প্রত্যাখ্যান

প্রত্যাখ্যান কথাটা এসেছে প্রতি+আখ্যান থেকে। আখ্যান বা কাহিনীবিরোধী জিনিস হলো প্রত্যাখ্যান। আমি গল্পকার। আমি আখ্যান লিখে খাই। আজকে আমাকে আখ্যানের বিরোধিতা কি করতে বলা হয়েছে?

আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, ঘটনা উল্টো। আমাকে কাহিনীই বলতে বলা হয়েছে, যে কাহিনী প্রত্যাখ্যানের। সেটা নিশ্চয়ই চাকরি চেয়ে পাঠানো দরখাস্ত প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, সেই বিষয়ে নয়। কিংবা আমার পাণ্ডুলিপি কত প্রকাশক কতবার ফিরিয়ে দিয়েছেন, সেই কাহিনীও আমার কাছ থেকে কেউ শুনতে চায় না। লোকে শুনতে চায়, আমি প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে কতবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছি।

কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরে আমি যা বলব, কেউ তা বিশ্বাস করবে না।

আমার প্রেমের ব্যাপারে সার্থকতা ১০০ ভাগ। আমি যত বার প্রস্তাব দিয়েছি, ততবারই সফল হয়েছি। আমার কোনো প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ইতিহাস নাই।

আপনারা কি কথাটা বিশ্বাস করলেন? এটা কি হতে পারে যে, আমি জীবনে কখনো প্রত্যাখ্যাতই হই নাই?

আপনাদের বলছি, কথাটা বিশ্বাস করুন। আমি প্রত্যাখ্যাত হই নাই, কারণ আমি আসলে প্রস্তাবই দিই নাই। একজনকে দিয়েছিলাম, আমি তার সঙ্গেই আছি- এখনো। দোয়া করবেন, যেন সুখী হই। অবশ্য সক্রেটিসের মতো বলা যায়, বৎস, তুমি নিশ্চিন্তে বিয়ে করো, হয় তুমি সফল হবে, তা না হলে আমার মতো লেখক হবে।

কিন্তু এটা কি কোনোদিনও সত্য হতে পারে, যে আমি জীবনে মাত্র একজনকে প্রস্তাব দিয়েছি?

আজকালকার ছেলেমেয়ে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি জিনিসটা ব্যাখ্যা করলে হয়তো মেনে নিতেও পারে।

আমরা বড় হয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের মতোই, নারীবর্জিত পৃথিবীতে। মেয়েদের সঙ্গে দেখাই হতো না, প্রস্তাব করব কাকে?

দুই, আমরা ছিলাম ঘোরতর রোমান্টিক। মানে, বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়, দূরপ্রেমিক। আমরা যা নাই তার প্রেমে পড়তাম। যা আছে, তার প্রেমে পড়তাম না।

বুদ্ধদেব বসুর শার্ল বোদলেয়ার বই থেকে একটা কোটেশন আমি সুন্দর বড় হরফে লিখে আমার হোস্টেলের দরজায় লিখে রেখেছিলাম।

আমার মন ভালো নেই।

কেন?

সে কি আমি জানি?

আমি একজনকে ভালোবাসি।

কাকে?

কী করে বলব? তাকে কি আমি দেখেছি?

যাকে দেখিনি, আমরা ছিলাম তার প্রেমিক। যাকে দেখেছি, তার প্রেমে পড়বার মতো নন-রোমান্টিক তথা রিয়েলিস্টিক আমাদের আমলে অল্প লোকই ছিল।

তাই আমরা যাকে দেখিনি, তাকে ভেবে ভেবে কবিতা লিখতাম।

আমিও কবিতা লিখে ফেললাম। আমার ছাত্রজীবনে।

তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার দুঃখ হবি?

এই আমি এক উড়নচণ্ডী আউলা বাউল

রুখো চুলে পথের ধুলো

চোখের নিচে কালো ছায়া।

সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।

তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার শুস্ক চোখে অশ্রু হবি?

মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?

তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর

নির্জনতা ভেঙে দিয়ে

ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে

ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?

একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা

কেমন যেন বিষাদ হবি?

তুই কি আমার শূন্য বুকে

দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?

নরম হাতের ছোঁয়া হবি?

একটুখানি কষ্ট দিবি?

প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়

কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?

একটুখানি কষ্ট দিবি?

তুই কি একা আমার হবি?

তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?

এই কথা কাউকে সরাসরি বলার মতো সাহস আমাদের ছিল না। আশেপাশের কাউকে ঠিক যোগ্য বলে মনেও হতো না। আবার যাদের যোগ্য বলে মনে হতো, নিজেকে তাদের নখেরও যোগ্য বলে মনে হতো না।

তবুও বহু সাহস সঞ্চয় করে একজনকে বলে ফেললাম।

আমার খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে নামের কবিতায় সে দৃশ্যের বর্ণনা আছে।

এই তো সেইদিন হলুদ বিকেলেতে তুমি তো এসেছিলে সুষমা;

শাহানা নাম নিয়ে, যেন বা সঙ্গীত, নষ্ট কোলাহল উজিয়ে।

মফস্বল নামে যে আজো অধোমুখী সেই সে শহরের প্রান্তে

একটি ছোটবাসা, ছোট সে নিশ্চয়, তুমি তো এসেছিলে সেখানে।

বিংশ শতকের শেষের প্রান্তিকে আবার যদি দেখা দুজনায়,

হাজার বছরের তৃষষ্ণা চোখে নিয়ে তোমাকে পাঠ করি মুগ্ধ।…

শাহানা, মনে পড়ে, একদা রাস্তায় হেঁটেছি পাশাপাশি দুজনে?

শাহানা, ভুলে গেছ, কে লিখে হৃদধ্বনি দিয়েছে নাম তার পদ্য?

আমার এই কবিতা বুয়েটের কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছিল। মহাদেব সাহা ছিলেন বিচারক। পরে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তোমার ওই লাইনটা সব কবির বেলাতেই সত্যকে লিখে হৃদধ্বনি দিয়েছে নাম তার পদ্য। আমরা সবাই হৃদয়ের কথা লিখি, আর সেটাকে নাম দিই কবিতা।

যাই হোক, একটা বালিকাকে রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলাম, মফস্বল নামক এক শহরে, তুই কি আমার দুঃখ হবি?

সে বলল, সে কী করে হয়?

আমি বুঝলাম, এর নাম প্রত্যাখ্যান।

এখন আমাকে কবিতা লিখতে হবে।

ব্যস, পাতার পর পাতা কবিতা লিখে ফেললাম। কবিতা লিখে লিখে খাতা ভর্তি করে ফেললাম।

তো বহুদিন পরে সেই বালিকার দেখা পেয়েছিলাম। তিনি আমাকে ফোন করলেন। বললেন, কাগজে একটা জিনিস ছাপাতে হবে। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এতদিন পরে, আকাশের দেবী মর্ত্যে নেমে আসবেন।

তিনি এলেন।

নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলি, বাসন্তী, সেই বাসন্তী, ডাকাত স্বামীর ঘরে পাঁচ সন্তানের জননী হয়েছে।

তা হয়নি। ভদ্রস্থ স্বামী। ভদ্রস্থ চাকুরে ভদ্রমহিলা।

আমার কল্পনায় ছিল, ষোল বছরের কিশোরী আসবে আমার সাথে দেখা করতে। কিন্তু এলেন ৪৫ বছরের এক নারী।

তিনি তার প্রেস রিলিজ দিলেন। আংকেল, এটা ছেপে দেবেন।

হায় হায়, বলে কী! আংকেল!

আমি বললাম, তোমাকে যে আমি প্রোপোজ করেছিলাম, তুমি রাজি হওনি কেন?

তিনি বললেন, কবে প্রোপোজ করলেন! আমার কিছু মনে নাই তো।

আমি আর কথা বাড়ালাম না।

তোমাকে না পেয়ে তোমাকে না পাওয়ার বেদনা ভরে ভরে কবিতা লিখে আমি কবি হয়ে গেলাম। শুধু তুমি আমার কবিতা পড় না।

তিনি বললেন, না না; আমি আপনার লেখা পড়ি তো।

তার জীবনের গল্প শুনলাম। তাতে বুঝতে পারলাম, আমি যদি কবিত্ব না করে ঠিকঠাকভাবে প্রোপোজালটা দিতে পারতাম, তাহলে ঘটনা ঘটে যেতে পারত।

তাহলে আর যা-ই ঘটুক না কেন, আমার আর কবিতা লেখবার দরকার পড়ত না। ভাগ্যিস, আমি সরাসরি তাকে প্রোপোজ করিনি! আর ভাগ্যিস ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক হয়নি। তা না হলে আমার কবি হওয়াই তো ঘটত না।

এই গেল আমার একমাত্র প্রস্তাব আর একমাত্র প্রত্যাখ্যানের কাহিনী।

এর পরে ভয়ে আমি আর কোনোদিন কাউকে প্রস্তাব করিনি। মানসম্মানের ব্যাপার।

বড় হয়ে করলাম। বললাম, তোমারও বয়স হয়েছে, আমারও বয়স হয়েছে, এসো আমরা বিয়ে করে ফেলি।

তিনি বললেল, করা যেত, যদি তুমি ইঞ্জিনিয়ার হতে। আমার বাবা-মা নিদেনপক্ষে ইঞ্জিনিয়ার জামাই না পেলে রাজি হবে না।

কী আর করা! বিসিএস দিয়ে রেলওয়েতে সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী পদে যোগ দিতে হলো।

এক মাসের বেতন তুলে পালিয়ে এলাম।

বিয়ের পরে অনেক বই বেরিয়েছে। বুঝতেই পারছেন, ভালো আছি। সক্রেটিস বলেছিলেন…

এর বাইরে একবার এক পেঁপেওয়ালা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই গল্প আমি আগেও করেছি।

হাতিরপুল বাজার। আমি বললাম, পেঁপে কত?

বলল, আশি টাকা।

আমি বললাম, সত্তর টাকা।

বলল, নেন।

আমি টাকা বের করতে করতে বললাম, কেজি কত করে?

বলল, ষাট টাকা।

ওজন দাও তো।

ওজন দিল। দুই কেজি। বলল, একশ বিশ টাকা হয়েছে।

আমি হেসে বললাম, আচ্ছা ওজন করে নেব না। এমনিই পিস হিসাবে নিই। নাও, তোমার সত্তর টাকা নাও।

পেঁপেওয়ালা বলল, আপনি ওজন করাইলেন কেন? আমারে অহন ১২০ টাকাই দেওন লাগব।

আমি হাসলাম।

সে বলল, আপনারে আমি পেঁপে বেচুমই না। আপনে যান।

আমি অপমান হজম করে চলে এলাম।

এর বাইরে আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছি বহুবার রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে। এই রিকশা যাইবেন?

না, যামু না।

যত ভাড়া চাও তত দেব।

না, যামু না।

একটু পরে আরেকজন এলেন। এই খালি, যাইবা?

কই যাইবেন?

আরে, আমাকে নিল না! একে নিচ্ছে; ব্যাপার কী?

এই ব্যাপার আমি কোনোদিনও বুঝলাম না।

এই রকম রিকশাওয়ালা, পেঁপেওয়ালা কেস ছাড়া আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছি কম।

কোনো দেশ কোনোদিন আমার ভিসা রিজেক্ট করেনি।

তবে কবিতা ছাপেননি, এমন প্রচুর সম্পাদক আছেন। এরা এখন আমার বাসায় আসেন। আমার লেখা চান। আমি চা-নাশতা খাওয়াই। খুব খাতির-যত্ন করি। কখনো বলি না- ভাই, আপনি কিন্তু আমার কবিতা বহুদিন ছাপেননি…।

বাংলাদেশে কোনো প্রকাশক কোনোদিন আমার কোনো পাণ্ডুলিপি ফেরত দেয়নি।

বিদেশে আমার পাণ্ডুলিপি বড় প্রকাশকেরা গ্রহণ করেননি। করলে, এতদিনে আমার অনেক অনূদিত বই বেরুত। আবার নানা ভাষায় আমার বই বেরুচ্ছেও। আরো বেরুবে। আগামী বছর বিগ নিউজ পাবেন।

নাটকের পাণ্ডুলিপি থেকে টিভি নাটক করার জন্য অনেক জায়গায় যেতে হয়েছিল বটে।

তবে শেষ পর্যন্ত সেই পাণ্ডুলিপি থেকেও টিভি নাটক হয়েছে।

বহু বড় লেখকের পাণ্ডুলিপি বহুবার প্রকাশকেরা ফিরিয়ে দিয়েছেন। স্যামুয়েল বেকেটের পাণ্ডুলিপি নাকি কয়েক ডজন বার ফেরত দিয়েছিলেন প্রকাশকেরা। শেষ পর্যন্ত তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

তার অমর বাণী্ত- শিল্পী হওয়া মানেই ব্যর্থ হওয়া আর শিল্পমাত্রই ব্যর্থতার বশংবদ।

আপনি যদি শিল্পী হন, আপনি ব্যর্থ হবেন। আর আপনি যদি ব্যর্থ হন, আপনার দ্বারা শিল্প হবে।

প্রত্যাখ্যান নয়, প্রত্যাবর্তনের লজ্জা শীর্ষক আল মাহমুদের কবিতাটা আমার খুব প্রিয়।

প্রত্যাবর্তনের লজ্জা

শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি

নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ

দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।

যাদের সাথে, শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ

জানালায় উপুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

….

….

বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেললেন।

ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে

ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ

ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।

আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে

ঘষে ঘষে

তুলে ফেলবো।

আসলেই। প্রত্যাবর্তনের লজ্জা আছে। প্রত্যাখ্যানেরও আছে। কিন্তু মায়ের কাছে কোনো লজ্জা নেই।

অন্যদিকে প্রেমে পড়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রেমে পড়লে মানুষ প্রস্তাবও করে বসতে পারে। কিন্তু প্রস্তাব করলেই যে তাতে ইতিবাচক সাড়া মিলবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এটাকেও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ধরে নিতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোঝাপড়া কবিতায় বলেই দিয়েছেন

‘সবার তরে নহে সবাই।’

সবাই আমার জন্য না। আমিও সবার জন্য না। তাই? ‘মনে রে আজ কহ যে, ভালোমন্দ যাহাই আসুক, সত্য রে লও সহজে।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত