হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে বারান্দার শেষ মাথায় নিয়ে আসে মামুদ। এখন ভরদুপুর, চারদিক নিঝুম। রান্নাঘরে বাবুর্চিদের সাড়াশব্দও নেই। এখানকার বাকি সবাই ঘুমুচ্ছে। ওর ঘুম কম, রাতে এবং দিনে। বারান্দার এই কোনা থেকে অনবরত ছুটে চলা মানুষ এবং যানবাহন দেখে ও। দেখতে ভালো লাগে, আপাতত এটাই ওর প্রিয় দৃশ্য। যুদ্ধের সময় ছিল অন্যরকম, বুলেটবিদ্ধ শত্রুর লাল ছিল ওর প্রিয়। এখন সেসব কিছু ভাবতে ভালো লাগে না। ওর খুব ইচ্ছে সেই সোনালি শহরটা বুকের কৌটায় খুব যত্ন করে রেখে দিতে, কিন্তু পারে না, কখনও বারুদ হয়ে ফেটে পড়তে চায়। খুব কষ্ট হয় নিজেকে সামলাতে। এখানকার সবাই যখন অনুযোগ করে, নিজেদের অন্ধকারময় ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ, বিরক্ত হয়ে ওঠে, তখন ও চুপচাপ থাকে। অন্যমনস্ক হবার ভান করে, এক সময় নিঃশব্দে সরে আসে। নইলে চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নিজের ওপর আক্রোশ বাড়ে। মনে পড়ে বাবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি, মার ব্যথিত বিষণ্ণ চাউনি।
কাজের ছেলে মন্টু এসে পাশে দাঁড়ায়, ঘুমাইবেন না স্যার?
– নারে, ঘুম আসে না।
– আপনে এক্কেবারে কম ঘুমান।
মামুদ কথা বলে না। মন্টু বেশ চটপটে, হাসিখুশি ছেলে। সবার সঙ্গেই ওর খাতির। মন্টুর অহঙ্কার- ও যাদের সঙ্গে কাজ করে তারা সবাই যুদ্ধ করেছিল। মামুদ নিজেও শুনেছে মন্টু অনেকের কাছে এদের গল্প করতে ভালোবাসে। আগ বাড়িয়ে অনেক বেশি গল্প করে, যার মধ্যে অনেকটাই ওর বানানো। ওকে নিষেধ করলে শোনে না। এখন ওরা সবাই এটা মেনে নিয়েছে, মন্টুর আনন্দটুকু নষ্ট করতে চায় না।
-মন্টু, আমার কোনো চিঠি আসেনি?
-অহনো পিয়ন আহে নাই।
-ও।
-আপনের চিঠি অ্যাতো কম আহে ক্যান স্যার?
-আমার বাবা আমার ওপর খুব রেগে আছে। সেজন্য লেখে না।
-ক্যান, রাগ ক্যান?
-দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, এখন পঙ্গু হয়ে রইলাম, কী লাভ হলো? সেজন্য বাবার খুব রাগ।
-কন কী স্যার?
মন্টুর বিস্মিত কণ্ঠে মামুদের চমক ভাঙে। ওর কাছে এ কথাটা বলা ঠিক হয়নি। মন্টুর কল্পনার প্রাসাদটা গুঁড়িয়ে দিয়ে লাভ কী?
-মন্টু, আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়া।
ও ছুটে চলে যায়। মামুদের ক্লান্তি আসে। হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে থামে। আর মাসখানেক পরই ও হাঁটতে পারবে। এই হুইল চেয়ারটা একদম অসহ্য। মন্টু পানি এনে দিলে এক চুমুকে খেয়ে শেষ করে। এতক্ষণ বকুটা কেমন শুকনো লাগছিল।
বিকেল নামতে শুরু করেছে। একে ছুঁয়ে জেগে উঠছে বাকিরা। মামুদের পাশে এসে থামে শুকুরের হুইল চেয়ার। শুকুর হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে। ম্লান হাসি ঠোঁটের কোণে।
-কেমন আছো?
-ভালো।
মামুদ ঘাড় কাত করে, শুকুরের জন্য ওর বুকের ভেতর একটা স্থায়ী কষ্ট আছে। শুকুর কাছে এলে সেটা আরও দ্বিগুণ হয়।
-আজ এমন চুপচাপ যে?
-ভালো লাগছে না কিছু।
মামুদ চেয়ার ঘুরিয়ে শুকুরের মুখোমুখি হয়।
-আমরা যুদ্ধ করেছিলাম কেন শুকুর?
-নিজেকে এসব প্রশ্ন করতে নেই মামুদ।
-তুমি নির্বিকার থাকতে পারো, আমি পারি না। আমার খুব কষ্ট হয়, তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে।
ডাক্তার তোমাকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছে।
-এই পঙ্গু, বিষণ্ণ, জরাজীর্ণ জীবনটার জন্য কি যুদ্ধ করেছিলাম?
মামুদের কণ্ঠ খাদে নেমে যায়। মন্টু ওদের চা-বিস্কিট এনে দেয়। পুরো বিস্কিট মুখে পুরে লম্বা টানে চায়ে চুমুক দেয় শুকুর। মামুদ অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। চা কেমন তেতো লাগে। শুকুরের পিঠের একটা অংশ উঁচু হয়ে আছে। ওখানে একটা বুলেট আছে, আজও বের করা হয়নি। সিলেটের কমলগঞ্জ থানায় শুকুর ৪ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয় শেলের আঘাতে। তারিখটা ছিল ১৩ নভেম্বর। শুকুরের কিছু মনে নেই। জ্ঞান হবার পর জেনেছে, শরীরের নিচের অংশে কোনো অনুভূতির নেই, একদম অচল। একটুও কান্না পায়নি শুকুরের, বুকে তখনও অনেক স্বপ্ন ছিল। এখনও খুব সহজে মচকায় না। অথচ নিজের অজান্তেই হয় ওর পেশাব-পায়খানা। আজ সাত বছর শুকুর ব্লাডারে পেশাব করে। মামুদের চা খাওয়া হয় না, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বিস্কিটও বিস্বাদ, মন্টুর হাতে কাপ তুলে দেয়।
মামুদ চেয়ার নিয়ে ঘরে আসে, বিছানার কাছে থামে, কী করবে বুঝতে পারে না। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। শুকুর অন্যদের সঙ্গে কথা বলছে, ওর জোরালো কণ্ঠ মামুদের কানে ভেসে আসে। ওরা দশজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা এই বাড়িতে থাকে, যুদ্ধের পর ওদের জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে, চিকিৎসা এবং থাকা-খাওয়া। ওদের জন্য কি আরও কিছু করা যেত না? মামুদের মনে হয় এই বাড়িটার ওপর অনবরত শুকনো পাতা ঝরে, আস্তে আস্তে এটা তলিয়ে যাবে, কোনোদিন কেউ আর ওদের কথা মনে রাখবে না। এই সাত বছরে ওর বাবার উদ্বিগ্নতা অনেক কমে এসেছে, এখন বছরে একবার দেখতেও আসে না, কুষ্টিয়া থেকে আসতে অনেক খরচ। চিঠি লেখাও কমে এসেছে, ও কার কাছে মনের কথা বলবে? মামুদ কাল রাতের অর্ধেক পড়া উপন্যাসটা পড়ার চেষ্টা করে, পারে না। বুকে কী একটু ব্যথা হচ্ছে, না কি মন খারাপ? যুদ্ধে ওর হার্টের একটা ভাল্ভ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গত সাত বছর ও হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাটিয়েছে। এ বছরই বিদেশ থেকে ফিরেছে, অপারেশন করে ওর হার্টে বসানো হয়েছে কৃত্রিম ভাল্ভ। বুকে কান পাতলে এই ভাল্ভের জোরালো ধুক ধুক আওয়াজ শোনা যায়। স্বাধীনতার মতো এই শব্দটুকু ওর বাড়তি লাভ। মামুদ হো হো করে হেসে ওঠে। তোফাজ্জল পাশের বিছানা থেকে হৈ-চৈ করে ওঠে।
-কী হলো, হাসছো কেন?
-একটা কথা মনে হলো।
– বলো না, শুনি।
-তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।
-বলোই না, যদি মন ভালো হয়। সন্ধ্যা থেকে খুব খারাপ লাগছে।
মামুদ তোফাজ্জলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাঙা চোয়াল, উঁচু দাঁত, ধবধবে গায়ের রঙ, তোফাজ্জল দুর্দান্ত যোদ্ধা ছিল। ভয় কাকে বলে জানতো না। ওরা সাত ভাই যুদ্ধ করেছে, একজন শহীদ হয়েছে, বাকি পাঁচজন চাকরি করছে, কোনোমতে দিন ঠেলে চলা আর কী। মাঝে মাঝে তোফাজ্জলকে দেখতে আসে।
-চুপ করে আছো কেন মামুদ?
বলার কিছু নেই। কেবলই মনে হয় দেশের জন্য যুদ্ধ মানে কি এমন নিদারুণ নির্বাসন?
-মামুদ, কাউকে ভালোবাসতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করে।
-ঠিক বলেছো, আমারও।
-মামুদের চোখ উজ্জ্বল হয়।
-কিন্তু কে আমাদের ভালোবাসবে?
-দেশে কি এমন কোনো নারী নেই?
-কে জানে!
দু’জনে আবার চুপ করে যায়। অকস্মাৎ সমস্ত শব্দ উধাও, ধূসর শীতার্ত সময় হামা দিয়ে এগিয়ে আসছে, ওরা সেই গহ্বরের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে।
-হা হা করে হেসে ওঠে তোফাজ্জল।
-শালা, আমি একটা বেকুব। আমার তো দুটো পা নেই। আমি কি দিবাস্বপ্ন দেখছি মামুদ?
-না।
মামুদ চিৎকার করে ওঠে।
-আমরা ভালোবাসা চাই, ঘর চাই, সন্তান চাই।
হা হা করে হাসে তোফাজ্জল। সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে ঘরে। মামুদের চিৎকার পৌঁছে যায় ওদের সকলের কানে। কান পেতে শোনে শুকুর, সিরাজুল, মুফাখখার, বাদল আরও অনেকে। সেই সঙ্গে শোনে তোফাজ্জলের ঠা ঠা হাসি। হাসি আর থামে না। সবার চোখের কোণ ভিজে ওঠে। এক সময় তোফাজ্জলের হাসি থেমে যায়।
-তোমার এখনও সময় আছে মামুদ, আর ক’দিন পর হাঁটতে পারবে। তোমাকে দেখলে মনে হয় না যে বুকের একটা ভাল্ভ নষ্ট হয়ে গেছে। চমৎকার স্বাস্থ্য তোমার। তুমি কারও ভালোবাসা পেতে পারো। কিন্তু এভাবে থাকতে থাকতে আমি একদিন পাগল হয়ে যাবো।
– তুমি থামো তোফাজ্জল।
– থেমেই তো আছি, জ্বলে ওঠার শক্তি কি আর আছে?
তোফাজ্জলের বুকভরা নিঃশ্বাস বাকিরা শুনতে পায়। ঘরের আবহাওয়া থমথমে। মামুদ চেয়ার ছেড়ে বিছানায় ওঠে। চিৎপাত শুয়ে ঘরের ছাদ দেখে, শাদা এবং শূন্য। ডাক্তার তার রিপোর্টে বলেছে, ও কোনো কাজ করার উপযুক্ত নয়। বেশি ছোটাছুটিও নিষেধ। কিন্তু আমাকে কাজ করতে হবে, আমি এত অচল জীবনকে ছেড়ে দেবো না। আরও দেখবো, অনেক দেখবো। আমি তো জানতাম স্বাধীনতা একটা দাঁতাল শুয়োর। কেড়ে নেয় জীবনের বাকি দিনগুলোর আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি। তবু আমি তার জন্য লড়েছি এবং জিতেছি। আমি পরাজিত হতে চাই না।
ও বিছানায় উঠে বসে। উত্তেজিত হলে বুক কেমন চেপে আসে। মনে হয় নিঃশ্বাসের পথে কোথায় কী যেন আটকে আছে! পায়ে মশা কামড়াচ্ছে, বাড়িটা স্যাঁতসেঁতে বলে মশা বেশি। মন্টু চিৎকার করে গান করছে, শুনতে ভালো লাগে। এতগুলো পঙ্গু, অথচ তাদের মধ্যে আশ্চর্য সজীবতা, প্রফুল্লতা। ওর বাবা, মা কবে মরেছিল, কী হয়েছিল জানে না। এর, ওর আশ্রয়ে থেকে বড় হয়েছে, কিন্তু তাতে ও দমেনি, সেসব নিয়ে ও ভাবেও না। ভালোবাসার জন্য ওর কোনো ব্যাকুলতা নেই। অথচ এত বয়সেও যার কথা ভাবলে মামুদের বুক কেমন খালি হয়ে যায়। ও হঠাৎ চিৎকার করে ওকে ডাকে।
-মন্টু! মন্টু!
– জি।
ও দৌড়ে কাছে এসে দাঁড়ায়।
– এক গ্লাস পানি।
মামুদ একটু থমকে থেকে বলে। ও কি আসলে পানি চাইছিল, না অন্যকিছু। কী করবে বুঝতে পারে না, কী করা যায়, কী করা দরকার। ও তোফাজ্জলকে দেখে। বালিসে মুখ চেপে শুয়ে আছে তোফাজ্জল, নির্ভীক, দুর্ধর্ষ, সাহসী, কেউ ওকে পিছু হটতে দেখেনি। তোফাজ্জল বলতো, বুলেট কখনও পিঠে নেবো না, এই কলজেয়।
– স্যার পানি?
– থাক, খাবো না।
– ক্যান?
– তুই আমাকে কড়া করে চা খাওয়া।
– আজিজ চাচা রানতাছে। চুলা খালি নাই।
– চুপ, এক্ষুনি চা নিয়ে আয়। নইলে সব ভেঙে ফেলবো।
মামুদের অসহিষ্ণু কণ্ঠের ঠমকে মন্টু চলে যায়। ওর জেদ বাড়ে। ইদানীং ওদের দিকে তেমন খেয়াল রাখা হচ্ছে না। এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধটাও পাওয়া যায় না। কত যে কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঘেন্না ধরে গেল। সাত বছরেই ওদের গায়ে শ্যাওলা পড়ে নোনা ধরে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও মন্টু চা নিয়ে আসে না। মামুদের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। বুঝতে পারে বাবুর্চি নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে ওকে এক কাপ চা দিতে রাজি নয়। মামুদের অস্বাভাবিক চিৎকারে হকচকিয়ে যায় ঘরের সবাই।
-জি স্যার।
– তোকে চা দিতে বললাম না?
মন্টু কিছু বলার আগেই মামুদ খাট থেকে লাফিয়ে নেমে ওর চুলের মুঠি ধরে।
– কথা বললে কথা শোনা হয় না, বেয়াদব? আজ তোকে মেরেই ফেলবো।
মন্টুকে দমাদম কয়েক ঘা লাগায়।
– বাবুর্চিকেও আজ খুন করবো।
মামুদ মন্টুকে ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরের দরজা পর্যন্ত ছুটে গিয়ে পড়ে যায়। বুকে অসম্ভব ব্যথা। কিছু একটা ধরার জন্য হাত বাড়ায়, কিন্তু পায় না। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। ক’দিন ওকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে ও জানে না। জওয়ান ফেরার পর দেখলো নাঙ্গ মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। ডাক্তার মিনুকে বলে দিয়েছে মামুদের একটু বিশেষ যত্ন নিতে।
– কেমন লাগছে?
– খুব ভালো।
– চুপচাপ শুয়ে থাকুন।
ও নিশ্চিত নির্ভাবনায় চোখ বোজে, যেন শরীরের কোথাও অসুখ নেই। বুকের ভেতরের যন্ত্রগুলো সবই তো ঠিক আছে, অথচ ওর কোনো যন্ত্রণা নেই। ঘুরেফিরে মনে হয় মিনু একদম নার্সের মতো নয়, কোথায় যেন আলগা স্ত্রী আছে, যা শুধু গৃহের নিরিবিলি সুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। যত্তসব নিজের ওপর রাগ হয়। এসব বাজে আবেগে হৃদয় প্লাবিত হয়ে গেলে মেজাজ খিচিয়ে ওঠে, শরীর ঝিম ধরে থাকে। মিনু কাছে এলে কিছুটা সময় ভালো লাগে, নইলে হাসপাতালের দিনগুলো ক্লান্তিকর, নোনাধরা। মামুদ জানালার ফাঁকে নারিকেল গাছের মাথার ওপর দিয়ে নীল আকাশ দেখে, ধূসর হয়ে আসে দৃষ্টি।
কাউকে ভালোবাসার মতো কোনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুদ্ধে চলে গেছে। ভালোবাসার আগে যুদ্ধ, যুদ্ধের পরে ভালোবাসা। নিয়মের ব্যতিক্রম হয় বলেই তো এমন বুকভরা তৃষ্ণা, কেবলই নোনাজল তৃপ্তি হয় না। ভালোবাসার আগে যুদ্ধ হলে এবং যুদ্ধ মাশুল উঠিয়ে নিলে ভালোবাসা আর মুখ ফেরায় না। মামুদের বুকের ভেতর দুপদাপ একটা বাড়তি শব্দ সব সময় ওকে যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ও ওঠে বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়ায়। রাস্তার মানুষ দেখতে দেখতে ছোটবেলার ঘরগেরস্তির কথা মনে পড়ে। যেখানে মা ছিল, ধান ছিল, চুলোয় আগুন ছিল। এখন আমি নারী চাই, ধান চাই, আগুন চাই। বুকে ব্যথা বাড়ে, ও আবার বেডে ফিরে আসে। মিনু কাছে এসে দাঁড়ায়।
– ঘুমুচ্ছেন না যে?
– ঘুম আসে না।
– এমন করলে শরীর খারাপ করবে।
মামুদ ফিরে দৃষ্টিতে মিনুর মুখের দিকে তাকায়।
– যুদ্ধে যেদিন আহত হয়েছি তারপর থেকে ডাক্তারের উপদেশ শুনতে শুনতে এই এতটা বছর পেরিয়ে এলাম। এখন তেতো লাগে। প্লিজ অন্য কথা বলুন, অন্য কিছু, মিনু বিব্রত হয়ে যায়। মামুদের ব্যাকুল দৃষ্টি উপেক্ষা করেই বলে, আমি তো এসবই শিখেছি।
– এগুলো তো জীবিকার কথা, আপনার নিজের কিছু কথা নেই, একদম ব্যক্তিগত?
– আপনি ঘুমুবার চেষ্টা করুন।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
মামুদ মুখ ফিরিয়ে নেয়। রক্তের গোঁয়ারতুমি থামাতে কষ্ট হয়। মিনু, মন্টু হলে হয়তো দমাদম কয়েকটা লাগিয়ে দিত। ইদানীং এমনই হচ্ছে।
মাস দু’এক গড়িয়ে গেছে। মিনু এখন অনেক সহজ। কখনও হাসি-তামাশা করে। রাতের ডিউটি থাকলে বিছানার কাছে এসে বসে কপালে হাত রেখে ঘুমুতে বলে। মামুদের বুক ভরে যায়, একটু অন্যরকম লাগে। তখন তোফাজ্জলের কথা মনে করে চোখের কোণ চিকচিকিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে মিনুর হাত ধরতে, পারে না। অনেক পরে বলে, ডাক্তার আমাকে কবে ছুটি দেবে?
– আর বোধহয় দিন সাতেক পরে।
– কাল হয় না?
– কেন? যদি আবার অসুখ বাড়ে?
– আর যদি কখনও অসুস্থ হই তাহলে নিজে নিজেই মরবো। কোনো ডাক্তার না, হাসপাতাল না, কারও কাছেই সাহায্যের জন্য হাত বাড়াব না। গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বললে মিনু চমকে ওঠে, কণ্ঠ একটু অন্যরকম, ভারী, যুদ্ধে যাবার সংকল্পের মতোই দৃঢ়প্রত্যয়ী।
– আমি জানি, আমি বেশিদিন বাঁচবো না। সাতাশ বছর বয়স এ দেশের জন্য অনেক। বাপ-মার সুখের ঘরগেরস্তি দেখেছি, যুদ্ধ দেখেছি, স্বাধীনতা দেখেছি, স্বাধীনতার পর, এই সাত বছর দেখলাম, এখন আমার না বাঁচলেও চলে। আর দেখার কী বা আছে?
মামুদের বিষণ্ণ হাসি মিনুকে চাবুক মারে, রাগী বিদ্রূপাত্মক চাবুক। ও মামুদের চোখের দিকে চাইতে পারে না। কেবলই মনে হয়, এক জীবনে মামুদ অনেক কিছু দেখেছে। ওর কিছুই দেখা হয়নি। পঁচিশ বছর এমনিই কেটে গেল। মামুদের দিকে হাত বাড়ালে হয় না?
আমি আর ওই খোঁয়াড়ে ফিরে যাবো না। কাজ করবো, মানুষের ভিড়ে মিলে যাবো। মুক্তিযোদ্ধা নামের বিশেষ চিহ্ন নিয়ে আর বাঁচতে চাই না। আমার আর নতুন চিকিৎসা নেই, আমার জন্য এ দেশের সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই। এখন ওই খোঁয়াড় থেকে পালানোই আমার জন্য জরুরি। মিনু কথা বলতে পারে না। এত গভীর, ভারী অথচ বুক নিংড়ানো কথা ও কখনও শোনেনি। কেমন এক শূন্যতা বুকের কোঠাবাড়িতে হা-হা ফিরে। গলার কাছে কষ্ট আটকে থাকে। মামুদ বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। বড় ইচ্ছে করে মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে চোখে চোখ রাখতে। একটু আগেও কেমন বিষণ্ণ উদাস কণ্ঠ ছিল মামুদের যেন নদীর ওপার থেকে ডাকছে। ভাবতে কষ্ট হয় যে, এই ছেলে দেশের স্বাধীনতার জন্য ঘর থেকে পালিয়ে ছিল। ও চুলে হাত রেখে গভীর স্বরে ডাকে, ঘুমিয়েছো?
মামুদ মাথা ওঠায়। মিনুর কণ্ঠ বুকের বাড়তি শব্দ দুটো থামিয়ে দিতে চায়।
– ঘুম এলে তো বেঁচে যেতাম।
– আহ্, তুমি এমন করে কথা বল যে বুক তোলপাড় করে ওঠে। চলো বাইরে বসবে!
– না থাক, ভালো লাগছে না।
ও আবার বালিশে মুখ গোঁজে। ভয় হয়, এত কাছ থেকে মিনু যদি পালিয়ে যায়। আশ্চর্য শীতল হয়ে গেছে অনুভূতি। বড় প্রাপ্তির আশায় সাময়িক সুখটুকু তুলে রাখতে চায়। বুকে কেমন ব্যথা হচ্ছে। মিনুকে বলা যাবে না। এখন শুয়ে থাকাটাই জরুরি। মিনু ওর কাছ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা করে, মামুদ কিছু বলে না। ওর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মিনুর বারবার মনে হয়ে বুকের ভাল্ভ নষ্ট হয়ে গেলেও এখনও জ্বলে ওঠার মতো সাহস ওর আছে। ও যে ক’দিন বাঁচবে মাথা উঁচু করেই বাঁচবে। এমন একজন মানুষই তো ও খুঁজছিল। মামুদ যে ক’দিন বাঁচুক, ঝুঁকিটা ও নেবেই। কেউ ওকে কোনোদিন ভালোবাসার কথা বলেনি, ওর নিজেরও সুযোগ হয়নি। আজ নিজ থেকেই মামুদের কাছে যেচে দাঁড়াবে। মিনু নির্ভার হয়ে কাজে চলে যায়।
আগামীকাল মামুদের ছুটি হবে। গত তিন-চারদিনে মিনুর আগ্রহকে ও জোর করে উপেক্ষা করেছে, একটি কথাও বলেনি। ও চায় না মিনু শুধু ওর জীবনে এক রক্তক্ষয়ী স্মৃতি হোক, কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক। তার চাইতে মিনু সময় নিক, বুঝে দেখুক। যুদ্ধ করা ছেলেরা এত তাড়াতাড়ি আবেগকে প্রশ্রয় দেয় না। মামুদ সারাদিন খাটে শুয়ে থাকে। কেবলই যুদ্ধের কথা মনে হয়। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ সেও তো এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা! ভালোবাসাকেও যুদ্ধের মতো জয় করতে হয়, এই বোধে আক্রান্ত হয়ে আছে আজ ক’দিন। তবু মুখ খোলে না। কেবলই মিনুর যন্ত্রণা দেখে। সকালে ও আসেনি। আজ ওর নাইট ডিউটি।
বিকেলের নার্সের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেবার পর মিনু একটু ক্ষণের জন্য বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
– তুমি আমাকে কিছু বললে না যে?
মামুদ চোখে চোখ রেখে হাসে।
– কী বলবো?
ওর দু’চোখে স্থিত প্রশান্তি। আবেগ প্রকাশের ভাষা নেই।
– কিছু বলবে না? এই যে তোমাকে তুমি করে বলছি?
মামুদ চুপ করে থাকে। মিনু আরও কাছে আসুক, আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়ে। মিনুর চোখের পাতা কাঁপে। মামুদ ওকে দেখছে না, মুখ নিচু, মাথা ভর্তি চুল কপালে লুটোয়।
– ঠিক আছে কিছু বলতে হবে না।
মিনু ক্ষুণ্ণ হয়ে টেবিলে ফিরে যায়। ইনজেকশনের সিরিজও নাড়াচাড়া করে, এখন অনেক কাজ। সাদা পোশাক-পরা ব্যস্ত মিনুর পিছু পিছু মামুদের দৃষ্টি ফেরে, ও এখন মামুদের আকাঙ্ক্ষিত ভূখণ্ড, স্বাধীন এবং শ্যামল সবুজ।
দশটার পর ওয়ার্ডের বাতি বন্ধ করে দিয়ে মিনু যখন মামুদের বেডের কাছে এসে দাঁড়ায় ও কপালের ওপর হাত রেখে শুয়েছিল। চোখ ঢাকা। টেবিলে খাবার পড়ে আছে। মিনু কপাল থেকে হাত সরায়।
খাওনি কি?
-ইচ্ছে হচ্ছিলো না।
মিনু কথা না বলে প্লেটে ভাত মাখিয়ে মামুদের মুখের কাছে ধরে। ও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়।
-দেখছো কী? আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
-না।
-হ্যাঁ, এখন থেকে আমি রোজ তোমাকে খাইয়ে দেবো।
-আমি কাল চলে যাচ্ছি।
-তাতে কী? তবু আমি তোমাকে খাইয়ে দেবো।
-কেমন করে?
-আমাদের ঘরে বসে।
এতক্ষণে মামুদ ওর হাত চেপে ধরে।
-সত্যি মিনু আমাদের ঘর হবে?
-বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
-বিশ্বাস করতে ভয় হয়।
-তোমার সাহস আছে তুমি সব যুদ্ধেই জিতে যাও। তোমাকে আমার ভীষণ হিংসে হয় মামুদ।
মামুদ মিনুর কথা শোনে না, মনে হয় প্রচণ্ড গোলাগুলির পর বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসা শত্রুমুক্ত মানুষ এখনও কামালপুর সীমান্ত দিয়ে স্বাধীন দেশে ঢুকছে।
মিনু ওর মুখে ভাতের গ্রাস তুলে দেয়।