রক্ত ভাঙছে-নদীর পাড় ভাঙার মতো। শেষ রাতের দিকে এলিনার শরীরও নদীর পাড় ভাঙার মতো ভেঙে পড়ে। আকাশে একটা দুটো তারা জ্বলছে। সুপারী বনে একটা দুটো জোনাকও। পাতা বনে ঝিঁঝিরা ডেকে যাচ্ছে- দূরে আরও দূরে শিয়ালও। কয়েকবার রক্তভাঙায় এলিনা বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। হঠাৎ তার নাকে আসে চালতা ফুলের ঘ্রাণ। সে ভাবে রক্তের গন্ধ কি চালতা ফুলের ঘ্রাণের মতো। উঠানে কুকুর ডাকে। কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। কে? কে? এলিনা দুর্বল হয়ে পড়ায় অনেকক্ষণ চেঁচাতে পারে না। সে ভাবে রাত কটা? সেলিম কবে ঘরে ফিরবে?
খোলা জানালায় বাতাস ঢুকে পড়ে। এলিনার শরীরটা আবার খারাপ হয়। বুনো বিড়ালটা তাড়া করে শুয়ে থাকা কবুতরটাকে। এলিনা টিনের চালে বুনো বিড়ালের দাপাদাপি শুনেও বিছানা ছাড়তে পারে না। সে ভাবে এসময় যদি সেলিম আসত। বুনো বিড়ালের দাপাদাপি থেমে যায়। কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এলিনা চোখ বুজে ভাবে কবুতরটার মৃত্যু কথা- সে আরও ভাবে বুনো বিড়ালের কথা। এলিনার কাছে সেলিমকে বুনো বিড়ালই মনে হয়। শেষরাতে ঘরে ফিরে শরীর খোঁজা আর ঘেমে ওঠাই তার বাহাদুরী। বিয়ের ছয় বছরেও এলিনার মনকে সে বোঝেনি। এলিনা ভাবে নারী কি কেবলই পুরুষের কাছে ব্যবহারের উপযোগী একটা তক্তা?
পশ্চিমে চাঁদ হেলে পড়ছে। ভোর ডানা ভাঙতে শুরু করবে। চালতা ফুলের ঘ্রাণে জেগে থাকে ওরা দু’জন। ওদের ঘরে ফেরার তাড়া নেই। পুরুষটার ভাল লাগে না স্ত্রী’র শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, ভাতের অভাব, কাপড়ের অভাব। তাকে কেবল রাত ডাকে। তাকে কেবল নিষিদ্ধ ফুল ঘর ছাড়া করে। ফুলের নাম নেহা। নারীটির কোন কিছুর অভাব নেই। ঘর আছে, বর আছে। ছোট্ট একটা রাজকুমারী। ফোকলা দাঁতে হাঁটি হাঁটি পা পা। তবে তার ক্ষুধার্ত শরীর তাকে ঘর ছাড়া করে। তাকে ডেকে আনে সেলিমের কাছে। চালতার শুকনো পাতা মাড়িয়ে একটা বুনো বিড়াল চলে যায়। ওরা দুজন শরীরে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে ভাবে ভোর হওয়ার আগেই ঘরে ফিরতে হবে।
রক্তভাঙা কাল। বিপদের রাত্রি, ঘুড়ির লম্বা সুতো- কিছুতেই ছিঁড়ে যায় না। এলিনা খুব কষ্টে বিছানা ছাড়ে। শরীরটা যেন বেদনায় কেন্নোর মতো গুটিয়ে আছে। অনেক কসরৎ করে এলিনাকে মানুষে রূপান্তরিত হতে হচ্ছে। সে টেবিলের কাছে যায়। জগের ভিতরে একটা ইঁদুর সাঁতার কাটছে। তাকে দেখে মুমূর্ষু মনে হচ্ছে। এলিনা ভাবে সেলিমের কথা। সেলিম যদি ইঁদুরটার মতো ছটফট করে মরে যেত-ভালই হতো। যে স্বামী শরীর বোঝে-শরীর বাঁচানো বোঝে না- সে স্বামী থাকার চেয়ে না থাকা ভাল। এলিনা কলস থেকে জল ঢালে আর বিড় বিড় করে স্বামীকে গালি দেয়। উঠানে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। কে কে? সেলিম জবাব দেয় আমি। এলিনা দরজা খুলে দেয়। সে বলল কোথায় ছিলে? সেলিম জবাব দেয়, ছিলাম।
-ঔষধ আনো নাই?
-না
-আমার আবার রক্ত ভাঙছে। যদি মরে যেতাম ভাল হতো।
– এসব বলতে নেই। শুয়ে পড়। কাল ঔষধ এনে দেব।
এলিনার কাছে স্বামীকে অচেনা মনে হয়। সে বুঝতে পারে স্বামী এখন নদীর ঢেউ ভেঙে এসেছে। তাই মুখের ভাষা অন্যরকম। তার খুব রাগ হয় স্বামীর ওপর, নেহার ওপর।
সে বলল, কবুতরের বাসাটা দেখবে?
-কেন?
-বুনোবিড়াল এসেছিল
– বাসার দরজা দাওনি?
– দিয়েছি তো।
– তাহলে?
– কিভাবে যে খুলে ফেলে বুঝতে পারি না
-তুমি ঘুমাও। আমি আসছি
-আবার কোথায় যাও?
-আসছি
আমবাগানে একটা পাখি ডেকে উঠল। পুরুষটা যাচ্ছে চালতা ফুলের ঘ্রাণ শুঁকতে। ওখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছে নেহা। ঝিঁঝির শব্দ। শুকনো পাতার শব্দ। রাতেরও অদ্ভুত শব্দ। সব শব্দকে কানে তুলে সেলিম যাচ্ছে চালতা গাছের কাছে। ছায়া ছায়া অন্ধকারে একটা মানুষ দৌড় দেয়। সেলিমের চোখে পড়ে লোকটা। পালিয়ে যাওয়া লোকটার কথা ভেবে সেলিমের হাসি পায়। মানুষ মল ত্যাগে এত অসহায় ভাবতেই তার হাসি নদীর ঢেউয়ের মতো খলবলিয়ে ওঠে। নেহাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সেলিম ভাবে মানুষের আসা টের পেয়ে নেহা লুকিয়ে পড়েছে।
হুতোম পেঁচা ডেকে যায়।
অদ্ভুত ডাক। গলা খামচে ধরা ডাক। সেলিমের কাছে হুতোম পেঁচাকে যমদূতের সহোদর মনে হয়। সে অস্পষ্ট স্বরে ডাকে- নেহা নেহা। না, নারীটি কোথাও নেই। রাত ভোরের দিকে যাচ্ছে। পুরুষটিকে ঘরে ফিরতে হবে। সেলিম ভাবে না বলে ঘরে চলে গেল; তার শরীরটা যে আবার চাগা দিয়ে উঠেছে। আনমনে কথা বলতে বলতে সেলিম হাঁটে। হঠাৎ ছায়া ছায়া অন্ধকারে সেলিম দেখে আম গাছের ডালে একটা শরীর ঝুলছে। সে ভয় পায়। সে চিনতে পারে এ শরীর নেহার। যে শরীরে কিছুক্ষণ আগেও আগুন জ্বালানোর রসদ ছিল; এখন সে শরীর উইয়ের খাদ্য হতে প্রস্তুত। সেলিম ভাবতে থাকে ছায়ামূর্তিটাকে। ভাবতে থাকে এলিনাকে। রাত ভোরমুখী। সেলিম ঘরে ফেরে। তার ভেতরে হতাশার চোখা চোখা মেঘ দলা পাকায়। এ যেন থোড়মুখে বলকা মারা কোন ধান হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়েছে। সেলিম ভাবতে পারে না, রাত পোহালে কি হবে? কিছুক্ষণ আগেও কি এক হাসিখুশি রাত ছিল। নেহা আর সে চালতা বাগানে চাঁদ দেখতে দেখতে কত কথা বলেছে। কত স্বপ্ন তাদের দু’ চোখে জোনাকের মতো নেচেছে।
নেহা বলেছিল, তোমার সিদ্ধান্ত কতদূর?
সেলিম বলেছিল, আরেকটু অপেক্ষা কর
নেহা বলেছিল, আর কত?
সেলিম জবাব দিয়েছিল, এলিনা যে কোন সময় মরে যেতে পারে।
নেহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল। সেলিম মনে মনে ভেবেছিল, নেহা তাকে কত ভালবাসে।
তার হাত পা অজানা ভয়ে কেমন ভার হয়ে আসে। সে ভাবে, লোকটার কথা। লোকটা কার? কে এভাবে পালাল? ভাবতেই তার মাথাটা ধরে আসে। মাথার দু পাশে কেমন মরণ কামড়। সে বুঝতে পারে এ কামড় কিছুতে থামবে না। রাত পোহালে মাথার ব্যথা আরো বাড়বে। তার তো শত্রুর অভাব নেই। এলিনা যে এক নম্বর শত্রু। কতবার এলিনা তাকে সন্দেহ করেছে, কতবার বলেছে দু’ নৌকায় পা রেখো না। নেহার স্বামীর কথাও মাথায় আসে। লোকটাও সুবিধার না; সুযোগসন্ধানী। সে আর ভাবতে পারে না। ঘরে ডুকে বিড়ি জ্বালায়। পায়চারি করে। এলিনা ঘুমাচ্ছে। বাইরে কে যেন কথা বলে। সেলিম আবারো ভাবে ভোর হলে কি হবে? তার ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে? এলিনা আধবোঝা চোখে বলল, গ্রামে কি কিছু হলো? চৌকিদারের ডাক শুনলাম। সেলিম চমকে ওঠে। বাইরে কেশু চৌকিদারের গলা শোনা যায়- সেলিম সেলিম…