আমাদের যুদ্ধ

মা মোসলেমা, আমি তোমাক হাতজোড় কইরা কইতেছি। যা কইতেছি শোনো। গাঁয়ের বিপদ

ডাইকা আইনো না। শ্যাষে আমও যাইব, ছালাও যাইব। মিলিটারি তুমিও চেনো, আমিও
এইডো কয়েন না চাচা! আপনে আমাক আপনের বাড়ি দিনরাইত কাম কইরব্যার কন, তাও ওইহানে পাঠায়েন না…

মা কিছু বলে না। কাজী সাহেবের জ্বলন্ত চোখের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারে
না। আমরাও মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। প্রতিবেশী দু-একজনও এদিকে আসছে দেখে কাজী
সাহেব বলে, যাইকগ্যা, বোঝোই তো দ্যাশের অবস্থা! লোকজন নানা কিছু কয়। চামড়ার
মুখ, সেলাই তো আর করা যায় না। এই হাশেমের উছিলায় যদি গাঁয়ের উপুর বিপদ
নাইমা আসে, কী করমু কও?…তুমি এক কাম কর, স্টেশনে মিলিটারি-রাজাকারগারে যে
ক্যাম্প হইছে, ওইহানে ঝিয়ের কামে যাও। তোমারও দুই ব্যালা ভাত জুইটব,
মানুষজনের মুখও বন্ধ হয়্যা যাব্যো।

চাচীক তো উদিনক্যা কইয়া আইছি আমি চাচা মিয়া, হেই যে ধাওয়া খাইয়া আমরা
গাঁয়ের ব্যাবাক লোক বাইর হইল্যাম, নদী পার হওনের আগ দিয়া কোন দিক যে হারায়া
গ্যালো। পাগলের মতো দৌড়াইতেছিলাম, উটকায়া আর পাই নাই। মনে পাপ আছিল, তাই
সব দৌড় দিছো! ক্যান, আমি তো গাঁও ছাড়ি নাই। আমার তো কুনু ক্ষতি হয় নাই।
তোমরা দৌড়াইলা ক্যান?- কাজী সাহেব গজ-গজ করতে থাকে – আর হাশেমকে তো দেখছি,
জয় বাংলা জয় বাংলা কইরা চিক্কুর পারতে। এ্যাহন কইতেছো হে পাছার কাপড় তুইলা
কোন মুহে চইলা গ্যাছো, তুমি তার কিছুই জানো না।

কাজী সাহেব এই কথার উত্তর দেয় না। তসবিহ টিপতে টিপতে বলে, হাশেম কোনে? তাক দেহা যায় না ক্যান!

চাচা মিয়া আইছেন!- আধা ভয় আধা সংকোচে মা কেবলই জড়োসড়ো হয়ে যায়।- আসার কী দরকার ছিল চাচা মিয়া, খবর পাঠাইলে আমিই যাইতাম।

হাশেম তো আমার বাপের নাম, আমি ঘরের মধ্যে ধড়মড় করে উঠে বসি। মা আর রীণাও দৌড়িয়ে আসে পেছন বাড়ি থেকে।

কী ভেবে আবারও বলে, হাশেম বাড়িত আছিস?

সেইদিন অনেক লটকন আর ডেউয়া নিয়ে এসেছি বাগানপাড়ার ঝোপঝাড় থেকে। আর হয়রানও
হয়েছি বেশ। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে শুয়ে থাকতে থাকতে একবার দেখতে পাই, মায়ের
নানীবাড়ির সেই মেয়েটাকে রীণা বুক ফুলিয়ে বলছে, গ্যাছে-গ্যাছে, আমাগারে গাঁও
থাইক্যাও গ্যাছে; আমার বাপেই তো গ্যাছে। তখনই আসরের নামাজের পর কাজী সাহেব
এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাকারি দিতে থাকে। তার পর ডাকতে থাকে,
মোসলেমা- মোসলেমা- বাড়িত আছো?

শুনতে পাই, মিলিটারিরা গাঁয়ে আসে নাই- তবে রেলস্টেশনে তারা ক্যাম্প করেছে।
সঙ্গে রাজাকাররাও আছে। মাঝেমধ্যে তারা টহল দিয়ে বেড়ায়। আমাদের গ্রামের
কুদ্দুস, কাজেম ভাইরাও রাজাকার হয়েছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরেফিরে তারা বলছে, ভয়
নাই- ভয় নাই, তোমাগারে কুনু ভয় নাই। তা ভয় না থাকুক, ক্ষুুধা তো আছে! আরে
বাপ রে ক্ষুধা, চিক্কুর দেয়ার শক্তিও খুঁজে পাই না। আমার কি আর কামলা দেয়ার
বয়স হয়েছে যে বাপের মতো কামলা খেটে বেড়াব! এ ঝোপ ও ঝোপ ঘুরে বেড়াই, বুনো
শাক তুলে বেড়াই, ফলমূল কুড়িয়ে খাই, ডোবার তলে মাছ হাতড়াই। কিন্তু সে আর
কতক্ষণ? পাগলের মতো লাগে, মার চুল ধরে টানি, অভুক্ত মা সহজেই হেলে পড়ে,
আমরা তার হাড় গুনতে পারি, আমরা তার চোপায় থু থু দিতে পারি, আমরা তার হাতের
ডানায় ঘুষি দিয়ে পারি, কিন্তু ভাত পাই না। মা রেগে রেগে ওঠে, আমাদের
চড়-থাপ্পড় মারে, আমরা তারস্বরে কাঁদি, কাঁদতে কাঁদতে তার হাতে কামড়াই,
পাঁজরে কামড়াই, ঊরুতে কামড়াই, মুখের নাগাল পাই না বলে থু থু ছিটাই আর
গালাগালি করি; মা আমাদের আবারও মারতে থাকে, মারতে মারতে শুইয়ে ফেলে,
আশপাশের বাড়ি থেকে লোকজন এসে থামায় তাকে, ‘অবলা ছাওয়াল-মিয়া, তাগারে ক্যান
মারো?’ কিন্তু কেউ আমাদের নিয়ে গিয়ে ভাত খেতে দেয় না। মা হাত-পা ছড়িয়ে বসে
পড়ে, দুই হাতে মুখ ঢাকে, হু-হু করে কাঁদে। আমরা দুই ভাইবোনও তার পাশে বসে
কাঁদতে থাকি।

ভোরের আলো ফোটার আগেই শুনি মোরগ ডাকছে- আমাদেরই মোরগ। মা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে,
আমিও উঠি। ছাপড়াঘরের ঝাঁপি সরিয়ে বাইরে গিয়ে দেখি, ডোবার ধারে ছাতিম গাছটার
ডালে বসে মোরগটা ডাকছে, সঙ্গে একটা মুরগিও আছে। মা হেসে ফেলে, আমিও হাসি।
তার পর কাঁচি নিয়ে শবরি গাছ থেকে এক কাঁদি কলা কেটে আনি। আধপাকা রেখে
গিয়েছিলাম। একদিনেই পুরো পেকে গেছে। কিছু কলা বাজারে নিয়ে বিক্রি করব,
ভাবি। তাই ডজন হিসেবে আলাদা করতে থাকি। আর দেখি, নামাজ পড়া শেষ করে কাজী
সাহেব পাড়া বেড়াচ্ছে। এ বাড়ি ও বাড়ির সামনে থামছে। আমার আত্মার মধ্যে কেমন
করে ওঠে- তাই তো, গাঁয়ের অবস্থা একটু দেখা দরকার না! মিলিটারি কি আমাদের
গাঁয়ের কাউকে মেরে ফেলে গেছে? কাজী সাহেবরা সেদিন পালায় নাই, নাকি?

আমরাও ন্যাটা দিয়ে বসলাম। খুব ক্ষুুধা পেয়েছে। কিন্তু কিছু বলার সাহসই
পাচ্ছি না। তা ছাড়া বাড়িতে খাওয়ার আছেই বা কী! বাবাও তো চলে গেল। কী যে খাব
আমরা! কিছুক্ষণ উশ-খুশ করে আমি আর রীণা সেই চিড়া আর চিটাগুড় খেতে থাকি। কী
ভেবে মা-ও খায় একটু। তার পর চাটাই পেতে শুয়ে পড়ি আমরা।

বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতই হয়ে গেল। কিন্তু জ্যোৎস্না ছিল, আলপথেও
আমাদের সমস্যা হলো না। সমস্যা একটাই, গ্রামটাকে একেবারে শূন্য মনে হচ্ছে।
আর কাজীবাড়ির হ্যাজাকের আলোর আভায় গাছের লম্বা ছায়া বিশাল ভূত হয়ে দাঁড়িয়ে
আছে। গড়ান বেয়ে আমরা বাড়িতে ঢুকতেই কয়েকটা শেয়াল লাফিয়ে বেরিয়ে পালায়। মা
দৌড়ে মুরগির খোপের কাছে গেল; হায়, হায়, তার যে তিনটা মুরগি আর একটা মোরগ
ছিল। সেগুলোকে কি শেয়াল-বেজি সাবাড় করে ফেলল! নাকি পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ
ধরে নিয়ে খেল! মানুষজনের স্বভাব কি আর যুদ্ধ লেগেছে বলে ভালো হয়ে গেছে?
দুইটা মুরগি ডিম পাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু মা আমাদের একটা ডিমও খেতে দেয়
নাই। ১০-১৫ দিনের মধ্যেই বাতে বসার কথা ওগুলোর। মোরগের না হয় ফুর্তি বেশি,
মুরগি দেখলেই তার পিছে পিছে অন্য বাড়ির খোপে গিয়ে ওঠে; প্রায়ই আমাকে আর
রীণাকে অন্য বাড়ির খোপ থেকে মোরগ ধরে নিয়ে এসে নিজেদের খোপে ঢুকাতে হয়;
কিন্তু মুরগিগুলোকেও খুঁজে পাওয়া গেল না। আবছায়া জ্যোৎস্নাতে মা একচিলতে
উঠানের মাটিতেই বসে পড়ল।

শুনে আমার খুব আরাম লাগে। বুকের ছাতিটা ফুলে ওঠে। কেন, তা জানি না। তবে
কোনো কারণ ছাড়াই মাকে অতিক্রম করে তার আগে-আগে হাঁটতে থাকি বাড়ির দিকে।

গ্যাছে তো- তোর বাপেও তো যুদ্ধ কইরবার গেল!

আমাদের জলাভূমিটা পার করিয়ে দিয়ে বাবা তার নিজের মতো উল্টো পথে অন্ধকারে
হাঁটতে থাকে। আমরাও গাঁয়ের দিকে হাঁটতে থাকি। হঠাৎ আমার সেই মেয়েটার কথা
মনে পড়ে; আমি বোকার মতো প্রশ্ন করি, মা, আমাদের গাঁয়ের কেউ যুদ্ধ শিইখব্যার
যায় নাই?

আমাদের ভয়-ভয় করে। কী এক অজানা শঙ্কায় বুকটা কলার ভেলা হয়ে হাবুডুবু খায়।
কিন্তু আমরা মাথা নেড়ে সায় দেই। আমার খুবই ইচ্ছা করে বাবার কোলে চড়তে।
বাবার কোলে কোনোদিন চড়েছি বলে এখন আর মনে পড়ে না। দিনের নীল আকাশটা এখন
কালো ছাতা ছড়িয়ে আমাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। মা মনে হয় মুখের মধ্যে আস্ত
আঁচলটাই গুঁজে রেখেছে। এখন তো কোনো মানুষজন নাই, কোনো মৌলভী-মুনশীও নাই;
তার পরও মা কেন যে এভাবে ঘোমটা টেনে আঁচলটা মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়েছে,
বুঝতে পারি না।

না রে। খান সেনারা ক্যাম্প কইরছে, বুঝলি? আমার বাড়িত থাহা ভালো না। তর মা
তোগারে দেইখা-শুইনা রাইখব। আমিও মাঝেমইধ্যে আসমু- ম্যালা রাইতে, বুঝলি?
তোরা কইল কারু কাছে কিচ্ছু কইবি না। কেউ কিছু জিগাইলে কইবি, ধাওয়া খাইয়া
পলানের দিন, বাবা য্যান কোন মুহে চইল্যা গ্যাছে, হারায়্যা গ্যাছে মনে কয়।

ক্যান, তুমি? তুমি যাইবা না?- সমস্বরে আবারও বলি আমরা।

হ, আইছি তো, এই জলা পার হইয়া সোজা ওই উত্তর মুহে। তোর মা খুব ভালো কইরাই চেনে। তোগারে বাড়ি নিয়া যাইব।

না বাবা, হয়রান হই নাই- আমরা সমস্বরে বলি- আর বাড়ির কাছে চইল্যা আসছি তো। আসি নাই, কও?

বাবা কাছাকাছি এসে আমাদের দুইজনকে একেবারে সাপ্টে ধরে, কী রে, এহেরে হয়রান হয়্যা গেছিস?

বলে আমার কাঁধে ভর করে রীণা উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখি, মা আর বাবা
কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে সন্ধ্যাও তো অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। আকাশের আগুন
আর ধোঁয়া তাই অন্ধকার সরিয়ে নীল আকাশকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

হ, বাড়ির কাচেই তো- তয় কত লম্বা দেখছোস? কোন মুখ দিয়া যাওয়া লাইগব কেডো জানে!

হু-উ-উ, রাস্তা মনে কয় ওই মুহে-সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলি আমি-এই জলা আমাগারে বাড়ির কাচে না?

নু, আব্বা-মা দাঁড়ায়া আচে। রাস্তা মনে কয় ওই মুহে- বলে রীণা আমাকে ঠেলতে থাকে।

বাড়ি যাওয়ার জন্যে এক পা বাড়িয়েছি- তখন এই সব খুচরা কথাবার্তা শুনতে কারই
বা ভালো লাগে! আমরা মাকে প্রায় টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে এসেছিলাম।
মায়ের নানী তার নাতনির জন্যে মরার কান্না জুড়েছিল আর মামি দৌড়ে এসে রীণা ও
আমার হাতে এই ত্যানায় বাঁধা চিড়া আর কলাপাতায় মোড়ানো চিটাগুড় দিয়েছিল। কখন
বাড়ি পৌঁছাবো সেসবের তো ঠিক-ঠিকানা নাই, দুই ভাইবোন তাই সেই চিড়া চিবুতে
থাকি। দূরের আকাশজুড়ে আবারও আগুন আর কালো ধোঁয়া দেখা যায়। তার মানে, আবারও
কোনো গ্রাম জ্বলছে, বাড়িঘর পুড়ছে, মানুষজন মরছে, পালানোর জন্যে দৌড়াচ্ছে।
আমাদের চিড়া খাওয়া থেমে যায়, জলাভূমি থেকে উঠে আসতে থাকা কাঁকড়াটাকে দেখতে
ভুলে যাই। একবার অনেক সাহস করে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, বেশ খানিকটা দূরে,
মনে হয় এক আকাশেরই গায়ে বাবা আর মা একজন আরেকজনের হাত আঁকড়ে ধরে সামনের
আগুনজ্বলা আকাশটাকে দেখছে। কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না- না তাদের রাগ, না
তাদের ভয়, না তাদের কান্না। শুধু এই আভাসটুকু দেখি, হাত ধরাধরি করে তারা
দাঁড়িয়ে আছে। আমার মনে কেমন যেন বিতৃষ্ণা জাগতে থাকে, আবারও কি আমাদের সেই
মায়ের নানীর গাঁয়ে ফিরে যেতে হবে? কী দরকার যাওয়ার? চুলার পাড়ে খড়ের মধ্যে
শুয়েছিলাম, রাতে বোধহয় একটা কুকুর এসেও শুয়েছিল আমার পাশে; তা সেসব কথা না
হয় বাদই দিলাম- আমাদের তো খাওয়াতেই পারল না ভালো করে দুই বেলা। তা হলে কী
দরকার আমাদের আর ওই গাঁয়ে আবার যাওয়ার! ক্যানো, বাবার বোনা যবের ক্ষেত
পাহারা দেয়ার জন্যে গত বছর আমি ক্ষেতের মধ্যে আলের ওপর কত রাত শুয়ে থাকলাম!
তা হলে এখন থাকতে সমস্যা কী? আর বাবা-মা তো আমাদের চেয়ে কত বড়, তাদের আলের
ওপর শুয়ে থাকতে তো কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা না। বাকি থাকে রীণা; তা
ধারেকাছে আমরা তিন-তিনজন মানুষ আছি-ওর কি ভয় করা উচিত হবে? তা ছাড়া খান
সেনারা কি আর এইসব চড়ার মধ্য দিয়ে হাঁটতে পারে? কোন দুঃখে তারা আসবে
ক্ষেতখোলার মধ্য দিয়ে আমাদের ধরতে?

‘হ, মামিজান, আপনেগারেও সমস্যা হইলে চইলা আইসেন। আমরা যেমন কইরা থাকি,
সেইরকম কইরাই থাইকবেন না অয়। বিপদ-আপদ তো আর বইলা-কইয়া আসে না।’

সেই দিন দুপুরের পর-পরই আবার আমরা বাড়িতে ফিরতে থাকি। কালকের মতো আজ আর
কোনো লোকজন নেই। মনে হয়, মা-বাপের অত তাড়াহুড়োও নেই। তবে কী যেন বলাবলি
করতে থাকে তারা নিচু গলাতে; কখনও হয়তো উঁচু গলাতেও। এদিকে আমরা তো হাঁটছি
না- রীতিমতো দৌড়াচ্ছি, তাদের পিছে ফেলে অনেক দূর গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছি কোনো
গাছের নিচে, কখনো-বা আলপথের ওপর বসে থাকছি। মাঝেমধ্যে ভয় করছে, হয়তো এখনই
নদীতে দেখতে পাব সেই মৃত মানুষের ঝাঁক। কিন্তু বাবা কোন দিকে দিয়ে যে নিয়ে
আসে, নদীর বুকে সেইসব আর দেখি না।

মাঝিটা আমাদের নদীর আরেক পাড়ে নামিয়ে দিলে আমরা আবারও হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে দেখি, ক্ষেতখোলার মধ্যে বেশ
বড়-সড় একটা জলাভূমিও আছে। এই গরমের দিনেও কী ঠাণ্ডা টলটলে পানি তার! একটা
বক আর মাছরাঙা চরে বেড়াচ্ছে সেখানটায়, বড়-সড় পদ্মপাতা ভাসছে। বাপ-মাকে
ছাড়িয়ে এত আগে চলে এসেছি যে রাস্তা হারিয়ে ফেলার ভয়ে শেষমেশ সেটার পাড়ে বসে
অপেক্ষা করতে থাকি আমরা দুই ভাইবোন। আসার আগে মায়ের মামী আমাদের সঙ্গে বেশ
ভালো ব্যবহার করেছে। একটা ত্যানায় খানিকটা চিড়া আর কলাপাতায় মুড়িয়ে
খানিকটা চিটাগুড়ও দিয়ে দিয়েছে। আবার যেতেও বলেছে। মাকে দেখি মায়ের মামি
বলছে, ‘এমন বিপদের দিনে আইসলা, কী আর কমু! দেখলাই তো, বাড়িঘরের কী অবস্থা,
কত মানুষজন আইসতেছে! কাক রাইখা কাক ফিরামু, কও? আল্লার নামে যাও, বিপদ-আপদ
কাইটা যাইব। যুদ্ধ শেষ হইলে ধীরে-সুস্থে আবারও আইস, বিপদে পইড়লে আগেই চইলা
আইস, মইরলে না হয় একসাথেই মরমু।’

ফিরে এসে দেখি, মা আর বাবা আমাদেরই খুঁজছে। তবে খাওয়ার জন্যে না- বাবা এরই
মধ্যে কোত্থেকে খবর পেয়েছে, গ্রামে ফিরলে এখন কোনো সমস্যা নাই। অনেকে এর
মধ্যে ফিরেও গেছে। অতএব কী দরকার অন্য বাড়ির লোকজনকে কষ্ট দেয়ার! বাবা তাই
চাইছে আজই ফিরে যেতে। আমার একবার বাবাকে বলার ইচ্ছে করে, নদীতে আমরা কী
দেখে এসেছি। কিন্তু সে কথা বলা হয় না। মায়ের নানীবাড়িতে দেখি লোকজনের ভিড়
আরও বেড়েছে। যারা চাল-ডাল খানিকটা সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পেরেছে, তারা
নিজেরাই রাঁধতে বসেছে চুলা বানিয়ে। রাঁধতে রাঁধতে খুনখারাপির গল্প করছে।
আমার কিছু কানে ঢোকে না। ডালের ঘ্রাণে আমার খুব ক্ষুুধা পেয়ে যায়। কিন্তু
আমরা খেয়েছি, নাকি খাই নাই, সেই খোঁজ মা-বাপেও করে না। আতাগাছওয়ালা
বাড়িটার সামনে দেখি, শহর থেকে আসা একটা পোলা খানিকটা বাঙ্গি আর খেতেই পারছে
না। আমি একটুও দ্বিধা না করে সেই বাঙ্গি নিয়ে খেতে থাকি। তার পর রীণা চেয়ে
আছে দেখে, তাকেও দেই বাকিটা।

নদীর ধারে গিয়ে কড়ূই গাছের নিচে মার্বেল খেলা শুরু করতে না করতেই ব্যাপারটা
আমাদের চোখে পড়ল। বর্ষা আসি-আসি করছে, নদীও তাই ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু
করেছে। সেই নদীর বুকে লাশের পর লাশ দোল খাচ্ছে। কোনো লাশ চিৎ হয়ে আছে, কোনো
লাশ উপুড় হয়ে আছে, তাদের চোখ-মুখ শরীরের অনেক কিছুই খুবলে খুবলে খেয়েছে
মাছ আর পানি। বাতাসের দেয়া সংবাদ পেয়ে কয়েকটা শকুন আর পাখি বারবার ঘাই
খাচ্ছে। নদীর পানিও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। একটার বেশি দুইটা লাশ আমরা কোনোদিন
দেখি নাই। এ সবই নিশ্চয় কাল করেছে পাকিস্তানিরা! মার্বেল খেলা বাদ দিয়ে
আমরা তিনজন আবারও গ্রামের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকি।

এইহানে খেইলবার নিলি মা আমাক খেইলবার দিব? আমি বড় হয়্যা গেছি, না? ওই নদীর ধারে কড়ূই গাছ আছে, নু যাই, ওইহানে খেলমু।

ক্যান, এইহানে সমস্যা কী? গাছের নিচের রাস্তা ফাঁকা পইড়া আছে, তুই খালি হাঁটাইতিছিস।

তালি চল।

খেলমু তো!

ক্যান, গুটি খেলবি না?

গ্রাম থেকে বেরিয়ে বাঁশবনের কাছ দিয়ে মেয়েটা আমাদের কেবল হাঁটাতেই থাকে।
আমরা খানিকক্ষণ হাঁটার পর বিরক্ত হয়ে উঠি। রীণা তো বলেই বসে, আমাগারে কই
নিয়া যাস?

তাই সই, হাঁপ ছেড়ে বাঁচি আমি। এই গ্রামে খুব বেশি বাচ্চা পোলাপান নাই মনে
হয়। আর থাকলেও আমাকে মনে হয় খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। একটা মেয়ের সঙ্গে
মার্বেল খেলতে হবে ভেবে কেমন যেন লাগে; তা ছাড়া খেলায় হেরে গেলে ব্যাপারটা
তো আরও খারাপ হবে। তা যাই হোক, এখন এই খেলার কথা চিন্তা করে আমার
ক্ষুধা-টুধা সব দূর হয়ে যায়। কাল এই গ্রাম দেখে আমার গা কেমন ছমছম করছিল।
কিন্তু আজ আর তেমন মনে হয় না।

এইসব বলে আর আশপাশে ঘন ঘন তাকায় মেয়েটা। রীণার মুখ একেবারে চুপসে যায়।
আমাদের গ্রাম থেকে কি কেউ যুদ্ধ করতে গেছে? যুদ্ধ শিখতে গেছে? সত্যিই তো,
কেউ কি গেছে? আমি আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকি। মেয়েটা মনে হয় আমাকে তা থেকে
উদ্ধার করার জন্যেই বলে, নু, গুটি খেলিগা। চিন্তা করিস না, আমার কাছে গুটি
আছে। খেলবি, খেলার পর সব আবার হাতে-হাতে ফেরত দিবি।

তবে এই মেয়ে সেসব কথায় পাত্তাই দেয় না। ঢোকসার গোবরে লুচানি চুবিয়ে ডোয়ার
ওপর শেষবারের মতো লেপতে লেপতে ওর গলা এবার আরও নিচু হয়ে আসে, তোরা তো ধাওয়া
খাইয়া পালায়া আছিস! আর আমাগারে এই গাঁও থাইকা ছয়জন যুদ্ধ শিইখা
মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জইন্যে ইন্ডিয়া গ্যাছে। বুঝলি? মুক্তিযোদ্ধার নাম শুনলি
পারে পাকিরা হাইগা-মুইতা ফ্যালায়, হে কতা জানিস? মা কইছে, যুদ্ধ শিইখা
ফিইরা আসার পর হ্যারা পাকিগারে ওইসব মেশিনগান-টান সব কাইড়া নিব। পাকিরা তহন
পাছার কাপড় তুইলা দৌড় দিব।

না দৌড়ায়া উপায় আছে? খালি কি মিলিটারি? এক গাড়ি মিলিটারি আইছে। ই রে বাপ রে
বাপ- তোগোরে এহেনে তো আসে নাই; তোরা কী বুঝবি! বিরাট মেশিনগান, হেইটা দিয়া
গুলি করে, এক্কেরে শিলাবৃষ্টির মতো দাপুরদুপুর পড়ে- রীণা এমনভাবে কথা বলতে
থাকে যে, মনে হয় ও নিজেই হাজার হাজার মেশিনগান নাড়াচাড়া করেছে আর রাজ্যের
গোলাগুলির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই গাঁয়ে এসেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
কথা হলো, এই গাঁয়ে মিলিটারি আসে নাই বলে, এ গাঁয়ের মানুষজনকে মিলিটারির
ধাওয়া খেতে হয়নি বলে এটার আর মানমর্যাদা তেমন নাই বললেই চলে।

ক্যা, গুটি নাই তোগারে কাছে?- তার পর মেয়েটি নিজেই বলে- ও-ও, তোগোরে ওহানে তো মিলিটারি আইছে! তোরা তো সব ফালায়া দৌড় দিছস?

কী খেলমু?- বোকার মতো বলি আমি।

পরদিন মানুষজনের চলাফেরা আর কথাবার্তায় তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙে আমাদের। তা ছাড়া
মায়ের মামিও চুলার পাড়ে চলে আসে রান্না চড়াতে। মা-ও হাত লাগায় তার সঙ্গে।
আমরা আর কী করি, ঠাহর করতে পারি না, এ বাড়িতেই আমাদের খাওয়া-দাওয়া হবে কি
না। কাউকে কাউকে দেখি, আশপাশের বাড়ির লোকজন ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। তবে আমাদের
কেউ ডাকে না। আমরা এলোমেলো ঘুরে বেড়াই। দেখি আমাদের বয়সী এক মেয়ে শলায় গোবর
লাগিয়ে রোদে দিচ্ছে। এইভাবে পাটশলাগুলো সব শেষ হয়ে গেলে সে বাদবাকি গোবর
গুলিয়ে তাদের ঘরের ডোয়া লেপতে থাকে। কোনখানে যেন একটা বুলবুলি পাখির ডাক
শুনে আমার আগের দিনের কাঠঠোকরাটার কথা মনে পড়ে যায় তখন। আমি রীণাকে নিয়ে
চলে আসার চেষ্টা করতেই মেয়েটা গোবর লেপা বন্ধ করে চাপা গলায় বলে, খেলতে
যাবি?

কিন্তু চুলার পাড়ে শুয়ে মনে হয়, ভালোই হয়েছে। আকাশে অনেক অন্ধকার। কিন্তু
সেই অন্ধকারের মধ্যে কত তারা ফুটে আছে! মনে হয়, দুপুরের সেসব আগুন গিলে
খেতে খেতে নিজেও পুড়ে কেমন টুকরো টুকরো উজ্জ্বল শাদা ছাই হয়ে গেছে। সেসব
দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি আমি।

রাতে বাবা কোনখানে থাকি, তা আর জানতে পারি না। মায়ের মামাবাড়ির চুলার
ছাউনিটার নিচে খরজাবা ছড়িয়ে তার ওপর একটা কাপড় বিছিয়ে আমি আর রীণা মায়ের
সঙ্গে শুই। সন্ধ্যা হওয়ার আগে আরও অনেক লোক এসেছে এ বাড়িতে। মায়ের মামির
ভাই-ভাবিরাও এসেছে ধাওয়া খেয়ে। মার ওপর খুব রাগ হতে থাকে আমার। কী দরকার
ছিল তার আগবাড়িয়ে গিয়ে বলার, মামি, বাড়িত এত মানুষজন, চিন্তা কইরেন না,
আমরা খরজাবা বিছায়া চুলার পাড়ে থাকমুনি? মা এইসব না বললে তার মামা নিশ্চয়ই
ভালো কোনো জায়গায় থাকতে বলত আমাদের!

লোকটাকে হঠাৎ ভীষণ সতর্ক মনে হয়। মুরগির ছানাকে উঠানে ছেড়ে দেয়ার মতো যত্ন
করে সে তার ভাতিজাকে নামিয়ে দেয় কোল থেকে, ‘জানি না। ক্যান, ওই পাড়ে যাইব
ক্যান? ওই পাড়ে কি রসগোল্লা আছে?’ বলতে বলতে সে হাঁটতে থাকে। বাবাকেও দেখি
তার পিছু পিছু হাঁটতে আর এই কথা বলতে, ‘না, কইলেন যে, বুহের মইধ্যে রাইখা
দিছেন! তাই কইলাম। ব্যাবাকরে তো আর কওয়া যায় না।’

ওই যে, ওই পাড়ে?

লোকটা ভ্রু কোঁচকায়, কোনহানে?

লোকটা হো-হো করে হেসে ওঠে, আমার বাপকেও দেখি কোত্থেকে এসে দাঁড়িয়ে হাসছে
হা-হা করে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বাবার চোখ যেন টলে ওঠে, দুলে ওঠে। কী
রকম যেন লাগে তাকে, মনে হয় ওই লোকটার মতো বাবারও আমাকে কোলে নিয়ে আদর করার
ইচ্ছা করে। কিন্তু শরমও করে। লোকজন সব চলে গেছে এখন, তাতে সে যেন আরও আড়ষ্ট
হয়ে পড়েছে। সেই আড়ষ্টতা নিয়েই সে বলে লোকটাকে, কেউ গেছে নাহি এ গাঁও
থাইকা?

এই যে দ্যাখ, এইহানে, এইহানে রাইখা দিছি- বলে লোকটা ছেলেটার হাত নিজের
বুকের ওপর টেনে নিয়ে ঘষটাতে থাকে। আর ছেলেটা আবারও প্রায় চিৎকার করে ওঠে,
এহ্‌, এইহানে বলে রাইখছে! খালি পশম-

হে-হ্‌- রাইখা দিছে! কোনে রাইখছ? আমি নিজের চোহে দেইখলাম-

ছিঁড়ি নাই রে ভাতিজা, রাইখা দিছি। যত্ন কইরা রাইখা দিছি।

না, ছেড়ো নাই! ছিড়্যা ফ্যালায়া দিলা-

কথা অসম্পূর্ণ রেখেই সে ছেলেটাকে আবার আদর করতে থাকে, কান্দিস ক্যা? ছিঁড়ি নাই তো।

শুনে লোকটা বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে থাকে, এইসব পোলাপান বোঝে না ঘোড়ারান্ডা, খালি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে…মিলিটারি আইলে…

আমাদের ছোট পাড়ার মতো এইটাও ছোট একটা পাড়া। ঘরদোর ছড়ানো ছিটানো হলেও মনে হয়
একটাই বাড়ি। কার বাড়ি বোঝা যায় না। যার যে বাড়িতে দরকার, অনায়াসে ঢুকে
পড়ছে, বড় জোর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে গলাখাকারি দিয়ে জানতে চাইছে, অমুকে বাড়ি
আছে কি-না। কিন্তু উত্তর না শুনেই ঢুকে পড়ছে বাড়ির ভেতর। মনে হয় এই গাঁয়ে
সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যা নেমে পড়ে। তবু তার আগেই গাঁয়ের লোকজনকে দেখি, সবাই
মিলে খুঁজে খুঁজে পাড়ার এ ঘর, ও ঘরের বেড়া আর গাছগাছালির সঙ্গে লাগানো নৌকা
আর জয় বাংলার সব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে, ভোটের পোস্টার তুলে ফেলছে। আমি ডান
হাতের চার নাম্বার আঙুল তোলা কালো কোট-পরা মুজিবের একটা পোস্টারের সামনে
দাঁড়িয়ে তার মতো করে বলার চেষ্টা করছিলাম, ‘ভায়েরা আমার…’; তাই দেখে রীণা
আর নতুন এই গাঁয়ের কয়েকটা মেয়ে হাসছিল যেন কী রকম ফিকফিক করে। কিন্তু আমার
বলা আর ওদের হাসা শেষ করার আগেই কে একজন এসে সে পোস্টারটাও টান দিয়ে ছিঁড়ে
নামিয়ে আনে ছনের ঘরের বেড়া থেকে। তাই দেখে নতুন এই গাঁয়ের আমারই বয়সী এক
ছেলে দেখি কেঁদে ফেলল, ‘ছিড়ল্যা ক্যান কাকা? ছিড়ল্যা ক্যান? কও ছিড়ল্যা
ক্যান?’

লোকজন এসব বলছে আর আমি দেখছি, মায়ের মামাবাড়ির বড় নারকেল গাছটার খরখরে শরীর
খুঁড়ে একটা কাঠঠোকরা বাসা বেঁধেছে। আর সেটা মাঝেমধ্যেই ফুটো দিয়ে তার
ঠোঁটটা বাইরের দিকে বের করে লোকজনের ভিড় দেখছে। অনেক দূরে, তাই ঠিক বোঝা
যায় না, ওর চোখে কোনো বিরক্তি আছে কি-না। আমার সারা শরীরের রক্ত চনমনিয়ে
ওঠে। মনে হয়, এখনই তরতরিয়ে গাছ বেয়ে পৌঁছে যাব কাঠঠোকরার কাছে। এ তো
নিশ্চিত- ওই বাসায় কোনো সাপ নাই। থাকলে কাঠঠোকরাটা এতক্ষণ বসে থাকত না;
কিন্তু তার পরই আবার ওঠার ইচ্ছায় ভাটা পড়ে। কী যেন আমার ইচ্ছাটাকে মেরে
ফেলে, বুঝতে পারি না। যুদ্ধ- যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, বলছে সবাই; ব্যাপারটা
বোঝার চেষ্টা করি আর মায়ের মামির দেয়া মুড়ি খাওয়ার চেষ্টা করি। মনে হয়,
মায়ের মামি খুব কিপ্টা, তেল-গুড় তো দূরের কথা, একটা পিঁয়াজ-মরিচও দেয় নাই
গামলার মধ্যে। মা কেন যে আমাদের তার মামি-নানীবাড়ির এত গল্প শোনাত, তা
বুঝতে পারি না!

অতএব আমাদের কখনো নানীবাড়ি-মামাবাড়ি যেটাই বলা হোক না কেন, দেখা হয় নাই। আর
মামা-নানাদের কাউকেও কখনো আমাদের বাড়িতে আসতে দেখি নাই। আমরা তাই ঘুরেফিরে
মায়ের এই নানীবাড়ি দেখতে থাকি। অবশ্য দেখারও বেশি কিছু নাই। আমাদের মতোই
ছনের ঘর মায়ের নানীর। বেশি বলতে একটা টিনের ঘর। তার মধ্যে আবার একটা চকিও
আছে। আমরা সেই চকিতে ওঠার সাহস পাই না, আর মায়ের মামা-মামিও সেইখানে আমাদের
উঠে বসতেও বলে না। চকির নিচে দেখি কাঁঠালের ম-ম গন্ধে ভরা। এ বছর এখনও
আমাদের ভাগ্যে কাঁঠাল জোটে নাই। কিন্তু পরের বাড়ির জিনিস খাই কী করে! আমরা
তাই টিনের ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের উঠানে দাঁড়াই। মনে হয় গাঁয়ের প্রত্যেকেই
আমাদের দেখতে এসেছে, বাবার সঙ্গে কথা বলছে। বলাবলি করছে, খান সেনারা এখন
শহর ছেড়ে গ্রামেগঞ্জেও ঢুকছে, মানুষজনকে মেরে ফেলছে, ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে।
তাদের ধাওয়া খেয়ে আমাদের গাঁয়ের সবাই এখানে-খানে ছড়িয়ে পড়েছে।

ক্যান, ঘর কি আপনের চৌদ্দখান নাহি? আপনেরও তো একখানই ঘর- হ্যার চালও আবার
ফুটা দিয়া বোঝাই। আপনে এত কতা কন ক্যান? মিয়া বড় হইক, বিয়া দ্যান, তহন
বুইঝবেন জামাই আইসবার না দিলি কেব্যা লাগে!

এক নদী পেরিয়ে মেঠো রাস্তা দিয়ে শেষমেশ ঘন বাঁশবাগানের মধ্য দিয়ে গিয়ে আমরা
আশ্রয় নিলাম কী এক গ্রামে। সেখানে নাকি আমার মায়ের নানীর বাড়ি। তখনও আমি
কোনো নানীবাড়ি দেখি নাই। আর রীণা তো আমারই যমজ বোন; আমিই যেখানে দেখি নাই,
সেখানে ও আর দেখবে কেমন করে! শুনেছি, আমাদের নানীবাড়ি একটা ছনের ঘর ছাড়া
কোনো কিছু নাই। তাও অন্যের ভিটার ওপর। এই জন্য মা কখনো তার মায়ের বাড়ি যেতে
চাইলে বাবা খেঁকি মেরে ওঠে, ঘর মোটে একখান- সেইহানেও একখান চাটাই পাতার
ক্ষ্যামতা নাই! হেরপরও তোমার মায়ের বাড়ি যাওয়ার হাউস-

রীণা পেটাবে আমাকে মুগুর দিয়ে! হু-হ্‌! আমি রীণার হাত ছেড়ে দিয়ে একা-একাই
হাঁটতে থাকি। তবুও আমাকে ও আর পাত্তা দেয় না। মনির, সাজিদরা আছে কি-না, তা
দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু এই হুড়ের মধ্যে কে যে কোথায় আছে, কে জানে।

কড়ড়-কড়ড় আওয়াজ হলো, আর কোথায় কারা যেন চিৎকার করতে লাগলো- খান সেনা আইছে,
খান সেনা আইছে- সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেল সারা গাঁয়ে। কিছু বোঝার
আগেই পুরো গ্রাম ফাঁকা। নিজের অজান্তেই দেখে নিই আমি, মা-বাপ আর রীণা
ঠিকঠাক আছে কি-না। নিশ্চিত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও পুব কোণের দিকে
তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। এখন আর কোনো ধোঁয়া নেই সেই দিকে, পশ্চিমের নিচ দিক
থেকে আকাশের যত ওপরেই তাকানো যাক না কেন, কেবল আগুন আর আগুনের শিখা।

চৈত-বৈশাখ মাসে আমাদের গাঁয়ে মাঝেমধ্যে আগুন লাগে বটে, কিন্তু এমন আগুন সে
সময়েও দেখা যায়নি। আমার পা সরে না, আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কী এক
জাদু-মন্ত্রবলে আর সবাইও আলপথে আর ক্ষেতখোলার মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তে
সবকিছু নির্বাক, শব্দহীন লাগে। আকাশ দিয়ে হঠাৎ আরও এক ঝাঁক পাখি তারস্বরে
কিচিরমিচির করতে করতে চলে যায়। হঠাৎ কে যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সর্বস্ব
হারানোর তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে, পালাও-পালাও…। তখন কে যেন
কোনদিকে, কার সঙ্গে, কীভাবে ছুটতে থাকি, কিছুই আর টের পাই না।

খবর অবশ্য দিতে হয়নি। খিড়কি দিয়ে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিল বুড়ির বড় নাতি।
সেই বুড়িকেও এখন এইভাবে যেতে হচ্ছে দেখে রীণা অবশ্য হাসে না আমার মতো। বরং
সেদিনের মতো ঝামটা মারে- চুপ কর। মানুষের দুঃখের শেষ নাই, আর তর খালি হাসি
পায়! তক মুগুর দিয়া পেটান উচিত।

গত বছর পরামানিকের বাড়ি জামরুল কুড়ানোর সময় ওই বুড়ি তার হাতের লাঠি তুলে
একটা বাড়ি দিয়েছিল। আরে বাপ রে, কী চকচকে লাঠি তার! মনে হয় সরষের তেল দিয়ে
ঘষে দৈনিক। তবে ঘটনা হলো, বাড়ি দিতে পারলেও পা পিছলে বুড়ি পড়ে গিয়েছিল।

থুতুনিটা পড়েছিল এক্কেরে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা গাছের শিকড়ের ওপরে। তা
ছাড়া আরেকটা ব্যাপার ঘটেছিল। হাতে ধরা লাঠিটাও তখন মাটির ওপর একটা
আঁকাবাঁকা লাইন তৈরি করে হড়কে যেতে যেতে গাছটার কাণ্ডের গোড়ায় থেমে
গিয়েছিল। তাতে হাতের মুঠ থেকে ছুটে গিয়ে লাঠিটাও বুড়ির পাঁজরে একটা দশাসই
গুঁতা মেরেছিল। বুড়ির তো তখন কঁকানোরও শক্তি ছিল না। আর ছয়-সাত বছরের
আমাদেরও সাধ্য ছিল না ওই রকম একজন ওজনদার মানুষকে টেনে তোলার।

তার পরও রীণা বুড়িটাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিল আর বলছিল, এসবই খোদার লীলা। আমাগারে
কিছু নাই বইল্যা কুড়ায়া-মুড়ায়া খাই। গাছ থাইকা পাইড়া তো খাই না। খোদার
বানাইনা পাখপাখালি ঠোকা মাইরা গাছ থাইকা ফ্যালায়। তাই কুড়ায়া খাই। তাও
আপনের সহ্য হয় না। এহন বোঝেন, খোদার বিচার কারে কয়! টানা তিন মাস ঘরে পইড়া
থাকা লাইগবো। ওই আজিজ, দাঁড়ায়া আছিস ক্যা? বাড়ির মইদ্যে গিয়া খবর দে না।
অ্যার ওজন হইল ৭-৮ মণ, আমরা কি অ্যারে তুইলবার পারমু নাকি?

কিন্তু এখন আকাশে পাখি উড়ছে, পুবকোণে আগুন আর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। কোত্থেকে
যেন কড়ড়-কড়ড় শব্দ ভেসে আসছে। হরেন তো হরেন; হরেনের বাপ-মাও দৌড়াচ্ছে।
আমাদের মা-বাপও আছে সেই দৌড়াতে থাকা লোকজনের দলে। এমনকি পরামানিক চাচার
বুড়ি থুত্থুড়ে মা’কেও দেখছি লম্বা শক্ত-সমর্থ একটা কাঁথার ওপর বসিয়ে সেটার
দুই কোণ ধরে পালকির মতো করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার নাতিরা। তা দেখে এত
হয়রানির মধ্যেও আমার হাসি ধরে যায়। একটু থেমে রীণার হাত ধরে আমি ফিসফিসিয়ে
বলি, দ্যাখ, দ্যাখ, মরার বুড়ি খ্যাঁতার মইধ্যে থাইকা কেইব্যা কইর‌্যা মাথা
দুলায়!

হরেন এখনও প্যান্ট পরে থাকতে পারে না। পরলেও উশপিশ করে আর এক সময় লোকজনের
সামনেই খুলে ফেলে। তার পর কাঁধের ওপর রেখে খেলতে থাকে। তবে গত কয়েক বছর হয়
বাবা আমাদের বছরে দু’বার তালগাছির হাট থেকে প্যান্ট এনে দেয়। রাতে
খাওয়াদাওয়ার পর মা পুরানো লুঙ্গি-শাড়ির কোণ ছিঁড়ে সেই প্যান্টের ফিতা
বানায়। আমরা দুই যমজ ভাইবোন তখন বারবার নতুন প্যান্টের ঘ্রাণ নিই আর পাড়ার
২-৪ জনের সঙ্গে মিলে মওকা পেলেই প্যান্ট-না-পরা হরেনকে চিল্লাচিল্লি করে
ক্ষেপাই, হরেন রে তোর পক্ষী দেখা যায়…হরেন রে তোর পক্ষী দেখা যায়।

পক্ষী লুকিয়ে রাখতে না পারলে, তাকে কি আর বড় মানুষ বলা যায়? হরেন তাই পক্ষী দেখা
গেছে বললে কেঁদেকেটে একাকার। গত পরশু অবশ্য গোল্লাছুট এত জমে উঠেছিল যে
আমরা খেয়ালই করিনি, হরেন কখন প্যান্টটা খুলে কাঁধের ওপর রেখে খেলতে লেগেছে।

আর কখন যে সেটা পড়ে গেছে, তাও দেখিনি। আমরা টের পাব কী, ও নিজেই তো টের
পায়নি! তবে কেউ না কেউ নিশ্চয় দেখেছে। তা না হলে সেটাকে আর খুঁজে পাওয়া
যাবে না কেন? মুশকিল হলো, সেসবও আমরা টের পাইনি। গাঁয়ের এত বড় মাঠ, তার
ধারঘেঁষা রাস্তা, তা ছাড়া ছিল হাটবার। কত লোকজন আসা-যাওয়া করছে, কে যে সেটা
কুড়িয়ে নিয়ে গেছে, কে জানে! তবে হরেন যখন ব্যাপারটা টের পেয়ে হায়-হায় করে
উঠল, তখন দু-চারবার পক্ষী দেখা যাওয়ার কথা বললেও পরে কিন্তু আর কিছু না বলে
আমরাও সেই প্যান্ট খুঁজেছি। অবশ্য খুঁজলেই কী, ইংলিশ প্যান্ট পেলে সেটা কি
আর কেউ ফেরত দেয়! কবিরাজ কাকু তাই পরশু রাতে ওকে হাইলা নড়ি দিয়ে খুব করে
মেরেছে। তারপর কাল সারাদিন একবারও আমরা ওকে আর ঘরের বাইরে দেখিনি।

এলোমেলো পায়ে হোঁচট খেতে খেতে গাঁয়ের আর সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে
দৌড়াতে ঠিকই দেখে নিই, আমাদের কবিরাজ কাকুর ছেলেটাও ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে
আলপথ দিয়ে ন্যাংটো হয়ে, হিমশিম খাচ্ছে মা-বাপের পায়ের সঙ্গে তাল মেলাতে
গিয়ে; অথচ কী আশ্চর্য! এ রকম একটা মওকা পেয়েও আমরা হাসতে হাসতে
চিল্লাচিল্লি জুড়ছি না, হরেন রে তোর পক্ষী দেখা যায়…হরেন রে তোর পক্ষী
দেখা যায়…

চিনি। কাইল সকালে তোমার চাচীর কাছে যাইও, আগাম চাইল-ডাইল, টাকাপয়সা কিছু দিয়া দিব।

বলে কাজী সাহেব যতদূর সম্ভব জোরে হাঁটতে থাকে। মা মনে হয় কেঁদে ফেলবে। আমি বুঝতে পারি না, মা কেন এ রকম করছে। ঝিয়ের কাজের জন্যে এ কয়দিনের মা কত বাড়িতে ধর্ণা দিয়েছে! আর আজ কাজী সাহেব নিজে এসে কাজের কথা বলার পরেও নাকি-কান্না শুরু করেছে। মিলিটারিদের ক্যাম্পে কাজ করতে সমস্যা কী? মাকে কি আর ওদের মতো গোলাগুলি করে মানুষ মারতে যেতে হবে?

সেদিন মা অনেক রাত অব্দি জেগে থাকে, নিচু গলায় কাঁদে। একটু দূরে শুয়ে থাকলেও আমি তা বুঝতে পারি। তবে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে; তাই কখন যে ঘুমিয়ে গেছি, বুঝতে পারি না। জেগে উঠে দেখি, মা বাড়িতে নাই। রীণা থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে। আজকাল আবার এই এক সমস্যা- বলা নাই, কওয়া নাই, রীণার মুখ থমথমে হয়ে যায়। আমি কিছু একটা বলতে যাব, তখনই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে ময়েজ আসে। আমি কিছু বলার আগেই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিসিয়ে বলে, মিলিটারি দেখবি? সড়ক দিয়া যাইতেছে। মসজিদের আমগাছটায় চড়লি স্পষ্ট দেখা যায়-

দেখমু না মানে! আমি সঙ্গে সঙ্গে ময়েজের সঙ্গে দৌড় লাগাই। কোত্থেকে ময়েজের কুকুরটাও আমাদের সঙ্গে দৌড়াতে থাকে। কাজী সাহেবকে দেখি এই বুড়ো শরীরেও হনহনিয়ে কোনদিকে যেন হেঁটে যাচ্ছে আরও ক’জনের সঙ্গে। মসজিদের আমগাছের উঁচু ডালটায় উঠে আমরা বসে বসে দেখি, এক দল মিলিটারি রেলস্টেশনের দিকে হাঁটছে। উত্তেজিত হয়ে ভাবতে থাকি আমি, এহ্‌, কবে যে বাপ যুদ্ধ শিখে ফিরে আসবে!

তোর বাপ কোনে গ্যাছে রে?- আচমকা ময়েজের এই প্রশ্ন শুনে আমি থতমত খাই আর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠি, হুরের মইধ্যে কোনে যে হারাইলো!

তোর যে কতা না! এ্যাত বড় মানুষ হারায়্যা যায়? অ আমি বুঝি- হয় যুদ্ধে গ্যাছে, নয় মিলিটারির গুলিত মইরা গ্যাছে।

সালিশ-দরবারের প্রামাণিকদের মতো কঠিন রায় দিতে দিতে ময়েজ এক ডাল থেকে আরেক ডালে চলে যায়। আমি আরও চুপচাপ হয়ে যাই। এ তো সত্যি, বাবা যুদ্ধে গেছে; কিন্তু তা কি আমার পক্ষে স্বীকার করা সম্ভব? রাস্তার ওপর মিলিটারিদের ছোট হয়ে আসা দেখতে দেখতে আমি ভাবি, মানুষের প্রাণ তাহলে বিরাট এক বনজঙ্গল-কত সত্য সেখানে নিশ্চিন্তে লুকিয়ে থাকে মানুষকে নিরাপদে রাখবে বলে। সত্য লুকিয়ে থাকে জীবনের কত রাস্তা, কত আলপথ, কত হালট আর নদী-বিল-ডোবাতে! আচ্ছা, মানুষের জীবনের বড় বড় সত্য কি এভাবে লুকিয়েই থাকে? অপেক্ষা করে নিশ্চিন্তে বেরুনোর দিনটির জন্যে? আর এ-ও তো হতেই পারে, বাবা এতদিনে মরে গেছে! কিন্তু কেন মরে যাবে?

চিন্তা করতে আর ভালো লাগে না। ইচ্ছা করে, কিলাতে কিলাতে ময়েজকে মাটির ওপর উপুড় করে ফেলি। খাই নাই, সে কথাও মনে পড়ে না। মনে হয়, হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে চলে যাই। কিন্ত ময়েজ বলে, বলা যায় না, রাজাকাররা আবার থালাবাসন ধুয়ে দিতে বলতে পারে, গা-হাত-পা টিপে দিতে বলতে পারে। যুদ্ধ লাগায় ময়েজের বেশ ভালোই হয়েছে- চার মেয়ের পর এক ছেলে ও। কী জানি, কোনখানে যাবে আর হঠাৎ গুলি লাগবে, ওর বাপ-মা তাই আর ওকে কোনো কাজে পাঠায় না। আমিও তো বাপের একটাই ছেলে, কিন্তু আমার অত কদর নাই। লটকন, ডেউয়া খুঁজে বেড়াই, মাইটা আলু খুঁড়ে তুলি, গামছা দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু আজ তো রীণা সঙ্গে নেই; আজ আমার সঙ্গে ময়েজ, আমি তাই সারাদিন টো-টো করে বনবাদাড়ে ঘুরি। কোনো কিছু করি না, শুধু ঘুরি আর শিয়ালের ডেরা দেখি। বিকালের দিকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রান্নার ঘ্রাণ পাই। দূর থেকেই দেখি, মা আর রীণা চুলার পাড়ে। আহ্‌, যেন কতদিন পর ডালের গন্ধ পাই, ভাতের ঘ্রাণ পাই! আনন্দে বুক ভরে যায়। লাফাতে লাফাতে গিয়ে চুলার ধারে ন্যাটা দিয়ে বসে হাসতে থাকি। কী বলব ভেবে পাই না, কেবলই হাসি।

দাঁত ক্যালায়া হাসতিছিসি ক্যা? – খরখরে গলায় বলে রীণা।

রীণাকে আমি পাত্তাই দেই না। চুলার মধ্যে খানিকটা জাবা ঠেলে দিতে দিতে বলি, ও মা, তুমি কামে গ্যাছো, আমি জানি না! আমি তোমাক সারা গাঁও উটকাতিছি।

মা আমার কথার উত্তর দেয় না। প্রতিবেশীদের গাছ থেকে একটা ছোট কাঁঠাল খসে পড়ে। এঁচোড় করা যাবে বলে মা দৌড়ে গিয়ে সেটাকে কুড়িয়ে নেয়। ঘরের মধ্যে নিয়ে যেতে যেতে বলে, যা, গোসল দিয়্যা আয়।

কেমন শুকনো গলা মায়ের! কত দিন পর এত আয়োজন করে রাঁধতে বসেছে, অথচ মেজাজ খারাপ। এমন ভাব, আমি ইচ্ছা করেই কোনো কাজ করি না, তাই বাধ্য হয়ে মা কাজ করছে। আসলে তো আমার কোনো কাজকামই নাই। এই গাঁয়ে রাখালি করা যায় কেবল কাজী, পরামানিক চাচা আর কবিরাজ কাকাদের বাড়িতে। কিন্তু কাজীবাড়ি আর পরামানিক বাড়িতে তো এসব কাজ করার লোকের অভাব নাই, এখন তো আরও যুদ্ধ লেগেছে- পারলে সারা গাঁয়ের লোকজন গিয়ে কাজীবাড়ির কাজকাম করে দেয়। এদিকে কবিরাজ কাকা ধাওয়া খেয়ে সেই যে গাঁও ছেড়েছে, আর ফেরে নাই; মালাওন মানুষ, আগ বাড়িয়ে গাঁয়ে ফিরে এসে ধরা খাবে নাকি! ধান কাটার সময় না হয় এর-ওর সঙ্গে গিয়ে গাঁতা বেঁধে দুই বেলা খাওয়া জোটানো যায়, দু-এক মগ চালও আনা যায়। তবে এবার বর্ষা এলেও পরিস্থিতি থমথমে। কে কোথায় ধান কাটছে, কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। তা যাই হোক, মা রাগ করলেই কী, আর না করলেই কী; আমি ফুরফুরে মেজাজে বলি, গোসল পরে দিমুনি। আগে তুমি ভাত বাড়ো তাড়াতাড়ি।

তুই একটা জানোয়ার, খালি ছাগলের মতো খাইতে জানিস…

বলে রীণা ধুপধাপ করে পা ফেলে চুলার কাছ থেকে উঠে যায়। বোকার মতো বসে থাকি আমি। কী করব বুঝতে পারি না। তবে মানুষের পেট তো- তা কি আর কোনো হিসেবনিকেশ করে? ক্ষুুধার চোটে দু-দু’গুণে চারের বদলে পাঁচও বানানো যায়। আমি তাই সাত-পাঁচ কোনো কিছু ভাবি না, সানন্দে ভাত-ডাল বেড়ে নেই। আর রীণাও আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খায়। রান্নাবান্না করার জন্যে মাকে তিনবেলাই যেতে হয় স্টেশনের ক্যাম্পে। কোনো কোনো রাতে কাজের এত বেশি চাপ থাকে যে, মা আর ফিরতেই পারে না। ফেরার সময় মা একগাদা খাবার নিয়ে আসে। মা না ফিরলেও আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। মাকে ছাড়াই আমি আর রীণা রান্না করি। বর্ষার পানি চলে গেছে, ডোবা-হালটের মধ্যে অতর্কিতে নেমে পড়ে মাছ ধরি, রাঁধতে শিখি, ভাত খেতে খেতে ঢেঁকুর তুলতে শিখি। আমাদের স্বাস্থ্যও ভালো হতে থাকে বেশ; আর মার তো দেখি ভুঁড়ি হতে শুরু করেছে। তবু কেন যেন মা অনেক রাগে একা-একা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আর রীণার কাছে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে উল্টো ক্ষেপে উঠে ও আমাকেই গালিগালাজ করতে থাকে।

তবে কাজী সাহেব হঠাৎ কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেছে। খুব একটা আর রাস্তাঘাটে বের হয় না। আগে তো মাঝেমধ্যেই বাড়ির সামনে চলে আসতো। মাকে ডেকে বের করত। এটাসেটা জিজ্ঞেস করত আর যাওয়ার সময় বলত, কুনু সমস্যা হইলে কইও। কিছু মনে কইর না মোসলেমা। বোঝোই তো, যুদ্ধের সময় কত কিছু ঘটে। আমরা না চাইলেও উপায় থাকে না। …কী দরকার আছিল শয়তানডোর যুদ্ধে যাওয়ার? তার বদলে রাজাকার হইত, মাসে ২০০-৩০০ টাকা কামাইতো! মা শুধু শুনত, কিছুই বলত না। তবে এখন তো কাজী সাহেবই বাড়ি থেকে বের হয় না খুব একটা। টাউন থেকে এইদিকে আসার পথের একটা রেল ব্রিজ নাকি মাসখানেক আগে মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিয়েছে। সেই থেকে কাজী সাহেবেরও ভয়ডর বেড়ে গেছে। ইদানীং ময়েজও বলে, আর বেশি দেরি নাই রে …, দ্যাশ দেহিস স্বাধীন হয়্যা যাব্যো। তহন তো তোর ঠাটবাটই বাইড়া যাব্যো। ক’বি, আমি মুক্তিযোদ্ধার পোলা! এইসব মিষ্টি কথায় ভুলি না আমি। বার বারই বলি, হেহ্‌, আমার বাপের অত সাহস আছে নাহি যে যুদ্ধ কইরতেছে। কবে কোনহানে মইরা গ্যাছে, কেডো জানে!

বলি, আর মনে মনে বুকের ওপর থু থু ছিটাই। যদিও হেমন্ত, শীত পড়তে শুরু করেছে। দিন ছোট হয়ে আসছে। সন্ধ্যা হতে না হতেই অজস্র্র পিঁপড়া পাখা মেলে আমাদের ঘরের পাশে ওড়াউড়ি করে। আমি আর রীণা চুলার আলোয় একজন আরেকজনের মুখ দেখাদেখি করি। তখনই অসময়ে মা বাড়ি ফিরে আসে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। অনেকক্ষণ পর মুখ খোলে মা। বলে, পাকিস্তানিরা নাকি ক্যাম্প গুটিয়ে চলে গেছে শহরে। রাজাকাররাও পালিয়েছে রেলস্টেশন থেকে। তার মানে, ময়েজ ঠিকই বলেছে! যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে। কিন্তু মা যে ঝি-গিরির কাজটা হারালো, আমরা খাব কীভাবে? সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, বাবা তো এবার ফিরে আসবে। তখনই কাজীবাড়িতে দাউ দাউ আগুন জ্বলে ওঠে আর মুহুর্মুহু স্লোগান শোনা যায়- ‘জয় বাংলা/ জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’…আহ্‌, কতদিন পর আবারও এসব স্লোগান শুনছি! রক্ত চনমনিয়ে ওঠে। সব ভুলে মাকে রেখেই বাড়ি থেকে চিৎকার করতে করতে বাইরে বেরিয়ে পড়ি আমি আর রীণা। দেখি এই রাতেও লোকজন সড়কে আর মাঠে ভিড় করেছে। কোত্থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল এসেছে। তারা বলছে, আর চিন্তা নাই। কালকেই নিয়াজীর হাতে হাতকড়া পড়বে। কোত্থেকে কে যেন পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে আসে। তারা মাঠের মধ্যে সেই পতাকা পোড়ায়। এত লোকের মধ্যে আর আগুনের শিখার তাপে বেশ ভালো লাগে আমাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আমরা আমাদের বাপকে খুঁজি, কিন্তু কোথাও তাকে পাই না।

কী এক ঘোরের মধ্যে আমাদের দিন কাটতে থাকে! বাবা হয়তো আজকেই ফিরবে। প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো না কোনো নতুন দল ফিরছে নিজেদের গ্রামে আর বাড়িতে। দূর থেকে গুলির সামান্য শব্দ শুনলেই কিংবা সড়কে অস্ত্র হাতে কাউকে দেখলেই আমি আর রীণা বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে সড়কে গিয়ে উঠি। কিন্তু বাবাকে কোনো দলে দেখি না। কেউ বাবার কথা বলতে পারে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত্রি নামে, তবু আমি আর রীণা নতুন কোনো যোদ্ধার আশায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি সড়কের ধারে শিশির আর কুয়াশার মধ্যে। তার পর এক সময় ক্লান্ত হয়ে মায়ের কাছে ফিরে আসি। দেখি, মা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে। মার ভুঁড়ি আরও বেড়ে গেছে।

কয়দিন হয়ে গেল, সবখানেই এখন জয় বাংলার পতাকাটা উড়ছে, গাঁয়ে যাদের ট্রানজিস্টর আছে, তারা জোরে জোরে বেতার বাংলা বাজাচ্ছে, সেই রক্ত গরম করা ভাষণটা ঘুরেফিরে বাজছে, কেবল বাবাই ফিরছে না। তবু আমরা দুই ভাইবোন প্রতিদিন ঘুম ভাঙতেই সড়কের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। প্রথম প্রথম মানুষজনের কাছে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতাম, এখন আর করি না। একদিন গাছের গুঁড়ির ওপর বসে থাকা পাশের গ্রামের মোজাম্মেল মাস্টার দেখি আমাদের গ্রামের ফজলু ভাইকে বলছে, কী কপাল দেখ! যুদ্ধ করতে গিয়া এগরে বাপের জীবন গেল, আর তারই ঘরে পাকি হারামজাদারা বেছন দিলো। মোজাম্মেল মাস্টার আর ফজুল ভাই অবশ্য হাসে না, কিন্তু আরেকটা লোককে দেখি ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। তা দেখে রীণা কী বোঝে, আমাকে নিয়ে টানতে টানতে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকে। আমি থামার চেষ্টা করি, বোঝার চেষ্টা করি, কিন্তু একটুও না থেমে আমাকে বাড়ির দিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে ও। মার সামনে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, মা চলো, এহানে থাকমু না। বাবা ফেরে না, হ্যার চে চলো, আমাগারে নানাবাড়িতে, নয় তোমার নানার বাড়ি চলো…

পাকিস্তানিদের ক্যাম্প উঠে গেছে, মার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, কাজী সাহেবরা তো গ্রাম থেকে কবেই পালিয়ে গেছে, এদিকে বাবাও আর যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছে না, শীতে ডোবা-নালা শুকিয়ে গেছে, আমরা আর কোনোখানে মাছ পাই না। এই সময় গাছগাছালিতে তেমন কোনো ফলও থাকে না। নতুন ধান উঠছে বটে, কিন্তু আমাদের তো কোনো জমি-জমাই নেই, নতুন ধানই বা পাই কোত্থেকে! তবু ঝরে পড়া ধানের খোঁজে অথবা ধান ঝরানোর কাজের খোঁজে আমরা ভাইবোন বের হই ঘর থেকে। লোকজন তখন আমাদের দিকে কেমন করে তাকায়! পাড়ার ছোট ছেলেপেলেরা আমাদের পিছে পিছে আসে আর সুর করে বলতে থাকে, ‘মুক্তিযোদ্ধার ঘরে/ পাকির বাচ্চা আসে’, ‘জারজের ভাই/ জারজের বোন’, ‘জারজের ভাই/ জারজের বোন’…।

লোকজন তাদের ধমক দেয়, ধাওয়া দেয়। কিন্তু তারাই আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে কেমন করে হাসে। হাসে আর বলে, ‘চামড়ার মুখ, আটকান কি যায়! শালার জাউরা পোলাপান!’ আমরা তাদের পিছু ধাওয়া করি, যেমন করে কবিরাজ কাকার ছেলে পক্ষী দেখার কথা বলায় আমাদের পিছু ধাওয়া করত; গ্রামের ছেলেপেলে ওইসব সুর করে বলতে বলতে হাসতে হাসতে গোল্লাছুটের মতো দৌড়াদৌড়ি করে। যেমন আমরাও করতাম হরেনকে ঘিরে। মা আমাদের ঘরের মধ্যে থেকে তারস্বরে ডেকে ডেকে বাড়ি নিয়ে যায়। আমরা মার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকি আর মা-ও আমাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আমরা ঘরের বাইরে বের হতেই গাঁয়ের পোলাপানরা আবারও সুর করে স্লোগান দিতে থাকে, ‘জারজের বোন তুই/ জারজের ভাই তুই’।এমনকি আমরা ঘরে এসে লুকালেও তারা বাইরে থেকে ক্রমাগত এইসব বলতেই থাকে।

তীব্র ক্রোধে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, পাগলের মতো তাদের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকি, আমাদের মা হাঁপাতে হাঁপাতে বাইরে এসে আমাদের থামানোর চেষ্টা করে। চিৎকার করে ডেকে ডেকে ঘরে ফেরানোর চেষ্টা করে, কিন্তু আমরা ক্ষেপাটে পাগল হয়ে গাঁয়ের পোলাপানদের তাড়ানোর চেষ্টা করি, তারা সুর করে স্লোগান দেয় আর এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে, আমরা তাদের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকলে তারাও আমাদের দিকে পাল্টা ঢিল ছুড়তে থাকে আর সুর করে স্লোগান দিতে থাকে- ‘মুক্তিযোদ্ধার ঘরে/ পাকির বাচ্চা আসে’। আমরা আরও ক্ষেপে উঠি, ক্লান্ত হয়ে গেলেও তাদের পিছু পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে ঢিল ছুড়তে থাকি, গালিগালাজ করতে থাকি। তারাও তখন আমাদের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকে। ঢিল ছুড়তে ছুড়তে আমাদের রুক্ষ মাঠের মধ্যে ফেলে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলে। আমাদের মা ঘরের সামনে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করতে থাকে। কেউ তার কথা শোনে না, কেউ আমাদের ক্রোধ কিংবা কান্না থামায় না, রক্তাক্ত হতে হতে আমরা দুই ভাইবোন বুঝতে পারি, এবার আমাদের যুদ্ধের শুরু হলো…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত