাওয়ার পর কুমিল্লায় তার মেজ ভাইয়ের বাসায় ওঠে। মেজ ভাইয়ের স্ত্রী অল্প দিনেই টের পেতে লাগল সুহৃদের ছোঁয়াচ লাগতে শুরু করেছে তাদের বাচ্চাকাচ্চার ওপর। বাচ্চাগুলো হাইপার হয়ে উঠছে। তারপর টুকটাক থেকেই শুরু হয়ে অসন্তোষের দমকা। মলিও তো কম যায় না। সকাল-সকাল গাট্টিবোঁচকা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা সে আরেকবার ঝালিয়ে নিল। বিষয়টা দারুণ ইন্টারেস্টিং, কো-অ্যাক্সিডেন্ট হোক আর যা-ই হোক, মলি প্রতিবারই বাসা ছেড়েছে সাতসকালে। মেয়েরা রাতের আঁধারে প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছাড়ে, আর মলি ছেড়েছিল কাকডাকা সকালে। আমার হাত ধরেই। তখন আমি নারায়ণগঞ্জে একটা টেক্সটাইলে অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করি। মলি আমার সহপাঠী ছিল। সাংঘাতিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও মেধাবী একটা মেয়ে। আমার মতো কোনো প্রকারে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া ছাত্রের প্রতি তার মনোযোগী হওয়ার কথা নয়। পড়ত প্রাণরসায়ন বিভাগে। দিনরাত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে পড়ে থাকত। তার প্রাণ কোন রসায়নের দ্রবণে ডুবিয়ে রেখেছিল, আমার জানা ছিল না। তবে মেয়েটাকে আমার চোখে ধরেছিল। এ রকম একটা মেধাবী মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে বাচ্চাকাচ্চা কেমন ট্যালেন্ট হবে, একবার ভাবতে পারছেন? তার ওপর ভালো চাকরির হাতছানি…। মেয়েটাকে ফ্ল্যাট করার চেষ্টা করতাম। তখনো মোবাইল, ফেসবুক আসেনি। আর্চিস গ্যালারিই ভরসা। একসময় কঠিন বহিরাবরণের মেয়েটির ভেতরের নরম শাঁসটার খোঁজ পেয়ে গেলাম। তারপর দেখা গেল, সম্পর্কের ব্যাপারে আমার চেয়ে সে-ই বেশি সিরিয়াস। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আমি গেলাম নারায়ণগঞ্জে আর ও বারডেমের একটা প্রজেক্টে কাজ পেয়ে গেল। বিয়ের জন্য চাপ আগে থেকেই ছিল। পাস করে বেরোনোর পর প্যাসক্যালের সূত্র ধরে সে চাপ জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল। এর মধ্যে একবার ঈদের বন্ধে কুমিল্লায় গেলে ধরে-বেঁধে বিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয় মলির পরিবার। খবর পেয়ে আমি দুজন বন্ধু আর একটা মাইক্রোবাস নিয়ে হাজির হই শ্মশানগাছা মোড়ে। মলি তার ছোট বোনকে নিয়ে কোন একটা কাজের ছুঁতোয় বেরিয়েছিল। ছোঁ মেরে নিয়ে যাই পথ থেকে ওকে। তার মেজ ভাইয়ের দাবড়ানিতে মাস তিনেক সীতাকুণ্ডে গা-ঢাকা দিয়েছিলাম। এর মধ্যে আমাদের দুজনের দুটো দোদুল্যমান চাকরির দড়ি ছিঁড়ে গেল। তারপর ঢাকায় চলে আসা। থাকতাম রূপনগরের ওদিকটায়। টিউশনি, পার্টটাইম চাকরি এসব করে করে সংসারের নৌকাটা এসে তীরে ভেড়ালাম। এর মধ্যে সুহৃদ চলে এল। সুহৃদের জন্মের পরদিন আমার বিসিএসের রেজাল্ট। বাবা খবরটা পেয়ে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোর ব্যাটা বরকত নিয়া আইছে রে বাপ!’

ছেলে; সঙ্গে সুস্থির একটা চাকরি—মাঘের শীতেই পেখম মেলে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছিল। অল্প দিনের মধ্যে উৎসবের আমেজ কেটে গেল। সুহৃদ হাসতে পারে না। এ রকম একটা চাঁদপনা মুখে হাসি নেই—ভাবা যায়! সুহৃদের সমবয়সী বাচ্চাদের কথায় যখন তাদের বাবা-মা অস্থির, সুহৃদ তখন অন্য জগতের বাসিন্দা যেন। কিন্তু এসব কিছুই আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হতো না। বৈচিত্র্যই তো মানবজীবনের সৌন্দর্য। ও কেন অন্য সবার মতো হবে। তার নিজস্ব একটা মত থাকতে পারে না? কিন্তু একটা সময় তার উগ্র আচরণ আমাদের বাধ্য করল ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে। তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে পাঠালেন। তারাই প্রথম নিশ্চিত করল ব্যাপারটা। কিন্তু মজার ব্যাপার কী, তারা বলার আগেই পাশের বাসার ভাবি, অফিসের কলিগ, রাস্তার শুভাকাঙ্ক্ষী—সবাই ইঙ্গিত করছিল বিষয়টা নিয়ে। একজন তো বলেই ফেলেছিল, ‘দেইখ্যেন অটিস্টিক টটিস্টিক না তো।’ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে সুহৃদের যন্ত্রণাগুলো যেন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল আমার জীবনে। এর মধ্যে উপদেশদাতার ভিড় লেগে গেল চারপাশে। পান চিবুতে চিবুতে এক ক্লার্ক বলল, ‘স্যার, মনে কিছু নিয়েন না, আপনারা তো বিশ্বাস করেন না, তারপরও বলি—অভিশাপ একটা জিনিস আছে। কার অভিশাপ কার গায়ে লাগে বলা যায় না। ধরেন আপনার দাদায়…’ গভীর মনোযোগ দিয়ে ভদ্রলোকের মতামত শুনি। তার কথামতো হালুয়াঘাটে এক বিরাট পীর সাহেবের কাছে যাই। তিনি বদদোয়াটা ট্রেস করতে পারছেন, কিন্তু সেটা ফেরাতে তাঁর যথেষ্ট সময় ও হাদিয়ার প্রয়োজন। যথেষ্ট সময় ও হাদিয়া দেওয়ার পরও সুহৃদ ‘অভিশাপ’মুক্ত হলো না। যখন যে ডাক্তার-কবিরাজের কথা শুনি, তার কাছেই ছুটে যাই। সান্ত্বনার ফুটবল আমাদের নিয়ে সারা মাঠ ছুটছে। অথচ আমাদের জানা ছিল না, এ মাঠে কোনো গোলবার নেই। এর মধ্যে মলির আচার-আচরণ ও ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন দেখা দিল। সারাক্ষণ খিটমিটে একটা ভাব করে থাকে। দাম্পত্য জীবনের স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়াগুলো অর্থহীন তার কাছে। সুহৃদ যত বড় হয়, তার উপদ্রব যেন আরও অদম্য হয়ে ওঠে। আমি অসহ্য হয়ে উঠছিলাম। আর পারছিলাম না জীবনের ঘানি টানতে। শেষমেশ মুক্তির ঘণ্টা মিলল। মলি চলে গেল নিঃশব্দে। আমার জীবনবৃক্ষের একটা পাতাও কাঁপল না তার ডানার ঝাপটায়।

মলি চলে গেল আমাকে একটা নিস্পন্দ জীবন দিয়ে। যে জীবনে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক নেই। দিন-ঘণ্টার হিসাব নেই। সে না জানিয়ে আমার জীবনের ঘড়িটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। ব্যাপারটা তখন বুঝিনি, এখন বুঝতে পারছি হাড়ে হাড়ে। সময়-টময় ছাড়া একটা জীবন হয় নাকি! শাপলা চত্বরের সামনে দাঁড়িয়ে বিষয়টা নিয়ে ভাবি। হঠাৎ করে সুহৃদের মুখটাও ভেসে ওঠে চোখের ওপর। মুখের আদলটা ঠিক আমার মায়ের মতো। কী মোহময় দুটি চোখ! এখন কেমন হয়েছে ছেলেটা? আমার রক্তের পিণ্ড! কলজের ধন। সেবার শম্পা এসে জানাল, মলি নাকি চট্টগ্রামে একটা অটিস্টিক স্কুলে পড়ায়। সুহৃদও সেখানে যায়। সে দারুণ ছবি আঁকে। গ্রামের ছবি। মা ধান কুটছে, বাবা গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। ওর স্মৃতিতে কি ওর বাবা এখনো আছে? আমি সামনে দাঁড়ালে আমাকে চিনতে পারবে? মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। মোড়টা পেরিয়ে একটা রিকশা ডেকে নিই। আর কোনো কথা নয়, কমলাপুর যাব। চট্টগ্রামের যে ট্রেন পাব, তাতেই উঠে পড়ব।

সামনে ঈদের বন্ধ। গমগম করছে মানুষ। প্রতিটি কাউন্টারের সামনে অজগরের মতো মানুষের লাইন। এমন একটা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবাই হুড়োহুড়ি করছে সামনে যাওয়ার জন্য। কেউ বলছে, ‘ভাই একটু পরে রংপুর ছেড়ে দিবে, লাইনে দাঁড়ালে ট্রেন ধরতে পারব না…’, কেউ বলছে, ‘এক টিকিট কাটতে সারা দিন চলে গেলে বাকি কাজ করমু কখন…’, অন্য একজন অসহিষ্ণু হয়ে বলছে, ‘অদক্ষ লোকজনে ভরে গেছে রেল, দেখেন না লাইনটা এগোচ্ছেই না।’ আমার কোনো তাড়া নেই। ট্রেন ছাড়তে আরও তিন ঘণ্টা। আমি এসব বিরক্ত, বিক্ষুব্ধ মানুষগুলোকে দেখি। কোলাহল উপভোগ করি।

কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারি, আমি আসলে একটা শূন্যস্থানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনের পেছনের সবাই যে যার মতো কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে। কেবল আমি দাঁড়িয়ে আছি মর্মরমূর্তির মতো। কিংবা কমলাপুরের বড় বড় থামগুলোর মতো। সবাই আমাকে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। সবাই আমাকে জড়বস্তু ভেবে অগ্রাহ্য করছে। আমি কবজি তুলে ঘড়ি দেখি। সর্বনাশ, ঘড়িতে কোনো সময়ের কাঁটা নেই! একটা বাচ্চা দোলনা দুলছে সেখানে। তাকাই কাউন্টারের ওপরের দেয়ালঘড়িটার দিকে। আশ্চর্য, আধখাওয়া ঘড়িটার ওপর মরে পড়ে আছে একটা টিকটিকি। আমি অস্থির হয়ে উঠি, কেবল জানতে চাই ঘড়িতে এখন কয়টা বাজে। তিনটায় ট্রেন। ট্রেনের সিটি শোনা যায়। একটা বড় ঘড়ি হাতে স্টেশনমাস্টার আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘড়ির ভেতর অজস্র প্রজাপতির ভাঙা ডানা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত