আউটডেটেড মাইয়া বললে যা বোঝায়, আমি সেই রকম একটা জিনিস। মানে টিএসসিতে বড় বড় টিপ পরা মেয়েদের মধ্যে তাকাইলে আপনি আমারে আলাদা করতে পারবেন না। কারণ টিপ আমিও পরি। টিপ পরলে আমারে সুন্দর লাগে, আমি সেইটা জানি। আর যারা কবিতা আবৃত্তি করে, তাগো একটু টিপ পরে থাকতে হয়। সঙ্গে চেইন খোলা ব্যাগ। জিন্স থাকতে পারে, পালাজ্জোও থাকতে পারে। আর সাদামাটা জামা। চেহারাটা তাদের মধ্যে এমন একটা ভাব আনে, যাতে তাদের এক দেখাতে বইলে দেওন যায়, ‘হয় তুমি চারুকলায় পড়, না হয় তুমি টিএসসিতে ঘুর ঘুর কর।’
যাক গা সেই কথা! আমি যা কইতেছিলাম। আমি আউটডেটেড। টিপ, জিন্স পইরেও আউটডেটেড। ডেইলি কবিতা আবৃত্তি কইরে বাইর হইয়া আমি যাদের সঙ্গে চা খাই, তারা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, নীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুইল্যা খাইছে। আমি এইখানে কবিতা শেখার আগে কোনোদিন এই একজনের নামও শুনিনি। এখন যখন আমার দিকে লক্ষ্মীট্যারা চোখে তাকাইয়া মনামি আপা কয়, ‘ডানা, তোমার কাছে পোস্ট মডার্নিস্ট কবিদের ভাষার ব্যাপারটা শুনতে চাই। আমরা যারা প্রমিত ভাষায় আবৃত্তি করি, তারা কি ওই কবিতাগুলো আদৌ আবৃত্তি করতে পারব?’ তখন আমি আর কিছু না পাইয়া চায়ের চিনিতে পিঁপড়া খুঁজি। অনেক কালো পিঁপড়া সেলিম মামার চায়ে। যা তা!
আমি কবিতা আবৃত্তি করার ধারের-কাছেও নাই। আমি টুকটাক রান্নাবান্না পারি আর ওই রান্নার রেসিপি লিখতে পারি। গত উইকে আমার পাঁচ পদের মাছ ভর্তার একটা রেসিপি ছাপানো হইছিল এক দৈনিক পত্রিকার ফিচারে। রেসিপি লিখি, ফেসবুকে পিজ্জা রাইন্ধে পিজ্জার ছবির শেয়ার দেই, গ্রুপ চালাই, ব্লগ চালাই। গার্লস গ্রুপের আপ্পিরা আইসা সাজেশন চায়, ‘আমার হাবির আজ মন খারাপ। ওকে একটু চালতার আচার করে খাওয়াব। ডানা আপ্পি, আমাকে রেসিপিটা বলবে?’ আমি প্রিয় ডানা চৌধুরী ওদের রেসিপি লেইখ্যা দিয়া হাজার হাজার লাইক কামাই।
আমার হঠাৎ শখ হইল ইউটিউবার হওয়ার। রান্নাবান্না নিয়া ইউটিউবে গিয়ে কথা কমু। কিন্তু আমাদের ২৪ বছরের পুরানো ঘুপচি রঙ ওঠা বাড়িতে কোনো স্টুডিও করার মতো জায়গা নাই। আমার জামাতপন্থি পিতা ক্যামেরা দেখতে পাইলেই আমারে দাবড়ানি দিবে। আমার আম্মাজান কাইন্দে দিবে এক দফা, ‘মেয়ের একটা ভালো জামাই পাচ্ছে না’ বইলা। আমার মুখরা ভাবিজান আমারে শুনায় কবে, ‘আর কত মুটি হইবা? পোলা দেখলে তো পালায়!’ এই সমস্যায় ডুইব্যা যখন মারা যাচ্ছিলাম তখন মুশকিল আসান পাইলাম শিহাব’স স্টুডিওতে। শিহাব ভাই আমার শুট কইরা দিবে, সব কইরা দিবে। তার একটাই অনুরোধ- তার ইউটিউব চ্যানেলেই কেবল আমার ভিডিও যাইবে। আমি আমার নিজের কোনো চ্যানেল খুলতে পারব না। আমি মাইনা নিলাম। মাইনা নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না!
প্রথম ভিডিওর ভিউ তরতর কইরা বাড়তে লাগল। আমাকে শিহাব ভাই ট্রিট দিল ধানমণ্ডির গুহায়। আন্ধার রেস্তোরাঁয় আমার হাত চাইপে ধরল সে। কইল, আমার ভিতর নাকি অনেক কিছু আছে। খালি কাজে লাগাইতে হবে।
আমিও বেচাইন হইয়্যা গেলাম। আগপিছু না ভাইবে পরদিন সোজা শিহাব ভাইয়ের কবিতার দল ‘কবুতর’-এ যোগ দিয়া দিলাম।
২.
কবুতর আর শিহাব ভাইয়ের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নাই। কবুতর যেমন শান্তশিষ্ট পাখি, ডাঁট নিয়ে চলে। শিহাব ভাইও তাই। কবুতরের মতোই সুন্দর একটা পাখি সে। শিহাব ভাইয়ের রূপ, গুণ, ক্যামেরা চালানো, ভিডিও এডিট করা নিয়ে আমার কোনোই সন্দেহ ছিল না। আমার শুধু সন্দেহ ছিল একটা বিষয়ে- কেন সে আমারে এতো পাত্তা দেয়?
ইউটিউবের চ্যানেলে মিলিয়ন খানেক ভিউ হইল ‘মেজবানি রান্নার আয়োজন’ ভিডিওটা। এর পরেই একটা টিভি চ্যানেল আমাকে অফার দিল রান্নার প্রোগ্রামের। আমিও রাজি হইয়া গেলাম নিশ্চিন্তে। আমার বাসায় টিভি নাই। ওয়াজ শুনা পিতার কোনো সমস্যা হইব না। বোরকা পইরে বের হই, বোরকা পরেই ঘরে ঢুকুম! মাঝের সময় বাপের আমারে দেখার দরকারটা কী!
বাপ অবশ্য আমাকে বোরকা ছাড়া দেখলেও চিনতে পারব না। কারণ জামাত বাপের সাথে আমার একবেলাও ঠিকমতো কথা হয় না। যেদিন থেকে তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চিন্তাভাবনা বোঝা শুরু করছি, সেদিন থেইকা বাপরে মনে মনে বয়কট করছি। বাপ সে কথা জানে না। মাও জানে না। কেবলমাত্র শিহাব ভাইরেই বিষয়টা কইছি।
আমি যেদিন অনেক টাকা কামামু। এই বাড়ি ছাইড়ে, বাপরে দেখাইয়্যা আমি চলে যামু।
৩.
কই থেকে কই আইলাম! আমি বরাবরই বাচাল।
কবুতর টিমটা প্রতি শুক্র-শনি টিএসসিতে বইসা কবিতা চর্চা করে। রবিঠাকুর থেকে রুদ্র গোস্বামী পর্যন্ত কবিতা নিয়া তারা গল্প করে। আর মাসে দুই একটা প্রোগ্রাম করে এখানে সেখানে। আমার চার মাস হইতেছে কবুতর টিমের সঙ্গে। এখানে আসলে শিহাব ভাই কেমন লিডার লিডার ভাব দেখায়। ঝাঁকড়া চুল আরও কয়েক গুণ ঝাঁকাইয়া কবিতা আবৃত্তি করে। সন্দেহ নাই- সে ভালো আবৃত্তিকার। মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে প্রোগ্রামে ডাক পায় সে। কবুতর দলে আমি আমার শিহাব ভাইরে চিনি না।
স্টুডিওতে এই শিহাব ভাই-ই আবার অন্যরকম। একদম কিছুই জানে না রান্না নিয়ে- এমন ভাব করে। বোকা বোকা স্ট্ক্রিপ্ট তৈরি কইরা ফেলায়। আর আমি সেইটা নিয়া হাসাহাসি করতে গেলেই ধাম কইরা আমার ঠোঁট চেপে ধরে, ঠোঁট দিয়ে। এই কথাটা আমি কাউরে কইনি। বেশ ক’বার আমার ঠোঁট কালো করে দিছিল সে। বোরকার নিচে মুখ ঢাকা থাকে বলে কেউ সেইগুলা দেখেনি। আচ্ছা, দাগগুলারে কি লাভ বাইট কয়? মনামি আপারে জিজ্ঞেস করতে হবে!
৪.
টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম করার পর যা হইলো, লোকে আমায় ভালো কইরে চিনল। তবে বেশিদিন আমি চালাইতে পারলাম না। আমার ভাগে ছিল দশ পর্ব। পাঁচ পর্বের পর প্রথম পেমেন্ট, পরের পাঁচ পর্বে পরবর্তী পেমেন্ট। আমি সর্বসাকল্যে তিনটা শো’র পেমেন্ট পাইলাম। তাদের লস যাচ্ছে কইল। কাইজ্জা করে লাভ কী? মাইনে নিলাম!
শিহাব ভাই আমার রেসিপি-টেসিপি কিছুদিন অফ রাখবে জানাইলো। সে এখন অন্য লাইফ স্টাইল শো শুরু করছে। ‘মেকাপ দ্রুম’। মেকাপ নিয়ে দশ-বারো পর্বের পর আবার আমার রেসিপি ধরবে। আমাকে কইছে নতুন কিছু এলাকাভিত্তিক রান্নার স্ট্ক্রিপ্ট তৈরি কইরা রাখতে। যেমন চুইঝাল-গরু, সাতকড়া দিয়ে গরু ইত্যাদি। আমি সুন্দর করে স্ট্ক্রিপ্ট তৈরি করি। রান্ধি। কবুতরে যাই। বাসায় ফিইরা গার্লস গ্রুপে পোস্ট দেই, ‘আপুরা, আমার মন খারাপ। তোমাদের?’
৫.
কাম-কাজ যেহেতু নাই, টুকটাক কবিতার বই পড়া শুরু করছি জীবনানন্দ দিয়ে। জীবন বাবুর লেখা ‘প্রেম মরে আসে’ পইড়া আমার প্রেম আরও জাগে। আমি বুঝতে পারি, আমি শিহাব ভাইরে সাবমেসিভ টাইপ ভালোবাইসা ফেলছি। এই ভালোবাসার এ-কূল ও-কূল দু-কূল নাই।
কবুতরের আড্ডা শেষে চা খাওয়ার সময় আলাদা করে শিহাব ভাইরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছে নিয়ে গেলাম।
মাথা নিচু করে আছি, উপরের ঠোঁট কামড়াই আছি। আর সে জিজ্ঞেস কইরাই যাচ্ছে, ‘কী হইছে, ক?’
অনেকক্ষণ পরে মাথা তুইলা কইলাম, ‘আপনার প্রেমে পড়ছি ভাই।’
শিহাব ভাই যেমনে হাসল মনে হইলো, তার হাসির চোটে উদ্যানের অগ্নিশিখা নিইভ্যা যাবো। সে যা বলল তা হইল, বিয়া-শাদি তার ইচ্ছায় নাই! যদি প্রেম করতে চাই তো করতে পারি!
আমি ব্যাক্কল হয়ে গেলাম। এতো সহজে সোনার হরিণ পাইয়া যাব, বুঝি নাই। বিয়ে-শাদির সাইড অ্যাফেক্টে আমিও বিয়েতে যামু না- মনস্থির করছি। কিন্তু প্রেম! কবুতর প্রেমে পড়ল তার ডানার? হা! হা!
৬.
সপ্তাহে চার দিন এইখানে সেইখানে ডেট করতাম। প্রথম সেগুনবাগিচা ঘোরা শেষ করলাম। এর পর পুরান ঢাকা, এর পর ধানমণ্ডি, এর পর যাত্রাবাড়ী। ঢাকার সব জায়গা ঘুইরা ভৈরব-সিলেট শুরু হইলো! একদিনে যেসব জায়গায় যাইয়্যা আসা যায় সেগুলোতে ঘুরলাম। কারণ আমার বাড়ির বাইরে রাইত কাটানো আর ট্রেনের নিচে মাথা দেওয়া এক কথা।
হোটেলে গিয়ে জামাই-বউ পরিচয় দিতে অনেক আনন্দ লাগা শুরু করল। মাঝে মাঝে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে হোটেলওয়ালা তাকাইলে আরও মজা পেয়ে ‘ওগো’ বলে রিসিপশনেই ঢলাঢলি শুরু কইরে দিতাম। মজা লাগত কনডমের দোকানে গিয়া কনডম কেনার সময়ে। মজা লাগত তখন, যখন ফাইভ এক্স পিল ফার্মেসির লোক মুড়াইয়্যা দিত।
উদ্দাম, জামাত বাপের ভাষায় ‘নাজায়েজ’ প্রেমে আমি ততোধিক জইমা যাইতে লাগলাম। আমার সারা শরীরে জমা হইতে লাগল শিহাব ভাইয়ের লাভ বাইট। আমার গায়ে, জামায় শিহাব ভাইয়ের পারফিউমের গন্ধ লাইগা থাকত। মুখে ঢুইকা থাকত তার ঝাঁকড়া চুলের এক দুই টুকরা।
৭.
হোটেল মায়াবী। রুম ২০৩-এ। আমরা শুইয়া আছি কম্বল গায়ে। শিহাব ঘুমে কাদা। ওর ফোনের ডাটা নিয়ে হটস্পট চালু করতে গিয়া একটা জায়গায় চাপ পইড়া গেল। মনাপি আপার আইডি আইল। কী মনে কইরা, ওপেন কইরা দেখি মেসেজ। শিহাব মনামি আপারে দিছে, ‘বুকের দাগটা গিয়েছে?’ আরেকটু পিছাইলে দেখি রগরগে ভাষায় চ্যাট করতেছে দুইজনে। আমার মাথা খারাপ হইয়া গেলো। ‘ওই কুত্তা, উঠ’ বলে শিহাবরে উঠাইলাম।
মেসেজ দেখাইতে গেলে শিহাব আমারে উল্টা প্রশ্ন করে, ‘কেন আমার মেসেজ দেখছিস তুই?’ আমার প্রশ্নের কোনো রিপ্লাই না দিয়া, হোটেল মায়াবীর বিলটা না মিটাইয়া সে বের হইয়্যা গেল। সন্ধ্যা ৭টা বাজে ঘড়িতে।
আমি মনামি আপারে ফোন দিলাম। বিজি পাইলাম। একটু পর মনামি আপা ব্যাক করল। আমি যা যা হইছে সব কইলাম মনামি আপারে। আপা জানাইলো, ‘এগুলো নিছক মজা! তোর সঙ্গে কি ওর বিয়ের কমিটমেন্ট হইছে? তাইলে তুই এত চ্যাতস কেন?’
আমি বড় টিপ পরা জিন্স পরা মেয়ে আর কথা বাড়াইলাম না। সেকি! আমারে সেন্টিমেন্ট হলে হইব কেন? আমার প্রেমিকের এইসব মজা আমার মাইন্যা নিতে হবে!
৮.
কবুতরে আইলাম পরের সপ্তাহে। এর মধ্যে তিন মিনিট কথা হইছে শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে। তাও হাজার ব্যস্ততার মাঝে। কবুতরে গাঞ্জাটাঞ্জা টানলাম সবাই মিলে। এরপর আলাদা করে আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়া গেলাম ওরে।
সেদিন রাতে তোমার মেসেজ পড়া উচিত হয়নি।
হুম, বুঝতে পারছিস বলে ধন্যবাদ।
আমার অনেক খারাপ লাগতেছে শিহাব ভাই।
তুই মজা বুঝস না? মনামির সঙ্গে আমার দুষ্টুমির সম্পর্ক।
সত্যি তোমাদের মইধ্যে কিছু নাই?
তুই যা, মনামিরে জিজ্ঞেস কর!
এর ঠিক দশ দিন পরে মনামি আপা আর শিহাব ভাই নিজেদের একখান অন্তরঙ্গ ছবি ফেসবুকে পাবলিশ কইরে ক্যাপশন দিল ‘একটি কবুতর আর তার একটি ডানা’। কবুতরের ফাজিল সদস্য জাহিদ হা-হা রিঅ্যাক্ট দিয়া কমেন্ট করল, ‘আর একখান ডানা কই? শিহাব ভাই!’
সেদিন কবুতরের শেষ দিন ছিল আমার। আমার ব্যাগ থেইকা একটা পিলের প্যাকেট পাইয়া আম্মা হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে কান্নাকাটি শুরু করল। আমি বোরকা ছাড়াই বাসা থেকে বাইর হইয়ে গেলাম। জামাত বাপ হার্ট অ্যাটাকের মতো মুখ করে দেখল তার মেয়ের কপালে টিপ, পরনে জিন্স। নিজেরে আউটডেটেড লাগতেছিল না একটু।
কবুতরে গেলাম। মনামি আপা আর শিহাব ভাই সিগারেট শেয়ার কইর্যা খাচ্ছে। আমারে দেইখা সিগারেট খাওয়া থামাইয়া আগায় আসল শিহাব। ‘ডানা! একটু দাঁড়াইস, কথা আছে!’
আমি দাঁড়াইলাম না। আসাদের কাছ থেকে পেনড্রাইভ নিয়া হাঁটা দিলাম। কই যামু, জানতাম না। শুধু জানি এলাকা ছাইড়ে যাচ্ছি।
‘তোমারে ছাড়ার ফিলিংস হচ্ছে, হোক!
আমি অনেক কিছুই ছাইড়ে আসার লোক!’