আনোয়ার করিমের হাসি

সিনথিয়ার ফোন আসে অনেক ভোরে। জামিল ঘুমিয়ে ছিল, পাশে মুন্নী। বোকাসোকা নির্বিরোধী একটা বউ, কিন্তু বউ তো! ভাইবারে সিনথিয়ার নাম দেখে জামিল তাই দ্রুত বেডরুমের বাইরে চলে যায়। ঘাড় ফিরিয়ে বেডরুমের দিকে তাকায় একবার। তারপর নিচু গলায় বলে, ‘হ্যালো!’

‘হানি ই ই!’

জামিল আদুরে গলায় বলে, ‘কি হানি! ছোট্ট সোনা হানি!’

‘পুরস্কার পাইসো তুমি!’

হাসে জামিল, ‘দেখেছ ফেসবুকে?’

‘দেখসি তো!’

এটুকু বলে থামে সিনথিয়া। পুরস্কারের জন্য তার জামিলকে কংগ্রাটস্ জানানোর কথা। কিন্তু সে তা জানায় না। বরং ক্ষুণ্ন গলায় বলে, ‘আমাকে নিয়ে লিখো নাই কেন?’

‘লিখব! তুমি একটু ধরো তো, প্লিজ।’

পেছনের দরজা দিয়ে বার-বাগানে চলে যায় জামিল। অস্ট্রেলিয়ার এ বাড়ির পেছনে বিরাট বাগান তাদের। মুন্নী উঠে এলে সে লক্ষ করতে পারবে দূর থেকে।

সিনথিয়াকে বলে, ‘তোমাকে নিয়েও লিখব, সোনা।’

‘কী লিখবা?’

‘কী লিখব!’

‘গল্প লিখো! প্রথম যেদিন আমাকে আদর করলা, মনে আছে!’ সিনথিয়া চটুল কণ্ঠে বলে, ‘সেটা লিখ।’

মনে আছে সেটা জামিলের। কামড়ে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল মেয়েটা। সেসব মনে করানোর জন্যই হয়তো গভীর কণ্ঠে উন্মাতাল শব্দ করে ওঠে সিনথিয়া।

জামিলের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, ‘কী করো পাখি!’

‘আমারে নিয়ে লেখো। এখনই লেখো।’

‘এখনই!’

‘না হলে তোমার সাথে প্রেম করে লাভ কী!’

‘আচ্ছা, লিখব।’

জামিল একটু অস্থির হয়ে ওঠে। মুন্নী যদি উঠে আসে এখন। সে বলে, ‘আমি তোমাকে পরে ফোন করি।’

‘কেন?’ সিনথিয়া ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি কি এক্সসাইটেড হয়ে গেছ?’

‘তাই কি!’ জামিল অবাক হয়ে অনুভব করে, মেয়েটা ঠিকই বলেছে। কিন্তু সে বলে, ‘কী যে বলো!’ ‘সকাল না অস্ট্রেলিয়ায় এখন। মুন্নী আছে না বাসায়।’

‘আচ্ছা!’

‘রাখি এখন সোনা!’

‘পরে কিন্তু ফোন করব।’

‘আচ্ছা, করো!’

জামিল ফোন রাখে। ঢাকায় এখন গভীর রাত। সিনথিয়া রাতে ঘুমায় না। ঠিক এখনই তাকে আবার ফোন করতে পারে। সে ফোনটা মিউট করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

পিচ্চি একটা মেয়ে সিনথিয়া। জামিলের এ লেভেল পড়া মেয়ের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে হয়তো। কিন্তু এসব কোনো ব্যাপার না তার কাছে। জামিলের কাছে তো আরও না! লেখকদের নানা বয়সী ক্রেজি ফ্যান থাকে। সে তো এখন লেখকই।

লেখক হিসেবে অবশেষে একটা সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে সে। পুরস্কারটা দেওয়া হয় প্রবাসী লেখকদের। জামিলকে অনেক কসরত করতে হয়েছে এটা পেতে। সে জন্য তার কোনো গ্লানি নেই। পুরস্কারের দুনিয়াটা এখন এমনই। পুরস্কার পাওয়াটাই বড় কথা, কে কীভাবে পেয়েছে তার খবর কয়জন রাখে!

পুরস্কারের খবরটা ফেসবুকে পোস্ট করেছিল জামিল। কতগুলো লাইক পড়ে দেখার জন্য ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। লাইক কম দেখে বিরক্ত হয়ে ল্যাপটপে হিন্দি সিনেমার গান শুনেছে। তারপর কখন যেন শুয়ে পড়েছে।

ভোরে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে সে ভাবতে পারেনি এটা সিনথিয়ার। সে এমনকি ফোনটা ধরতেও চায়নি প্রথমে। ভাগ্যিস ধরেছিল! না হলে সাতসকালে স’না নেওয়ার মতো এমন একটা উষ্ণতা কোথায় পেত সে!

জামিল শোয়ার ঘরে ফিরে দেখে, মুন্নীর ঘুম ভাঙেনি এখনো। ভাঙলে অবশ্য সমস্যা হতো না তেমন। মুন্নী ঝামেলা করার মতো মেয়ে না। মুন্নীকে সে বুঝিয়েছে, লেখকদের অনেক ফ্যান থাকে। তারা কেউ কেউ পাগলামো করে। লেখকদের এগুলো মেনে নিতে হয়।

জামিল আরাম করে বিছানায় বসে। ল্যাপটপটা তুলে নেয় খাটের পাশ থেকে। স্ক্রিনে চোখ রেখে বিহ্বল হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। দুই শ সতেরোটা লাইক পড়েছে এতক্ষণে তার পুরস্কারের খবরে। মাই গড! জামিল চেক করে দেখে সে পোস্ট করেছিল মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট আগে। এর মধ্যে এত লাইক! কমেন্টও আছে সাত-আটটা।

তার কিছু বাঁধা ভক্ত আছে। তারাই কমেন্ট করেছে। ওয়াও! কংগ্রাটস্! অভিনন্দন! এ ধরনের কমেন্ট। একজন আবার লিখেছে ফাটায় ফেলছ বস! সঙ্গে মোশাররফ করিমের দাঁত উঁচানো হাসির ছবি। পারেও এরা!

কমেন্ট পড়া শেষ হলে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাইক দেওয়া মানুষের নাম দেখে। লেখালেখি করেন এমন কয়েকজন লাইক দিয়েছেন। কিন্তু তার মধ্যে আনোয়ার করিম নেই। আনোয়ার করিম অনেকের পোস্টে লাইক দেন। তার পোস্টেও দেন মাঝে মাঝে। কিন্তু তার লেখায় কখনো না। পুরস্কার পাওয়ার সংবাদেও তিনি কোনো লাইক দেননি। জামিল অবাক হয় ভেবে। এত লাইকের মধ্যেও সে কেবল তাঁর নাম খোঁজে কেন?

সে বাথরুমে ঢুকে অনেক সময় নিয়ে শেভ করে। তার যে বয়স হয়েছে, এটা বোঝা যায় এখন। আঙুর থেকে কিশমিশে পরিণত হতে চলেছে সে। পুরোপুরি না, কিন্তু গলার দিকটা ঝুলে পড়েছে। ফেসলিফটিং বলে কী জানি একটা আছে। জামিল সিদ্ধান্ত নেয়, এবার ঢাকায় যাওয়ার আগে সে ফেসলিফটিং করে যাবে। জমজমাট একটা পার্টি দেবে ইসফাকের বাসায়। ঢাকার চেনাশোনা সব লেখক আর সাংবাদিককে নিমন্ত্রণ করবে।

তার পুরস্কারের সংবাদটা দেখেনি হয়তো সবাই। কিন্তু তাতে কী। জোশ একটা পার্টি দিলে চেনাজানা সবাই জানবে সেটি। নিশ্চয়ই সেই পার্টিতে তার পুরস্কার নিয়ে কথা হবে। সিনথিয়া থাকবে সেখানে। বুনো এই মেয়েটি ঢলে ঢলে পড়বে তার গায়ে। সবকিছুর মধ্যমণি থাকবে জামিল।

জামিলের ভেতরে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়, এসব দেখে কেমন লাগবে করিম ভাইয়ের! জামিলের হঠাৎ চিন্তাটা ঢোকে মাথায়। করিম ভাই কি দেখেছে তার সংবাদটা? ফেসবুক ফ্রেন্ড যখন তখন নিশ্চয়ই দেখবে। লাইক না দিন, পুরস্কার পাওয়ার সংবাদটা তো চোখে পড়বে তাঁর। জামিলের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে বাথরুম থেকে বের হয়ে নিউজটা ট্যাগ করে দেয় আনোয়ার করিমের ওয়ালে। এবার না দেখে যাবেন কোথায় তিনি।

জামিল দেখে, মুন্নী ভোঁতা চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

জামিল বলে, ‘দূরভাষ পুরস্কার পেয়েছি আমি!’

মুন্নী শরীরটা নৌকার মতো করে আড়মোড়া ভাঙে। হাই তোলে। সে অবস্থায়ই বলে, ‘পুরস্কার পেয়েছ! কেন?’

জামিল উত্তর দেয় না। মুন্নী তার এক্সপায়েরি ডেট বউ। তার সব কথার উত্তর না দিলেও চলে। পুরস্কার, সিনথিয়া, ঢাকার পার্টি—এসব ভেবে তার ভেতর আনন্দের ঢেউ উথলে ওঠে।

২.
ঢাকায় যাওয়া ম্যানেজ করতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। প্লেনে উঠে দু-গ্লাস হোয়াইট ওয়াইন খায় জামিল। সিনথিয়ার কথা ভাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তার বারবারই আনোয়ার করিমের কথা মনে হতে থাকে। বহু বছর আগে সে অনেক আশা নিয়ে করিম ভাইয়ের কাছে একটা ছোটগল্প দিয়েছিল।

আনোয়ার করিম তখন নামকরা ঔপন্যাসিক। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন মাত্র। তাঁর কাছে জামিলের যাতায়াত ভক্ত হিসেবে। জামিলকে তিনি গল্পকার হিসেবে পাত্তা দেননি। গল্প নিয়ে মাসের পর মাস রেখে দিয়েছেন। জামিল অস্থির হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করামাত্র গল্পটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। জামিল কোনোমতে শুধু জানতে চেয়েছিল, ‘পড়েছেন?’

করিম ভাই মাথা নাড়িয়েছে। এর মানে তিনি পড়েছেন।

‘ভালো হয়নি!’

তিনি উত্তরে বিষণ্ন একটা হাসি হাসেন শুধু।

জামিল হাত বাড়ায় গল্প ফেরত নেওয়ার জন্য। নিজেকে তার ভিখিরির মতো মনে হয় তখন। সেই অনুভূতিটা বুকের খুব গভীরে রয়ে গেছে কোথাও। করিম ভাইয়ের লাইক আছে নাকি দেখার সময় একই ফিলিংস কি হয় না তার এখনো?

তার রাগ লাগে নিজের ওপর। আনোয়ার করিমের আর নামডাক নেই তেমন। তাঁর বই খুব একটা বিক্রিও হতো না কখনো। তাঁকে এত পাত্তা দেওয়ার কী প্রয়োজন?

ঢাকায় তার নতুন বন্ধুবান্ধব হয়েছে। ইসফাকের সঙ্গে ঢাকা ক্লাব, পত্রিকা অফিসে আড্ডা, সিনথিয়া কিংবা তার মতো কারও সঙ্গে স্বপ্নের মতো মোলায়েম সময় কাটে তার। অস্ট্রেলিয়ায় একটা পত্রিকায় সে বিনা বেতনে সম্পাদকের কাজ করে। কাজ মানে ঢাকার পত্রিকা আর অনলাইন থেকে বেছে বেছে লেখা তুলে দেওয়া। পাক্ষিক পত্রিকা বলে এসব করার পরও অঢেল সময় থাকে তার। বাকিটা সময় সে উবারের ট্যাক্সি চালায়। পারতপক্ষে বাঙালি খরিদ্দার এড়িয়ে চলে। পার্থের যে জায়গায় সে থাকে, সেখানে অবশ্য বাঙালি নেইও তেমন। অস্ট্রেলিয়া, ঢাকা, লন্ডন আর নিউইয়র্কের ফেসবুক বন্ধুরা তাকে চেনে লেখক হিসেবে।

জামিলের টাকাপয়সার সমস্যাও হয় না কখনো। মুন্নী অস্ট্রেলিয়ায় নার্সিংয়ের ওপর পড়াশোনা করে ভালো বেতনের চাকরি করছে। কোনো দিন জামিলের কাছে সংসারের টাকা চায় না সে, সংসারের কোনো দায়িত্বও দেয় না। জামিল অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হয়েছে তার পীড়াপীড়িতে। কাজেই এখানকার সব দায়িত্ব তার। মুন্নী দায়িত্ব পালন করে। কোনো কিছুতে সে সমস্যা করে না। এমনকি ঢাকায় যাওয়ার সময় একবার জিজ্ঞেসও করে না।

ঢাকায় ল্যান্ড করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায় জামিল। এই বয়সে এত জার্নি ভালো লাগে না তার। সে ঠিক করে, ঢাকায় চলে আসবে পুরোপুরি। মুন্নীকে সিরিয়াসলি বলতে হবে বিষয়টি।

৩.

ইসফাক মহা পার্টির আয়োজন করেছে। হুইস্কিই রেখেছে চার পদের। জিন, ভদকা, ওয়াইন, বিয়ার-কিছু বাকি রাখেনি। ইসফাকের টাকা সে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংকে নিরাপদে রাখে। ছোটবেলার বন্ধুত্ব। তা ছাড়া এসব পার্টির মাধ্যমে বহু মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ জমে ওঠে। জামিলের জন্য জানবাজি আয়োজন করে সে। এবারের পার্টিটা করেছে আরও আলিশানভাবে। সে এখন টিভির নাটক প্রযোজনা করছে। ঢলে পড়তে প্রস্তুত ধরনের একটা উঠতি নায়িকাও এসেছে পার্টিতে।

পার্টিতে সিনথিয়া এসেছে প্রায় বুকখোলা ফ্রক পরে। মুখে চড়া মেকআপ। উঠতি নায়িকাকে দেখেই কিনা সে একটু অ্যাগ্রেসিভ হয়ে আছে। ইসফাক নিজে বারটেন্ডারের কাজ করছে। তার কাছ থেকে কয়েকটা বিয়ার পটাপট খেয়ে মাতাল হয়ে যায় সে। ‘সাবাসাবা সিতো, পাসিতো পাসিতো, ডেসপারেতো’ গানের সঙ্গে হঠাৎ নাচ শুরু করে। জামিল টয়লেট থেকে ফিরে দেখে, অতিথিরা অনেকে তালি দেওয়া শুরু করেছে ওকে ঘিরে।

জমজমাট একটা পার্টি। এখন এতে মন্ময় চৌধুরী এলেই হয়। মন্ময় চৌধুরী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর পত্রিকায় লেখা ছাপা না হলে জাতে ওঠে না কেউ। জামিল তাঁকে নিজে বাসায় গিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছে। এটাও বলেছে যে অস্ট্রেলিয়ায় তারা একটা সাহিত্য সম্মেলন করবে। মন্ময় চৌধুরী হ্যাঁ-না কিছু বলেননি। জামিল তাঁকে কায়েস ভাইকে দিয়ে ফোনও করিয়েছে। কায়েস ভাই জনপ্রিয় কবি। তিনি বলেছেন, তিনি নিজে নিয়ে আসবেন মন্ময় চৌধুরীকে। তাঁরা এলে আনোয়ার করিম বুঝবেন, জামিলের জায়গাটা কোথায় এখন।

আনোয়ার করিমকে আনতেও কষ্ট করতে হয়েছে জামিলকে। তিনি থাকেন আজিমপুরে। এত দূরে গুলশানে তিনি আসতে চাননি বলে তাঁকে গাড়ি পাঠিয়েছে জামিল। এখন তিনি পার্টিতে এসে নির্বিকারভাবে ভদকা খেয়ে চলেছেন।

জামিল তার রেখে যাওয়া গ্লাসটা খোঁজে। ডিভোর্সের পর ইসফাক একাই থাকে এ বাড়িতে। বাড়িতে সব সময় থাকে দু-তিনটে কাজের লোক। একটু পরপরই এসে তারা খাবার দিয়ে যাচ্ছে-চানাচুর, বাদাম আর টেমপুরা দিয়ে ভাজা কপি। তাদের কেউ কি নিয়ে গেল তার গ্লাস!

জামিল আরেকটা নতুন গ্লাস নেবে কি না ভাবছে, তখনই সিনথিয়া দেখে তাকে। নাচতে নাচতে এসে জড়িয়ে ধরে। সবার সামনে গালে চুমু খায়। জামিলের গালে তার লাল লিপস্টিকের দাগ। সেদিক তাকিয়ে দু-হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে সিনথিয়া।

তারপর তার কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘আমার সাথে আসো!’

‘এখন!’ জামিল চট করে তাকায় অতিথিদের দিকে। বলে, ‘একটু পরে!’

‘আই এম ওয়েট!’

‘এখনই!’

জামিল হেসে ফেলে।

সিনথিয়া খামচে ধরে গলার এক পাশ। তারপর সরি! সরি! বলে তার গালে হাত বোলায়।

ইসফাকের উঠতি নায়িকার সঙ্গে পাগলাটে চুলের একটা ছেলে এসেছে। সে নাকি নাটকের পরিচালক। সে-ই তোলে জামিলের একটা গল্পের প্রসঙ্গ। গল্পটা নিয়ে টেলিফিল্ম বানাতে চায় সে।

ইসফাক বলে, ‘যা তুমি লেখসো না দোস্ত!’

অতিথিরা পড়েছে কি না কে জানে। কিন্তু তাদের কেউ কেউ জামিলের গল্প নিয়ে আলাপে ঢুকে যায়।

৪.
জামিলকে অবাক করে দিয়ে কথাশিল্প পত্রিকার সম্পাদক মন্ময় চৌধুরী আসেন পার্টিতে। জামিল ছুটে গিয়ে তাঁকে বসায়। কী ড্রিংকস খাবেন জিজ্ঞেস করে। তিনি কিছু খাবেন না। কিন্তু জামিল পীড়াপীড়ি করতে থাকে। শিভাজ রিগ্যাল গোল্ড সিগনেচার আছে একটা, শুধু তাঁর সৌজনেই খোলা হবে সেটা। তিনি এ কথা শুনে স্মিত হাসেন। জামিল ইসফাকের বেডরুমে ঢুকে শিভাজ রিগ্যাল খুঁজে বের করে। নিজ হাতে তা খোলে। রান্নাঘরে ঢুকে নিজে নির্দেশ দিয়ে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ আর প্রচুর লেবু দিয়ে একটা বাদামমাখা বানায়। ট্রেতে করে তা নিয়ে এসে বসার রুমে ঢোকে।

পার্টি জমে উঠেছে। সিনথিয়া, উঠতি নায়িকা এবং আরও কয়েকজন নাচছে। নতুন কিছু অতিথিও এসেছে। কিন্তু জামিল ব্যস্ত হয়ে মন্ময় চৌধুরীকে খোঁজে। তিনি নেই তাঁর চেয়ারে।

জামিল তাঁকে খুঁজে পায় বারান্দায়। সেখানে সিগারেট হাতে তিনি গল্প করছেন আনোয়ার করিমের সঙ্গে। জামিলের আহ্বানে বসার ঘরে ফিরে আসেন তাঁরা। ইসফাক গ্লাসে চামচ দিয়ে শব্দ করে থামায় সবাইকে। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে জানায় এই পার্টির উপলক্ষ। জামিলের পুরস্কারের নামটা সে ঘোষণা করে ভুলভাবে। কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না। সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে জামিলের দিকে তাকিয়ে। হাততালির শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ইসফাক অনুরোধ করে তাকে কিছু বলতে।

রিং-এ বিজয়ী মুষ্টিযোদ্ধার মতো বুক ফুলে ওঠে জামিলের। কিন্তু সে মাথা ঠান্ডা রাখে। চরম বিনয়ী হয়ে বলে, ‘পুরস্কারের চেয়েও বড় আনন্দ আজকে সবাই এসেছে বলে। বিশেষ করে মন্ময় চৌধুরী।’ বাংলা সাহিত্যে মন্ময় চৌধুরীর অবদান নিয়ে একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেলে সে।

মন্ময় চৌধুরী লজ্জা পেয়েছেন। তিনি জিবে কামড় দিয়ে বলেন, তাঁকে বড় লেখক বলাটা ঠিক হয়নি। তাঁর চেয়ে বড় লেখক একজন আছেন এখানে। তিনি কাকে যেন খোঁজেন। হাত টেনে তাঁকে নিয়ে দাঁড় করান নিজের পাশে। তারপর বলেন, ‘করিম ভাইয়ের সামনে লেখক হিসেবে কিছুই না আমি।’

আনোয়ার করিম কিছু বলেন না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কিন্তু মন্ময়ের কথা শুনে যেন টনক নড়ে কবি কায়েসের। হঠাৎ নাটকীয় ভঙ্গিতে একটা সংবাদ দেন তিনি। তাঁর এক বন্ধু ফরাসি ভষায় কয়েকটি বাংলা উপন্যাস অনুবাদ করবেন। আনোয়ার করিমের একটা উপন্যাসেরও অনুবাদ করবেন তিনি। ফ্রান্সের একটা বড় প্রকাশনী থেকে বের হবে সেটা।

সিনথিয়া কী বোঝে কে জানে। সে হাততালি দেওয়া শুরু করে। তার সঙ্গে বাকি সবাই। শেষে জামিলও।

আনোয়ার করিম খুব অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মলিন শার্টের নিষ্প্রভ একটা মানুষ। জামিলের রাগ লাগে নিজের ওপর। কেন সে দাওয়াত করল তাঁকে!

আনোয়ার করিম যান অনেক রাতে। বমি করে নিস্তেজ হয়ে গেছেন। জামিল তাঁকে নিজে ড্রাইভ করে পৌঁছে দেয়। নোংরা একটা গলিতে তাঁর বাসার সামনে গাড়ি থামায়। তিনি একটুও নড়ছেন না। তাঁর গায়ে হাত রাখে জামিল, ‘যাবেন না করিম ভাই!’

তিনি নিস্তেজ গলায় বলেন, ‘যাব।’

জামিল অপেক্ষা করে।

আনোয়ার করিম কোনোমতে তাকান জামিলের দিকে, ‘থ্যাংকস।’

জামিল তাঁকে ধরে ধরে তিনতলা পর্যন্ত তোলে। কলবেল টিপে অপেক্ষা করে। আনোয়ার করিম অসুস্থ চোখে তাকিয়ে আছেন। বয়স গ্রাস করেছে তাঁকে। হয়তো এটাই শেষ দেখা তাঁদের!

জামিল চেষ্টা করে কথাটা না বলতে। কিন্তু বলেই ফেলে, ‘আমার গল্প ভালো লাগে না আপনার?’

তিনি কিছু বলেন না।

জামিল আবার বলে, ‘গল্প হয় না আমার?’

আনোয়ার করিম এবার মুখ তুলে তাকান। বিষণ্নভাবে হাসেন।

এই হাসিটাই বহু বছর আগে দেখেছিল জামিল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত