লেখকের বন্ধুরা একত্রিত হয়ে একটাই সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর ম্যারেজ ডে-টা হবে বড় কোনো ভেন্যুতে। আয়োজক হবো আমি। এবং সেই আয়োজনে লেখকের কাছ থেকে আলাদা থাকা তাঁর স্ত্রীকে আসতে হবে।
যদিও এখন ওঁরা দু’জন দু’জায়গায় থাকেন, দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে, তবু আমরা কেন এর একটা সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছি না?
উদ্যোগটা কী? তাঁরা দু’জনেই এই পার্টিতে আসবে। এলে পরে দু’জনের মধ্যে মিল করানো সম্ভব হবে। এই কাছাকাছি উপস্থিতির মধ্য দিয়ে গ্যাপটা কেটে যাবে। মিল হওয়ার সম্ভব হবে তখনই।
বিনয়ী প্রস্তাবটা পেয়ে আমি দুই সেকেন্ড ভাবলাম। আমি চিরকালই ‘সংসার’ রাখার পক্ষে। যে কোনো মানুষেরই সংসার অটুট রাখতে চাই।
ভাবলাম, আমি যদি প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান না করে এমন এক অভিনব উদ্যোগে সম্মত হই, ব্যাপারটা পরে চিন্তা করে আমারই তো ভালো লাগবে।
তাই আমি পিছালাম না। রাজি হয়ে গেলাম। সব চূড়ান্ত হয়ে গেল। ভেন্যু শেরাটন হোটেল। তারিখও ফাইনাল।
কিন্তু তাতে কি সহজে বিপত্তি কাটে?
কাটল না। সাহিত্যিকের এক ঘনিষ্ঠ স্থপতি বন্ধু তখন বললেন, পার্টি দিলে তো হবে না। তুমি যেহেতু পার্টি দিচ্ছ, হোস্ট হিসেবে সবাইকে তোমার একে একে দাওয়াতের কাজটিও করতে হবে।
বললাম, এ আবার কোন বিপদ! আপনারা তো বলেছিলেন আপনারাই সব করবেন। আমি শুধু পার্টির আয়োজনে থাকব। স্থপতি বন্ধু মাথা নাড়লেন, যুক্তিপূর্ণ কথা। আমাদেরই সব করতে হবে। তবে দু’চারজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে তো তোমাকেই বলতে হবে।
কয়েকজন আমন্ত্রিত মানুষের ফোন নাম্বার দেওয়া হলো আমাকে। সেই তালিকা ধরে ধরে দাওয়াত করতে থাকলাম। এভাবে একপর্যায়ে গিয়ে দেখি, সাহিত্যিকের স্ত্রীর নাম্বারও সেই তালিকায় সযত্নে লেখা হয়েছে।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, এ আবার কেমন কথা। আমি কেমন করে এ ভদ্রমহিলাকে ফোন করি? এ বিশিষ্ট মানুষটির সঙ্গে তো আমার কখনও আলাপ হয়নি। আমি তাকে তো চিনি না। তাঁকে ফোন করব কেমন করে?
বন্ধুরা বললেন, আহা, পার্টি তো দিচ্ছেন আপনি, ওদের সম্মানে। সুতরাং এই দু’জনকে তো আপনাকে নিজের মুখে দাওয়াত দিতে হবে। অন্যদের বলেন কি না বলেন সমস্যা নেই, আমরা আছি।
কথার মধ্যে অকাট্য যুক্তি আছে।
মেনে নিলাম সহজেই। বললাম, ঠিক আছে। চেষ্টা করি।
এক সকালে ফোন করলাম ভদ্রমহিলাকে।
ফোন ধরলেন তিনি।
বিনীত গলায় বললাম আমার নাম এই…।
উত্তর এলো, হ্যাঁ। আপনাকে চিনি আমি। বলুন, কেমন আছেন?
বললাম, আপনাদের দু’জনের অমুক দিন ম্যারেজ ডে। সেই পঁচিশতম ম্যারেজ ডে উপলক্ষে আমি একটা পার্টি করার ব্যবস্থা করতে চাই।
ভদ্রমহিলার গলায় বেশ বিস্ময়, আমার ম্যারেজ ডে’র পার্টি দিচ্ছেন আপনি! সেই পার্টিতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন আপনি?
বললাম, হ্যাঁ, যদি আপনি রাজি হন, তবেই এই আয়োজন সফল হতে পারে।
ওপাশে ভদ্রমহিলা নিশ্চুপ।
বললাম আমি, যদি কিছু মনে না করেন, যদি হোটেল শেরাটনে আসেন আমি অনেক কৃতজ্ঞ থাকব। যদি প্রয়োজন মনে করেন, আপনার বাড়িতে এসেও নিমন্ত্রণ করে যাই। সেই ছোট্ট সামান্য পার্টিতে এলে খুবই বাধিত হবো। আপনার সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় নেই। পরিচয়টাও হয়ে যাবে। বাড়িতে আসব?
ভদ্রমহিলা জানালেন, না, তার আর দরকার হবে না। আমি চেষ্টা করব। আমাকে একটু দেখতে হবে, সেদিন আমার কী অবস্থা, কী সিডিউল সব একটু দেখে নিতে হবে। এখনই পাকা করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এবার ফোনের এপাশে আমি নীরব।
উনি বললেন, আপনার কথাবার্তায় খেয়াল হলো সেদিন আমার ম্যারেজ ডে। সেদিন কী কী কাজ রেখেছি ব্যস্ততার মধ্যে, সেটা আগে দেখে নিতে হবে।
তো?
তো, আমি আপনাকে কোনো কথা দিচ্ছি না।
বললাম, কিন্তু আপনি না এলে তো সে দিন পার্টিটা হবে না।
খুব শীতল গলায় ওপাশ থেকে উত্তর এলো, না। এ মুহূর্তে আমি যে কোনো কথা দেব না।
আমি তবে আবারও আপনার সম্মতি পাওয়ার জন্য ফোন করব। ঠিক আছে?
ভদ্রমহিলার এক লাইনে জবাব, ঠিক আছে। চেষ্টা করব- বলেই ফোন রেখে দিলেন।
এ কথা শোনার পর সেই সাহিত্যিক আর উনার বন্ধুরা প্রশ্ন করলেন, তুমি কি ওনাকে ফোন করেছো?
করেছিলাম।
কী বলল।
বললাম, বলছিলেন যে…
কথা কেড়ে নিয়ে সাহিত্যিক বললেন, নিশ্চয়ই বলেছে চেষ্টা করব।
আমি বললাম, হ্যাঁ, এ কথাই বলেছেন। তাছাড়া ওনার মনেও নেই, সেদিন ম্যারেজ ডে।
তাই নাকি?
জি।
আচ্ছা ঠিক আছে। তাও তুমি আরেকবার ফোন করো। তারিখটা আসার আগে আবার করো।
জি। করব।
কথা অনুযায়ী পার্টির তারিখটা কাছাকাছি আসার তিন দিন আগে আরেকবার ফোন করলাম।
জানালাম, আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আবার ফোন করেছি।
ভদ্রমহিলা এবারও ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো আপনাকে বলেছি, এতটা চিন্তা করার কিছু নেই। আমি চেষ্টা করব।
না, না, আপনি না এলে তো আমার পার্টিই হবে না। সব আয়োজন মাটি হয়ে যাবে। আপনাকে তো আসতেই হবে।
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা।
তারপর ভদ্রমহিলা বললেন, না। আমি আপনাকে কথা দিতে পারছি না।
আমিও নাছোড়বান্দা। লেগে থাকলে ফলাফল একটা মিলবে। অনেকভাবে কথা বাড়াতে থাকলাম।
একপর্যায়ে তিনি বললেন, ঠিক আছে। কাল সকালবেলায় একটা ফোন দিন।
বললাম আমি, ধন্যবাদ। আমি তাই করব।
সকালেই ফোন করলাম।
তিনি বললেন, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
আমি পার্টির আয়োজক। আমি ব্যস্ত হবো না?
কিন্তু আমি তো আপনাকে তখনও হ্যাঁ বলিনি!
বললাম, আপনাকে সেখানে না দেখলে আমি আমার স্ত্রীকে কী বলব? আমার স্ত্রী প্রোগ্রামে এসে আপনাকে খুঁজবে তখন?
আপনি এ জন্যেই আমাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন?
তা না। আপনি আসলেই আমার কেন, সবারই একটু ভালো লাগবে।
ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন, শোনেন আপনার এত ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আপনি একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, যা ঘটবার ঘটবেই। আপনার উপর্যুপরি অনুরোধেও কিছু হবে না, যা কিছু ওই সাহিত্যিকের কাছ থেকেই ঘটবে।
মানে?
মানে, আপনার টেনশনের কিছু নেই। প্রয়োজনও নেই। সাহিত্যিক ভদ্রলোককে তাঁর মতো কাজ করতে দিন। উনিই তো আপনাকে বলেছেন যে, আমাকে ফোন করতে। তাই না? মাথাব্যথাটা আপনার চেয়ে ওনার বেশি। এই অস্পষ্ট কথাটা বলেই ভদ্রমহিলা ফোনটা রাখলেন।
আমার মনে হলো, সব মিলিয়ে অথৈ জলে পড়েছি আমি।
আমি যে এতটা চিন্তিত হয়ে পড়েছি, আমার স্ত্রীর সামনে শেষ পর্যন্ত আমি ছোট হয়ে যাব, সেটা নিয়ে ফোনের ওপাশের মানুষটির কোনো বিকার নেই। বরং কেমন যেন আত্মপ্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর। আমাকে উৎকণ্ঠিত না হয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বললেন!
বিকেলে অনুষ্ঠানে সবাই এলেন। এমনকি সেই সাহিত্যিকও। এসে সবার সঙ্গে হইচই। চোখেমুখে কোনো উৎকণ্ঠার ছাপ নেই।
সময় বয়ে যাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে আমি ঘামছি।
এক সময়ে এলেন তিনি। খুশিতে যেন আমার চেহারায় এক পশলা আনন্দ-বৃষ্টি নামল। ভদ্রমহিলা মিটি মিটি হাসছেন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই যেচে পরিচিত হলেন। মেজাজটিও যেন ফুরফুরে।
পার্টি জমে উঠল। ষোলোকলা পূর্ণ, আমার স্বপ্ন সফল।
একপর্যায়ে পার্টি শেষ হলে ডেকে নিলেন আমাকে। ভদ্রমহিলা তারপর যে তথ্য দিলেন, তা শুনে আমার সবচেয়ে বেশি অবাক হওয়ার পালা।
বললেন, আপনি খুব অবাক হচ্ছেন আমাকে শেষ পর্যন্ত দেখতে পেয়ে!
মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ!
আমি তো আপনাকে বলেছিলাম, টেনশন না করে নিশ্চিত থাকুন। কারণ আমি জানতাম, একটা ঘটনা ঘটবে। আপনাদের প্রিয় সাহিত্যিক কিছু একটা ঘটাবে, যাতে আমার আসাটা কনফার্ম হয়ে যাবে।
আজ বিকেল ৫টায় আমার কাছে একটা ফুলের তোড়া এলো। সেখানে সাহিত্যিকের ছোট একটা চিরকুট। লিখেছেন, শোনো, আমি জীবনে কখনও কোনো কবিতা লিখিনি। আজ লিখে তোমাকে পাঠালাম। এই কবিতাটির সম্মানে তুমি অন্তত আজ এসো।