চোখ বাঁধা ছিল, ঠাওর করা যায়নি। গ্রাম, শহর, না মফস্বল? ঘোরের ভেতরই চলে গিয়েছিল সে। তাই বিপদের মাত্রা বা কারণ বোঝা যায়নি। আলাদা করা যায়নি সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আলোকরশ্মি। দিন ও রাতের পার্থক্যও আর অর্থ বহন করছিল না। অনন্ত জীবনেই যেন প্রবেশ ঘটেছিল তার। ছিল একঘেয়ে ধমকা-ধমকি আর অন্তহীন পানির তৃষষ্ণা। পিস্তলের শীতল ধাতব স্পর্শ টের পাওয়া গিয়েছিল কপালে। অথবা সেটা কোনো আগ্নেয়াস্ত্রই ছিল না; শিউলি ফুলের টোকাও হতে পারে। সেখান থেকে শিশিরের ফোঁটা পড়ছিল রক্তের ফোঁটার মতো। ঠোঁট ভিজে উঠেছিল। রক্তে, না শিশিরে? অবশ ভাব সর্বত্র। স্বপ্নের মতো। শুধু দৃশ্যের যাওয়া-আসা। ঘ্রাণ থাকে না, ছোঁয়া থাকে না। সময়ের মালায় ঘটনাগুলো একটার পর একটা বিন্যস্ত থাকে না। স্বপ্ন ভাংলে অনেক কিছুই মনে থাকে না। কখনও পুরোটাই হারিয়ে যায় কর্পূরের মতো। সেও নিখোঁজ হয়েছিল, তবে ফিরে এসেছে।
দারা-পুত্র-পরিবারের বুক থেকে পাথর নেমে গেছে। সঙ্গে শকুনের মতো উড়ন্ত শঙ্কা। উৎকণ্ঠায় দুটি দিন হয়ে উঠেছিল দুশ’ বছরের সমান। বৃদ্ধ পিতার কাছে তামাম দুনিয়া যেন পরিণত হয়েছিল হাবিয়া দোজখে। বয়স্ক মা কষ্টের ভারে মিশে যাচ্ছিল মাটিতে। আর স্ত্রী-পুত্র ভুলে গিয়েছিল ক্ষুধা কাকে বলে? সব, সব অন্ধকার ফুঁড়ে সে ফিরে এসেছে। এটাই ঢের। আর কী চাই? ফেসবুক? ব্লগ? লেখালেখি? চটাংচটাং কথা বলা? অনলাইন অ্যাক্টিভিটি? আর কিছুর দরকার নেই। বোবার কোনো শত্রু থাকে না- এই সত্য সবাই জানে। তার পরও মানুষ অবিরত শত্রু উৎপাদনে লেগে যায়। কেন যায়? অন্যে যদি নিষ্পেষিত করে, তখন? তখনও চুপ থাকতে হয়। জবানে লাগাম টেনে নয়, কাঁচি দিয়ে কচ করে কেটে ফেলতে হয় জিহ্বা। নয়তো জানটাই চলে যাবে। কোথায় যাবে? সবাই যেখানে যায়। মাটিতে, নয়তো পানিতে। কোনো সাকিন থাকে না। থাকতে নেই। তারাও ভেবেছিল, গেল- আর হদিস মিলবে না। কোরআন-হাদিসের কিরা কেটেও না। মাথা ঠুকে তো নয়ই। কিন্তু না; সূর্য মনে হয় আজ পশ্চিম দিক দিয়ে উঠেছে।
অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় সে ঘোরাঘুরি করছিল তেজগাঁও রেল স্টেশনে। পুলিশ উদ্ধার করে মিরপুরের বাসায় নিয়ে আসে। ভোর তখন সাড়ে ৫টা। অত সকালে কলিংবেল শুনেই সবাই ছুটে যায় দরজার দিকে। বাচ্চাটা তখনও ঘুমে। গত ৪৮ ঘণ্টায় কাঁদতে কাঁদতে সে কখনও অজ্ঞান হয়েছে, কখনও ঘুমিয়ে পড়েছে। এটাই হয়ে উঠেছিল রুটিন। প্রতিবেশীরা এসে খাবার দিয়ে গেছে। বিপদের আঁচ ঘরে ঢোকার পর আগুন জ্বলেনি চুলায়। হৈচৈ শুনে ঘুম ভেঙেছিল সন্তানের। চার-পাঁচজন পুলিশ। সঙ্গে সে। সেই শার্ট, সেই প্যান্ট, সেই জুতো। একই চেহারা, একই চিবুক, একই অবয়ব। শুধু মানুষটা বদলে গেছে। চোখটাও বোধ হয়। চাহনিটা আগের মতো নেই। যেন হাজার বছর পথ হেঁটে আসা এক উদ্ভ্রান্ত, রোগাক্রান্ত আগন্তুক। পরিবারের সঙ্গে মিলনের মুহূর্তেও হাসি ফোটেনি তার মুখে।
পুলিশ জানতে পারেনি, কোথায় ছিল সে। সে নিজেও জানে না। জানতে চায়ও না আর। জেনে কী হবে? হবে কি কিছু? যা জানার সে তো জেনেই গেছে। এবার সেটা মুছে ফেললেই বা কী? আর রেখেই বা লাভ কী? লাভ-ক্ষতির সব হিসাবের ঊর্ধ্বে এই ফিরে আসা। তাই মন এই ফিরে আসাটাকেই সত্যি বলে আঁকড়ে ধরতে চায় সে। আর সব মিছা। তার কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই। আছে শুধু পলকে পলকে হারিয়ে যাওয়া ঘটমান বর্তমান।
ঘড়ি ছিল হাতে, এখন নেই। ছিল কি কখনও আগে? থাকলেই কী, আর না থাকলেই বা কী? সময় এখন থমকে আছে তো। ঝুলে আছে মগডালে। সেও কি ঝুলে ছিল অনন্তকাল ধরে? পেট্রোলের উৎকট গন্ধমাখা এক গুমোট প্রকোষ্ঠে? পৃথিবীটাও ঝুলে আছে। ঝোলাঝুলির একটাই পরিণতি- মৃত্যু। তবে সে পরিণতি অর্থাৎ মৃত্যুকে সঙ্গে করেই ফিরে এসেছে। এতদিন সেই মহাত্মা ছিল অদেখা; সুদূরের অধরা। এখন মহাত্মা তার সহোদর। বরং বলা ভালো, মহাত্মার শরীরে তার আত্মা আটক হয়েছে। এই শরীরে তাই ক্ষুধা লাগে না, ভালোবাসা জাগে না। প্রেম অঙ্কুরিত হয় না। স্নেহ আর প্রস্ম্ফুটিত হয় না।
আসলেই কি মনে নেই তার? কিছুই কি মনে নেই? স্মৃতির কুলুঙ্গি কি তবে কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে? মনে হয়, একটা লোক কৃষষ্ণগহ্বর থেকে এই মাত্র অবতরণ করল সূর্যালোকে। তার পরই সবার দৃষ্টিগোচর হলো। এতদিন যেন এই লোকটি ছিলই না। থাকবেও না হয় তো ভবিষ্যতে। সে কি এলিয়েন? এত লোক কেন এখানে? টলটল চোখে সবদিকে তাকিয়ে থাকে সে। সন্তান এসে বাম বাহুটি জড়িয়ে ধরে আছে। মুখে একটানা উঁ-উঁ-উঁ-উঁ শব্দ। চোখ জলে ভাসা। অন্যদের অবস্থাও তাই। তার চোখে জল নেই। ছিল কি কখনও? শুস্ক মরুভূমির উটের মতোই তার ঠোঁট, গ্রীবা, শরীর। ধূসরিত। উদগ্রীব কয়েকশ’ জোড়া চোখ দরজার বাইরে অপেক্ষমাণ। পুলিশ কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। শুধু কয়েকজন সাংবাদিক ভেতরে। কী যেন প্রশ্ন করছে তারা। অব্যক্ত। কিছু বুঝিয়ে বলতে পারছে না। না সে নিজেই কিছু বুঝতে পারছে না? শুধু চেয়ে আছে। স্ত্রী কিছু বলার চেষ্টা করছে। সেটাও ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। যেন কথা আসছে নদীর ঠিক ওপারে যে লোকালয় আছে, সেখান থেকে। অত দূর থেকে এই মরুতে কণ্ঠধ্বনি এসে পৌঁছুলেও মর্মার্থ উদ্ধার করা যায় না।
কেবল একটি প্রাণীর উচ্চারণ তার মাথায় বোধগম্য ঠেকছে। একটা মাদি বিড়াল। ঘুরঘুর করছে পায়ের কাছে। সন্তানের পা ঘেঁষে। সেও একটানা মিউ-মিউ শব্দ করে যাচ্ছে। এই দু’জনের ধ্বনিই মনে হচ্ছে মগজের নিউরন কোষে প্রবেশ করছে। বাকি সব নিরর্থক, অযথা। ফাঁপা মনে হচ্ছে। ধ্বনিগুলো যেন কোনো শব্দ নয়, শব্দের বুদবুদ মাত্র। পানির উপরিভাগে আসছে ঠিকই; তার পর ফেটে যাচ্ছে মৃদু শব্দ সহযোগে। এমনই অনুচ্চ শব্দে দু’দিন আগে তিনজন লোক কানের কাছে এসে বলেছিল- ‘গাড়িতে ওঠেন; কোনো শব্দ করবেন না। আওয়াজ করলেই গুলি করব।’ তখন সে অফিসে যাচ্ছিল। সকাল সকাল এমন আমন্ত্রণে হতভম্ব হয়ে যায় সে। তবে চাবি দেওয়া পুতুলের মতোই সে নির্দেশ মেনেছে। গাড়িতে উঠেছে। এর পর তারা কী কী যেন বলল। মারধর করেছিল। প্রথম ব্যথা লাগলেও, পরে আর সেটা গায়ে লাগেনি। মনে হয়েছিল, শরীরটা একটা বালির বস্তায় পরিণত হয়েছে।
ভাগ্য ভালো; খুন করে তাকে বস্তায় পুরে কোনো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়নি। গুম হয়ে যেত যদি? অনেকেই তো হচ্ছে। কতজনই তো আর ফিরে আসছে না- এসব কথানিচয় ভেবে নফল নামাজ আদায় করতে বসে মা। বিড়ালটা তখনও পা ঘেঁষে বসে আছে, যেন উত্তাপ দিয়ে ভেতরের পুরনো মানুষটিকে জাগিয়ে তুলতে চাইছে অবোধ প্রাণীটি। স্ত্রী অবোধের মতো কী যেন বলেই চলেছে! সামনে ক্যামেরার যান্ত্রিক শব্দ। বিরক্তি লাগছে। আবার সেটা বলতেও সাহস হচ্ছে না। ভেতর থেকে, যেখান থেকে সাহসটা আসে, সেই জায়গাটা কোথায় যে! হারিয়ে গেল নাকি? সাবেক নিখোঁজ ব্যক্তি সে। এখন সদ্য প্রাপ্তির খবরে হয়তো স্ত্রী আনন্দে আত্মহারা। তাই ভুলভাল বকেই চলেছে। সাংবাদিকরাও খুঁজে চলেছে তাদের মনের মতো উত্তর। বাচ্চার বাহুসংলগ্নতা তাকে কি অভয় দিচ্ছে? ভরসা? ওর ভরসা কে হবে? বাচ্চাটা ভবিষ্যতে কি তার মধ্যে ভরসা খুঁজে পাবে, যে নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে না?
কে কাকে রক্ষা করবে? রক্ষা করার দায় আসলে কার? রক্ষক আর ভক্ষকে এখন কোনো তফাৎ নেই। তফাৎ আছে শুধু মৃত্যুতে। জীবন আছে, জীবন নেই। বাইনারি পদ্ধতি। এই দুই বাস্তবতার ফারাকটাও এখন আর মানে রাখে না তার কাছে। দু’দিনে সে কি দার্শনিক হয়ে গেছে? না বোবা? নাকি দুটোই? নির্বাক দার্শনিক। কখনোই কি সে সবাক হবে না আর? অন্তত দুই-একটা শব্দও কি উচ্চারণ করবে না? আগের স্বভাব ফিরে আসবে হয় তো। আগের মতো করে তো আসবে না। সেই ফিরে আসায় ভীতিকর স্মৃতির হানা থাকবে। শুধু হানাটাই থাকবে; স্মৃতি থাকবে না। দুদিনেই সেটা মন পাঠিয়ে দিয়েছে অচেতনের গুদাম ঘরে। স্বপ্নে দুই একবার লাফ দিয়ে তারা ফিরে আসবে হয় তো। নাও আসতে পারে। তার এই ফিরে আসার মতোই। দোদুল্যমান একটা অবস্থা। শঙ্কা ও সম্ভাবনা- দুটোই সমানভাবে ক্রিয়াশীল। এই ক্রিয়ার মাঝে আর কোনো ভেদাভেদ নেই, জীবন বা মৃত্যুর। পুরোটাই যেন মৃত্যু-পরবর্তী নতুন জীবন। সে যেন আগের দুনিয়াতে নেই। উপরে উঠে এসেছে। ঊর্ধ্বে। বেহেশত! মৃত্যুর পর বাঁচার আকাঙ্ক্ষা থেকেই বেহেশতের সৃষ্টি। আগেও সে এমনটা বলত। তারও বাচার আকাঙ্ক্ষা আছে। তীব্র ভাবে। কিন্তু ঠোঁট যে সেলাই করা।
হঠাৎ ডান হাত তুলে সে ঠোঁটে সুতা খুঁজতে লাগল। সবার চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। এমনকি পায়ের কাছে থাকা বিড়ালটিরও। সবাই বোঝার চেষ্টা করছে- সদ্য ফিরে আসা লোকটি কী খুঁজছে? জবান, না অন্য কিছু?