ক্ষমা নেই

ক্ষমা একটি প্রতারণামূলক শব্দ, কেউ কাউকে ক্ষমা করে না, ক্ষমা করতে পারে না। ক্ষত তৈরি হয়ে গেলে সময়ের ধুলোয় তাতে আস্তরণ পড়ে বলেই ক্ষমা নামক বিভ্রম তৈরি হয়। ক্ষমা কি করা যায়? মানুষের এতখানি ক্ষমতা কি আছে যাতে করে সে অপরকে ক্ষমা করতে পারে? আসল বিষয় হলো চেপে যাওয়া, পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক ঘটনাই চেপে যেতে হয়। দীর্ঘমেয়াদি অন্য কোনো স্বার্থচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে ক্ষমাকে সহ্য করতে হয়। অনেক ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে হয়। সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে, সমাজে বসবাসের প্রয়োজনে ক্ষমা বিষয়টিকে মাহাত্ম্য দেওয়া হচ্ছে। সমাজ থেকে ক্ষমা উঠিয়ে দেওয়া হলে সমাজ কি ভেঙে পড়বে? না নতুন আনন্দময় ভিন্ন ধারার গতিশীল সমাজ তৈরি হবে? যেখানে ক্ষমা জাতীয় বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিকতা হারাবে।

ক্ষমা যদি তার কারণকে হারিয়ে ফেলে তাহলে একটি শোষণ ও অপরাধহীন সমাজ তৈরি হতে পারে। ভাবনাটিকে ইউটোপিয়ান মনে হলেও এর মর্মে বাস্তব যুক্তির অভাব ঘটবে না। এই মাহাত্ম্যের বোধ এক মিথ্যা জগৎ ও সম্পর্ক তৈরি করছে। এই মিথ্যা আমাদের জীবনের মূল স্র্রোত থেকে সরিয়ে দিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখেছে। আমরা পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকে ক্ষমার রঙিন মোড়কে উজ্জ্বলতা দেওয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু গোপনে আমাদের জানা আছে বিষয়গুলোর গতি-প্রকৃতি অন্য ধারায় নিজেদের সংযুক্ত রাখে, কী সেই অন্য ধারা? সেটি কি মন থেকে মুছে ফেলা? না কোথাও লুকিয়ে রাখা? মুছে ফেলাও আমাদের হাতে নেই বরং গোপনে লুকিয়ে রাখাই পন্থা। কেউ সাহস দিলে একদিন হরবর করে সব বেরিয়ে আসবে।

দেখা যাবে সেখানে কোনো কিছুই তথাকথিত ক্ষমার আওতায় পড়ছে না। কেউ হয়তো মনে মনে ভিন্ন কোনো ছক আঁটছে। ওই ছকে ক্ষমা নেই, আছে অনেক অভিনয়ের নিত্যনতুন নকশা। অন্তরের সত্যকে বাধাগ্রস্ত করে ক্ষমা নামক প্রপঞ্চের চতুর্মুখী চাপ। পারিপার্শ্বিক অভিনয় মণ্ডল ক্ষমা করার বিনিময়ে কী কী প্রাপ্তিযোগ ঘটতে পারে এবং ক্ষমা না করলে কোথায় কোথায় অসুবিধা হতে পারে তার একটি তালিকা অতি সংগোপনে হাতে ধরিয়ে দেয়। নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা কমবেশি সবারই থাকে সুতরাং নিজের হিসাবটি মিলিয়ে নিয়ে ক্ষমায় সম্মতি জ্ঞাপন করাই চলমান পদ্ধতি। এভাবে নির্জলা মিথ্যাকেই ধীরে ধীরে সত্য বলে মনে হতে থাকে। বহুবার, অসংখ্য পন্থায়, বহুযুগ শতাব্দী ধরে ক্ষমার গুণকীর্তনে আমরা একে সুদৃঢ় করে তুলেছি।

সত্যের থেকেও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছি একটি সর্বৈব মিথ্যাপিণ্ডকে। সত্যের বিবিধ প্রেক্ষিত, বহুমুখী রূপ থাকলেও তার একত্ম বিষয়ে কোনো ধোঁয়াশা নেই। সত্য থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়া পরিবেশে ক্ষমা তার শাসন খুব শক্তভাবে চালাতে পারে। অসম ক্ষমতায়িত পরিবেশকে মিথ্যা ও ভ্রমের আবরণে মুড়িয়ে দিয়ে গোবেচারা মানুষদের ক্ষমার দীক্ষায় বিকল করে তোলা হয়। বিকল অসৃজনশীল অপোগণ্ড সমাজের যে সম্ভাবনাকে মৃত্তিকায় সমাহিত করা হয়েছে আমরা তাকে ক্ষমা নামে আখ্যায়িত করি। কিন্তু এমন ক্ষমা নামক বিভ্রমের অন্তরালে আমরা কি মানসিক বিকাশের দ্বারগুলোই রুদ্ধ করে দিচ্ছি না? ক্ষমা আসলে হবার বস্তু নয়। যিনি ক্ষমা করছেন এবং যিনি ক্ষমা নিচ্ছেন উভয়েই একটি অভিনয় দলের সদস্য, তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে, টিকিট বিক্রির স্বার্থে এই অভিনয়টুকু করতেই হবে। ক্ষমাকে অন্যভাবে দেখার দরকার আছে, কেননা ক্ষমার নামে আমরা আসলে প্রতারিত হচ্ছি, এর বদলে যেটি হতে পারে তাহলো ক্ষতিপূরণ। ক্ষতিপূরণ ক্ষমার বিকল্প না হলেও এতে প্রাপ্তিযোগের ব্যাপার আছে।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবই শেষ কথা, হ্যাঁ প্রাপ্তির ধরন আর বোধ নিয়ে কথা বলা যায়, একজন গুণগ্রাহী শিল্পী এবং একজন ব্যবসায়ীর প্রাপ্তিবোধে ভিন্নতা আছে, আছে অনুভূতির সূক্ষ্ণতায় পার্থক্য। প্রাপ্তিতে গরমিল হয়ে গেলেই ক্ষমার প্রশ্ন আসে, ক্ষমার আবরণে অপ্রাপ্তির বেদনাকে ঢেকে দেওয়া গেলেই আমরা তাকে ক্ষমা নামে অভিহিত করছি। আবার যোগ্যতার অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা থেকেও আমরা ক্ষমার বোধে নমিত হই। কাঙ্ক্ষিত বস্তু ব্যক্তি বা বিষয়ের অর্জনে ব্যর্থতাকে ক্ষমার খোলসে মুড়িয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে বদ্ধ সমাজ কাঠামোর খুপরিগুলোতে।

ক্ষমা একটি মহৎ গুণ হিসেবে অক্ষম এবং বিকাশের একটি পর্যায়ে থমকে যাওয়া সামাজিক ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের প্রণোদনা হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। কারা করছে? এটি খুব সহজভাবেই দেখা যেতে পারে, ক্ষমা নামক ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে শাসন-শোষণ দীর্ঘায়িত করার গভীর ষড়যন্ত্রটি আমরা ভুলে থাকছি। পৃথিবী আগাগোড়াই দু’ভাগে বিভক্ত ছিল; আছে। ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতাহীনের দ্বৈরথ চলছে তো চলছেই, আর এখানে পরাজিত পক্ষও পূর্বনির্ধারিত। বৈষম্যযুক্ত পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের মনোজগতের এত গভীরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে যে, এর পরিবর্তন যেন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।

শাসক-শোষিতের এই নষ্ট চক্রের ইতিহাসই এখন পৃথিবীর ইতিহাস, কিন্তু এটি পৃথিবীর নির্ধারিত নিয়তি নয়। এর পরিবর্তন সম্ভব। পুরাতন জটিল রোগের চিকিৎসা পদ্ধতিও জটিল, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এর প্রথম ধাপ অবশ্যই নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয়; রোগ চিহ্নিত করায় ভুল হয়ে গেলে সবই পণ্ডশ্রম। ক্ষমা এই পুরাতন রোগের একটি অন্যতম উপসর্গ। ক্ষমার ক্ষমতা ব্যক্তির নিজের থাকে না, এর আবশ্যিক শর্ত হলো মালিকানা অপরের হাতে রেখে তার কাছে চাইতে হবে। তিনি দিতেও পারেন আবার নাও দিতে পারেন। এর নির্ধারিত কোনো পারিশ্রমিক নেই, মালিক চাইলে অনন্তকাল খাটিয়েও ক্ষমা না করতে পারেন অথবা বিনা কারণেই ক্ষমা করে দিতে পারেন। এমন অসীম ক্ষমতা অপরের হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ হলো নিজেকে অপার নিঃস্ব হিসেবে শনাক্ত করা। যার নিঃস্বতা দারিদ্র্য অক্ষমতা একেবারেই তলানিতে থাকে, তার পক্ষে সত্য উচ্চারণই সম্ভব নয়। সে শুধু চাইতেই পারে, করুণ ফরিয়াদি হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। অপরের অনুগ্রহই হয় তার জীবনের মোক্ষ।

ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মীয় বিধিবিধানগুলো এদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ঈশ্বরের কাছে অনন্তকাল ধরে বিনা অপরাধেই ক্ষমা প্রার্থনা করে যেতে হয়। পাপের কোনো ইয়ত্তা নেই; জানা-অজানা ভূত ও ভবিষ্যতের পাপ। পূর্বপুরুষ উত্তরপুরুষ অধমপুরুষের পাপ। মানব জন্মই পাপের ভেতর থেকে এমন ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে একজন স্বাভাবিক মানুষকে পাপী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং তাকে অনুগত রাখার পুরনো কৌশল হিসেবে ক্ষমা করে দেওয়ার ধারণা প্রচারিত আছে। প্রথমে নানা ছলনায় অপরাধী বানানো, তারপর ক্ষমা করে দেওয়ার প্রলোভন, এই চক্রের বাইরে এখনও মানুষের জীবন প্রবেশ করতে পারেনি। এমন পতঙ্গসম জীবনে মানুষ ক্ষমা লাভের কাঙাল হয়ে ওঠে। ক্ষমা ভিক্ষার মাধ্যমে একটি শ্রেণিকে স্থায়ী ভিক্ষুুক বানিয়ে রাখার চক্রান্তটি এভাবেই অন্তরালে থেকে যাচ্ছে; কারণ এখানে রয়ে গেছে ক্ষমা নামক ভারী ইতিহাসের গুরুগম্ভীর পর্দার আস্তরণ।

কে কাকে ক্ষমা করে? কার হাতে সেই ক্ষমতা ন্যস্ত করা আছে? কে সেই ক্ষমতার মালিক? একটু তলিয়ে দেখলেই আমরা ক্ষমা নামক চোরাবালির আসল হদিস করতে পারি। ক্ষমতাবানের শর্ত মেনে, তার আনুগত্যের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়ার মানসিক দৌর্বল্যে যতখানি ক্ষমার মালিশ লাগানো যায় ততই আমরা ক্ষমাশীল হয়ে উঠি। ছকের বাইরে চলতে গেলেই নতুন পথের সন্ধানে বের হলেই যে চোখ রাঙানি এবং ভীতিকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করার হুমকি আসে, তা থেকে বাঁচার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়াই রীতি, এই রীতিকে প্রশ্ন করার সামর্থ্য যাতে কোনোভাবেই অক্ষম অর্জন করতে না পারে তার জন্যই তাকে ক্ষমার আওতায় আনতে হয়। ক্ষমা শব্দটি স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ, সুতরাং আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি স্বাধীনতা না ক্ষমায় বিশ্বাসী। ক্ষমায় বিশ্বাসীগণ বেঁচে বর্তে থাকবেন বটে, সমাজও চলবে সুশৃঙ্খলভাবে, এই শৃঙ্খল পরেই হাঁটতে হবে, বেড়ি পরে যতখানি স্বাধীনতা লাভ করা যায়, ক্ষমাশীল সমাজ ততখানি স্বাধীন তো অবশ্যই। শাসক চিরকাল অত্যাচার এবং ক্ষমা করার একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করেন। অধস্তন কখনও ক্ষমা করার অধিকার অর্জন করে না। অধস্তন ক্ষমা পাওয়ারও অধিকার রাখে না। সে শোষিত এবং প্রতারিত হওয়ার পর ক্ষমা নামক প্রবঞ্চনার শিকার হয়।

ক্ষমার বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। এই মোহন বাঁশির সুরে টলটলায়মান মানবতাকে উল্টেপাল্টে দেখলে এর কদাকার কুৎসিত চেহারাটি প্রকট হয়ে বেরিয়ে আসবে। ক্ষমার আসল চেহারা লোভের লার্ভায় ঘিনঘিনে বিবমিষার তৈরি করবে। পৃথিবীকে ক্রমাগত আরও পাশবিক করে তোলায় ক্ষমা নামক ঔষধি পত্রের ভূমিকা আছে। এই ধারণাটিকে কিছুটা সমর্থন করলে বলা যায়- ক্ষমা করতে হলে ক্ষতি করার, ক্ষত সৃষ্টি করার ক্ষমতা থাকতে হয়। ক্ষমা আসলে ক্ষমতাবানের বিষয় অথবা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার অস্ত্র কিংবা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার একটি কূটকৌশল। কিন্তু আমরা অক্ষমদেরই বেশি ক্ষমা করতে দেখি এবং চাইতেও দেখি (কারণ এর বাইরে তার সান্ত্বনা পাওয়ার অন্য কোনো গতি নেই, এমন মিথ্যা প্রলেপ লাগিয়ে জীবন পার করে দেওয়ার ক্ষমতাটুকু তার থাকে)। ক্ষত সৃষ্টি করার ব্যর্থতাই আমাদের ক্ষমাশীল হয়ে ওঠার অভিনয় শেখায়। আসলে কেউ কাউকে ক্ষমা করে না। ক্ষমা করতে হলে যতখানি মানুষ হতে হয়, ক্ষমাই তার পথে প্রধান অন্তরায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত