প্রীতিভাজনেষু, স্কুলজীবন থেকেই শুনে আসছি ক্ষমা নাকি মহত্ত্বের লক্ষণ। এক কাজ করুন না, এই রচনা কর্মটি থেকে আমাকে অব্যাহতি দিয়ে মহত্ত্বের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে কেমন হয়? আমি জানি, ক্ষমা করার মতো সময় কিংবা সুযোগ এখন আর নেই। তদুপরি আমি কথাও দিয়ে ফেলেছি। সময় যতই কমে আসছে, আমার অপারগতার অস্বস্তি ততই ঘনীভূত হচ্ছে। প্রস্তাবনার সময় এমনটা ছিল না। তার একটা কারণ : তখন হাতে সময় ছিল। আর এখন হাতে আছে শুধু কলম। এখন যদি বলি, অক্ষমেরে করে দাও ক্ষমা, তাহলে সেই আকুতি অদৃশ্য দেয়ালে ঠোক্কর খেয়ে পিংপং বলের মতোই ফিরে আসবে।
থাক। এটা এমন কী! এর চেয়ে কত নির্মমভাবে ক্ষমাহীন পরিস্থিতিতে মানুষকে ফেলে দিয়েছেন তারা, যারা স্বতঃদয়াদ্রচিত্ত বলে স্বীকৃত। যেমন, শেক্সপিয়র।
আমরা দেখেছি, রাজা লিয়ার কর্ডেলিয়ার প্রতি অন্যায় করেছিলেন। নির্মম বাস্তবতার কবলে পড়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি রীতিমতো অপরাধই করে ফেলেছেন। গ্লানিতে তিক্ত হলেন তিনি,-অনুশোচনায় দগ্ধ। -ক্ষমা চাওয়া ছাড়া মুক্তির আর কোনো বিকল্প নেই। যখন তিনি মনস্থ করলেন যে, কর্ডেলিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবেন, ঠিক তার আগেই শেক্সপিয়র কর্ডেলিয়াকে তুলে নিলেন। এবং রাজা লিয়ারের জন্য রেখে দিলেন ক্ষমাহীন অন্ধকার, অন্তহীন অন্তর্জালা।
২.
‘ক্ষমা’ মামুলি কোনো শব্দ নয়। মামুলি ভুলত্রুটির ক্ষেত্রে সেটাকে প্রযোজ্য বলেও মনে করি না। ছোটখাটো ভুলত্রুটি কে না করে! তেমনি, ক্ষমাও পেয়ে যায়। কোনো দোষ না করেও তো আমরা ভিখারির কাছে ক্ষমা চাই। এগুলোকে যেমন দোষ বলে না, তেমনি ক্ষমাও বলা যায় না।
কিন্তু, ‘মহত্ত্ব’ শব্দটিকে জড়িয়ে যে ক্ষমা, সেটা খুব ভারী, খুব তাৎপর্যময়। ইতিহাসের কোথাও কোথাও সে রকম দৃষ্টান্ত হয়তো আছে। কিন্তু সেই ঘটনাগুলো বিশ্নেষণ করলে দেখা যাবে, স্বল্প খ্যাতিকে মহত্ত্বর পর্যায়ে উন্নীত করার সুপ্ত বাসনা সেখানে ক্রিয়াশীল। এর ফলে জনপ্রিয়তা বাড়ে কিংবা অন্যভাবে লাভবান হওয়া যায়। ক্ষতিপূরণ বলে তো একটা আইনসম্মত ব্যাপারই রয়েছে।
সমাজবাস্তবতায় দেখা যায়, যেভাবে ক্ষমার ‘আয়োজন’ করা হয়, সেভাবে ন্যায়-প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গৃহীত হয় না। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প বলি।
৩.
সুন্দর সুন্দর উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি। কাছেই ফাঁকা কয়েকটা প্লট। তারপর দোকানপাট। তার পেছনে বস্তি। ফাঁকা প্লটে ছেলেপুলেরা নিয়মিত খেলাধুলা করে। ফ্ল্যাটবাড়ির ছেলেরা খেলে ক্রিকেট। বস্তির ছেলেরা ডাংগুলিও খেলে, মার্বেলও খেলে। তক্তা দিয়ে ক্রিকেটও খেলে। মাঝেমধ্যে বিরোধ হয়,
আবার মিটেও যায়।
একবার ঝগড়াটা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াল। দু’জনের বয়সই সাত কী আট। একজন :ফ্ল্যাটবাড়ির ছেলে; ফর্শা সুন্দর, অতি যত্নে বেড়ে ওঠা নাদুসনুদুস- ফার্মের মুরগির মতো। অন্যজন : বস্তির ছেলে, অযত্নে হালকাপাতলা, কিন্তু আগাছার মতন শক্ত। দু’জনেই দৌড়াচ্ছিল। একজন বল ধরার জন্য, অন্যজন গুলি লোফার জন্য। ধাক্কা থেকে শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি। তর্কাতর্কি, মুখ খারাপ করা। ‘ফকিন্নির পোলা’ শুনে বস্তির ছেলেটা সহ্য করতে পারল না। ভালো করে লাগিয়ে দিল একটা। অমনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে সাহেবি ছেলেটা বাসার দিকে দৌড়ে গেল।
খেলা বন্ধ। কিছু একটা হতে পারে। কে একজন বললো- ‘ঐ সুমইন্যা, পালা, পালা; হের মামা পার্টি করে।’
– ‘আমার মায়েরে গাইল দিব ক্যান?’ – সুমনের গোঁ থামেনি।
অল্পক্ষণের মধ্যে ভাগ্নেসহ তথাকথিত মামা হাজির। জটলা বাড়তে লাগল। সুমনের মা ছুটে এলো। চায়ের দোকান থেকে উঠে এলো দিনমজুর চাচা। – আরও কিছু উৎকণ্ঠ দর্শনার্থী।
– ‘কই, বান্দির পোলাটা কই? ডাক কুত্তার বাচ্চাটারে।’
সুমন পালায়নি। মায়ের কনুই ধরে দাঁড়িয়েছিল। তাকে চিলের মতো থাবা মেরে ছিনিয়ে নিল বিশিষ্ট মামা। তারপর রাজনৈতিক জোশ নিয়ে বেধড়ক পেটাতে লাগল। সুমনের চাচা অসহায়ভাবে তাকিয়ে রয়েছে। তারপর অক্ষমতার জ্বালা থেকে বলতে লাগল- ‘কতবার কইছি এই মাঠে খেলিছ না, খালপাড়ে যা। … মারেন, আরও মারেন।’
‘আম্মা, আম্মা’ করে সুমন কাতরাচ্ছে। আর তার মা দুর্দম লোকটার পা আঁকড়ে আছে। -‘মাপ কইরা দেন সা’ব, মাপ কইরা দেন। আমার পোলাটারে আর মাইরেন না।’
এরপর একটা লাথি মেরে সুমনকে কানে ধরে ওঠ-বস করানো হলো। তার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। তারপর ছোটলোকের বাচ্চাদের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত একটা ভাষণ দিয়ে বিজয়ী মামা প্রস্থান করলেন। সুমন তখনও কাঁদছে আর বলছে- ‘আমি কিচ্ছু করি নাই। অ আগে আমার মায়েরে গাইল দিছে।’
চাচা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল- ‘বড়লোকের কোনো দোষ নাই রে বা’জান, দোষ নাই।’
এক বুড়ি সান্ত্বনা দিয়ে বলল- ‘থাক দুলী, মাপ কইরা দে। … আল্লা বিচার করব।’
যাদের শক্তি আছে, তারা নিজেরাই বিচারক হয়ে নগদ বিচার করে ফেলে; পরকালের জন্যও অপেক্ষা করে না, ক্ষমাও করে না। পক্ষান্তরে গরিব লোকেরাও ক্ষমা করে না; স্রেফ ক্ষমার ক্ষমতাটুকু পরকালের হাতে ছেড়ে দেয়।
৪.
সেমীয় পুরাণে বর্ণিত পরলোকে কিছু ক্ষমার দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। সামান্য একটি নিষেধাজ্ঞা ভুলে যাওয়ার কারণে নির্মম শাস্তি পেতে হয়েছিল অ্যাডাম ও ঈভকে। ব্যাপারটাকে ভুল হিসেবে বিবেচনা করার যৌক্তিকতা ছিল। বর্ণনা মোতাবেক স্বর্গোদ্যান এলাকাটির একচ্ছত্র মালিকানা কিন্তু ঈশ্বরের। কোন ক্ষমতাবলে শয়তানের বাচ্চা সেখানে চারাগাছটা লাগাবার সাহস পেল! সংরক্ষিত এলাকায় নিষিদ্ধ বৃক্ষরোপণের অনুমোদন নিয়ে অ্যাডাম কিংবা ঈভ সেদিন প্রশ্ন তুলতেই পারত। তবু তারা অনুশোচনা বোধ করেছে।
এই প্রথম মানুষ একটা দোষ করল কিংবা অপরাধ করল কিংবা পাপ করল।- করল এই কারণে, যেহেতু দুর্বলচিত্তের মানুষ হিসেবেই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছিল। পরম করুণাময়রূপে খ্যাত বিধাতার জন্য সেদিন পরম একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল ক্ষমা করার। অধিকাংশ ধর্মদর্শনে বলা হয়েছে, ঈশ্বর পরম দয়ালু এবং ক্ষমাশীল। তাই যদি হবে তবে প্রশ্ন উঠতে পারে- আগাম নরক সৃষ্টি করে রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু?
৫.
এসব দৃষ্টান্তে প্রতীয়মান- বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই, আদর্শবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও ক্ষমার অস্তিত্ব আসলেই নড়বড়ে। পক্ষান্তরে, ক্ষমতার অস্তিত্বই প্রকট। যারা ক্ষমতাহীন, তারা স্বভাবতই ক্ষমা চায়- যদিও পায় না। আবার, ক্ষমা না পাওয়া এসব মানুষই সহজে অন্যকে ক্ষমা করে দেয়। আসলে তা উদারতাবশত নয়, সমুচিত প্রতিবিধান রচনা করতে পারে না বলেই ক্ষমা করে। অতএব অনস্বীকার্য যে, ক্ষমা প্রায়শ দুর্বলতার নামান্তর।
কথা বাড়াতে গেলে বিপদসীমা লঙ্ঘনের আশঙ্কা আছে। তাই কলম থামানো দরকার। কেননা, ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ- এই কথায় আমার আস্থা নেই।