শুক্রর খুব লালবুনির কথা মনে পড়ে। আহা লালবুনি! নিজের কন্যার কাছেও যে কেবল গল্প হয়ে আছে! হাসপাতালের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে বাবার ভাবনায় ডুবে যায় শুক্রমনি। দেহের ভেতরে তার নড়েচড়ে ওঠে অনাগত শিশু।
ভাবনায় ডুবে থাকে গুণমনিও। যন্ত্রণা আর অপেক্ষার রাতে প্রসব-আসন্ন মেয়ের পাশে বসে সেও এক গল্পের মধ্যে ডুবে যায়। ঠাকুরদার মুখে শোনা গল্প। যার তোড়ে ভেসে থাকে পূর্বপুরুষের ভিটা। এক স্বপ্নের জগৎ ছিল গুণের। তা যেন ঠিক তার নয়, আবার তারও বটে। একটা দ্বন্দ্ব! ভেতরে জেগে থাকা অতীত, ভুলে থাকাই ভালো। এই ভেবে ভুলে থাকে সবাই। গুণমনি, রতন পাল, মঙ্গল দাশ, ভরত চাষা, তৃপ্তি বাড়ইক, শুকরা মুন্ডা, বাসন্তিসহ আরও কত কত বাগানি মানুষ। এই লাইনের বস্তিবাসীর ওই তো গল্পে শোনা অতীত ছিল। যা তাদের দুঃসময়ে কেবল হাতছানি দেয়, একটা ঝলক তোলে মাত্র। বর্তমান তো এই, সেই ঊষালগ্নে জেগে ওঠো। খুদকুঁড়ো খেয়ে কাঁচি হাতে টোপর ঝুলিয়ে, ঝুড়ি কাঁধে ঢাল বেয়ে নেমে যাও বনসাই গাছের কাছে। গাছের মাথায় সকালের রোদ যদি চিকচিক করে তবেই সুখ। কচিপাতায় রোদ বসলে কেমন ঝিলিক মারে, কাচের মতো চকচকে। নরম সেই দুটি পাতা একটি কুড়ি নুয়ে নুয়ে ঝুড়ি ভরো। লাইন থেকে টিলা বাগান, পাতাঘর, রেশনঘর আর পথে টুকলি বাজার আবার লাইনে আসা। এই তো জীবন। তা সেও তো বনসাই। এক চক্র। ছায়া গাছ আর চা গাছ সমান দূরত্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মানে বাগানিরা বেঁচে থাকে। পরস্পর বেঁচে থাকার সম্পর্কে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর।
অতীত তো আর জীবন নয়, গল্প। বাপ-ঠাকুরদার গল্প। সন্ধ্যেবেলায় ঝোপঝাড়ের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতো। সেই গল্পে কেবল ঝিম ধরে। ক্লান্ত শরীর ক্রমশ ঘুমের দেশে যেতে যেতে ভাবে হয়তো ছিল, একটা নিজের ভিটে! তা তো বহুদূরের কোনো গ্রাম। দেশ বা ভূখণ্ডের কেতাদুরস্ত বিভাজন আর কে কবে খুলে কয়? আর বলে থাকলেও মাথাভর্তি অত শব্দ আর কথা জেগে থাকে না। গল্পের মধ্যে কেবল একটা ভিটা থাকে, তা এই লাইনের বস্তির মতো নয়। দূরের দিগন্তে জেগে থাকা গেরস্ত বাড়ি। ওমন বাড়িতে জীবন কেমন? তাও ভাবতে শেখেনি তারা। সেই সন্ধ্যের গল্পের মধ্যে হঠাৎ-ই শোনা গেল, এই যে চা-বাগান, এই যে তাদের সকাল-সন্ধ্যার জগৎ তা নাকি স্বাধীন নয়!
গত মে মাসের এক তারিখে সবাই যে ভিজেপুড়ে মিছিল দিল। তা তো চা-বাগানের বাবুদের সুখ আর তাদের দুঃখ ঘুচাবার কথা বলেকয়েই সার। গুণমনি মনে মনে হাসে, কী চিন্তায় সেদিন বাবুটির ওপর রাগ হয়েছিল! না হয় সন্ধ্যের আঁধারে বাবুটি বলেই ছিল- চুলে জবা ফুল পরিস রে গুণ। তোরে বড় সুন্দর লাগে।
অনেক ভেবেছে, শহুরে বাবু তাকে ফুল পরতে বলল বলেই কি আর প্রেম হয় নাকি? প্রেমেও দরদ লাগে। নিজের বোকামির জন্য লজ্জা হয় গুণমনির। ওইসব চিন্তা বাদ দিয়ে সে সন্ধ্যা কাটাতে শূরিটোলার আসরে গিয়ে বসে। সেই আসরেই প্রথম জানল তারা পরাধীন! এ গল্পের বাবুটি আবার নতুন, শহর থেকেই আসা। শহরের গরম বাতাসকে সে চা-বাগানের ছায়াগাছের তলায় বিছিয়ে দিতে দিতে গল্প করে।
বাতাসে নাকি কেবল চা-বাগানের দুঃখ-কষ্ট থাকে না, সারাদেশেও নাকি বাতাস ভারি! কষ্টে ভরে গেছে সব। সারাদেশ বলতে কতটুকু? কত বড়? কোন কোন লাইন? কিছুই ঠাওর করতে পারে না। রতন স্কুল পাস। তাকেই ধরে গুণমনি। তা দেশটা কোথায়?
– ক্যান এই সারাবাংলা, দেশের নাম হচ্ছে পাকিস্তান। আমরা সব্বাই তো পূর্বের মানুষ রে, সকল কষ্টও এখন পূর্বের।
রতনের কথায় দেশের হদিস মেলাতে সমবেত সবার মাথা ক্রমশ নড়ে নড়ে যায়। কেউ বিষয়টা ঠিকঠাক বোঝে না। কিন্তু শোনে। বাতাস ভারি, কষ্টের সমুদ্রে সারাদেশ! শুধু চা-বাগানে নয়, সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুঃখ। দেশ পরাধীন! নেতারা দেশ স্বাধীন করতে চায়।
এসব কথায় সহসা চা-বাগানে একটা চঞ্চল বাতাস বয়ে যায়। নতুন খবরের শাখা-প্রশাখা প্রতিদিন বেড়েই চলে। গুণমনি খেয়াল করে বাগানের ডাক্তার বাবুর বাড়িতেও এই গল্প হয়। কেমন আজব কথা! কুলি-কামিনদের মতো ডাক্তার বাবু-টিলা বাবুও পরাধীন! মাত্র কিছুদিন আগে শোনা শোষণের গল্প-গাথা, সংগ্রামের স্বপ্ন, দল বাঁধার গল্প কেমন ভেঙে ভেঙে যায়। গুণমনি কি আর বোঝে শ্রেণিসংগ্রাম কী? সে কেবল ভাবে, তাইলে এইবার কি বাঙালি বাবুরা… আমরা এক হলাম? কথা তো ছিল এক হতে হবে। তাইলেই দুঃখ-কষ্ট ঘুচবে। তা পরাধীনতা কি এখন এলো? গুণমনির ঠাকুরদা গত হয়েছে বছর পাঁচেক হলো। সে থাকলে ঠিক জিজ্ঞেস করত, আড়কাঠি দিয়ে সে যখন তার বাপের সঙ্গে এই বাগানে এলো, তখন কি তারা জানত এ দেশ পরাধীন? আজ কারে জিজ্ঞেস করবে?
২.
শুক্রর চোখ বেয়ে পানি পড়ে। তার এখন প্রসব যন্ত্রণার চেয়েও কষ্ট লাগে বাবা লালবুনির কথা ভেবে। অশিক্ষিত চা-বাগানের কুলিদের কথা ভেবে। যে কষ্ট সারাটা জীবন বাবাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। শুক্রর হাতেখড়ি নিজে হাতে দিয়েছিল লালবুনি। সেদিনের কথা শুক্রর সব কি আর মনে থাকে? কিন্তু শুক্র নিজে আর কতটুকু স্মরণ করতে পারে? মা গুণমনির গল্পে, বাগানের কুলি-কামিনদের গল্প শুনে শুনে শুক্রর মনে থাকে বাবা লালবুনির ঘরের খিড়কি দরজায় আলতার রঙ দিয়ে প্রথম অ লিখেছিল, তার জন্য।
সেই রঙ আজ আর নেই, কিন্তু শুক্র দেখতে পায়। শুনে শুনে ও সব দেখতে পায়। চোখের পাতায় কিছু অস্পষ্ট হয়ে উঠলে বেদনায় ছটফট করতে করতে শুক্র জানতে চায়- লালবুনির কিচ্ছা ক, মা।
গুণমনির সেই গল্প করতে কোনো ক্লান্তি নেই। শুক্রর বয়স মাত্র সাত বছর, তখন থেকে সে এ গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। শুক্রর কালো পেটের চামড়া উঁচু হয়ে ওঠে, গর্ভস্থ শিশুটির কোনো অঙ্গ। সেদিকে তাকিয়ে গুণমনি হারিয়ে যায়, গভীর রাতে। সে তো ম্যালা আগের কথা, সেই গোণ্ডগোলের বচ্ছর। গুণমনি এমনি করেই শুরু করে, আগে-পাছে মিশিয়ে।
৩.
দীঘিভাঙা চা-বাগানের গোপাল বুনরাজির খুব ইচ্ছে ছেলেটা শিক্ষিত করবে। সে না হয় এই বাগানের আর সব মূর্খ জলটানা-পাতাতোলা-গাছচিরা মানুষগুলোর মতোই, কিন্তু তার লাল- সে এমনটা হবে না। তাই লাল বুনরাজিকে চা-বাগানের বাইরের জগতে নিয়ে যায়। দীঘিভাঙা চা-বাগানের ২১ নম্বর লাইনের বস্তি থেকে কেবল লালই স্কুলে যায়। আর দু-একটা লাইন থেকে দু-চার জন যায় বটে, তবে বেশি স্কুলে যায় বাবুপাড়ার ছেলেপেলে। তারা তো যাবেই। বাবুরা তো আর এই লাইনের কুলিদের মতো অশিক্ষিত নয়, যে ছেলে-পিলে মর্দনা দফায় নাম লেখিয়ে পাতা তুলতে নেমে যাবে।
সেই লাল বুনরাজি, তখন ভিক্টোরিয়া স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র। সন্ধ্যা হলে লালের সামনে মুখে হাত দিয়ে বসে থাকে ২১ নম্বর লাইনের কুলি-কামিন। লালবুনি তখন গল্প করে। সে যে গল্প বলে, তা পূর্বপুরুষের নয়, তার নিজের গল্প। যা এক যুদ্ধের গল্প।
স্কুল থেকে আজকাল প্রায় সে শহরে মিছিল দেখতে যায়। এই দেখতে দেখতে একসময় মিছিলে ডুবে যেতে থাকে লাল বুনরাজি। মিছিল থেকে সে প্রথম জানতে পারল দেশ পরাধীন! নেতারা তা স্বাধীন করতে চায়। সরকারের সঙ্গে দেশের জনগণের খুব গোলমাল চলছে। অন্ধকারে বসে শুনতে থাকা মানুষগুলোর চোখ জ্বলজ্বল করে কালো মেকুরের মতো। মনে হয় তারা যেন সে কোন এক দেশের কথা শোনে। লালবুনি বলে- শেখ মুজিব নামের নেতা দেশে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। হঠাৎ করেই সবার মধ্যে নড়াচড়া পড়ে, যেন তা ব্যাপারটা কী? নড়ে না বসলে বোঝা যাবে না।
নিতাই চাষা প্রশ্ন করে- হ্যারে লালবু, তুর ওই মুজিব কোন বাগানের বাবু?
লালের ভীষণ রাগ হয়, সে বাগানের বাবু নয়… নেতা… দেশের নেতা…।
লাল বুনরাজিও যে খুব তাকে চেনে, তা নয়। সবই তো সে শুনে এসেছে। কথার মধ্যে বাধা দিলে খেই হারিয়ে ফেলে। রেগে যায়, তখন বলে বসে- যাও পঞ্চায়েতের কাছে, বুঝে নিও। এত কথায় গল্প এগোয় না।
সবাই তখন চুপ মেরে যায়, কী কাজ ভাই মূর্খদের। যা বলে সেটুকু শোনায় ভালো।
লাল বুনরাজি সব কথা শুনে সব যে ভালো বুঝত, তা না। কিন্তু মিছিলে হাঁটতে, চিৎকার করে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিতে খুব ভালো লাগত তার। কৈশোর পেরোনো লাল চা-বাগানের ছায়াগাছ ছেড়ে উত্তপ্ত রাজপথের উত্তেজনায় ডুবে যেতে থাকে। এতসব কেন? কী ঘটছে, কী হবে? অতশত না বুঝেই সে হেঁটে চলে। কিন্তু এটুকু বোঝে- বিপদ আসছে। বাগানের পঞ্চায়েতদের কপালেও ভাঁজ। সবাই চিন্তিত। ভয়ঙ্কর কিছু না হলে এমন হয় না। চেনা মুখের আতঙ্কগুলো তাকে কেমন ভাবনায় ফেলে দেয়। সেই শোনা গল্পের সঙ্গে ভাবনাটাও মিশিয়ে সে ২১ নম্বর লাইনের বস্তিবাসীকে গল্প শোনায়। সব যেন হাভাতের দল। শোনার জন্য গেরো মেরে বসে থাকে। এরই মধ্যে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। শহরে খুব হইচই। গোপাল বুনরাজি ছেলেকে ডেকে বলে- শহরে এখন আর যাসনে বাবা।
কিন্তু লাল খুব অস্থির হয়ে থাকে, বাবাকে না বলে সে শহরে ঠিকই যায়। বাগানের বাবুদের সঙ্গে সঙ্গে বর্ডারের কাছে যায়, খবর আনে, খবর দেয়। বাবাকে অতশত বোঝাতে যায় না। সবে তো সেই বুঝতে চেষ্টা করছে। বয়স্ক আবার মূর্খ মানুষ। কী আর করবে, খামাখা ভয়ে সিঁটকে থাকা ছাড়া কিইবা করার আছে।
৪.
সেই লাল বুনরাজিকেই কুড়িয়ে পেল গুণমনি। তাতে সবার কেমন বিশ্বস হয় এসবই মা-কালীর খেলা। সেই সঙ্গে শুক্রর বাপের মরা-বাঁচা সবকিছুতে আদি মাতা গুণমনির কেরামতির দেখা পায় বাগানিরা। কিন্তু শুক্রর মা, এই যে এই গুণমনি। সেসব কথা বিশ্বাস করতে পারে না। চা-বাগানের বিশ্বাসকে সে আবার অবিশ্বাসও করতে পারে না। তাই তাকে চুপ থাকতে হয়। মেয়েকে গল্প বলার সময়ও তাকে বেছে নিতে হয়, কখন কতটুকু বলা যাবে। অশিক্ষিত, জঙ্গলি গুণমনির এসব বুদ্ধিসুদ্ধি একদিনে হয়নি। বহু দিনে দেখে দেখে যেমন হলো, তেমনি তো সে কথাও ঠিক যে, শুনে শুনেও ম্যালা কিছু জেনেছে সে।
সুন্দরী চা-বাগানের সবাই নিত্যদিন নতুন খবর শুনতে পাচ্ছিল! ভয়ে ভয়ে সবাই কেমন গোল হয়ে বসে। এসব কথা শুনে। কুলি বস্তির লোকেরা বনসাই চা-গাছের মতো ঘন আর কালচে মুখে ভাবতে বসে জন্মের পর আজ পর্যন্ত দেশের নামটাই তারা ঠিকমতো মাথায় রাখেনি! যেন সেই দোষেই পাকিস্তানি সৈন্যরা বাগানে বাগানে যুদ্ধ করবে। সবাই ভয়ে সিঁটকে থাকে, খবর আসে মিলিটারি আসছে। কোথা থেকে? পাকিস্তানি? কখনও বা বাঙালি মুক্তি… এমন খবরও আসে ভারতীয় সৈন্য আসছে! চা-বাগানের কুলি-কামিনরা দিশা পায় না। কে শত্রু? কে মিত্র? এই বুঝ কি সকলে একবারে মাথায় নিতে পারে? পঞ্চায়েত, বাঙালি বাবু খুলে বললে তারপর বোঝে। এত প্যাঁচ খুলে যুদ্ধ বুঝতে সময় লাগে। যখন আশপাশের বাগান থেকে প্রাণ বাজি রেখে কোনো কুলির দল পালিয়ে বাঁচে। তখন তারা জানতে পারে পাকিস্তান মিলিটারির কথা। সেসব খবর রটে আর গুণমনি দেখে এই প্রথম বাগানের ম্যানেজার বাবু, ডাক্তার সাহেবসহ সব বাবু কেমন ভয় পায়। ফিসফিস করে কী সব পরামর্শ করে। কুলিদের মতো তাদেরও মারতে পারে? এ কথা এই কুলি-কামিনকেও বিশ্বাস করতে হয়। এ বিপদ সবার। বাঙালি বাবুরা গোপনে চা-বাগানের ছড়া ও টিলা পেরিয়ে ভারতের দিকে মুক্তি পাচার করে। বাগানের টুকরিতে করে কুলিরা ভারত থেকে অস্ত্র এনে মুক্তিবাহিনীকে দেয়। এমন এক সময় তো গণ্ডগোলের সময়ই। কত বাগানের কুলিরা নাকি পালিয়ে বর্ডার পেরোচ্ছে। একে একে নতুন নতুন শব্দ আর পাঠের মধ্য দিয়ে নিত্যনতুন আতঙ্ক বাসা বাঁধে। ঠা… ঠা… শব্দ দূর থেকে ভেসে এলেই সব দৌড়ে গাতার মধ্যে, ছড়ার মধ্যে বা গাছের মধ্যে পালায়। এই পালানোর পরামর্শ কারও দিতে হলো না। প্রাণের ভয়ে সব দৌড়ে পালায়। এর মধ্যেই কুকুর মারার খবরটা আসে। তারা কুকুরের ডাক শুনেছে, তা কুকুর তো ডাকেই।
আজকাল নীরব রাত্তিরে দূরের গুলির আওয়াজ যেমন স্পষ্ট, তেমনি কুকুরে ঘেউ ঘেউ চারদিকের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। জানা গেল পাকিস্তানিরা কুকুর মারছে! শুনে গুণমনির কেমন গা কেঁপে ওঠে। সে কথায় গুণমনি লালুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। দূরে গুলির শব্দে লালু ঘেউ করে উঠলে গুণ মুখ চেপে ধরে। চা-বাগানের কুকুরগুলো বস্তির মানুষের খুব কাছের পশু। শক্রর গন্ধ পেলে দলবেঁধে কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ করে উঠবেই। তাতেই মিলিটারিদের রাগ। চা-বাগানে ঢুকতে মিলিটারিদের প্রথম শত্রু কুকুর! তাই কুকুর মেরে সাফ কর! গুণ নিজেদের পোষা কুকুর লালুকে জড়িয়ে ধরে আরও ঘন হয়ে বসে। লালুর ভেতরে আদরমাখা গরগর শব্দ হতে থাকে। কত শীতের রাতে লালু গায়ে গা দিয়ে শুয়ে শুয়ে গুণকে ওম দিয়েছে। সহদোরের মতো।
৫.
সেদিন কত তারিখ? তা মনে নেই। তবে সন্ধ্যার বাতাসে মানুষ আর কুকুরের আর্তচিৎকার শোনা যায় সুন্দরী বাগান থেকেও। গুণরা সবাই ঘর ছেড়ে জংলায় লুকিয়ে ছিল। রাত বাড়লে আওয়াজ কমে, আর হঠাৎই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলে সবাই ঘরে ফিরতে থাকে। ফিরতি পথে জানা যায় দীঘিভাঙা বাগানে পাকিস্তানিরা বিশটা কুকুর খেদা করে নিয়ে গুলি করে মারছে। কেউ কেউ সেই বৃষ্টিতে ঘরে ফেরে না, জংলা পেরিয়ে, কোনাকুনি হেঁটে যেতে থাকে দীঘিভাঙা চা-বাগানের দিকে। কখন যেন গুণও সেদিকে হাঁটা শুরু করেছিল। কুকুরের প্রতি মিলিটারিদের রাগটা সে বোঝে না। সে কিই বা বোঝে? তবুও মায়া লাগে। ওই দলের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে দীঘিভাঙা বাগানের দিকে যায়।
দীঘিভাঙা বাগানে পৌঁছলে শোনা যায় কুকুর নয়, বাগানের কুলি-কামিন খেদা করে একটা গাতার মধ্য নিয়ে ব্রাশফায়ার করেছে! ব্রাশফায়ার কী? তা গুণমনি জানে না, তবে জানতে পারে যারা পালিয়ে গেছে আর যারা পালাতে পেরেছে, তারা বাদে সবাই নাকি মৃত! পালিয়ে যাওয়া দু’চারজন বৃষ্টির মধ্যে ফিরে এসেছে, স্বজনদের খুঁজতে।
খুঁজতে খুঁজতে একটা ছড়ার কাছে মানুষের রক্তাক্ত দেহ পায় তারা। তখনও ভেসে যাচ্ছিল তাজা রক্ত!। প্রাণহীন দেহগুলো থেকে খুঁজে পাওয়া এক দেহ, নিস্তেজ। খুব ভালো করে কান পেতে থাকলে ধমনির অস্তিত্ব মেলে। সেখানেই গুণমনি খুঁজে পায় লাল বুনরাজিকে।
লালবুনির গুলি লেগেছিল বাঁ-পায়ে, প্রায় পাঁজরের কাছাকাছি। নিজের গায়ের রক্ত আর মরে যাওয়া স্বজনদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল তার সারা দেহ, ছড়ার স্রোতে বইছিল মানুষের রক্ত। কোথা থেকে জোগাড় হয় চা-টুকরি! তা কি আর খেয়াল থাকে? তার মধ্যে বসিয়ে সুন্দরী বাগানে আনা হলো লালবুনিকে। রক্ত আর কাদা পরিস্কার করতে গিয়ে গুণমনি দেখে শ’খানেক জোঁক সারাদেহে লেগে আছে! পাকিস্তানি মিলিটারিদের মতো যেন ছড়ায় ওত পেতে বসেছিল এসব জোঁক। রক্তের গন্ধে তাদের শিকার খুঁজতে বেগ পেতে হয়নি।
বুনোলতার রস থেঁতলে দিয়ে সে রক্ত বন্ধ হয় না, পরের দিন সকাল পেরিয়ে দুপুর নাগাদ রক্ত বন্ধ হলো। লালবুনির তখন সদ্য যুবক বয়স। পরের দিন সন্ধ্যায় জ্ঞান ফেরে, কথা বলে ওঠে লাল বুনরাজি।
৬.
লাল বুনরাজির সেই রাতের গল্প শুনতে বসলেই গুণমনি আর শুক্রমনির চোখে আলতায় আঁকা অক্ষর মনে পড়ে। সেই দিন ছিল এক তারিখ, বৃহস্পতিবার। দীঘিভাঙা চা-বাগানের ২১ নম্বর লাইনের সবাই আচমকা মিলিটারির গাড়ির শব্দ শুনে দৌড়ে পালাচ্ছিল। পলায়নরত সেই দলে ছিল লাল বুনরাজি, তার বাবা-মাসহ প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন মানুষ। পেছনে বুটের শব্দ ক্রমশ কাছে আসে। অশিক্ষিত, বুনো সব মানুষগুলো প্রাণের ভয়ে দৌড়ে যেতে থাকে। হঠাৎ খুব কাছ থেকে মিলিটারি চিৎকার করে বলে- হল্ট!
চা-বাগানের কুলি-কামিনরা কিছু বোঝে না। সে কথায় তারা বিচলিত হয়ে আরও জোরে দৌড়ে যেতে থাকে। লাল বুনরাজি তাদের থামানোর কোনো ফুরসত পায় না। সে দুই হাত উঁচুতে তুলে দাঁড়িয়ে পড়লে ভারি বুটের শব্দ তুলে মিলিটারির দল তাকে অতিক্রম করে পলায়নরত মানুষের বুক ঝাঁঝরা করে ব্রাশফায়ার করে। চোখের সামনে সবাইকে মরতে দেখে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বুনরাজিও দৌড় দেয়। একটা গুলি এসে তার বাঁ-পাশের পাঁজর ফুটো করে বেরিয়ে যায়। সে ঢলে পড়ে ছড়ার ভেতর। তারপর জ্ঞান ফিরলে সে গুণমনিকে দেখতে পেল। যুদ্ধ লালবুনির জীবনের সঙ্গে গুণের জীবনকে জড়িয়ে দেয়।
সব বনৌষধি ওষুধে ক্ষত শুকাতে ম্যালা সময় লাগে, এর মধ্যে খবর আসে এই বাগানে আর্মি আসছে। সবাই পালাতে শুরু করল, গুণমনি অসুস্থ লালবুনিকে পিঠের সঙ্গে বেঁধে সীমান্তপথে সবার পেছন পেছন হাঁটা শুরু করে। কখনওবা ঢালু পথে কাপড়ের টুকরি করে টেনে নামিয়ে নিয়ে চলে। সেই থেকে গুণমনির গল্প আবার সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। এ তো সাক্ষাৎ সেই আদি মা গুণমনি। তা না হলে একলা যুবতী মেয়ে ওমন টগবগে লালবুনিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে?
লাল বুনরাজির বাঁ-পা কেটে ফেলে দিতে হলো। সেই গুলি লাগা, জোঁকে খাওয়া পা, পচন ধরা পাটা তো সেই ওপারে রয়ে গেছে। সীমান্তের ওপারের আশ্রয়কেন্দ্র, কোনো এক মাঠের কোনায় মাটিতেই পুঁতে রেখেছিল গুণমনি। সে ঠিকানা এত বছর কি আর মনে থাকে! জীবনে আরও কত কত যুদ্ধ বয়ে যায়। তাই লাল বুনরাজি পূর্বপুরুষের গল্পে মেতে ওঠে না, সে নিজের জীবনের গল্প বলে। যা এক ক্রমাগত যুদ্ধের গল্প।