শিশিরের শব্দের মতন

কিছু পাখি রাতে ঘুমায় না। রাইসুলের ঘরের ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে রাইসুল একদিন এই কথাটা বলেছিল জিনাত আরাকে। শুনে জিনাত আরা হি হি করে হেসেছে, ‘আপনের মাথামুথা গেছে। হি! হি! হি!’

হি! হি! হি! রাইসুল আহত হয়েছে। মাথামুথা যাবে কেন তার? তখন, তখনই সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তুমি জগতের সেরা সুন্দরী, মিস ওয়ার্ল্ড, কিন্তু তোমারে আমি বিয়া করব না, জিনাত আরা। কোনো দিন না।

ইদরিশ খলিফার মেয়ে জিনাত আরা। আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় ইদরিশ খলিফা ইন্তেকাল করেছে। খলিফার বউ আবার বিয়ে করে চলে গেছে সৌদি আরব না দুবাই। নাখালপাড়ার সাহারা ভাবি বলেছে রাইসুলকে, ‘হেরেমের বান্দী হইছে। হেয় আর ফিরব নি কুনু?’

নাখালপাড়ার সাহারা ভাবি। পত্রিকায় নাম উঠেছে কয়েকবার। মাঝেমধ্যে তার ফ্ল্যাটে যায় রাইসুল। সাহারা ভাবির রহস্যময়ী মেয়েরা, শারমিন, পিয়া, মম, সোনিয়া, রাইসুলকে পছন্দ করে সবাই। জিনাত আরা করে না। একটুও না। ইদরিশ খলিফার মেয়ে জিনাত আরার লোকাল গার্ডিয়ান, এবং খালা এখন সাহারা ভাবি। বলে, আপন বোনের মেয়ে। সত্যি আপন না মিথ্যা আপন, সংশয় আছে রাইসুলের। নিজের বোনকে হেরেমের বান্দী বলে কেউ? জিনাত আরাও একদিন সাহারা ভাবির রহস্যময়ী মেয়েদের একজন হয়ে যাবে হয়তো।

হিন্দি ছবির নায়িকা ক্যাটরিনা কাইফের মতো নাক-নকশা খানিকটা জিনাত আরার। সর্বনাশ হয়েছে এতে। রাইসুলের হার্টথ্রব দীপিকা পড়ুকোন। দীপিকা পাড়ুকোনের ছবি সে মিস দেয় না। ওম শান্তি ওম দেখেছে আটবার, পিকু এগারোবার, চেন্নাই এক্সপ্রেস সাড়ে উনিশবার। মানে একবার অর্ধেকটা দেখেছে। তামাশা এখন পর্যন্ত দেখেছে তেরোবার। জুনিয়র বাবু তামাশা করে একদিন কমেন্ট করেছিল দীপিকা পাড়ুকোনের ফিগার সম্পর্কে। পেনসিল ব্যাটারির মতো ফিগার। জুনিয়র বাবুর একটা চোখ উপড়ে নিতে এবং অর্ধেকটা জিভ টেনে ছিঁড়ে নিতে মনস্থ করেছিল রাইসুল। সেই দীপিকা পাড়ুকোন সম্পর্কে আরও কুকথা বলেছে জিনাত আরা।

‘দীপিকা পাড়ুকোন, ওইটা তো একটা চিকি।’

‘চিকি মানে?’

‘চিকি চিনেন না? হি! হি! হি! চিকা চিনেন তো? চিকা আইল চিকচিকায়া, বামুন আইল লাঠি লইয়া, ধর চিকা, মার চিকা, চিকার দাম পাঁচ সিকা। হি! হি! হি! সেই চিকার বউ চিকি। হি! হি! হি!’

দীপিকা পাড়ুকোন চিকি? তুই চিকি! তোর ধুমসি খালা চিকি! তোর ক্যাটরিনা কাইফ চিকি! মনে মনে দুই শ চৌষট্টিবার চিৎকার করে বলেছে রাইসুল। আছেটা কী? রূপ। তার জন্য এত দেমাগ! অবহেলা করে রাইসুলকে। মশকরা করে দীপিকা পাড়ুকোনকে নিয়ে। ছাদে পাখি হাঁটে বিশ্বাস করে না। এত! কেন?

ঘরের ছাদে পাখি হাঁটাহাঁটি করে। রাইসুলের ঘর বলতে একটা একটেরে চিলেকোঠা। দোতলার ছাদে। পুরোনো দিনের ডাকঘরের মতো রং হলুদ। এবং জীর্ণ। দরজা-জানালার কাঠে ঘুণ ধরে গেছে। ছাদের কিছু অংশ অত্যন্ত করুণভাবে টিন দিয়ে মেরামত করা রয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলের টিন। তবে এটা ভালো হয়েছে। রাত নিশুতি হলে আজব পাখিদের হাঁটার শব্দ শুনতে পায় রাইসুল। শিশিরের শব্দের মতো তারা হাঁটে। টুপটাপ, টুপটাপ। এই যে হাঁটছে।

রাত এখন আড়াইটার কম নয়। শীতকালের রাত। জমাট নিশুতি। কিছু আগে রওশন মঞ্জিলের বিদেশি কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করেছে কয়েকবার। কিছু আগে বিকট শব্দে একটা হিন্দি গান বেজে ওঠেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সব সুনসান। শুধু টুপটাপ। টুপটাপ, টুপটাপ। রাইসুলের ঘরের ছাদে পাখির দল হাঁটছে।

এই পাখিরা নিশাচর না। এরা হাঁটে এদের ঘুম পায় না বলে। রাইসুল কি ফোন করে কথাটা আবার ক্যাটরিনা কাইফ জিনাত আরাকে বলবে? এখন বলবে?

জিনাত আরাও রাতে ঘুমায় না। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রামে থাকে। রাইসুল নেই ওসব কোনোটাতেই। ইন্টারনেট কানেকশন আছে তার আইফোনে। ইউটিউবে দীপিকা পাড়ুকোন এবং আরও নানা কিছু সে দেখে। সময় বিশেষে আবার অফ থাকে তাতেও। অফ আছে এখন।

শুয়ে আছে রেলিং মার্কেট থেকে কেনা উষ্ণতাদায়ক একটা কুইল্ট পেঁচিয়ে। ফুলহাতা শার্ট, হাফ সোয়েটার, ট্রাউজারস, মাফলার পরেছে। শীত কী শীতরে! কনকনে ঠান্ডা। এই শীতেও ঘুম ধরে না ছাদের পাখিদের? শীতও করে না? তারা সেই হাঁটছে। হাঁটছে। হাঁটছে।

রাতের এই পাখিদের কী কখনো দেখেছে রাইসুল? না, তা কেন দেখবে? বিরক্ত করবে কেন এমন কিছু পাখিকে? তার কিছু ক্ষতি তো তারা করছে না। হাঁটে শুধু।

রাইসুল তার মোবাইল ফোন নিয়ে দেখল মিসড কল হয়ে আছে আটটা। মানে কী এর? ফোন তো সে সাইলেন্ট করে রাখেনি। ভাইব্রেশনও দিয়ে রাখেনি। আটটা কল তবে শুনল না কেন? কললিস্ট দেখল। নাম্বার একটাই। অচেনা নাম্বার। কলব্যাক করবে? না।

রাইসুল কল দিল জাহানূর বিল্লাকে। স্কুলজীবনের বন্ধু। পরিবার-পরিজন নিয়ে টাঙ্গাইলে বাস করে এখন। পুলিশেরর এসআই। এবং হলফ করে বলছি, জাহানূর বিল্লা নামক প্রাণীটি কোনো প্রকার ঘুষ গ্রহণের কথা উঠলেই বিমর্ষ হয়ে পড়ে এবং ঘুষ গ্রহণ করতে পারে না। আজব প্রাণী।
ইনসমনিয়া আছে বলে রাতে ঘুমায় না, জাহানূর ‘আজব’ বিল্লা কল ধরল। নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘বল’।

‘জাহানূর?’

‘বল। ঘুম ধরে না?’

‘না। আমার ঘরের ছাদে পাখি হাঁটে।’

‘কী পাখি?’

‘বলতে পারব না।’

‘কয়টা পাখি?’

‘বলতে পারব না।’

‘তাহলে আর কী করে হবে? কী পাখি, কয়টা পাখি, বলতে পারলে না হয় কথা ছিল একটা।’

‘কোনো কথা ছিল নারে, ভাই।’

‘অ। আইনুলের বউ শুনলাম আবার প্রেগন্যান্ট।’

কী কথার মধ্যে কী কথা! এই হলো জাহানূর বিল্লা।

রাইসুল বলল, ‘ঘরের ছাদে পাখি হাঁটে। শিশিরের শব্দের মতন। টুপটাপ, টুপটাপ। আমার মাথা আউলা হয়ে যায়।’

‘অ’।

‘অ! এটা একটা সিগন্যাল, জাহানূর।’

‘অ। রেলওয়ে না হাইওয়ে ট্রাফিকের?’

‘মৃত্যুর।’

‘তুই এত সহজে মরবি না।’

‘কেউ তো মরবে।’

‘তাতে তোর কী? তুই বরং কী পাখি চেনার চেষ্টা কর। কয়টা পাখিশুমারি করে দেখ। তোর ছাদে তারা কেন হাঁটবে?’

‘কেউ মরবে বলে।’

রাইসুল হাসল।

জাহানূর বিল্লা বলল, ‘তোর মাথা এখনো ঠিক হয় নাই?’

না, এখনো ঠিক হয়নি। কী করে হবে? কাল দুপুরের কিছু পর থেকে শোকার্ত থাকবে পুরান ঢাকার একটা মহল্লা। শোকসংবাদ প্রচারিত হবে মহল্লার মসজিদের মাইকে। পুলিশের গাড়ি ঢুকবে মহল্লায়। হত্যাকাণ্ড। উপস্থিত হবে টিভিওয়ালা, পত্রিকাওয়ালা, অনলাইনওয়ালারা।
পাখিরা হাঁটছে। টুপটাপ। টুপটাপ। জাহানূর বিল্লা শুমারি করতে বলেছে। এত দিনে এখন হঠাৎ এই পাখিদের সংখ্যা ধরতে পারল রাইসুল। বিরক্ত হলো। আরও আগে ধরতে পারেনি কেন ব্যাপারটা? এত সহজ! প্রথম তো একটা পাখি হাঁটত। তারপর দুটো। তারপর তিনটে…। এখন আঠারটা পাখি তার ঘরের ছাদে হাঁটছে। নিশ্চিত রাইসুল। কাল রাত থেকে উনিশটা হাঁটবে। হাঁটুক।

বিন্দুমাত্র টেনশন হচ্ছে না রাইসুলের। কখনো হয় না। নিশ্চিন্তে পাখিদের হাঁটার শব্দ শুনছে সে। খুঁচরো-খাচরা কিছু চিন্তা আসছে মাথায়। জাহানূর বিল্লাকে আবার কল দেবে নাকি? জিনাত আরা কী করে এখন? ঘুমায়? কল দিল রাইসুল। জিনাত আরার ফোন বিজি। আবার কল দিল। আবার বিজি। আবার। আবার।
রাইসুলের মোবাইল ফোনের পিকচার গ্যালারিতে তেইশটা ছবি আছে জিনাত আরার। মাঝেমধ্যে সে বের করে দেখে। আর দেখবে না। ডিলিট করে দিল। জিনাত আরার নাম্বার? থাক আপাতত।

জিনাত আরা জানে রাইসুল কী?

সাহারা ভাবি বা তার রহস্যময়ীরা?

জাহানূর বিল্লা?

ইকোনমিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছে। কী হওয়ার কথা ছিল রাইসুলের? ব্যাংকের কর্মকর্তা? পুলিশের এসআই? ড্রয়িংয়ের শিক্ষক? ড্রয়িংয়ের শিক্ষক! হা! হা! হা! কীসব চিন্তা যে আসে মাথায়। এত থাকতে ড্রয়িংয়ের শিক্ষক হতে যাবে কেন রাইসুল? কাকের ঠ্যাঙ বকের ঠ্যাঙ কিছুও আঁকেনি জীবনে। আচ্ছা, সে যদি মেক্সিকোয় জন্মাত, রিভেরা কী এসকোবার নাম হতো তার, কী হতো সে? আর কিছু? না মনে হয়। কাল যা ঘটবার তা ঘটবেই। এটা সে মেক্সিকোতে থাকলেও ঘটত। রুয়ান্ডা, সেনেগালে থাকলেও ঘটত।

আঠারোটা পাখির হিসাব আরেকটু। সতেরোটা পাখি। একটা পাখিনী। করপোরেট অফিসের রূপবতী সিইও। পাখি হয়ে গেছে। কম হইচই হয়নি মিডিয়ায়। বাংলাদেশ ফেসবুক সোসাইটি শোকসন্তপ্ত ছিল কিছুদিন। তাতে কি আর খুনি ধরা পড়ে? ধরা পড়েনি।

শুয়েছিল, শোয়া থেকে রাইসুল উঠল। ড্রয়ার খুলে মেশিনটা দেখল। ছয় হাজার টাকা ভাড়া দিনে। কাটাসুরের শিয়াল জোহা ভাড়া দেয়। এটা একটা বেরেটা অটোমেটিক। সেফটি ক্যাচ অফ করল রাইসুল। ছাদে তাক করল। পাখিরা হাঁটছে। টুপটাপ, টুপটাপ। শীত শুধু? বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্তের সব রাতে তারা এ রকম হাঁটে। হাঁটবে। রাইসুল যত দিন আছে তত দিন। সেটা কত দিন? রাইসুলের বয়স এখন উনত্রিশ। কাল রাত থেকে উনিশটা পাখি তার ঘরের ছাদে হাঁটবে। বিশ নম্বর পাখিটা যদি সে হয়? হতেই পারে। প্রফেশনাল সে। অতএব, নিশ্চিত না একটা সেকেন্ডও। পাখির কারিগর পাখি হয়ে যাবে একদিন। যায়। এটা নিয়ম। তবে?

টুপটাপ, টুপটাপ।

তারা হাঁটছে।

তারা কারা?

কিছু পাখি।

কিছু আফসোস হলো রাইসুলের। কালকের পাখির ছবি আছে তার ফোনে। দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে। তা-ও এখন আবার দেখল। অল্পবয়স্ক, মায়াকাড়া চোখ-মুখ। প্রাইভেট পড়ায় যে হান্ডুল-বান্ডুল মেয়েকে, তার বাপ ডিমান্ড দিয়েছে রাইসুলকে। ফুল অ্যাডভান্স। কী করতে পারে রাইসুল? আরেকটু আফসোস? করে কী হবে? কিছু মানুষ তো পাখি হতেই জন্মায় এবং পাখি হয়ে যায় একদিন। তারপর? রাইসুল বা আর কারওর ঘরের ছাদে হাঁটে। টুপটাপ, টুপটাপ। শিশিরের শব্দের মতন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত