ঝকঝকে দিন। চারপাশ থেকে মৃদু হাওয়া ধেয়ে আসছে। রোদও তেমন সতেজ নয়। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা, আচ্ছন্নতা মায়াবী পরিবেশকে ঘিরে রেখেছে। রিনু বারান্দায় বসে চুল মেলে দিয়েছে সেই রোদে। এই সকালে রোদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ভঙ্গিটা চমৎকার লাগে বলেই নাশতা খেয়ে-না খেয়ে ছুটে আসে সেতু। বারান্দায় একসঙ্গে মোড়া নিয়ে চুপচাপ গল্প করার ছলে রিনুকে দেখে। রিনু রোদের ঠোঁটে চুলকে ছুঁইয়ে দিতে দিতে নাক কুঁচকে বলল, তুই রোজ এভাবে…
আমাকে তুই তুই করবেন না, আমাদের সম্পর্কটা সেসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছে। সেতু বলল।
রিনু বিষণ্ণ হলো। তারপর রোদ থেকে একটু একটু সরে এসে মুখোমুখি বসল, কেমন আছ?
হেসে ফেলে রনজু সম্বোধনটা শোনানোর জন্যই এই প্রশ্ন, না সত্যি সত্যি জানতে চাইছে।
সত্যি সত্যি রিনু অনেক দূর থেকে বলল, আসলেও তুমি কখন কেমন থাকো ইদানীং খুব জানতে ইচ্ছা হয় আমার।
সেতু অহন হয়ে বসল তাই?
তাই না, রিনুও সহজ হয় এমনিই বলার জন্য বললাম। সেতু রিনুকে তীব্র চোখে দেখল তারপর বলল, আমিও বলার জন্য একটা কথা বলি?
রোদটা তেতে উঠছে। রিনু মোড়া সরিয়ে বারান্দার ভেতরের দিকে চলে এলো। এতে করে সেতুর সঙ্গে তার বাহ্যিক দূরত্বটা কমে গেল। সে ইচ্ছে করলেই হাত সোজা না করেই রনজুকে ছুঁয়ে দিতে পারে। ইচ্ছেটা হলোও একবার। কিন্তু নিশুকে এক মুহূর্তের জন্য সামলে নিয়ে বলল, তোমার কোনো কথাই আপাতত ভালো লাগছে না আমার।
সুতরাং অপমানিত হলো। ওর নাক-মুখ লাল হওয়া দেখে রিনুর তা-ই মনে হলো। রিনুর ইচ্ছে হলো কথাটা ফিরিয়ে নেয়া। কিন্তু এক ধরনের আলস্য ওকে গ্রাস করল। তাই সে চুপচাপ উঠোনের দিকে চেয়ে রইল। যেখানে কয়েকটা কাক একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। রিনুর রোদের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে একটা স্বপ্ন সৃষ্টি করতে চাচ্ছিল, তখনই সেতুর গলা তাকে সচকিত করল, তুমি না শুনতে চাইলেও কথাটা আমাকে বলতেই হচ্ছে, তা হলো আমি তোমার প্রতি আকর্ষণ ফিল করছি। রিনু মিশ্র অনুভূতির ভেতর পড়ে গেল। ওর বুকের ভেতর দ্রুত শব্দ হতে থাকে। ঘোরের ভেতর থেকে সে বলল, সত্যি বলছ?
ততক্ষণে সেতু বারান্দায় সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর একটু জোরেই বলল, এটাও আমার একটা কথার কথা, সেটা ভুলে যেয়ো না।
রিনু ভাবলো সেতুকে ডেকে বসায়। কিন্তু আলস্য কিংবা মিশ্র অনুভূতির ধাক্কাই পুতুলকে ডাকা হলো না। সে দেখল প্রভুর ছায়াটা উঠোন থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে, ওর মনে হলো সেতুর সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। তবুও সেতুকে ডাকা হলো না। উঠোন থেকে সেতু হাওয়া হলে গেল।
বিছানায় চুপচাপ শুয়েছিল রিনু। জানালা দিয়ে সোজা ঘরে ঢুকছে। বইয়ে অসংলগ্ন চোখ রেখে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছিল সে রাতে খুব সম্ভবত কোনো নাজুক স্বপ্ন দেখেছে সে। অর্ধেক দৃষ্টি বইয়ে এবং বাকি অর্ধেকটাকে স্বপ্নের ভেতর ডুবিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতির ভেতর পড়ে গেছে সে। স্বপ্নটা আবছাভাবে স্মৃতির শরীরে দাগ কাটছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। রিনু বই রেখে স্বপ্নকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে উঠল।
পাহাড়ের কাছাকাছি কোথাও সবুজ কি লাল রোদ উঠেছিল। সেই পাহাড়ের শরীর বেয়ে একতা মানুষ কি দেবতা রিনুকে টেনে টেনে পাহাড়ে উঠাচ্ছিল। পাহাড়টাকে যত সুন্দর দেখাচ্ছিল তার শরীরে তত বেশি ক্ষতের চিহ্ন ছিল। তাই হোঁচট খেতে খেতে রিনুর মতে, খুব সম্ভবত সারারাতই লেগে গিয়েছিল পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে। যা হোক ভোরের স্বপ্নে রিনুকে অনেক কষ্টে পাহাড়ের চূড়ায় উঠালো মানুষটা। তারপর রিনুর চোখের দিকে কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকাল এবং এক ধাক্কায় সেই উঁচু পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দিল।
স্বপ্নের মতোই স্বপ্ন বটে। রিনু অবাক হলো এটা তার সারাদিন মনে হয়নি। সারাদিন তো তার কোনো ব্যস্ততাও কাটেনি। হাজব্যান্ড বিদেশে আছে, খরচ পাঠাচ্ছে বাবার বাড়িতে, ওর রাজকীয় ভঙ্গিতেই দিন কাটছে। এতে এমন একটা জটিল সুন্দর স্বপ্নের কথা ওর মনে আসেনি কেন। মা ওয়ারড্রোবে কাপড় গুছিয়ে রাখছেন। রিনু মাকে দেখছেন এবং তারপর মা’র ভেতর স্বপ্নের মানুষটার চেহারা মনে করতে চাইল। কিছুতেই মনে হচ্ছে না। রিনু মরিয়া হয়ে উঠল। তখনই সেতু এলো, রিনু তার স্বপ্নে ফেরা অসম্ভব জটিল মানুষটাকে মনে করতে পারল।
মা বললেন, তোমার পরীক্ষা কবে? একটু অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। সেতুর আগামী মাসে।
প্রিপারেশন কেমন? মা কাপড় গুছিয়ে রান্নাঘরের দিকে চললেন, যেন বলার জন্যই বলা। এর উত্তর দেওয়ার আর প্রয়োজন হলো না। মা রান্নাঘরে পা রেখেছেন। বুকের ভেতর অস্থিরতা টের পেল রিনু। ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। জ্যাকেটটাকে ঘাড়ে ঝুলিয়ে ঘরে আলো জ্বালালো সেতু। তারপর বিছানায় রিনুর কাছাকাছি বসল।
আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি জানো… রিনু বলতে চাইল। সেতু চুপচাপ চেয়ে রইল রিনুর দিকে। রিনু থেমে গেল। না এমনিই। এসবের সঙ্গে পরিচিত সেতু। সে উঠে দাঁড়াল। তারপর টেবিলের ওপর রাখা ক্যাসেট নিয়ে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ। প্লেতে চাপ দিল। সাগর সেন জেগে উঠল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বিছানায় কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকে রিনু।
আসলে তোমাকে আমি প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিতে চাচ্ছি। রিনুর প্রশ্নবোধক চোখের সামনে বলতে থাকে সেতু। তার কারণ… সেতু জানালা দিয়ে সন্ধ্যায় চলে যাওয়া দেখে। তারপর হেসে ফেলে, না কোনো কারণ নেই, এমনিই বললাম।
রিনুর একটা কিছু মনে হওয়ায় তোশকের নিচে থেকে একটা ইনভেলাপ বের করে সেতুর দিকে বাড়িয়ে দিল। সেতু একপলক ইনভেলাপের ওপর চোখ বুলিয়ে বলল, তোমাদের ব্যক্তিগত চিঠি আমাকে দেখাচ্ছ কেন!
ফেব্রুয়ারিতে আমার টিকিট আসছে।
রিনু উচ্ছল হলো, এটা খুব ভদ্র চিঠি তুমি পড়তে পারো ইচ্ছে করলে।
সেতুর মুখের দিকে তাকালে ওর প্রতিক্রিয়া কম বোঝা যায়। রিনু সেতুকে পড়াতে চাইল। সেতু চিঠিটা বিছানায় রেখে রিনুর দিকে সরাসরি তাকাল- আমার প্রতি তোমার কোনো ফিলিংস আছে?
রিনু হাসতে থাকল। অসম্ভব রেগে গেল সেতু- তুমি অসভ্যের মতো হাসবে না। আমার ভালো লাগছে না।
রিনু স্থির হলো। সেতু নিজেকে সামলে নিল, আই অ্যাম সরি! রিনু বিপন্ন চোখে সেতুকে দেখল। অনেক দূর থেকে তারপর বলল, জানি না।
সেতু অস্থির হলো। রিনু পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে রইল বিছানায়। তারপর সেতুর অস্থিরতায় চোখ রেখে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, তুমি আর এসো না। আর না।
পালাচ্ছ? সেতুর চাহনি তেমনই তীব্র। রিনুর বুকের ভেতর শব্দটা ধাক্কা লাগল। রিনু অস্থিরভাবে বলল, তাই চাচ্ছি। কেননা আর পথ নেই।
সেতু স্থির হলো। তারপর রিনুর কাছাকাছি বিছানায় বসে বলল, তোমাকে ছুঁয়ে দেই?
রিনুর হাত-ঠোঁট কেঁপে ওঠে। তারপর প্রাণপণে নিজেকে সামলাতে গিয়েও হোঁচট খায়- না, মরে যাব।
লেকের জলে চোখ রেখে উদাস হয়ে যায় রিনু। সেতু রিনুর হাতে আঙুলের ডগা ছোঁয়ায়। রিনু স্পষ্টভাবে একটু কেঁপে উঠল। রিনু লেকের জল দেখে। সেতু রিনুর উড়ো চুলে চোখ রাখে। তারপর চিবুকের গর্তে। রিনু লেকের জল দেখে। সেতুর চারপাশে মানুষজন থেকে অনেক দূর থেকে বলে, যমুনা হাত ধরো স্বর্গে যাব। রিনু লেকের জল দেখে। সেতু রিনুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আলতো চাপ দেয়। রিনুর বুকে আনন্দ শংকরের মিউজিক বাজে। রিনু সেতুর চোখে চোখ রেখে বলে, আর কত কষ্ট দেবে? আর কত? সেতু হাসল। ওর হাসির ম্লান ভঙ্গিটা আবারও কাঁপাল রিনুকে। সেতু খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দাও সবকিছু। সেতুর চোখ জ্বলে। হাসল রিনুও। তারপর সেতুর দিকে সরাসরি তাকাল যে ভালোবাসায় কষ্ট সব… একবিন্দু সুখ নেই কষ্ট ছাড়া, তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়াই উচিত। হাত বাড়াও সেতু। আমি ফুঁ দেবো আঙুলে তোমার সত্তায়।
সেতু হাত বাড়াল। ফুঁ দিতে গিয়ে সেতুর চোখে চোখ রাখল রিনু। স্থির হয়ে গেল সে। রিনু ভাসতে ভাসতে শেষে মাটিতে এসে নামল। তারপর সেতুর দিকে তীব্র শীতেও ঘামছে যেন। সে চেয়ার থেকে উঠে রিনুর কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে বসল। রিনু হাঁটুতে মুখ গুঁজে আছে। ওর বুকের ভেতর সমুদ্রের শব্দ। রিনুর চোখ জ্বলছে। এক সময় তা ভিজে আসে। সেতু অস্থির হয়। সে দাঁড়ায়। তারপর রিনুর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসে তীব্র কণ্ঠে বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি রিনু।
আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড় সেতু। রিনু সেতুর দিকে তাকাল। সেতু ঘাড় নাড়ল- ওটা পুরনো কথা।
আমার হাজব্যান্ড ক’দিন পর বিলেত থেকে ফিরছে- রিনু দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল।
সেতু বলল, আমি জানি।
রিনু উত্তেজিতভাবে সেতুর হাত চেপে ধরল, অত জানো তুমি এরপরও এদ্দুর এলে কেন?
আমি একা আসিনি- সেতু বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল।
রিনু নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। তারপর সেতুর হাতে নিজে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল। আসলে সব দোষ আমার নিঃসঙ্গতার। কখনও আমরা আমাদের মধ্যকার উঁচু দেয়ালগুলো ডিঙাতে পারব না। আত্মদহন আর কাকে বলে। রিনু হাসতে থাকে।
মা বাসায় নেই। ছোট বোনটা বাইরে খেলছে। বড় ভাই কোথাও আড্ডা দিচ্ছে। নির্জন বাড়িতে সেতুর উপস্থিতি রিনুকে একটা কষ্টকর অনুভূতিতে ফেলল। এই কষ্টটা নিতে যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমন ভালোও লাগছে। রিনু ঠিক বুঝতে পারছে না এর পক্ষে না বিপক্ষে যাবে। বয়স এবং সামাজিক বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে কী করে সেতু ওর এত কাছে এলো? ওর নিজের ভেতরই কি প্রশ্রয় ছিল না? শূন্যতাও ছিল কি? রিনু ওর হাজব্যান্ডের চেহারাটা বুকের কাছে নিয়ে এলো। কিছু বুঝতে না পেরে সে সেতুর দিকে তাকাল। সেতুর দৃষ্টি বাইরে। রিনু বলল, কাল তুই ভার্সিটিতে যাবি না?
সেতু রিনুর দিকে পলকহীন তাকাল। তারপর বলল, যাব। ক্লাস ঠিকমতো করিস তো? অনার্সে এসে আমার মতো লাড্ডু মারবি না তো? সহজ হয়ে বসল রিনু।
সেতু দাঁড়াল। তারপর দরজার কাছে গিয়ে বলল, দেশের বাইরে চলে যাব এবং কোনো দিনই ফিরব না, লাড্ডু মারলেই কী?
শোনো, রিনু তাকালো সেতুর দিকে, এভাবে কথা বলবে না কখনও এসে, বসো।
সেতু বলল, কী বলবে বলো, দাঁড়ালেও আমার কান খোলা থাকে। গোঁয়ার্তুমি ছাড়, রিনু স্থির কণ্ঠে বলল। ছবি আঁকাও ছেড়ে দিয়েছিলাম মনে হয়? প্রেমে পড়ে এমনভাবে মরে যাওয়া তোমাকে মানায় না।
সেতু হাসে। হাসতেই থাকে, ভালোই জানো দেখছি। মরে যাচ্ছি। নিজের সম্পর্কে শিশুর হন্ত, আমার ব্যাপারে তোমার অতটা ধারণা না থাকাই ভালো। আর আমি আবার ছবি আঁকা ধরব কোন শর্তে, সেটা নিশ্চয়ই নতুন করে বলতে হবে না তোমাকে। কেঁপে ওঠে রিনু। সেতু এসে বসেছে। রিনু ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, তুমি বললেই আমি নির্লজ্জের মতো আমার পুরো শরীর তোমাকে দেখাব- তুমি এতটা আশা কী করে করো?
নির্লজ্জের মতো? সেতু তীব্র কণ্ঠে বলল, তুমি আমাকে চিনতে ভুল করেছ রিনু। শরীরটা আমার কাছে শুধুই শিল্প। এটাতে লজ্জা, নির্লজ্জতার প্রশ্নই আসে না। তুমি আমাকে অতটা ভুল বুঝবে জানলে… আমি যাচ্ছি।
রিনু ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, তোমার আকুলতা হিমালয় হোক সেতু।
রিনুর টিকিট আনার দিন ঘনিয়ে আসছে। রিনুর ভেতরটা ক্রমশ তীব্র অস্থিরতায় ভরে যায়। রিনুর প্রথম প্রেম সেতু। বিয়ের আগেও এমন একটা বন্দিত্বের ভেতর জীবন কাটিয়েছে, যেখানে ইচ্ছে থাকলেও কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবতে পারেনি সে। ভাইজান, স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ জীবনেও ওকে রোজ কলেজে পৌঁছে দিত, নিয়ে আসত। বন্ধুদের সঙ্গে কখনোই কোনো সিনেমা বা অনুষ্ঠানে একাকী যাওয়ার স্বাধীনতা পায়নি সে। বিয়ের পর হাজব্যান্ডকে ভালো করে চেনা-জানার আগেই সে বাইরে চলে যায় এবং তার সঙ্গে একটা হাওয়াই সম্পর্ক চলাকালীনই সেতু এদের পাড়ায় ভাড়াটে হয়ে এসে ওর বুকের ভেতরটা তছনছ করে দিল। রিনু বাথরুমে যায়। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে ওর বুক ঠেলে একটা কান্না বেরিয়ে আসতে চায় চোখ জ্বালা করে। চোখে পানি দেওয়ার সময়ই ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। সেতু এসেছে, ও এলেই রিনুর ভেতরে একটা কবুতর লাফায়। রিনু দেখল ভাইজানের সঙ্গে গল্প করছে সেতু। ভাইজান রিনুর দিকে চেয়ে বলল, ইস তুই চলে গেলে খুব খারাপ লাগবে।
সেতু কিছুই না বলে একটা বই উল্টাতে থাকে। রিনু পাশের রুমে যায়। মা কাপড় সেলাই করছেন। রিনু রান্নাঘরে যায়। কাজের বেটি মসলা বাটছে। রিনু বারান্দায় আসে। ছোট বোনটা কুতকুত খেলার দাগ কাটছে বারান্দায়। রিনু মাকে ডিঙিয়ে আবার ড্রয়িং রুমে যায়। ভাইজান বেরিয়ে গেছে। সেতুর চোখ বইয়ে। রিনু ক্যাসেটের প্লেতে চাপ দিল পংকজ জেগে উঠল। সেতু রিনুর চোখে চোখ রাখল, আজ আমার বাসায় কেউ নেই, তুমি এসো। আকুলতা হিমালয়… বলতে চাইল রিনু। হিমালয় ছাড়িয়ে সেটা আকাশ ছুঁয়েছে রিনু, প্রায় চিৎকারের ভঙ্গিতে বলল সেতু। আমি তোমাকে আবিস্কার করব। বিশ্বাস করো আমার দৃষ্টিতে একবিন্দু অপবিত্রতা থাকবে না। রিনু ঠাণ্ডা চোখে সেতুকে বলল, চলো।
সেতু কাঁপছে। চোখ বুজে শুয়ে আছে রিনু। ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত উদাস শরীরে সেতুর দৃষ্টি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। রিনুর ঠোঁট কাঁপছে, সেতু ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। তারপর সে নতজানু হয়ে বলল, তুমি আমার ভাগ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছ ঈশ্বরের মতো। তুমি এত সুন্দর রিনু। রিনু যেন জমে আছে। সেতুর কোনো কথাই তার মনে গেল না। সেতু চোখ বুজে প্রচণ্ড শক্তিতে নিজেকে ফেরাল, তারপর পাশের রুমে চলে গেল।
রিনু স্বাভাবিক হয়ে ফিরে এলো সেতুর কাছে। তারপর মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। সেতু রিনুর হাত ছুঁয়ে বলল, পৃথিবীতে এত সুন্দর শিল্প থাকতে আমি শুধু শুধুই বনে বনে ঘুরি। শিল্পের সন্ধানে। রিনু তুমি আসলেই… তুমি…।
ক্লান্ত অবসন্ন দেহে সেতু বারান্দায় পা রাখল। রিনু ড্রয়িংরুমে বসে দেখল সেতুর হাতে বড় একটা ক্যানভাস। সেতু আলতো পায়ে এগিয়ে এলো ড্রয়িংরুমের দিকে। রিনু স্থির কণ্ঠে বলল, আমি কালই যাচ্ছি।
আমি জানি সেতু বলল। রিমু সেতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেতু সোফায় বসতে বসতে বলল, তোমার চোখ খুব সুন্দর। রিনু স্থির বসে থাকে। ক্যানভাসটা রিনুর সামনে মেলে ধরে সেতু। একটা ঘন সবুজ বন এবং সেই সবুজের ভেতর একটা সাদা উদোম শরীর মিশে আছে। মেয়েটার হাত চাঁদের শরীর ছুঁতে চাচ্ছে। চোখ বুজল রিনু।
আমার হাজব্যান্ড নতুন করে জানব আমি- রিনু ঠোঁট কামড়ে বলল এবং ওর বুকের প্রতিটি শব্দ নিয়ে ওকে ভালোবাসতে চেষ্টা করব।
সেতু তুমি…।
সেতু ক্যানভাসটা রিনুর হাতে দিল। তারপর ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, তাই করো। আজ থেকে আমি তোমার অস্তিত্বের বাইরে চলে যাব। তোমাকে আর ছুঁতেও আসব না কোনোকালে। তুমি এয়ারপোর্টে যাবে না? রিনুর আকুল কণ্ঠ। ওই সৌজন্যের ভয়েই তো পালাচ্ছি। তুমি যা দিয়েছ তার ভার নিয়ে আজই আমাকে যেতে দাও। রিনু বলল, তবে সমস্ত স্মৃতির মুখে ফুঁ দিই? তুমিও ফুঁ দিয়ে সব সম্পর্কের অস্তিত্ব ভাসিয়ে দিয়ে এত সহজেই ভাসিয়ে দেখা যায় যদি মনে করো তবে রিনুর দিকে তীব্র চোখে তাকাল সেতু, তারপর বলল আগে তুমিও ফুঁ দাও।
রিনু চোখ বুজে সেতুর হাত টেনে নিল ঠোঁটে। ভিজে এলো। সে ঠোঁট দুটো জড়ো করল- ফুঁ। সেতু রিনুর ঠোঁটের বাতাস হাতে পেয়ে সচেতন হলো, সে বিস্ময়ভরা চোখে রিনুর দিকে তাকাল। রিনু সেতুর হাত চেপে ধরল। তুমি ফুঁ দিলে না? সেতু হাত ছাড়িয়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। রিনু প্রায় চিৎকার করে উঠল। সেতু আমি হেরে গেছি সেতু, প্লিজ…।
সেতু বারান্দার বাইরে পা রাখল। রিনু দাঁড়াতে চাইল। কিন্তু অনুভব করল ওর শরীর জমে আসছে। রিনু সেতুর ক্যানভাসে চোখ রাখল, একটা সবুজ বন, উদোম নারীর এবং একটা হাত যে চাঁদের শরীর ছুঁতে চাচ্ছে। রিনু পরাজয় অথবা স্থির অনুভূতির কষ্টে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ততক্ষণে সেতুর নীল জ্যাকেটের ছায়া উঠানের বাঁকে মিলিয়ে গেছে।