শিমুলের দুহাতে বাজারের ব্যাগ। রিকশায় আসছে তবুও ঘামছে। চোখে মুখে বিরক্তি। এমনিতে বাজার করতে ভালো লাগে ওর। কিন্তু আজকে মাছঅলার সঙ্গে অযথাই একটা তর্কে জড়িয়ে যাওয়ায় মনটা খিঁচড়ে আছে। মন যাতনার ভেতরে রিকশা বাসার গেটে থামার সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ায় কুশল, আজ কিন্তু বাসায় থাইকেন ভাই।
আমিতো বাসায়ই থাকি, বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দেয় শিমুল।
আরে ভাই, আপনিতো ভুইলা গেছেন। আউজকা বাড়িঅলার বাসায় যাওয়ার কতা আছে না?
সে তো সন্ধ্যায়—
হ সন্ধ্যায়। কিন্তু আমি আপনারে আবার মনে করাইয়া দিলাম। সবাই মিইল্লা বাড়িঅলারে না ধরলে কাম অইবে না ভাই। যেভাবেই হোক, লোকটাকে বাসা থেকে তারাইতে হবে, দৃঢ় কণ্ঠে সিদ্ধান্ত জানায় কুশল।
ঠিক আছে, রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দুহাতে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিন তলায় এসে শিমুলের মেজাজ আবার বিগড়ে যায়। দ্রুত ব্যাগদুটো রেখে দোতলায় এসে বাড়িঅলা আবদুল আজিজের দরজায় কড় নাড়ে। কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দাঁড়ায় আবদুল আজিজের মেয়ে, বাবাতো বাসায় নাই।
বাসায় নেই? যতদূর সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে শিমুল।
মেয়েটির হাতে একটি পাকা কলা। পাকা কলা খেতে খেতে মেয়েটি মাথা নাড়ায়, নাই।
কোথায় গেছে বলতে পারো?
দুদিকে প্রবলভাবে মাথা নাড়ায় মেয়েটি, না।
তুমি একটু দেখে যাও।
কলার শেষটুকু মুখে দিয়ে মেয়েটি দরজার কাছে আসে, কি দেখবো আংকেল?
আসো না, দেখে যাও।
চলেন, বাড়িঅলা আবদুল আজিজের মেয়ে, নামটা মনে করতে পারছে না শিমুল, স্কুলে সিক্সে বা সেভেনে পড়ে। সকালের গাড়িতে স্কুলে যায়। দোতলা থেকে তিনতলায় উঠতে উঠতে মেয়েটির নাম মনে পড়ে, সীমানা। বাড়িঅলা আবদুল আজিজের এক ছেলে দুই মেয়ে। ছেলেমেয়েদের নামগুলো অন্যরকম। ছেলে পড়ে কলেজে, নাম সীমান্ত। ছোট মেয়ের নাম মগ্ন। একেবারে বাংলা নাম।
তিন তলায় উঠে শিমুল হাত দিয়ে দেখায়, দেখো।
শিমুলের হাত অনুসরণ করে তাকাইতে সীমানা দ্রুত দৌড়ে নিচের দিকে নামতে থাকে কিন্তু নামতে নামতে গল গল বমি করতে থাকে। দোতলা এবং তিন তলার ফ্লাট, ছুটির দিনে বাজার থেকে আসা লোকজনে গোটা সিঁড়ি একাট্টা। ঘটনা কি? আবদুল আজিজের এই বাড়িতে, যে বাড়ির নাম ‘শরণ’ সেই বাড়ির চারতলায় থাকে সোমনাথ রায়। রায়ের মেয়েটি, নাম যার পিংকি, বয়স নয় বছর, সেই পিংকি মাঝেমধ্যে সিঁড়িতে প্রকৃতির কাজ সাড়ে। পিংকি এ্যাবনরমাল। দেখতে একেবারে চাঁদের মতো সুন্দর। কথা বলার সময়ে বোঝাই যায় না, পিংকি মারাত্মক এক মনোরোগে ভোগে। ডাক্তারের কাছে সোমনাথ রায় মেয়েকে নিয়ে নয় বছর ধরেই যায়, চিকিৎসা চলে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয় না। মেয়েটি গায়ে পায়ে বড় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বুদ্ধির প্রকাশ একদম নেই বললেই হয়।
ডাক্তারের একই কথা, এইসব রোগ সহজে ভালো হয় না। লেগে থাকতে হয়।
কি আর করা! সোমনাথ রায় এবং পারুল রায়তো মেয়েটির পিছনে লেগেই থাকে। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে দেয় না। কিন্তু মানুষ তো, কোনো না কোনো কাজের ফাঁকে ভুলে যায় পিংকিকে। পিংকিও সেই সুযোগটা নেয়। কি এক দুর্বোধ্য কারণে প্রকৃতির কাজ সাড়তে সিঁড়ি ওর খুব পছন্দ। ডাক্তার এই সিঁড়িপ্রীতির কোনো সঠিক ব্যাখা দিতে পারে না। কারণ, এই রোগ নিদিষ্ট নিয়ম মেনে হয় না।
এই ঘটনা নিয়ে ভাড়াটেরা সবাই বিরক্ত। আবদুল আজিজের বাড়িটা ছয়তলা। প্রতিটি তলায় দুটি ফ্লাট। আবদুল আজিজকে বাদ দিলে বাসায় এগারোজন ভাড়াটে। এগারোজনের একজন সোমনাথ রায়। বাকি দশ জনের প্রত্যেকেই দেখা হলেই আবদুল আজিজকে বলেন, ভাই কিছু করলেন?
কী করবো?
সোমনাথ রায়ের ব্যপারটা?
গাল ভরে হাসে, দেখছি।
অনেক দিন তো হয়ে গেলো। আপনাকে বলি আর আপনি বলেন, দেখছি। কিন্তু কিছুতো করছেন না। এভাবে তো থাকা যায় না। আপনার বাড়িতে আমরা তো ভাড়া দিয়ে থাকি ভাই!
আমি কি কোনোদিন বলেছি, আপনারা বিনা ভাড়ায় থাকেন?
সেটা বলবেন কেনো? পাঁচতলার ভাড়াটে ব্যাংকার লোকমান হোসেন পানের পিক ফেলে, কিন্তু আমাদের দাবীটা তো আপনি শুনছেন না।
ছয় তলার বশিরউদ্দিন তখন যাচ্ছিল দোকানে, ঘটনার গন্ধ পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়— বুঝলেন লোকমান ভাই, বাড়িঅলা আমাদের মানুষই মনে করে না। নইলে তিন চার বছর ধরে একই কথা বলে যাচ্ছি আমরা, আমাদের কথা উনি কানেই তুলছে না। মনে হয়, সোমনাথ বাবু আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া দেয়। আমাদের চেয়ে সোমনাথ বাবুই ওনার কাছে বড় হয়ে গেলো?
কি যে বলেন আপনারা! আবদুল আজিজ নিজের মতো বলে, আমার কাছে আপনারা সবাই সমান। আপনাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ব্যাংকের দেনা দিই। আপনারা প্রত্যেকে আমার লক্ষী।
কিন্তু সোমনাথ বাবুর মতো এই অপকর্ম কেউতো করে না— চেচিয়ে ওঠে লোকমান। কতোটা সহ্য করা যায়?
আবদুল আজিজ জিহব্বায় কামড় দেয়, ছি ছি লোকমান ভাই, কি বলছেন আপনি? সোমনাথ বাবুতো এ কাজ করে না। করে তাদের মেয়েটি, পিংকি।
সোমনাথ বাবু এই জঘন্য কাজ কেনো করতে দেয় তার মেয়েকে? আটকে রাখতে পারে না? লোকমান হোসেন হন হন করে যেতে যেতে বলে, অনেক হয়েছে। আর এই বাড়িতে না। টাকা দিয়ে থাকবো, তো সিঁড়িতে সোমনাথ বাবুর মেয়ের ইয়ে দেখে থাকতে হবে কেনো? আমরা কি ভেসে এসেছি ঢাকা শহরে?
লোকমান হোসেনর সঙ্গে গলা মেলায় বশিরউদ্দিন, আমিও আগামী মাসে আপনার বাসা ছেড়ে দেবো আজিজ ভাই, যদি আপনি সোমনাথ বাবুকে বাসা থেকে চলে যেতে না বলেন।
মৃদু হাসার চেষ্টা করে আবদুল আজিজ, দেখছি, আমি দেখছি কী করতে পারি?
আবদুল আজিজ জানে, কেউ তার বাড়ি ছেড়ে যাবে না। কারণ, তার বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টা পানি থাকে। রুমগুলো তুলনামূলকভাবে বড়। ভাড়াও নেয় কম। সোমনাথ বাবুর মেয়ে পিংকির কারণে প্রতি মাসেই বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়ে প্রায় প্রত্যেক ভাড়াটে। কিন্তু কেউ যায় না। মাস ছয়েক আগে চারতলার মোতালেব মিয়া, যে পুরানো ঢাকায় লোহার ব্যবসা করে, সে একেবারে জানিয়ে দেয়, আমি আর আপনার বাড়ি থাকুম না। আগামী মাসে আপনি নতুন বাড়াটে আনবেন। ছি ছি, সিঁড়িতে…. এইসব কি! টাকা দিয়া থাকি!
অবশ্য মোতালেব মিয়ার রাগেরও যথেষ্ট কারণ ছিল। পিংকির প্রকৃতির কাজের উপর তার পা পরেছিল এবং আছাড় খেয়ে একটা পা মচকে গিয়েছিল। সোমনাথ রায় রিকশা ভাড়া করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। দুদিন বাসায় ফল নিয়ে দেখেও এসেছে স্বস্ত্রীক। তো মাসের শেষের দিকে বাড়ির সামনে টুলেট সাইনবোর্ড টানিয়ে দিলে, দুপুরের দিকে একজন ভাড়াটে আসে। ভাড়াটে নিয়ে চারতলায় মোতালেব মিয়ার ফ্লাটে গেলে চমকে ওঠে মোতালেব মিয়া, আমি বাসা ছাড়ার কথা কবে বললাম?
গত মাসেই তো বললেন, গেটে দাঁড়িয়ে ব্যাথায় কোকাতে কোকাতে, আপনার মনে নেই?
আরে দূর! তখন আমার মেজাজ মর্জির ঠিক ছিল? মোতালেব মিয়া একেবারে গলে যায়, বাসা ছাড়লে ভাড়া দেওয়ার সময়ে আপনাকে বলতাম না?
আবদুল আজিজের ‘শরণ’ এর সিঁড়িতে পিংকি প্রকৃতির কাজ প্রতিদিন করে না। ওকে বাসায় আটকে রাখে ওর বাবা মা, দাদী এবং একমাত্র ভাই, অনল। অনল সকালে প্রাইভেট পড়তে যায়, মায়ের একটু স্বাস্থ্য খারাপ, বাবা বিছনায় আড়ামোড়া ভাঙ্গছে, সেই ফাঁকে পিংকি দরজা খুলে সিঁড়িতে নেমে আসে। এবং প্রকৃতির কাজ সেরে চুপ করে বাসায় চলে যায়। অনেক সময়ে কেউ দেখে চিৎকার করলেও পিংকি নির্বিকার। ওর কাজ নিবিষ্ট মনে করে। এবং কাজ শেষ হলেই উঠে চলে যায়। এই দুর্ঘটনা ঘটে হঠাৎ হঠাৎ। কিন্তু সেই হঠাৎ ঘটনাই গোটা ‘শরণ’ কে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দু’একবার বাড়িতে আসা মেহমানেরও বিপদে পড়েছে। আবদুল আজিজ, সোমনাথ রায় ছাড়া এই বাড়ির সবাই মুক্তি চায় অসহ্য যন্ত্রণা থেকে। ভাড়াটেদের মুক্তি দেবে যে সেই বাড়িঅলা নিঃশব্দ। বাড়িঅলার এই অবাক নিঃশব্দ রহস্য দশ ভাড়াটের কেউ খুঁজে পায় না।
রহস্যে নয়, এই দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাবার জন্য সবাই একজোট। যেভাবেই হোক, বাড়িঅলাকে বলে, জোর করে হলেও সোমনাথ রায়কে ‘শরণ’ থেকে উৎখাত করতেই হবে। দশ ভাড়াটের আটজন জড়ো হয়েছে পাঁচ তলায় আজিজুর রহমানের বাসায়। দোতলায় বাড়িঅলার বাসায় যাবার আগে সবাই মিলে চা সিঙ্গারা খেতে খেতে পরিকল্পনা করছে, বুদ্ধিতে শান দেয়।
যদি বাড়িঅলা এইবার আমাদের দাবী না মানে, আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করবো— গরম সিঙ্গারায় কামড় দিয়ে বলে দোতলার দবিরউদ্দিন। পুলিশের একজন এআইজি আমার খুব পরিচিত । লোকটা চাচাতো ভাই আবার সরকারী দলের এমপি। মন্ত্রী হওয়ার চান্স আছে।
পুলিশের কাছে গেলে ঘুষ লাগবে, উত্তর দেয় কুশল।
ঘুষ লাগবে? লাগলে দেবো। তবুও এই অনাচার থেকে মুক্তি চাই, যন্ত্রনা থেকে রেহাই চাই— প্রায় শ্লোগানের মতো হাত তুলে বলে চারতলার বারেক আলি। ওর দিকে সবাই তাকালে হাত নামিয়ে হাসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমি ছাত্রনেতা ছিলাম, মিছিলের সামনে থেকে গলা ফাটিয়ে ম্লোগান দিতাম, এরশাদের চামড়া…
সবাই হাসে। হাসির সঙ্গে চা ছিটকে পড়ে আজিজুর রহমানের শার্টে। মেয়ে বাশরীকে ডাকে, বাশরী?
বাশরী দরজায় উকি দেয়, মা এক বাটি পানি নিয়ে আয়তো। শার্টটা পরিষ্কার করতে হবে। নইলে চায়ের দাগ উঠবে না। তোর মা জামার এই দাগ দেখলে গালাগালি করবে।
বাসার ভেতর থেকে বাশরী পানির বাটি আনে, আজিজ শার্টে পানির ঝাপটা লাগায়। এই ফাঁকে শিমুলের কানে ফিসফিসিয়ে বলে দবিরউদ্দিন, আমি জানতাম আমার পাশের বাসার সোলেমান মিয়া আসবে না।
ভ্রু কুঁচকে তাকায় শিমুল, কেনো আসবে না?
সোলেমান মিয়ার সঙ্গে সোমনাথ বাবুর খুব খাতির।
তাই নাকি?
হ্যাঁ,দুজনে মিলে শেয়ারের ব্যবসা করে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেয় শিমূল, এখন মিলে গেছে।
মিলে গেছে মানে?
আমি প্রায়ই দুজনকে মতিঝিলে দেখি। এখন বুঝতে পারলাম। এই জন্য সোলেমান আসবে না?
আমার সেটাই মনে হয়।
এ্যাই আপনারা বারান্দায় কী ফুসুর ফুসুর করছেন? তাড়াতাড়ি নিচে লন— তাড়া দেয় কুশল। অথচ সে এসেছে সবার শেষে।
চলেন।
সবাই বাড়িঅলা আবদুল আজিজের বাসায় ঢোকে। আবদুল আজিজ অপেক্ষা করছিল। ড্রয়িংরুমে বসে ট্রকটাক কথাবার্তার পর আজিজুর রহমান গলা খাকারি দিয়ে বলতে শুরু করে, চাচা আপনার কাছে আমরা একটা আর্জি নিয়ে এসেছি।
বলেন আপনাদের আর্জি।
এই বাড়িতে সোমনাথ রায় থাকতে পারবে না।
কেনো? সোমনাথ বাবুতো আপনাদের মতো ভাড়া দিয়েই থাকে। এবং নিয়মিত ভাড়া দেয়। তাকে আমি কেনো বাসা ছেড়ে দিতে বলবো?
তার মেয়েটা—
হাত তুলে থামিয়ে দেয় আবদুল আজিজ তার বাড়ির পাঁচতলার আজিজুর রহমানকে, আমি আপনাদের সমস্যা বুঝি। কিন্তু আমার কয়েকটা কথা আছে, বলবো?
বলেন, বলেন। আপনে বাড়িঅলা, আপনের কতাতো আমগো হুনতে অইবেই— কুশল এমন ভাব করে, সে অনেক শক্ত কথা বলছে সাহস করে বাড়িঅলাকে।
আমি যখন বারো তেরো বছর আগে ছয় তলার ফাউন্ডেশন দিয়ে দুই তলা মাত্র করেছি বাড়ির, প্রথম ভাড়াটে হয়ে আসে এই সোমনাথ বাবু। তখন সোমনাথ বাবুর সঙ্গে ছিল তার মা, ছোট বোন আর এক মামা। ‘শরণ’ এ আসার বছর খানেক পর সোমনাথ বাবু বিয়ে করেছে, পুরানো ঢাকার রায় বাড়ির মেয়ে পারুলকে। সেই বিয়েতে আমিও গিয়েছিলাম। পারুল এই বাড়ির প্রথম বৌ। পরের বছর করলাম তিন তলা, তিনতলা করার পরের বছর করলাম চারতলা। চার তলা করার তিন বছর পর করলাম পাঁচতলা আর ছয়তলা, এক সঙ্গে। আপনারা আসলেন, আমরা বাড়ি ভরে গেলো মানুষে। আমি তো সবাইরে নিয়া থাকতে চাই। কাউকে বাদ দিয়া আমি থাকতে চাই না। আর আপনারা মাসে মাসে টাকা দিয়া থাকেন। মাগনাতো থাকেন না। আপনারা আমার লক্ষী।
জানিতো চাচা।
জানলে এতো দরবার কেনো?
দরবার তো ইচ্ছে করে করিছ না। বলেন, এতো বছর আপনার বাড়িতে থাকি, কোনোদিন একটা কথা বলেছি? সোফা ছেড়ে দাঁড়ায় আজিজুর রহমান।
বলেননি। কিন্তু আজকে কেনো এসেছেন?
শিমুল মোটা গলাটাকে আরও মোটা করে, আমরা এসেছি সোমনাথ বাবুর মেয়ে পিংকি—
শিমুল, আমার কথা শেষ হয় নি, আবদুল আজিজ আরও গম্ভীর গলায় বলেন, আমার এই বাড়িতে একে একে সোমনাথ ও পারুলের সংসারে তিনটি বাচ্ছা আসলো। যে সংসারের শুরু আমার বাড়িতে, যে বাচ্চারা জন্মের পর খেলতে খেলতে বড় হয়েছে এই বাড়িতে সেই সংসারের মানুষেরা যদি নিজেরা যেতে না চায়, আমি কখনো তাদের বলতে পারবো না তোমরা আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। আর পিংকির বিষয়ে বলছেনতো?
বারেক আলী নড়ে চড়ে বসে, জি চাচা, সোমনাথ বাবু বা তার সংসার নিয়েতো আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, আমরা কেবল তার মেয়ে পিংকির বিষয়ে আপত্তি তুলছি আপনার কাছে। দেখুন, আমরা যারা আপনার বাড়িতে ভাড়া থাকি, তারাতো কেউ ফেলনা লোক নয়। এই ঢাকা শহরে বানের জলে কেউ ভাইসা আসি নাই। আপনি না হয় একটা ছযতলা বাড়ি করছেন, আমরাও করবো। আমি উত্তরায় জমি কিনেছি। তিন কাঠার প্লট। আশা করি পাঁচ সাত বছর পর বাড়ি করে নিজের বাড়িতে চলে যাবো। শিমুল তো কলাবাগানে ফ্লাটের বুকিং দিয়েছে। আমাদের দবিরউদ্দিন ভাইও আগামী দু এক মাসের মধ্যে ফ্লাট কেনার জন্য টাকা জমা দেবে। হাইরাইজ কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। আমিও সেই চুক্তির একজন স্বাক্ষী।
হালকা হাসে আবদুল আজিজ, আমি সবার সব জানি বারেক ভাই। আপনারা কেনো ফেলনা হবেন? আপনারা প্রত্যেকে স্বাবলম্বী। কয়েক বছরের মধ্যে আপনারা আমার মতো বাড়িঅলা হবেন। আপনারা প্রত্যেকে বাড়িঅলা হোন, আমিও চাই। এই দেশের প্রতিটি মানুষ বাড়ির মালিক হোক। কিন্তু এখন আমার কথা পিংকিকে নিয়ে। পিংকি সোমনাথ বাবুর মেয়ে, একবার ভেবে দেখেছেন, ঐ রকম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি একটি সন্তান আপনাদের যে কারো হতে পারতো। বলুন হতে পারতো না ? যদি হতো তখন কী করতেন? চুপ করে আছেন কেনো?
পুরোটা কক্ষ জুড়ে পাষাণ নীরবতা নেমে আসে। সবাই চুপ করে বসে আছে। আবদুল আজিজ সামনে রাখা পানের বাটা থেকে ধীরে সুস্থে পান বের করে মুখে দেয়, চিবায়— আপনাদের যাতনা আমি বুঝি। মলমূত্র দেখলে আমার বমি আসে। কিন্তু সহ্য করি। আর পিংকি কি প্রতিদিন সিঁড়ি নষ্ট করে? করে মাসে একবার কি দুইবার। আবার কোনো কোনো মাসে করেই না। ওর জন্য বাসায় আলাদা আয়া রাখা হয়েছে। সবাই মানুষ, কতক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারে? পিংকির ডাক্তারের কাছে আমি গিয়েছিলাম, ডাক্তার বলেছে পিংকির ডিজঅর্ডারে বৈশিষ্ট হলো, ওকে যা নিষেধ করা হবে, ও সেটাই বেশি করবে। পিংকি কিন্তু বাসায় এসব করে না। কারণ, ওকে তো ওর মতো চলতে দেয়া হয়। কিন্তু আপনারা চেচামেচি করেন, গালমন্দ করেন, ওর ভেতরের মন ওই কাজ করতে প্ররোচিত করে। আর পিংকি এসব করার কয়েক মিনিটের মধ্যে ওর মা এসে নিজের হাতে পরিষ্কার করে দেয় পুরো সিঁড়িটা। পরিষ্কার করে সেন্ট দিয়ে দেয়, যাতে গন্ধও না পাওয়া যায়। একজন মা আর কী করতে পারে? এখন আপনারা বলুন, সোমনাথ রায়কে কী বলবো?
প্রতিবাদে মুখর, উত্তেজনায় ঠাসা আট জন মানুষ নির্বাক বসে থাকে একজন আবদুল আজিজের সামনে, মানুষ সম্পর্কে এমন করেও ভাবা যায়!